ফাল্গুনী

ফাল্গুনী
-“মামা,এক প্যাকেট সিগারেট দেন তো।” প্রায় বিশ একুশ বছরের কাছাকাছি মেয়েটা যখন দোকানে এসে এক প্যাকেট সিগারেট চাচ্ছিলো,আমি হা হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। কড়া লিকার চা খাচ্ছিলাম। গাল পুড়ে লাল হয়ে গেলো। আমি তবুও ওর দিকেই চেয়েই ছিলাম। মেয়েটা একবার আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল। তারপর সিগারেটের দাম পরিশোধ করে চলে গেল। কোথায় গেল,জানি না।
মেয়েরা সিগারেট খায় ,সেটা জানতাম। কিন্তু এত সুন্দর মেয়ে সিগারেট টানবে,ওর নরম ঠোটে নিকোটিন স্পর্শ করবে-এসব ভেবে হিংসায় জ্বলে যাচ্ছি আমি। রাতে ভাল ঘুমও হলো না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে জগিংয়ে বের হলাম। জগিং না করলে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। জগিং শেষে বাসায় ফেরার সময় হঠাৎ চোখ পড়ল পার্কের কোণার দিকের একটা বেঞ্চে। গতকালের মেয়েটা একটা সিগারেটের প্যাকেট খোলার চেষ্টা করছে।দেখে মনে হচ্ছে,ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে।যত্নে কুড়িয়ে রাখা বাসি সন্ধ্যামালতী ফুলের মত মুখখানা।কি মনে হল সাহস করে ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-আমি কি সাহায্য করবো? মেয়েটা একবার ভ্রু কুঁচকে তাকাল।তারপর অবজ্ঞার সুরে বলল-আমি নিজেই পারবো। আপনাকে সাহায্য করতে ডেকেছি?
-আচ্ছা আচ্ছা,ঠিক আছে। তোমার নাম জানতে পারি?
-ফাল্গুনী।
নামটুকু বলেই মেয়েটা ফাল্গুনী হাওয়ার মত পালিয়ে গেল।আহা,কি এমন হত আরো একটু বসে থাকলে? এই সুন্দর সকালে কেবল ওই ঠোঁটে প্রেমিকের ছোঁয়া বা বড়জোর এক কাপ গরম ধোয়া ওঠা কফির স্পর্শই দারুণ মানায়। সেখানে কিনা এক প্যাকেট বিচ্ছিরি সিগারেট?না, না, এ আমার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। জগিং শেষে বাসায় ফিরে এলাম।ইন্টারভিউ দিতে যাবার ইচ্ছে মোটেও নেই।শার্টের বোতাম লাগাচ্ছিলাম,তখন সম্ভবত উপরতলার ভাড়াটিয়া আংকেলের মেয়ে চা দিয়ে গেল।গত দুইমাস ধরে আমাদের বাসায় ভাড়া থাকছে তারা।
গতকাল রাত থেকে মায়ের জ্বর।মেয়েটা বেশ সেবাযত্ন করছে মায়ের।কয়েকদিন ধরেই মা কানের কাছে মন্ত্র পড়ছে,একটা ভাল চাকরী পেলে মেয়েটার সাথে মা আমার বিয়ের কথাবার্তা শুরু করবেন।এতদিন কিছু বলতে পারি নি।কিন্তু গতকাল ওই সন্ধ্যামালতীকে দেখার পর অন্য কোন মেয়েকে আমি কল্পনাও করতে পারছি না।মায়ের মন্ত্র আমার মস্তিষ্ক থেকে উধাও হয়ে গিয়ে শুধু দুটো কথাই কানে বাজছে,”মামা,একটা সিগারেট দিন তো” আর “ফাল্গুনী”। মায়ের ঘরে গিয়ে সালাম করে ফিরে আসতেই মা আজ আবার বললেন-হ্যাঁ রে সায়ান,এবার চাকরীটা হয়ে গেলে আমি উপরতলার ভাবির সাথে তোর কথাটা বলবো,কেমন?গুণীর মত এমন রুপে-গুণে লক্ষী মেয়ে এ যুগে পাওয়া যায় না।
মাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলাম উপরতলায় পড়ে থাকার দিন শেষ।আমার জীবনে অন্য কেউ এখন জায়গা করে নিয়েছে।জীবনের এই আটাশ বছর বয়সে আমার মুখে এমন কথা শুনে মা হতভম্বের মত চেয়ে রইল।সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে ইন্টারভিউয়ের উদ্দেশ্যো রওনা দিলাম।প্রতিবার ট্র্যাফিক জ্যামে বিরক্ত হলেও আজ জ্যাম হয়েছে কিনা টের পায় নি।ইন্টারভিউ রুমে যখন আমার ডাক এল,তখন একটু নড়েচড়ে বসতে হল।তিনজন বস বসে আছেন।ডান পাশের কোণায় একটা ঝুড়িতে খালি সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে।ওদিকে চোখ পড়তেই ফাল্গুনীর কথা আবার মনে পড়ল। কোনমতেই ভুলতে পারছি না।ভাইভা বোর্ডের একজন সম্ভবত প্রশ্ন করলেন।আপনার জেলার একজন বিখ্যাত লোকের নাম বলুন দেখি।
প্রশ্নটা ভাল করে খেয়াল করে শুনতে পাই নি।আনমনেই উত্তর দিলাম-ফাল্গুনী। তিনি বেশ ড্যাবড্যাব চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-ফাল্গুনী? উনি কি কাজের জন্য বিখ্যাত? ততক্ষণে আমার হুঁশ হল,সাথে দেরীও হয়ে গেল। বুঝতেই পারছি,এই চাকরীটাও আর হবে না। মন খারাপ করে বাসায় ফিরে এলাম।মন খারাপ করার সময়ই বা কোথায়? মাথায় তো শুধু ওই ফাল্গুনী আর এক প্যাকেট সিগারেট।বাসায় ফিরে ফেসবুকে যত ফাল্গুনী নামের আইডি আছে একে একে সব খুঁজে ক্লান্ত হয়ে গেলেও আমার ফাল্গুনীর দেখা পেলাম না।
মায়ের শরীর আগের চেয়ে বেশ ভাল হয়েছে।উপরতলার ভাড়াটিয়ার মেয়েটাও আর আসছে না।ব্যাপারটা বেশ ভালোই হয়েছে।মেয়েটা যত আসবে,মা ততই আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করতে থাকবে। আপাতত এ সমস্ত চিন্তাগুলো তার মাথা থেকে দূরে সরে গেছে। বিকেলবেলা হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে মা বলল,একটা টকটকে লাল রঙের শাড়ি কিনে আনতে হবে। ভাড়াটিয়ার মেয়েটার আজ সন্ধ্যায় এংগেজমেন্ট হতে চলেছে।আর আমার জনসেবিকা মা তাকে বউমা করতে না পারার দুঃখে মেয়েটাকে শাড়িটা উপহার দিতে চান।
সন্ধ্যাবেলায় বাসার সবার উপরের ফ্ল্যাটে দাওয়াত।একেবারে কটকটে কালো রঙের একটা পাঞ্জাবী পরে মা এবং বাবার সাথে গিয়ে হাজির হলাম।ছেলেপক্ষ অনেক আগেই চলে এসেছে।উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙ।দেখেশুনে বেশ দারুণ ছেলেই পছন্দ করেছে দেখছি। আমাকে ছেলের পাশে ভদ্র ছেলের মত চুপচাপ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।একটু পরেই সম্ভবত মেয়েটাকে নিয়ে আসা হল।মায়ের দেওয়া টকটকে লাল শাড়িটা পরে দীর্ঘ ঘোমটা টেনে আছে।বর্তমান সময়ে এত লাজুক মেয়ে আছে!মা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-সরে বোস।মেয়েটাকে তো বসতে দিবি।
মায়ের কথা মত সরে বসলাম।নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিণ ব্যতীত এখানে কোন কিছুর প্রতিই আমার আগ্রহ নেই। কিছুক্ষণ পর ফোনের দিকে তাকিয়ে শুনতে পেলাম একটা ভারী নারীকন্ঠে কেউ বলছে-মা,এবার তোমার আংটিটা বদল কর। কিছুক্ষণ পর আবার শুনতে পেলাম-কি হল ফাল্গুনী,আংটি বদল কর।
নামটা শুনেই চমকে উঠে তাকালাম।ফাল্গুনী! এ তো আমার সেই ফাল্গুনী যার সিগারেটের প্রতি আমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে আছি। তার মানে ফাল্গুনীই আমাদের ভাড়াটিয়ার মেয়ে।ইন্ট্রোভার্ট টাইপ হওয়াতে সাহস করে খুব বেশি মেয়েদের দিকে তাকানোর সাহস হয়নি আমার।তার উপর ফাল্গুনীরা আমাদের ভাড়াটিয়া হওয়াতে এই কয়টা মাস চলে গেলেও ভুল করেও মেয়েটার দিকে ভয়ে তাকাতে পারি নি।ভাড়াটিয়ার মেয়ের দিকে তাকালে যদি উল্টাপাল্টা ভাবে,সেই ভয়ে।শুধু সেদিন সিগারেটের কথাটুকু কানে আসাতেই অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে ফাল্গুনীর একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে বলে উঠলাম-ফাল্গুনী তুমি! আজ তোমার এংগেজমেন্ট?
মা বেশ বিরক্ত হয়ে বলল-ওর এংগেজমেন্ট না তো কার?এই কয়টা দিন ধরে তো তোকে বলেই আসছি গুণীর এংগেজমেন্ট।সব জেনে এখন নাটক করা শুরু করেছিস নাকি?
বুঝতে পারলাম,ফাল্গুনী নামটা ছোট করে মা এতদিন গুণী বলে ডাকত।যদি এতদিনে একটাবারেও জন্যেও গুণীটাকে বড় করে ফাল্গুনী নামটা বলত,তবে আজ অন্য কিছুই ঘটত। ফাল্গুনীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম-তুমি কি আজও সিগারেট খাও? দেখ,তোমার মত এত সুন্দরী মেয়ের সাথে সিগারেট জিনিসটা মানায় না।তোমার মুখে সিগারেট আমি সহ্য করতে পারি না,ফাল্গুনী। পুরো ঘরজুড়ে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।আমার দিকে সবাই বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।মা আমার হাত ধরে টেনে বলল-সায়ান,কিসব উল্টাপাল্টা বকছিস? ওর মত এমন নিষ্পাপ মেয়েকে নিয়ে কি মিথ্যে দোষারোপ করছিস,জানিস?
-কিন্তু মা,আমি নিজে ওকে সিগারেট কিনতে দেখেছি।বিশ্বাস না হয় ওকেই জিজ্ঞাসা করো। সেদিন থেকেই তো আজ অব্দি আমি ওকে খুঁজে এসেছি। আমার কথা শুনে মা ফাল্গুনীকে জিজ্ঞেস করতেই সে সত্যিটা স্বীকার করে বলল,সে সিগারেট কিনেছিল। এমন কথা শোনার পর কোন বাঙালী মেয়ের আর বিয়ে হবার কথা নয়।সেটা হলোও না।এংগেজমেন্ট ক্যান্সেল করে পাত্রপক্ষ ফিরে গেল। মা আমার দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে একবার চেয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। এই কথাটা আমার এই সময়ে বলাটা উচিত হয় নি।আজ শুধু আমার ভুলেই বাড়িশুদ্ধ লোকের মন খারাপ হয়ে গেল। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা ফাল্গুনীর। নিজের কাছেই এখন ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে।
মাথা নিচু করে সবার থেকে লুকিয়ে ছাদে চলে এলাম।কাউকে ভাল লাগার অধিকার আমার আছে,কিন্তু কোন মেয়ের সাজানো স্বপ্ন ভঙ্গের অধিকার আমার নেই।মোটেও নেই।অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে পানি চলে এল। মুছে নেওয়ার চেষ্টা করলাম না। এটা আমার শাস্তি।আকাশে চাঁদ নেই,নক্ষত্রগুলোও কেন জানি উধাও হয়ে গেছে।মাঝে মাঝে মেঘ গর্জন করে চলেছে।হয়ত একটু পরেই ঝুম বৃষ্টি নামবে। ওভাবে কতক্ষণ চুপচাপ ছিলাম,জানি না।কারো একজনের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়ে পাশ ফিরে তাকালাম।ফাল্গুনী একা দাঁড়িয়ে আছে। আমার মুখ থেকে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। ফাল্গুনী বলল-আপনি এমন স্বার্থপর কেন,সায়ান সাহেব? মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওকে জবাব দিলাম-আমাকে ক্ষমা কর ফাল্গুনী।আজ আমার জন্যই তোমার এতবড় ক্ষতি হল।
-ক্ষমা চাইছেন কেন?আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি।
-কেন?
-এই যে বিয়েটা ভেঙে দিলেন,তার জন্য।আমি মোটেও রাজি ছিলাম না।একারণেই তো আংটিটা বদল করি নি।
অপেক্ষায় ছিলাম,আপনি কখন আমার দিকে ফিরে তাকাবেন।আর আমি জানতাম,আপনি আমার বিয়েটা ভাঙার জন্য এমন কিছু একটা করবেনই। এই বাসার সবাই একটু আগে যতটা অবাক হয়েছিল,এখন তার চেয়ে হাজারগুণ হতবাক আমি হচ্ছি। বোকার মত ফাল্গুনীর দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া বলার মত আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। ফাল্গুনী একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলল-গুলিয়ে যাচ্ছেন? গুলিয়ে তো আমিও অনেক আগেই গেছি। যেদিন প্রথম আপনাদের বাসায় আসি,আপনি বাবাকে জিনিসপত্র তুলতে সাহায্য করেছিলেন।এরপর কতশতবার আপনাদের ফ্ল্যাটে গেছি।আর আপনি বুদ্ধুরাম,একটাবারও আমার দিকে ফিরেও তাকান নি।চা করে দিয়ে এসেছি,আরাম করে পান করেছেন।খাবার দিয়ে এলে চেটেপুটে গিলেছেন।
আপনার মা আমাকে নিজের বউমা হিসেবে পছন্দ করলেও আপনার কোন পরিবতর্নই পাই নি।শুনেছি,আপনি নাকি খুব ছোটখাট ঘটনাতেও অবাক হয়ে যান।তাই,ইচ্ছে করেই আপনার সামনে সিগারেট নিয়ে ঘুরেছি।সায়ান সাহেব,আপনার কাছে আর কতভাবে নিজেকে প্রকাশ করবো? আর কতবার বুঝাবো,আমি আপনাকে ভালবাসি।আপনি বড্ড স্বার্থপর। ফিসফিস করে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে।সিঁড়ি থেকে প্রতিফলিত সামান্য আলোয় দেখতে পেলাম,বৃষ্টির ফোঁটায় ওর চোখ,মুখ,ঠোঁট ভিজে যাচ্ছে। ছলছল চোখে মেয়েটা মাথা নিচু করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।নাহ,এই মেয়েটাকে ছাড়া আমার একদমই চলবে না।অনেক খুঁজেছি,চোখের সামনে থেকেও অনেক ফিরিয়েছি।আর না। পিছন থেকে ওর নাম ধরে ডাকলাম।
-গুণী ফাল্গুনী থেমে গেল। আমি আবার বললাম-নিজেকে অনেক প্রকাশ করেছ।এবার আমাকেও একটু সুযোগ দাও।তোমার ওই মিথ্যে সিগারেটের প্যাকেটের প্রতি হিংসায় জ্বলতে জ্বলতে কতখানি তোমার মায়ায় জড়িয়েছি,সেটুকু জানবে না? আমি তোমায় ভালবাসি।সন্ধ্যামালতীর মত আমার বারান্দায় এসে ফুলদানীতে সাজবে না? ফাল্গুনী পিছন ঘুরে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।কালো পান্জাবীটার বুকের কাছে ভিজে যাচ্ছে।ফাল্গুনীর চোখের জলে নয়,হুট করে নেমে আসা ঝুম বৃষ্টিতে ওর অর্ধভেজা চুলের জলে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত