অমিতের মনে হলো বারান্দায় কাঠের চেয়ারটায় কেউ বসে আছে। যে বসে আছে, তার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী। মোটাসোটা কেউ। কাঠের চেয়ারে বসার সময় চেয়ারের পেছনের দু’পায়ের নড়ে উঠার মৃদু ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ শুনেছে সে। এখন ঐ ভারী মানুষটি চেয়ারে বসে পা দুলাচ্ছে। এটা অমিতের অনুমান। অনুমান ভুল ও হতে পারে।
অমিত বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতড়ে নিয়ে টাইম দেখলো। দু’টো বাজে। রাত অনেক হয়েছে। মোবাইল বালিশের পাশে রাখতেই বারান্দা থেকে হু হু করে মৃদু কান্নার শব্দ শুনা গেলো। অমিতের গা কেঁপে উঠলো। এটা মেয়েমানুষের কান্না। এই বাসায় অমিত একা। অতো রাত্রে বারান্দায় চেয়ারে বসে পা দুলাতে দুলাতে হি হি করে হাসার কিংবা হু হু করে কাঁদার কেউ নেই এখানে। অমিত জোর করে চোখ বন্ধ করলো, চেয়ার টা আরেকবার ক্যাঁচক্যাঁচ করলো। মেয়েটা কি চেয়ার ছেড়ে উঠেছে? বারান্দার দরজা টা খোলা, এখন কি রুমে আসবে মেয়েটি?
অমিত পায়ের কাছে গুজে থাকা কাঁথাটা পা দিয়ে টেনে চট করে খুলে সারা গায়ে জড়িয়ে ডানপাশ হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। পায়ের আওয়াজ শুনা গেলো মেয়েটির। মোটাসোটা মানুষের মতো থপ থপ আওয়াজ নয়, মৃদু আওয়াজ। পায়ের পাতা মেঝেতে রাখার পর আবার উঠানোর সময় মেঝেতে হালকা ঘঁষা খায় পায়ের নরম তালু, একটা নরম- কোমল শব্দ। অমিত দু’হাতের আঙ্গুল কানের ফুটোয় লাগিয়ে কাঁপতে লাগলো। বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি। অমিত চোখ কান বুজে রেখেও স্পষ্ট টের পাচ্ছে, মশারীর একপাশ তুলে বিছানায় উঠে অমিতের পাশেই শুয়ে পড়েছে মেয়েটি। অমিত ওপাশ ফিরে আছে। অথচ অমিতের প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে একটিবার এপাশ ফিরে চোখ খুলে মেয়েটিকে দেখতে। মানুষের অদ্ভুত সব স্বভাব। ভয় থেকে দুরে থাকে, অথচ ভয় এসে গলা জড়িয়ে ধরলেই ভয়ের কপালে চুমু দিতে ইচ্ছে করে। অমিতের কপালে ঘাম জমলো, মেয়েটি কি শাড়ি পড়েছে? কতো বয়স মেয়েটির? আঠারো- উনিশ- বিশ? মোটাসোটা? দেখতে কেমন?
লাবণ্যের মতো? মেয়েটি এপাশ ফিরে, অমিতের দিক করে। একটা চমৎকার স্নিগ্ধ ঘ্রাণ ও এপাশ ফিরে অমিতকে ঝাপটে ধরে এবার। এ বড্ড পরিচিত ঘ্রাণ। অমিত নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখে। একটা স্পর্শ টের পায়। পরিচিত স্পর্শ। বাঁ হাতে। ভেজা, কেমন কান্না কান্না স্পর্শ। কেউ ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে বাঁ হাতে হাত রেখেছে। নরম আঙ্গুলে আঁকড়ে ধরেছে বাহু। এই আঁকড়ে ধরা নরম আঙ্গুলগুলোর ফাঁক দিয়ে দলা দলা অধিকার ঝরছে। কিসের অধিকার? কি চায় মানুষটি? অমিতের ঘুম পায়। এই স্পর্শে কি ফ্রিজিয়াম মেশানো? চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে অমিতের। ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বারবার মনে হয় তার… ইশশ, আরেকটু যদি জেগে থাকতে পারতাম! ইশশ…!
— আমায় কেউ স্পর্শ করে, রোজ রাতে। একটা মেয়ে।
আমি ছেলেটির দিকে তাকাই। বয়স তেইশ। চেহারায় যৌবনের আভা স্পষ্ট। সমস্যাটা ও ধরতে পেরেছি আধেকটা। এই বয়সের স্বাভাবিক একটা ব্যাপার- এই সামান্য সমস্যা নিয়ে কেউ ডাক্তারের কাছে আসে? ঘুমের ঔষুধ চাচ্ছে ছেলেটি। ঘুমোতে চায়। একটানা ঘুম। এক ঘুমেই যেন সকাল হয়। ছেলেটি এখন এইমুহূর্তে একদৃষ্টিতে টেবিলের উপর তাকিয়ে আছে, নাড়াচাড়া করছেনা। টেবিলে তিনটে কলম, কিছু ঔষুধের বক্স। এতো মনোযোগ দিয়ে কেউ কলম কিংবা ঔষুধের বক্সের দিকে তাকায়না। ছেলেটি অন্যকিছু ভাবছে। ইতস্তত করছে।
— মারা যাওয়ার যে হাজারটা উপায় আছে, ডিসপেনসারির লোকগুলা সম্ভবত জানেনা। ঘুমের ঔষুধ চাইলাম, দিচ্ছেনা। প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেবেনা। আপনি আমার সমস্যাটা শুনুন ছেলেটার নাম অমিত। অমিত সমস্যাটা গুছিয়ে বলতে পারছেনা। একটা অস্বস্তি কাজ করছে। ডাক্তারদের মিশুক হতে হয়, রোগীদের সাথে চট করে আপনজনের একজন হয়ে যেতে হয়। আমি যথেষ্ট মিশুক, কিন্তু অমিত নয়। অমিতের চোখের নিচে কালি, অনেক রাত ঘুমোয়না। সমস্যাটা মানসিক। অমিত অনেকক্ষণ চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাথা তুলে কোনো প্রকার জড়তা ছাড়াই বলতে আরম্ভ করলো,
— আমি সারাদিন বাসায় থাকি। বাইরে খুব একটা বের হইনা। রোদ সহ্য হয়না একদম, মাথাব্যথা করে। সামনে ২ নাম্বার রোডের পূর্বদিকে, আমার বাসা। ছয়তলা বিল্ডিং। নাম, মেঘদল। বাড়ির মালিক সাহিত্যমনা একজন লোক। সারাদিন বই পুস্তক নিয়ে পড়ে থাকেন। নাম বারেক। বারেক মিয়া। আমি ডাকি, বারেক আংকেল। বয়স, পঞ্চান্ন- সাতান্ন। বারেক আংকেল থাকেন দোতালায়। আমি তিন তলায়। পুরো বিল্ডিং এ মাত্র একজন সৌভাগ্যবান ব্যাচেলরের জায়গা হয়েছে। সেটা আমি। বারেক আংকেল আমায় পছন্দ করেন। অনেকগুলো কারণ থাকলেও প্রধান একটা কারণ যেটা, সেটা হলো আমি শেষ কবে মিথ্যে বলেছি ভুলে গিয়েছি। বারেক আংকেল আমায় ডাকেন, স-বালক। মানে সত্যবাদী বালক। অমিত থামলো। আমি ভাবছিলাম, অমিতের সমস্যা শুধুমাত্র একটি মেয়েকে ঘিরে। ভুল ছিলাম। বারেক মিয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারছিনা। অমিত একটু দম নিয়ে বললো,
— বারেক আংকেল কে আমি প্রথম মিথ্যে বলি জানুয়ারির এগারো তারিখ। মিথ্যেটা লাবণ্য কে নিয়ে।
— লাবণ্য কে?
— বারেক আংকেল এর মেয়ে।
— আচ্ছা আচ্ছা। থামবেন না, বলতে থাকুন..
— লাবণ্যের বয়স আঠারো। একদম গোল নয়, ডিম্বাকৃতি মুখ। উজ্জ্বল শ্যামলা। ঝরঝরে লম্বা চুল। লাবণ্যের ডান ভ্রুঁ’য়ে একটা কাটা দাগ। ছোটবেলায় দরজার সাথে বাড়ি খেয়ে কেটে গিয়েছিলো, দু’টো সেলাই পড়েছে। আমার কেন জানি মনে হতো, লাবণ্যের মুখমন্ডলের সমস্ত সৌন্দর্য্য এই মাঝখান বরাবর হালকা বেঁকে যাওয়া কাটা দাগওয়ালা এই ডান ভ্রুঁ’তে জমা হয়ে আছে। লাবণ্যের বয়সটা অস্থির ছিলো। কোনো কারণ ছাড়াই যে কারো প্রেমে ভয়ংকর রকম পড়ে যাওয়ার বয়স।
ফড়িঙের মতো চঞ্চল সে। আমি নিজেকে যথেষ্ট দুরত্বে রাখার পরেও লাবণ্য আমার প্রেমে পড়ে। অস্থির রকমের প্রেম। বারেক আংকেল প্রতি সন্ধ্যেয় আমায় ডাকতেন বাসায়, গল্প গুজব করতেন। বই নিয়ে কথা বলতেন। নতুন লেখকরা যে কাঁচা কাঁচা লিখা লিখছেন, তা নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা করতেন। লাবণ্য কারণে- অকারণে ঐ রুমে আসা যাওয়া করতো। না চাইলেও ঘন্টায় কয়েকবার করে পানি এনে দিতো, বাহানা খুঁজতো রুমে আসার। আমার দু’য়েক সপ্তাহ লেগে যায় বুঝতে এটা। বুঝতে পারার পর, টানা দুই দিন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি সন্ধ্যেবেলা, যাতে আংকেল ডাকতে এসেও পড়ছি দেখে না ডাকেন। সেটাই হলো। দুইদিন বাসায় যাইনি আংকেলের, তৃতীয় দিনের মাথায় শুনি লাবণ্যকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। প্রচণ্ড জ্বর। শরীর থরথর করে কাঁপছে, প্রলাপ বকছে অনবরত।
আমার বুকটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা টের পেলাম। কাউকে বলতে না পারা- বুঝাতে না পারা কষ্টগুলোর চেয়ে বিচ্ছিরি কিছু আর হয়না। লাবণ্যের জ্বর টা ভয় থেকে সৃষ্টি হওয়া- প্রচণ্ড ভয়। আমায় হারিয়ে ফেলছে টাইপের ভয়! লাবণ্য অদ্ভুত ছিলো, কে জানে হয়তো বয়সটাই অদ্ভুত ছিলো তার। কোনো অষ্টাদশী তরুণীর প্রচণ্ড ভালোবাসা পাওয়ার দু’টো ফলাফল থাকে। হয়তো, সাময়িক প্রচণ্ড আবেগ- কিছুদিন পর হুট করে যেমন এসেছে তেমন করেই কেটে যায়। নয়তো, আজন্ম প্রচণ্ড আবেগ- মানুষের মৃত্যুর পর সবকিছুর শেষ ধরা হয়, কিন্তু এটি বাদ দিয়ে, মৃত্যুর পরেও এটি থেকে যায়। যাইহোক, লাবণ্য সুস্থ হলো, তারপর এক সন্ধ্যেয় ছাদে আমায় বাচ্চাদের মতো দু’হাতে আঁকড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো, ভালোবাসি।
ফলাফল চিন্তা করে ভালোবাসা হয়না, ভালোবাসা হচ্ছে একটা উঁচু গর্জে উঠা ঢেউয়ে চোখ বুজে গা ভাসিয়ে দেয়ার মতো। হয়তো তীরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে, নয়তো টেনে নিয়ে যাবে গভীর সমুদ্রে। আমি গা ভাসালাম। আমরা ভালোবাসলাম একে অপরকে। সবকিছু আগের মতো চলছে। বাড়তি একটা যুক্ত হলো, আমাদের গোপন প্রেম। স্থান- ছাদ। সতর্ক থেকে ছাদের দরজায় চোখ রেখে হাত ধরে বসে থাকা একে অপরের। লাবণ্য বলতো, ‘আমার বদ্ধ রুম ভাল্লাগেনা। বিয়ের পর আব্বুকে বলবো, একটা বাসা বানায়ে দাও, যেইটার ছাদ হবে শক্ত- স্বচ্চ কাঁচের। ইচ্ছে করলে যেন ঐ কাঁচ সরিয়ে দেয়া যায়। যে রাতে জোৎস্না কিংবা বৃষ্টি থাকবে, ঐ রাতে কাঁচ সরিয়ে দেয়া হবে।’ অমিত থামলো, ওর ঠোঁটে মিষ্টি একটা হাসি লেগে আছে। সম্ভবত অনেকগুলো কষ্ট কষ্ট স্মৃতির মধ্যে গুটিকয়েক সুখকর স্মৃতির একটি এটি। কিন্তু প্রথম মিথ্যেটা কি?
— বারেক আংকেল কে প্রথম মিথ্যে বলি আমি জানুয়ারির এগার তারিখ, দুপুর। সিঁড়ির গোড়ায় আমায় দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। আমি তাকিয়ে দেখি, বারেক আংকেলের বিধ্বস্ত চেহারা, সারারাত ঘুমোন নি তিনি। আমার হাত শক্ত করে ধরে কন্ঠস্বর একটু নিচে নামিয়ে জড়ানো গলায় বললেন, ‘লাবণ্যকে খুঁজে পাচ্ছিনা। কাল একটু বকেছিলাম। ওকে দেখেছো কোথাও যেতে? রাগ করে বের হয়েছে, রাতেই, একটা ব্যাগ নিয়ে, ব্যাগভর্তি কাপড়চোপড়। কালো রঙের ব্যাগ। দেখোনি? রাস্তায়, কোনো স্টেশন? কোথাও? কোথাও না…?’ আমি বারেক আংকেলের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে প্রথম মিথ্যে বললাম, ‘না!’ অমিত থামলো আরেকবার, চোখে অপরাধবোধ। চোখ নামিয়ে টেবিলে রাখা কলম আর ঔষুধের বক্সের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
— যখন ‘না’ বলছিলাম, লাবণ্য আমার বাসায় তখন। গতরাতেই এসেছে। সাড়ে নয়টায়। হাতে ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ। চোখ লাল, ফোলা। বাসার ভেতরে ঢুকে বললো, আমি আর বাসায় ফিরবোনা। হয় তোমার কাছে থাকবো, নয়তো ছাদে উঠবো। ছাদে উঠবো বাস করতে নয়, লাফ দিতে। কুইক ডিশিসন নাও, আমি থাকবো নাকি যাবো? আমি আচমকা এই অদ্ভুত মেয়েটির অদ্ভুত কথাবার্তায় হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লাবণ্য হঠাৎ ব্যাগটা মেঝেতে ফেলে দু’হাতে ঝাপটে ধরলো আমায়, তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ঐ মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমি পৃথিবীর শেষ শ্রেষ্ঠ সম্পদটি পেয়ে গেছি। প্রচণ্ড এই অভিমানী মেয়েটিকে বুকে আঁকড়ে ধরে রেখে বলি আমি, ‘তুমি কোথাও যাবানা!’ লাবণ্য আমার বাসায় থাকে পুরো দুই সপ্তাহ।
মজার ব্যাপার হলো, পুলিশ এই দুই সপ্তাহ তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে ও কে, তবে এই বিল্ডিং বাদ দিয়ে। লাবণ্যের বাসার কেউ জানেইনা, সে ততোদিনে ঐ বাসার ই উপরের তলায় সংসার পেতেছে। আমি টিউশনি করি বেশ ক’টা, সারাদিন বাইরে থাকি, বাসায় তালা দিয়ে যাই। অবাক হই। বদ্ধ রুম ভালো না লাগা মেয়েটি কি চমৎকার ভাবেই না মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে, তালাবদ্ধ একটি ঘরে। আমি বাইরে থাকি, লাবণ্য অপেক্ষায় থাকে। আমি ফিরলেই ভাত বেড়ে দেয়, নিজে খেতে বসে। রাতে জড়াজড়ি করে ঘুমোই আমরা, একিই বিছানা। একটি বালিশ। আমি বালিশে মাথা রাখি- আর লাবণ্য ঘুমায় আমার হাতে মাথা রেখে। অমিতের গাল গড়িয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু, টুপ করে নিচে টেবিলে পড়লো। কাঁচের টেবিল। পড়ে গোল হয়ে চারোপাশে ছড়িয়ে যাওয়া অশ্রুফোঁটার দিকে তাকিয়ে অমিত জড়ানো গলায় বললো,
— দু’সপ্তাহ পর আমরা ধরা পড়ি। লাবণ্য সেরাতে প্রচণ্ড কাঁদলো, বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। অথচ দেখার কোনো উপায় নেই। বারেক আংকেল অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ততোদিনে। প্রেশার বেড়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। বাসার বাইরে বের হন না।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকের এক সকালে, লাবণ্য জানালার পর্দা সরিয়ে নিচে উঁকি দেয়। নিচে বাবা বসে আছেন, একটা চেয়ারে। লাবণ্য হু হু করে কেঁদে উঠে, কয়েকদিনেই কি অবস্থা হয়েছে বাবার। কেমন ভেঙ্গে গেছেন তিনি। লাবণ্য জানালায় হাত রেখে জলভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। বারেক আংকেলের দৃষ্টি যায় ওদিকে, চট করে পর্দা নড়ে উঠে। লাবণ্যের বুক কেঁপে উঠে। দুপুরে আমি ফিরতেই দেখি বাসার দরজা খোলা, ভেতরে বিছানায় শুকনো মুখে লাবণ্য বসে আছে, পাশে বারেক আংকেল। আর কিছু মহিলা। বারেক আংকেলের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। আমায় দেখেই তেড়ে এসে কলার ধরে ঠেলতে ঠেলতে বাসার বাইরে এনে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন, রাগে তার শরীর কাঁপছে। পুলিশ আমায় যখন নিয়ে গেলো, পুলিশের গাড়িতে উঠার সময় আমি শেষবারের মতো লাবণ্যের চেহারাটুকুন দেখতে পাই। একটা ডিম্বাকৃতি মুখ, ঝরঝরে চুল আর একটা কাটা ভ্রুঁ.. লাবণ্য আমার বাসায় তখনো, কাঁচের জানালায় হাত রেখে কাঁদছিলো। এটাই শেষ, এরপর আর কখনো কাঁদেনি…!
— মানে?
অমিত এই প্রথম আমার চোখের দিকে তাকালো। আমি এখন টের পাই, তার চোখের নিচে ঘুমোতে না পারার দাগগুলোতে স্মৃতি মিশে আছে কিছু। আঁধার রঙা স্মৃতি। কথা বলতে বলতে অমিত সহজ হয়ে এসেছে অনেকটা। সহজ গলায় ই বললো,
— পুলিশ আমায় বেদম মারধোর করে, বারেক আংকেলের নির্দেশ। কোনো একটা মামলা তৈরী করে, মাদক কেনা বেচা টাইপের কিছু একটা। প্রচুর মারধোর করে একটা অন্ধকার গলিতে এনে ছেড়ে দেয় আমায়। মেঘলা ছিলো আকাশ, ঝুম বৃষ্টি নামে, সাথে বজ্রপাত। বজ্রপাতের প্রচণ্ড আওয়াজ। প্রচণ্ড আওয়াজে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান যখন ফিরে আসে, তখন আমি আমার বাসায়। অবাক হই, এতোকিছুর পরেও বাসায় থাকতে দিচ্ছে? বাইরে কোলাহল শুনি। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি, একটা খাটিয়া। বুক ধক করে উঠে। খাটিয়ায় একটা লাশ। সাদা কাফনে মোড়ানো। আমি কোনোরকমে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলাই। লাশের পাশে বারেক আংকেল দাঁড়িয়ে।
একফোঁটা জল নেই চোখে। তারপর আমি জানিনা, কিভাবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। ঘোলা দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাই। খাটিয়ায় কে দেখার সাহস হয়না। কাফনে মোড়ানো লাবণ্য শুয়ে আছে হয়তো। হয়তো তার চোখ দুটো খোলা। হয়তো তার বুকের বাঁ পাশ শক্ত পাথর হয়ে আছে। প্রচণ্ড অভিমানী আমার। আমি যাওয়ার পর কি করেছে ও জানিনা। জানতে চাই ও না। ও কে একটিবার দেখারও সাহস হয়নি আমার আর। গেইট ছেড়ে হাঁটতে শুরু করি সামনে, কোনো গন্তব্য নেই। পাঁচ ছ’দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। পাগলের মতো। তারপর ফিরতে হয় বাসায়। এই বাসা ছেড়ে যেতে পারিনা কোথাও আমি। এখানে গেঁথে থাকি। গেঁথে থাকতে হয় আমায়।
ততোদিনে বাসার সমস্ত ভাড়াটিয়াদের নোটিশ দেয়া হয়েছে, একমাসের মধ্যে পুরো বিল্ডিং খালি করতে হবে, এখানে কারো থাকার প্রয়োজন নেই। কেন নেই, কেউ জানেনা। সিদ্ধান্তটা বারেক আংকেল এর। তিনি অসুস্থ, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। পুরো বিল্ডিং এ শুধু আমি থেকে যাই, আমাকে বাসা ছাড়তে বলা হয়না। কেন জানিনা। অথচ সবার আগে আমার ই ছাড়ার কথা ছিলো। আমার দিন কাটে বদ্ধ রুমে… তারপর একরাতে আমি লাবণ্যকে দেখি! অমিত থামলো। বাকি অংশটা শুনেছি আমি। গভীর রাতে বারান্দায় চেয়ারে বসে একটি মেয়ে হু হু করে কাঁদে, তারপর এসে রুমে বিছানার মশারি তুলে ভেতরে ঢুকে শুয়ে পড়ে অমিতের পাশে। স্পর্শ করে ও কে। সহজ ব্যাখ্যা। আমি একটু কেশে বললাম,
— অমিত, তুমি জেগে থাকো অনেক রাত। তারপর ঘুমিয়ে পড়ো। স্বপ্নটা শুরু হয় তোমার, তখনিই। স্বপ্ন আর জেগে থাকা, তুমি গুলিয়ে ফেলছো দু’টো একারণে যে, স্বপ্নের শুরুটাই হয় তোমার ঘুম ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে। তুমি স্বপ্নের শুরুতেই দেখো, তোমার ঘুম ভেঙ্গেছে বারান্দায় বসে থাকা কারো কান্নার শব্দে। অথচ সত্যিই যদি তোমার ঘুম ভাঙ্গতো, তবে তুমি দেখতে বারান্দায় আসলে কেউ নেই। অমিত সন্তুষ্ট হয়না ব্যাখ্যায়, সে ঘুমের ঔষুধ চায়। জিজ্ঞেস করি,
— ধরে নিলাম, ওটা সত্যিই লাবণ্য। তবে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা, জেগে থাকার কথা। ঘুমোতে চাও কেন?
অমিত অসহায় চোখে তাকায় আমার দিকে, বলে,
— এপাশ ফেরার সাহস হয়না আমার। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়, একটু এপাশ ফিরি। একটিবার দেখি। একটি ডিম্বাকৃতি মুখ, ঝরঝরে চুল, কাঁটা ভ্রুঁ। ভয় পাই, হয়তো তাকাবো আর দেখবো পাশে কেউ নেই। হয়তো জেনে যাবো, সবটাই আমার ভ্রম, আসলেই পাশে কেউ নেই। দরকার নেই জানার, তারচে নাহয় থাকুক, এমন করেই থাকুক সে। আমাদের দু’সপ্তাহের মিষ্টি গোপন সংসারের মতোন। ঐ স্পর্শে থাকুক লাবণ্য, যে স্পর্শে আমি ঘুমে তলিয়ে যাই। এই স্পর্শের আগেকার প্রতিটি সেকেন্ড আমার এপাশ ফিরতে ইচ্ছে করে, দেখতে ইচ্ছে করে ও কে। অথচ দেখা উচিৎ না, আমি ঘুমোতে চাই… ঘুম আমায় ওপাশ ফিরিয়ে রাখবে৷ আমি আমার এপাশ ফেরার ইচ্ছেটাকে ভয় পাই। ও নেই বলেই ওর না থাকাকে ভয় পাই। অমিত আরো একগ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, আমি একটা কাগজে আমার পার্সোনাল নাম্বার টা লিখে অমিতের দিকে বাড়িয়ে বললাম,
— ইশ্বর কে চোখে দেখিনি বলে আমি কখনো ইশ্বর বিশ্বাস করিনি। তুমি আমায় একটা মৃত মানুষের অস্তিত্ব বুঝাতে এসেছো। এটা আমার পার্সোনাল নাম্বার। আমি প্রতিরাতে অপেক্ষায় থাকবো। যে রাতে পাশে লাবণ্যে এসে শুয়ে তোমায় ছুঁয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, আমায় ফোন করো অমিতের সাথে এতোটুকুই কথা। তারপর অমিত আর আসেনি চেম্বারে। তবে দুইদিন পর একটা ফোন আসে মোবাইলে। গভীর রাত। প্রায় দেড়টা অথবা দু’টো। একটা ছেলে ফোনের ওপাশে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
— লাবণ্য.. লা..বণ্য। পাশে…!
আমি মোবাইল চেপে ধরি কানে, অমিতের গলার স্বর। আর একটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। ছেলেটা মিথ্যে বলছে না তো? একটা মেয়ের স্পষ্ট কান্নার স্বর, আমার শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে যায়, শিউরে উঠি। পরদিন ই অমিতের বাসা খুঁজতে বের হই। দুই নাম্বার রোড, পূর্বদিক, বাসার নাম মেঘদল। পুরো বাসা খালি, অথচ বাইরে টু-লেট লাগানো নেই। আমি সোজা তিনতলায় উঠি। কলিংবেল চার বার চাপ দেওয়ার পর কেউ একজন দরজা খুলে। একটা মেয়ে। বয়স চব্বিশ- পঁচিশ। ডিম্বাকৃতি মুখ, ঝরঝরে চুল, ডান ভ্রুঁ’য়ে একটা কাটা দাগ। আমি পড়ে যেতে যেতে কোনোরকমে সামলাই। মেয়েটি ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
— কে আপনি? আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। ছেলেটা এতো সিরিয়াস ভঙ্গিতে মজা করলো কেন? মানসিক কোনো সমস্যা নয়তো? আমি ঢোক গিলে বলি,
— অমিত আছে বাসায়? মেয়েটি কুঁচকানো ভ্রুঁ সোজা করে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— অমিতের কে হন আপনি?
— কেউ না। দু’দিন আগে সে আমার কাছে এসেছিলো, আমি একজন ডাক্তার। এই তো কাছেই আমার চেম্বার। অমিত এসেছিলো ঘুমের ঔষুধের জন্যে। একটা গল্প বলেছে সে। অবশ্য এখন বুঝতে পারছি, মজা করেছে সে।
মেয়েটি এবার বিরক্তভরা স্বরে বললো,
— অমিত না, অন্যকেউ মজা করেছে। আপনি এখন আসুন। দরজা বন্ধ করতে চাইলো মেয়েটি, আমি অনেকটা অনুরোধের স্বরে বললাম,
— লাবণ্য, প্লিজ ওকে ডাকুন, ওর সাথে কিছু কথা আছে আমার। মেয়েটি চমকালো, জিজ্ঞেস করলো,
— আমার নাম জানেন কি করে?
— অমিত বলেছে। আপনি প্লিজ ডাকুন… কিছু কথা ছিলো ওর সাথে। মেয়েটি আমার কৌতুহলী চোখের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করার আগে স্পষ্ট স্বরে বললো,
— অমিত কে ডাকলেও আসবেনা। অমিত নেই। সে মারা গেছে প্রায় দেড় বৎসর হলো। আপনি আসুন প্লিজ। রাত দু’টো। লাবণ্য বারান্দায় বসে টের পেলো, নিচের তলায় আলো জ্বলছে এখনো বাবার রুমে। বই পড়ছেন তিনি। বিছানায় শুয়ে থাকছেন দিন রাত। অসুস্থ! অবশ্য অসুখটা যে তাকে এতোটুকুন ও অসুখী করেনি, বই একটা পড়ে শেষ করে আরেকটা হাতে নেয়ার মধ্যেকার সময়টায় তার হাসৌজ্জ্বল চেহারা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে। লাবণ্য কথা বলেনি আর বাবার সাথে। অমিতের হত্যার সাথে অবশ্যই বাবার সম্পর্ক রয়েছে।
লাবণ্য কাঠের চেয়ারে বসে সামনে তাকায়, শুভ্র চাঁদের আলো টলমল করছে সবুজ পাতার গায়ে। অথচ একটা ঘর বানানো হয়নি এখনো, যার ছাদ শক্ত- স্বচ্চ কাঁচের; এমনই টলমলে জোৎস্নায় কাঁচ সরিয়ে দেয়া হবে। লাবণ্য হু হু করে কেঁদে উঠলো, চোখ ভিজে আসলো, একটা চিৎকার এসে গলায় আটকে রইলো। এই চিৎকার গিলে ফেলা যায়না, বাইরে আনা ও যায়না। আটকে থাকে, আর প্রতিটি ক্ষণ কষ্ট দেয় নতুন করে। চেয়ার ছেড়ে উঠলো লাবণ্য। রুমে ফিরে আসলো। একটা বিছানা পাতা আর একটা পুরনো মশারি। এটি অমিতের। দু’সপ্তাহের সংসারে এটিও সঙ্গী ছিলো ওদের। লাবণ্য মশারি তুলে শুয়ে পড়ে একপাশে, একটা বালিশে মাথা রেখে একটা হাত পেতে দেয়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে তার।
মাঝে মাঝে লাবণ্যের মনে হয়, অমিত পাশেই শুয়ে আছে। ওপাশ ফিরে। প্রচণ্ড অভিমান ওর। কক্ষনো এপাশ ফিরবেনা। লাবণ্য ভেজা চোখে হাত বাড়িয়ে দেয় পাশে, শূণ্য পড়ে থাকা বিছানার একপাশ…! মাঝে মাঝে লাবণ্যের মনে হয়, অমিতের হাত ধরে আছে সে। এই যে শূন্য একপাশ, অথচ শূন্য নয় একদম ই। কেউ একজন থাকে। সে চলে যায়না। কক্ষনো না। থেকে যায়- একটা স্বচ্চ কাঁচের ঘর, একটু ঘুম, একটু অভিমান, একটা মশারি, দু’সপ্তাহের সংসার কিংবা একটু স্পর্শের জন্য হলেও থেকে যায়।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা