সকালবেলা অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। হুট করে মেস মালিক হাসান সাহেব এসে হাজির। সবে তিনি ব্রাশ করছেন। আমি সালাম দিলাম।
হাসান সাহেব একটু এগিয়ে জানলা দিয়ে মুখের ফ্যানা সব ফেলে দিলেন। ঘাড়ে রাখা গামছা দিয়ে মুখ মুছলেন। আর বললেন, বলছিলাম অভ্র আজ বুয়া আসতে পারবে না। খাওয়াদাওয়ার নাহয় তোমরা নিজে থেকে ব্যবস্থা করে নিও।
.
হাসান সাহেব আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন। মাথায় তখন কিছু আসছিল না কি করবো। পাশে দেখি সাকিল তখনো ঘুমাচ্ছে। এদিকে আমারো লেট হয়ে যাচ্ছিল। তাই সাকিল কে কিছুনা বলে অফিসের জন্য বের হয়েছিলাম।
.
এখন ফুটপাত দিয়ে হাটছি। অফিস থেকে মেস ফিরছি। মাসের আজ ২১তারিখ। খুব না মাসের ২০তারিখ পেরুলে আমার টানাপোড়ন শুরু হয়। যা বেতন পাই বেশিভাগ বাড়িতে পাঠাতে লাগে। এই হিসেবে পুরো মাস ই টানাপোড়নে চলে। এতে অল্প কিছু টাকার গুরুত্ব কোটি টাকার সমান হয়। আর তাই মধ্যবিত্ত দের বিলাসিতা থাকতে নেই। মানিয়ে চলতে হয়।
.
দুপুরবেলা কাজের ফাকে সাকিলকে টেক্সট করে জানিয়েছিলাম আজ বুয়া আসবে না। না জানি টেক্সট সিন করেছে কি না। না করলে আজ রাতে না খেয়ে থাকতে হবে।
মেসে ফিরে দেখি সাকিল শুয়ে আছে। মাঝেমাঝে ভাবি একটা মানুষ এতো কি করে ঘুমাতে পারে। মাথায় আসে না।
ডাকাডাকি না করে ফ্যান অফ করে দিলাম। অমনি সাকিল সজাগ হল।
.
বলল, কিরে এসেছিস তুই??
– হু স্যার এসেছি। আপনার খাওয়া হয়েছে কিছু??
– ঠাণ্ডা ভাত ছিল রাতের। জামিল ভাইয়ের দোকান থেকে পিয়াজু এনে ভাত খেয়েছি দুপুরবেলা। কেন জানি বুয়া আজ আসলো না।
– তারমানে তুই আমার টেক্সট সিন করিস নি??
– কিসের টেক্সট!! আমি কোনো টেক্সট পাইনি।
.
ফোন বের করে দেখি ম্যাসেজ সেন্ডিং ফেইল দেখিয়েছে।
যারা প্রেম করে না তাদের এই এক প্রবলেম। ফোনের ব্যালেন্স সম্পর্কে কোনো ধারনাই থাকে না।
বড্ড টায়ার্ড লাগছে। কিছু যে রান্না করবো এতোটা এনার্জি শরীরে নেই। সাকিল লুঙ্গী ঠিক করে বলল, শুনেছি পুলিশ কমিউনিটি সেন্টারে নাকি খুব সহজে খাওয়া করা যায়। বিনা দাওয়াতে।
– এইই! তুই বলতে কি চাচ্ছিস?? এমন কিছু আমি করবো তুই ভাবলি কি করে।
– উফফ! এদিক থেকে ভাবছিস কেন?? ধরে নে তোর নতুন কোনো অভিজ্ঞতা হবে।
– দরকার নেই কোনো অভিজ্ঞতার। তুই বরং জামিল ভাইয়ের দোকান চল। ডালভাজি দিয়ে ভাত খাবো। আমি বিল দিবো নি।
– তোর মতো বোরিং ছেলে আমি দেখিনি। কেউ তোর সাথে রিলেশন করেছিল কোন দুঃখে, আল্লাহ্ পাক ভালো জানেন। এজন্যই মনে হয় ব্রেকআপ হয়েছিল তোর।
.
একথা বলামাত্র জিহ্বা তে কামড় দিলো সাকিল। বলল, সরি ভাই ভুলে বলে ফেলেছি।
– ব্যাপার না দোস্ত। এসব কথা শোনার অভ্যাস আছে। তুই বরং রেডি হয়ে নে। নতুন অভিজ্ঞতা নিতে হবে তো।
– রেডি হওয়ার আর কি আছে! থোড়াই না বিয়ে করতে যাচ্ছি। তুই আগে বল মনেধরে নি তো কিছু??
.
কথা আর বাড়ালাম না। রেডিওর মতো সাকিল এমন করে এখন বাজবে। বসে থাকলে বিড়ম্বনা শুধু বাড়বে। তাই ফ্রেশ না হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
.
বিয়ে বাড়িতে দুটো জিনিস কখনো লাগে না। এক হলো বিদায়ের সময় কান্নাকাটি। আর দুইয়ে নারীর অতিরিক্ত মেকআপ। এতে সমস্যা হলো আমি বউ কে চিনতে পারিনা। তাই বউ কে দেখার ইচ্ছে আজো পূরণ হলো না।
সাকিলকে বললাম, খেতে এসেছি। যত তাড়াতাড়ি পারি খেয়ে চলে যাবো বুঝলি।
– বাহ রে। চারপাশে দেখ। পরিবেশ কতো মনোরম। একটু উপভোগ করবো না।
.
শুরু হয়ে গেলো শালার লুচ্চামি। টেনে ওকে সাইটে নিয়ে গেলাম। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা চলছে। এরপর হয়তো খাওয়াদাওয়া হবে।
কিন্তু আমার যে সইছে না। ক্ষুধা বেশি পেলেই আমার মাথা কাজ করে না। উজবুক লাগে নিজেকে।
সাকিল হুট করে বলল, আয় খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
.
রাধুনীর সাথে সাকিল বেশ আসর জমালো। কথার ফাকে দুটা সিগারেট বের করলো। ব্যাস এতেই কাজ হলো।
সাকিল দু প্লেট খাবার নিয়ে হাজির।
সব্বাই বিয়েতে মনোযোগ দিয়েছে। আর ভিনদেশীর মতো শুধু আমরাই খাওয়া করছি। ভয় করছিল। কেউ না আবার সন্দেহ করে ফেলে।
.
আপনারা বরপক্ষ থেকে এসেছেন তাই তো?? তা দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন যে। কিসের তাড়া এতো।
.
খাওয়াতে মগ্ন ছিলাম। ফিরে দেখি এক মেয়ে দাঁড়িয়েছে সামনে।
মুখে মোলায়েম এক ভাব আছে। বেশি মেকআপ করেনি। তাই আবাক হলাম একটু। কিন্তু মন্দ লাগছিল না দেখতে। ল্যাহেঙ্গা পড়েছে মেয়েটা। কালো রং এর। ভালোই মানিয়েছে।
.
মেয়েটা আবার বলল, কিছু বলছেন না যে??
.
আমি তখনো মেয়েটাকে দেখে চলেছি। সাকিল কনুই দিয়ে ঘুতা দিলো।
এতে যেন ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরলাম আমি। একটু লজ্জা পেলাম সাথে। তখন থেকে মেয়েটাকে অমন ড্যাবড্যাব করে দেখছি, লাজলজ্জা সব বিসর্জন দিয়ে।
.
আমি বললাম, হু বরপক্ষ থেকে এসেছি।
– ওহ তাহলে নিশ্চয় দুলাভাই এর ফ্রেন্ড হওয়ার কথা। নাহলে কাজিন।
– হুম ফ্রেন্ড হই।
.
ফ্রেন্ড হই একথা শুনতে মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বলল, মানুষ বুঝি ফ্রেন্ডের বিয়ে তে লুঙ্গী পড়ে আসে!!
.
লুঙ্গী পড়ে আসে মানে??
কই আমি তো লুঙ্গী পড়িনি। পাশে দেখি সাকিল লুঙ্গী পড়া। শালার আক্কেল নেই। তখন কতো করে বললাম রেডি হতে। আমার কথাই শুনলো না। আর তাড়াহুড়োর মাথায় আমিও অতোটা খেয়াল করিনি।
এখন যদি ধরা পড়ে যাই। কি বিশ্রী কাহিনী হবে। কি বলবো তখন??
.
আয়াত ওখানে করছিস কি??
মিষ্টি নিয়ে আয় জলদি।
.
মেয়েটা ভদ্রমহিলার কথায় হাটা শুরু করলো। যাওয়ার আগে একবার ফিরে তাকালো। চোখে কি তেজ!! যেন বলছে, দাড়াও আমি আসছি ফিরে। তারপর খবর নিচ্ছি।
মেয়েটার নাম তাহলে আয়াত। বড্ড মিষ্টি নাম। দেখতেও তাই।
কিন্তু এখন দেরি করলে এই মিষ্টি মেয়ের হাতে খবর আছে। তাই সাকিল কে তাড়াতাড়ি খেতে বললাম। যতো দ্রুত পারি পালাতে হবে। আয়াত ফিরে আসার আগে।
.
এতো জলদি আমি কোনদিন খাওয়া করিনি। তবু করলাম। বাঘিনীর হাতে বাচতে হলে শীঘ্রই পালাতে হবে।
তবে আমি সেই হরিণ যে ধড়া দিতে চাই বাঘিনীর হাতে। ভক্ষণ হলেও তার ছোয়া পেতে চাই।
কিন্তু সাকিল তাড়াহুড়ো করছে। সে তো বাচতে চায়। আমি নাহয় সুপ্ত অনুভূতি দরুন ধড়া দিলাম বাঘিনীর কাছে। সাকিলের তো দেয়ার কথা না।
.
মরবো কিনা বাচবো এরপর, জানা নেই। যাই হোক না কেন, আয়াতের মায়াবী মুখখানা দেখতে মন উতলা করছে।
গেট দিয়ে যখন বের হবো কয়েকজন মুরব্বীর ভাবাত্মক কথায় থেমে গেলাম।
.
একজন লোক কে ঘিরে বাকিরা দাঁড়িয়ে। তাদের কথায় বুঝতে পারলাম বিয়েতে প্রবলেম হয়েছে কিছুটা। বিয়েবাড়ি তে প্রবলেম জিনিস টা নরমাল ই বলা যায়। যেমনি করে ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়, তেমনি বিয়ে আর প্রবলেমের রিলেশন একি বলা যায়।
.
একটু পর ভদ্রলোককে সব্বাই একা ছেড়ে প্রস্থান করলো। সহি কাজ বটে। মন আর মস্তিষ্ক দুটোই যখন যুদ্ধরত তখন সৈনিক অসহায় হয়ে পড়ে। বেমানান কথায় অবস্থা আরো প্রতিকুল হওয়ার রিস্ক থেকে যায়। তবু রিস্ক নিতে হয়। তবেই না মুনাফা পাওয়া যায়। সব্বাই যখন ব্যর্থ এই দায়িত্বটা আমি ই নাহয় নিলাম।
.
ভদ্রলোকের পাশের চেয়ারে বসলাম। তিনি মাথায় হাত রেখে নিচু করে আছেন। আমি বললাম, এমন সময় ভেঙ্গে পড়লে চলে না। সঠিক সময়ে, সঠিক কাজ করা গেলে কোনো প্রবলেম ই বড় না। কি হয়েছে বলা কি যায়??
ভাবছিলাম ভদ্রলোকে থেকে আশানুরূপ জবাব পাবো না। নয়তো তিনি রুডলি বিহেভিয়ার করবেন। কিন্তু হলো না এমন কিছু।
.
তিনি মাথা উচু করে বললেন, ” মেয়েটা বিয়ে করে সুখে থাক সেটাই চাই। সব পিতার তো একি চাওয়া। এজন্য যতদূর পেরেছি, কমতি রাখি নি। তবু মনে ভয় হয়, শঙ্কা জন্মায়। সুখে থাকবে তো মেয়েটা!!
– দ্বিধায় কাজ করলে মনে রোগ হয়। লাগে না ভালো কোনকিছু। চুপিসারে চিন্তায় ডুবে মরি সবাই। তাই যদি বুঝিয়ে বলেন কিছু, অন্ততপক্ষে কথা দিয়ে পাশে দাঁড়াবো না হয়।
– হুম বিয়াই সাহেবের সব অবদার পূরণ করেছি। কিছু দেনাপাওনা বাকি আছে। মেয়ের মুখের দিক চেয়ে টাকাকড়ি বড় কথা না। টাকা আজ গেলে কাল আসবে, এই তো। কিন্তু যদি মেয়েটাই সুখে না থাকে…..
.
ভদ্রলোক কথা শেষ করলেন না। কিছু লোক ঠাণ্ডা পানীয় নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। নিলাম এক গ্লাস। এক চুমুকে সব পেটে চালান। পরে ভাবলাম করা কি যায়।
বললাম, ” বলছিলাম আঙ্কেল মেয়ের নামে টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করলে কেমন হয়?? বিয়াই সাহেব যতো চেয়েছেন তারচেয়ে বেশি দিলেন নাহয়। এতে করে মেয়ে মনেরমত সংসার সাজাতে পারবে। জামাই যাতে টাকা উড়াইতে না পারে সেটাও বশে থাকবে। এতে কিন্তু বিয়াই সাহেবের স্বার্থও হাসিল হবে।
.
ভদ্রলোক খানিক ভেবে উঠে গেলেন। বিয়াই সাহেবের সাথে কথায় মশগুল হতে দেখলাম।
ভদ্রলোকের মুখে হাসির রেখা ফিরেছে দেখছি। বিফলে যায়নি প্রচেষ্টা।
মানুষ হিসেবে আমার কাজ এখানে শেষ। যেতে হবে এখন। একটু পর বউ বিদায় হয়ে চলে যাবে। কিন্তু সেই ফিলিংস আমি অনুভূত করছি।
আয়াতের সাথে আর মুলাকাত হবে কি না জানা নেই। তবে বিদায় লগ্নে মন আনচান করছে।
এতো অল্প সময়ে মেয়েটাকে আপন লাগার মানে হয়। দ্বিতীয় বারের মত আবার নিজের অনুভূতি গুলোকে বলিদান দেয়ার কারসাজি নয় তো। নাকি নতুন এক আশার কিরণ। যা করবে আলোকিত জীবন!
.
গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর ভাবছি। অন্যসময় হলে নিশ্চিত জিহ্বা পুড়ে যেত। কিন্তু চিন্তায় পুড়ে যাওয়ার লেশমাত্র করছি না অনুভূত।
সেদিন বিয়েবাড়ি থেকে ফেরার পর এতো বড় ধাক্কা খেতে হবে ভাবা যায়। হাসান সাহেব বিদ্রূপ করেই বলেছিলেন, মেস ছেড়ে দিতে। আর থাকতে যদি চাই পুরো ফ্লাট ভাড়া নিতে। সময় দিয়েছিলেন এই মাস পর্যন্ত। আজ দুদিন পর শেষ হবে।
ফ্লাটে তিনটে রুম ছিল। দুজন করে ছয়জন থাকতাম। এতে করে পার্সোনালি ভাড়া অনেক কম পড়তো।
কিন্তু এখন পুরো ফ্লাট ভাড়া নিলে আরেকটা বোজ বাড়বে। ছয় হাজার টাকার ব্যাপার। আমার জন্য পুরো মাসের খাওয়াদাওয়া জঞ্জাজলি দেওয়া। কারণ এরপর হাতে কোনো আর টাকাই থাকবে না।
.
“এই ছেলে!!
সেইদিন পরে তোমাকে কতো করে খোজ করলাম, পেলাম ই না।
চলে গেছিলে যে??
.
লোকটা কে পরিচিত লাগছে। কথা শুনে মনে হলো তিনিও আমাকে চিনেন।
সাকিল হুট করে বলল, ” আরে অভ্র! উনি ই তো বিয়েবাড়ির ভদ্রলোক।
.
ছি!
কেমন করে উনাকে ভুলে গেলাম। অপরাধী কণ্ঠে বললাম, আঙ্কেল একটু ভাবনায় ছিলাম তো, মনে করতে পারিনি। আরে দাঁড়িয়ে যে?? বসুন না।
– ( চেয়ারে বসে) মনে হচ্ছে অল্প বয়সে বড্ড ভার তোমার উপর। এখন তো আড্ডাবাজি করে তোলপাড় করার বয়স তোমাদের। আর তোমরা এতোটা চিন্তিত। বলা কি যায় কিছু??
.
সেইদিন অচেনা আমাকে নির্দ্বিধায় তিনি পুরো মন জুড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তার দোদুল্যমান মনের হালের কথা।
আজ আমি কি তার সরলতার ইনসাফ করতে পারিনা। পারিনা তার পথে চলতে। না বললে হয়তো আঙ্কেলকে খারাপ লাগতে পারে।
সাকিলের দিকে তাকালাম। সে মুচকি হেসে সবকিছু বলার আশ্বাস দিলো। তখন আর আমাকে থামায় কে!!
.
সবি বুঝিয়ে বললাম উনাকে।
এতে তার চেহারায় লেশমাত্র পরিবর্তন দেখলাম না। বরং তিনি স্বাভাবিক। মুচকি হেসে বললেন, তোমার ঋণ শোধ করার মত নয়। তবু যে তোমার কাজে আসতে পারবো এটাই কম কিসে। বলছিলাম আমাদের বাসার ছাদে একটা রুম খালি থাকে। সেখানে তোমরা শিফট হতে পারো। মানা করবে না প্লিজ।
.
ভদ্রলোকের কথা ফেলতে মন সায় দিচ্ছে। আবার এমন করে কারো সাথে থাকাও যায় না। আমি একটু ভেবে বললাম, তাহলে ভাড়া কিন্তু নিতে হবে।
.
ভদ্রলোক আমার কথায় ব্যথিত হলো মনে হচ্ছে। তবু দমে গেলো না। মুচকি হেসে বলল, ” তাহলে খাওয়া কিন্তু আমাদের সাথে করতে হবে। তবেই তোমার কথা মানবো।
ভদ্রলোক হেরেও জিতে গেলেন। তিনি এতোটা প্রফুল্ল যেন আমাদের থাকার ব্যবস্থা নয়, এভারেস্ট জয় করেছেন। খুশির ঝলক চোখেমুখে বিরাজ করছে। কেমন জানি এক বাচ্চা বাচ্চা ভাব। এমনো আবার মানুষ নয় নাকি!!
.
মাসের আরো দুদিন বাকি আছে। ভেবেছিলাম হাসান সাহেব কে এ মাসের ভাড়া নিয়ে ঘুরাবো। পরে ভাবলাম, থাক না। লাভ কি এতে?? হাসান সাহেব কে ভাড়া দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
বাড়ির ঠিকানাটা আরেক বার মিলিয়ে নিলাম। পাশ থেকে সাকিল বলল, আরে এই বাড়িটায় হয়। ভাবিস না এতো। নক কর দরজায়।
.
তখন আঙ্কেলকে বিকেলবেলা আসার কথা বলি। মেস ফিরে গোছগাছ করতে বিকেলবেলা হয়ে যায়। আর এখন আঙ্কেলের দেয়া ঠিকানা মোতাবেক এসেছি। তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে।
.
দরজায় নক করার মিনিট দুয়েক পর, কে জানি দরজা খুলে দিলো। আমি লাগেজ উঠাতে নিচে ঝুকেছি সবে। সাকিল পাশ থেকে টোকা দিলো। এই শালার হুট করে কি হয় মাথায় আসে না। লাগেজ উঠে সামনে দেখি দরজার সামনে আয়াত দাঁড়িয়ে।
বাঘিনী আমাদের এমন করে তাকিয়েছে, যেন গিলে খাবে। আমি ঢোক গিললাম। সাকিলের অবস্থা আরো বেগতিক।
একবার ভাবলাম ফিরে যাই। নাহলে আজ আমরা শেষ।
.
এমন সময় আঙ্কেল আমাদের দেখলেন। যাক বাচা গেলো। সেফটি তে থাকা যাবে এখন। আঙ্কেল কাছে এসে বললেন, এসেছ তোমরা; আয়াত যা শরবত করে নিয়ে আয়।
চোখে পাকিয়ে আয়াত ভিতরে গেলো। মেয়েটার নিশ্চয় তুলা রাশি। ভাগ্য ভয়ানক খারাপ। বারবার আমাদের কাছে পেয়েও খেতে পারে না। সমবেদনা এক বুক বাঘিনী।
.
শরবত খেয়ে উপরে যাচ্ছি। সাথে আয়াত আছে। আঙ্কেল আয়াতকে আমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। বাঘিনীর এমন ভাবসাব যেন মহাভারত অশুদ্ধ করেছি। শুনেছি সাতখুন পর্যন্ত মাফ হয়। আর সেইদিনের এতটুকু অপরাধের জন্য এমন প্রতিক্রিয়া।
.
আঙ্কেলের মেঝো মেয়ে আয়াত। একটা ছোট মেয়েও আছে; নাম ফাবিহা।
সেইদিন বিয়েবাড়ি তে বুঝতে পারিনি আয়াত পাত্রীর ছোটবোন। মুশকিল কাজ তা বটে। কেননা বিয়েবাড়ি তে সব মেয়েই মাতবর হয়।
আয়াত সকালবেলা ভার্সিটি গেছে।
ফাবিহা আমাকে বাসা ঘুরে দেখাচ্ছে। ওর সব প্রিটেস্ট শেষ, তাই বাসায়।
.
আয়াতের রুমটা বেশ গোছালো। চারিদিক বই আর বই। মেয়েটা বইপাগল, দেখলে বুঝা যায়। বললাম, ফাবিহা তোমার আপুনি বড্ড ভালো স্টুডেন্ট তাই না??
– হুম কি লাভ তাতে ভাইয়া। শেষমেশ তো বড় আপুর মত বিয়ে করে শ্বশুরঘর চলে যাবে।
.
আঙ্কেলের সাথে মর্নিং ওয়াকে বেড়িয়েছি। সেইদিন ফাবিহার কথা মনে খানিক লেগেছিল। এতদূর লেখাপড়া করে লাভ কি?? তার যদি যথোপযুক্ত সম্মান না করা হয়।
ব্রেক নিয়ে একখানে বসলাম দুজনে। আঙ্কেল কে পানির বোতল এগিয়ে দিলাম। বললাম, আঙ্কেল কিছু না বললে একটা কথা বলি??
– আরে পারমিশন নিতে হয় নাকি।
– জানেন আঙ্কেল ফিউচারে আমার মেয়ে হলে, তাকে এমন ভাবে গড়বো যাতে নিজেই তার ভার নিতে পারে। বিয়ে দেয়ার সময় যেন শঙ্কায় না পড়তে হয়। সংসারে মেয়ে যদি কিছু টা কন্ট্রিবিউট করে, অন্যরকম সম্মান পাবে। আল্লাহ না করুক জামাই এর কিছু হলে মেয়েটা যেন নিজে সংসার চালায়। একেবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে আমার মেয়ে।
– কথা গুলো কিন্তু মন্দ বলো নি।
– তাহলে বড় মেয়ের বেলায় এমন হলো কেন। আমার কথা মেনে চললে সেদিন আপনাকে এতো ভাবতে হতো না। মেঝো মেয়ে কিন্তু সে পথেই যাচ্ছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেন। দেখবেন সে একদিন গর্বের কারণ হয়ে দেখাবে।
.
আমার কথা মগ্নপ্রায় হয়ে আঙ্কেল শুনলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আবার দৌড়ানো শুরু করলেন।
আঙ্কেল না আবার আমাকে ভুল বুঝেন। আয়াতের কাছে ডিগ্রী শুধু কিছু কাগজ নয়; প্যাশন বলা যায়। এমন এক স্বপ্ন যা তার কাছে অকল্পনীয়। স্বপ্ন ভাঙ্গার দরদ নিয়ে আয়াত ব্যথিত হোক চাইনা।
.
আপনি আব্বু কে কি বলেছেন??
সাহস তো কম না আপনার!
.
রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে হাটছি। এমন সময় আয়াত একথা গুলো বলল। কিছুক্ষণ ঠিক মাথায় আসলো না আয়াত কি বলতে চাচ্ছে।
কিছু বুঝবার আগে আয়াত বলল, আমার কথা আপনাকে চিন্তা কে করতে বলেছে শুনি?? আব্বু যদি আমায় ভুল বুঝে আপনার খবর আছে বলে দিলাম।
.
আর আয়াত দাঁড়ালো না। সিড়ি বেয়ে চলে গেলো। ঠিকি তো আঙ্কেল কে এসব বলার আগে ভাবা উচিৎ ছিল। তিনি যদি ভাবেন আয়াতের কথায় আমি এসব বলেছি, তাহলে স্বভাবত ভুল বুঝতে পারেন। নিশ্চয় আঙ্কেল আয়াত কে কিছু বলেছে। তাই হয়তো আয়াত এমন রিয়াক্ট করলো।
আঙ্কেল তো আমার কথা বুঝতেও পারেন। দেখা গেলো আয়াত কে জব করার পারমিশন দিলেন। কিন্তু আয়াত তো এমন কিছু বলল না। আমাকে ঝাড়ি মেরে চলে গেলো। মেয়েটার একটু ভালো করে কথা বললে কি হয় হু?? আন্টি বুঝি আয়াত গর্ভে থাকাকালীন মিষ্টি খান নি।
.
আগেকার জবটা ছেড়ে দিছি। অবশ্য নতুন জব পেতে সময় লাগে নি। কিন্তু ট্রেনি হিসেবে যোগ দিয়েছি; আজ কয়েকদিন হলো। এক প্রোজেক্ট দিয়েছে। কমপ্লিট করতে পারলেই জব ফিক্সড। ভালো বেতনের জব, হাতছাড়া করতে চাই নে।
আগামীকাল প্রোজেক্ট জমা করার শেষদিন। তাই বাসায় বসে তাই করছি। কেউ নেই বাসায়, সব্বাই বাইরে গেছে। হুট করে কলিং বেল বেজে উঠলো। একটু বিরক্ত হলাম। এখন ছাদ থেকে নিচে নামতে হবে।
.
দরজা খুলে দেখি আয়াত ওর বান্ধুবির সাথে দাঁড়িয়ে। কেমন জানি লাগছিল আয়াত কে। পাশ থেকে ওর বান্ধুবি বলল, ভাইয়া আয়াত ক্লাসে বমি করেছে অনেকবার। মেডিসিন দিয়েছি, এখন রেস্ট করলে ভালো হতো।
এমন কথায় বুকটা একটু মোচড় দিয়ে উঠলো। আয়াত কে রুমে নিয়ে গেলাম। শোয়ানো মাত্র ঘুমিয়ে পড়লো। আয়াতের বান্ধুবি চলে গেলো। প্রোজেক্টের কাজ আছে বাকি। আবার রুমে ফিরে যেতেও মন করছে না। যদি আবার মেয়েটা আবার বমি করে।
.
আয়াত থেমেথেমে বমিবমি ভাব করছে। আর তখনি লেবু পাতা ওর নাকের কাছে রাখছি। মাঝখানে আরেকবার ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি। তবু মনে যেন শান্তি পাচ্ছি না।
রাত হয়ে গেছে খেয়ালি করিনি। আয়াত এখন অনেকটা সুস্থ। ফোনে টুকটুক করে গেম খেলছে, ক্যান্ডি ক্রাশ হয়তো। আর একটু পর পর হেসে উঠছে। আমি যে রুমে জ্বলজ্বান্ত মানুষ আছি; মেয়েটা পাত্তাই দিচ্ছে না।
.
কিরে তুই প্রজেক্টের কাজ করিস নি কেন?? আর কখন করবি।
.
সোফায় বসে আছি। সাকিল হুট করে এসে একথা বলল। আয়াত আমার দিক তাকিয়ে আছে, যেন মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলছি। আমি বললাম, রাত পুরো আছে। ফিনিশিং টা বাকি, করে নিবো একসময়।
– ওহ তাহলে চল। মেডিকেলে যেতে হবে।
– বলিস কি!! কার কি হয়েছে?
– রিয়াদ বাইক এক্সিডেন্ট করেছে। কন্ডিশন ভালো না রে।
.
রাত এখন দুটা বাজতে চললো। তখন থেকে মেডিকেলে আছি। একটু আগে সাকিল কে বাসা পাঠিয়ে দিলাম।
আঙ্কেল আন্টি ফেরার পরে বেরিয়ে আসি। মেয়েটাকে এতো বড় বাসায় একা ফেলে আসতে মন করছিল না তাই।
রিয়াদ আমাদের মতোই মেসে থাকে। বাড়ি ঠাকুরগাঁও। ওর বাবা আসতে সময় লাগবে। তাই আমি ফিরে যেতে পাচ্ছি না। প্রোজেক্ট কমপ্লিট আর করা হলো না। আধঘণ্টার কাজ ছিল, করলে হয়ে যেতো। কিন্তু কি আর করার?? বিকেলবেলা আয়াত অমন অসুস্থ ছিল, আর রিয়াদের এখন অবস্থা। সময় ই পেলাম না।
.
রাত পেরিয়ে আজ দুপুরবেলা পর্যন্ত মেডিকেলে আছি। সকালবেলা রিয়াদের বড়ভাই আর বাবা এসেছেন। তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা, মোটকথা সব বুঝিয়ে দিয়েছি। এতে দুপুরবেলা গড়িয়েছে। তাই উনারা আমাকে আর থাকতে দিলেন না।
মেডিকেল হতে বেরিয়েছি সবে, এমন সময় অফিস থেকে কল। ঝাড়ি দেওয়ার জন্য হয়তো মনে করেছে।
.
কাল থেকে আমার জয়েনিং। চাকরি টা হয়ে গেছে। কিন্তু প্রোজেক্ট কমপ্লিট করলো কে, আর সাবমিট ই বা কে করলো?? সাকিল তো রাত জেগে এমন করার ছেলে না। তাহলে করলো টা কে???
বাসায় ফিরে সাকিল বলল, সব আয়াতের কাজ। জানিস দোস্ত মেয়েটা জাগিয়ে রেখে সব বুঝিয়ে নিয়েছে, নিজে প্রোজেক্ট কমপ্লিট করে ই-মেইল করে পাঠিয়েছে।
মেয়েটা এমন করতে গেলো কেন?? আমি তো অন্যএক আয়াত কে চিনতাম। যাক মেয়েটা অতোটা কঠোর না। অনুভূতি আছে।
.
ছাদে দাঁড়িয়ে আছি, পাশে আয়াত। সাকিল শালা ঘুমাচ্ছে। ওহ থাকলে হয়তো বাচার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এখন আমি শেষ।
আসলে আঙ্কেল আয়াতের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আয়াতের এমবিএ শেষ হলে বিয়ে হবে। তাই আয়াত আমার ক্লাস নিতে ডেকেছে।
.
সাকিল ভাইয়া বলেছে আপনার নাকি কারো সাথে রিলেশন ছিল। তাকে কি ভুলেছেন, না আজো ভালবাসেন?? নাকি নতুন কেউ আছে?
.
আয়াতের কথায় একটু তাজ্জব হলাম। ভেবেছিলাম আয়াত বকাঝকা করবে, বিয়ে থামাতে বলবে। কিন্তু এমন কিছু হলো না।
আয়াত আবার বলল, বলছেন না যে কিছু?
– না কেউ নেই। যে চলে গেছে তাকে মনে রেখে লাভ কি। আর নতুন কেউ নেই।
– ঠিক তো?? ভেবে নিয়েন একবার কিন্তু।
– হুম ঠিক।
.
আয়াত আমার কথায় ব্যথিত হলো মনে হয়। একটু মন খারাপ করেই চলে গেলো। আয়াত কে ভালো লাগে ঠিকি। কিন্তু অমন করে ফিল করিনি কখনো। তাই না চাইলেও এমন কথা বলে ফেলেছি।
.
লাঞ্জ টাইমে ক্যান্টিনে বসে আছি। আয়াতের দেখা করার কথা। কার সাথে জানি পরিচয় করিয়ে দিবে।
অনেকক্ষণ ওয়েট করার পর দেখলাম আয়াত আসছে, সাথে সমবয়সী এক ছেলে। দুজন কে সাথে খুশি লাগছিল দেখে।
.
এই যে মিস্টার!!
মিট মাই বয়ফ্রেন্ড আকাশ।
এর সাথে আমি বিয়ে করতে চাই।
.
আয়াত বসার একটু পর একথা বলল। বড্ড রাগ হলো আমার। আয়াত কে নিয়ে ফিল করেনি ঠিক, কিন্তু খারাপ তো লাগে না। তাই বলে আয়াত আমার সামনে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে হাজির হবে।
আর বেকুব, বজ্জাত ছেলেটা দাত কেলিয়ে হাত এগিয়ে দিলো। বেটা থাম, দেখাচ্ছি মজা। আমার বউ কে পালিয়ে নিয়ে যাবি।
.
আমি রেগে বললাম, এই ছেলে তোমার সাহস তো কম না। আমার উট বি বউকে নিজের জিএফ বলছো। কি করো তুমি?? বাসা কোথায়?? একদম কিডন্যাপ কেসে ফেলবো নাহলে নির্যাতন। জানি বানোয়াট সব। কিন্তু আঙ্কেল আমার পক্ষে থাকবে জেনে রাখো।
আয়াত আমার কথায় যেন আসমান হতে মাটি তে পড়লো। ওসব পরওয়া না করে আয়াত কে বললাম, তুমি এসব ধান্দা বাদ দাও। আঙ্কেল যখন একবার বলেছেন তোমার সাথে তোমার বিয়ে হবে; তবে তাই হবে। দরকার পড়লে তোমার হাত পা বেধে বিয়ে করবো।
.
আমার কথায় এবার আকাশ ছেলেটা হেসে ফেলল। আয়াতকে দেখলাম কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। গাল দুটো লাল বর্ণ ধারন করেছে। আজিব তো!! এমন তো হওয়ার কথা না।
আকাশ ছেলেটা বলল, দোস্ত তোকে বলেছিলাম না অভ্র ভাইয়া তোকে ঠিকি ভালবাসে। তুই যেভাবে বলেছিলি এমনি হওয়ার কথা। শুধু মানতে চায় না। দেখ তার প্রমাণ দিলাম। এবার কোন রেস্টুরেন্টে যাবি চল। খাওয়াবি আমায়।
.
মাথা কিছুটা চক্কর খেলো। আমার সাথে এতো বড় গেম হু।
আয়াত মুচকি হাসছে। লজ্জায় এদিকওদিক দেখছে। একসময় আমাকে বলল, সাথে টাকা এনেছেন তো। আপনার জন্য এতো কিছু সাজিয়ে করতে হলো। তাই বিল আপনি ই দিচ্ছেন।
আমি কিছুনা বলে মুচকি হাসলাম। আয়াত তো ঠিকি বলেছে। সেইদিন সিধা ভালবাসি বললে হতো। আয়াত এমন কিছু করতো না।
থাক যাই হোক। দোদুল্যমান মন সঠিক রাস্তার সন্ধান পেয়েছে, আর কি চাই।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা