সরকারি চাকরীতে বদলি নিত্যনতুন ঘটনা। রঞ্জুর বদলি হয়েছে একমাস হয়নি এখনো।
নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, আর নতুন করেই ভাল লাগা…
নিয়ম করেই যেন টেবিলের উপর অসংখ্য ফাইল জমা হয়ে প্রায়ই স্তূপাকার ধারণ করে থাকে।
রঞ্জু স্তুপগুলোর মাঝখান দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে তন্বীকে দেখে। রোজ সকালে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই অফিসে আসে তন্বী।
এসেই ফাইলগুলো খুলে কাজ শুরু করে। নিজের মত করে নির্বিঘ্নে কাজ করতে থাকে।
চা আসলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিছুক্ষণ গল্প করে আশেপাশের কলিগদের সাথে। গল্পের মাঝে মাঝে উচ্ছলভাবে হেসে ওঠে তন্বী।
সেসময় জানালার ঈষদচ্ছ কাচের মধ্য দিয়ে সূর্যের সোনালী আভা পড়ে তন্বীর মুখের উপর।
রঞ্জুরও ইচ্ছা করে গল্পে সামিল হতে। প্রায়ই পেরে ওঠে না। এখনো পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারেনি রঞ্জু।
অফিসের সবার ভীষণ প্রিয় এই তন্বী। যে কারো যেকোন সমস্যায় সবাই তন্বীর কাছেই যায়।
হাসিব সাহেবের মেয়ের স্কুলে পেরেন্টস মিটিং। তন্বীকে বলেন, “একটু কাভার দিও”
তন্বী মৃদু হেসে বলে, “কোন সমস্যা নেই। আপনি নিশ্চিন্তে যান”। তাই তন্বীর যেকোনো প্রয়োজনে বাকিরা নিজে থেকেই এগিয়ে আসে।
পহেলা ফাল্গুন ছিল সেদিন। বাসন্তী রঙের শাড়ী পরেছিল তন্বী। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল রঞ্জু।
বাসন্তী রঙের শাড়ীতে সব মেয়েকেই কি সুন্দর লাগে? নাকি আগে কখনো এভাবে দেখেনি তন্বীকে? রঞ্জু বুঝতে পারে না।
খোলা চুলে আগে তন্বীকে দেখেনি রঞ্জু। কপালের কালো টিপেও দেখেনি।
তন্বীর গালে খুব ছোট একটা তিল আছে, যা সহজে চোখে পড়ে না, সেদিনই খেয়াল করল রঞ্জু।
মানুষ প্রায়ই বুঝে উঠতে পারে না তার আশেপাশের মানুষগুলো যে কতোটা সুন্দর। জীবনের ব্যস্ততা তাকে মুগ্ধতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
রঞ্জুও তাই লক্ষ করে নি কখনো।
রঞ্জু ফার্নিচারের দোকানে গিয়ে সোফা দেখছিল। সেখানেই দেখা হল স্কুলবন্ধু শোভন। দুই বন্ধু কোলাকুলি করেই কাছে থাকা সোফায় বসে পড়ে।
রঞ্জু বলল, “মাশাল্লাহ, দারুন একটা ভুঁড়ি হয়েছে তোর”
“আরে, ব্যাটা, বিয়া করলাম। ভুঁড়ি যদি নাই হবে লোকে বুঝবে কী করে?” বলেই চোখ মারল শোভন।
“ম্যালা সুখে আছো মনে হচ্চে”
“অসুখ যখন হয় নি, সুখেই তো আছি”
“ভাবী ভাল রাঁধতে পারে নাকি?”
“খুব ‘ভাবী’ বলা হচ্ছে? বিয়েতে এসে ভাবীকে দেখার সময় হল না!”
“আরে প্রব্লেমে না পড়লে অবশ্যই যেতাম। তা ভাবী কেমন?”
“ভাল রাঁধুনি না হলেও খারাপ না, ভালই। পছন্দ করেই তো বিয়ে করেছি”
“শুধু পছন্দ? না আরো কিছু?”
“না, প্রেম করার ভাগ্য হয় নি। তবে আমি ওকে চিনতাম। ও আমাকে চিনতো না। হয়ে গেল…”
“বাঃ, বেশ তো। কিভাবে চিনতি?”
“এক ফ্রেন্ড এর ফ্রেন্ড… সেই ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখেছিলাম। ওর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছিল ব্রেক-আপ এর পর…”
“তোর ফ্রেন্ড কি ছেলে না মেয়ে?”
বিরক্ত হয়ে শোভন বলল, “মেয়ে। কাঁধে মাথা রাখবার মত ভরসা আমরা কয়জনকে করতে পারি?
যেটা লক্ষ করেছি, আমার ফ্রেন্ডের নাকের সর্দিও গড়িয়ে পড়ছিল। ব্যাপারটা টের পেয়েও সে এতটুকুও বিচলিত হয় নি, ওর সর্দিতেই কাঁধ ভিজাচ্ছিল।
খুব অদ্ভুত লেগছিল। আরো বেশ কয়েকবার দেখেছি। ও অবশ্য আমাকে খেয়াল করেনি”
“বাঃ, বেশ তো। তবে এখন বিয়ে করার জন্য পকেট ভারী হওয়া লাগে। বউদের কত চাহিদা… শাড়ী গাড়ি বাড়ী চুড়ি…”
“এই দিক দিয়ে ভাল আছি বলা যায়, আবার যায়ও না”
“মানে?”
“শাড়ি গহনার ব্যাপারে ওর অতোটা ইন্টারেস্ট নেই। জব তো ও করেই। শি কেন বাই হার অউন শাড়ী এন্ড জুয়েলারী।
সেজন্য তাকে খুশি করার ব্যাপারে মাথা খাটাতে হয়। অল শি কেয়ারস আবাউট ইজ মাই এফোর্ট”
“মাথা খাটাতে হয়?”
“ওর মতে, ভালবাসা প্রকাশের ধরন এক-একজনের এক-একরকম। শাড়ি-গহনা দিয়ে যে ভালবাসা প্রকাশ হয় না, তা না।
যার জন্য কিছু কেনা হচ্ছে, সেই ‘কিছু’ কিনতেও অনেকে সারাটা দিন মার্কেটে মার্কেটে ঘোরে।
কিন্ত ও চায়, আমি ওকে খুশি করার ব্যাপারে যে এফোর্ট দেব সেটা যেন মেন্টাল এফোর্ট হয়। মানে আমি যেন ভাবি”
“মেন্টাল এফোর্ট?! যেমন?”
“আমার গত জন্মদিনে ও আমাকে কি দিয়েছে জানিস?”
“কী?”
“একটা বয়েমভর্তি হরেক রঙের কাগজ। লাল নীল হলুদ…”
“শুধু এই? ভাবী কিপটা নাকি?”
“আরে নাহ। শার্টও দিয়েছিল”
“ও। তুই তো শিশু না। হরেক রকমের কাগজ দিয়ে কী হবে?”
“মোট ৩৬৫টা কাগজ। কাগজ না, আসলে চিরকুট। সাথে একটা ‘আইন’ ফ্রী। রোজ সকালে আমি একটা করে চিরকুট খুলে দেখব”
“চিরকুটে কি লেখা?”
“স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপার শুনতে নেই, জানিস না? তবে হ্যা, রোজ সকালে যখন একটি করে চিরকুট পড়ি, মনের মধ্যে আলোড়ন হয়।
মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে যায়। সকালটা সুন্দর লাগে”
“বাঃ, ভাবী ভাবুক আছে”
“হুম। বিপদের কথা শোন। কয়েকমাস পর ওর বার্থ ডে। কোন ইউনিক আইডিয়া আসছে না মাথায়, যা দিয়ে ৩৬৫দিন কভার দেওয়া যায়”
“৩৬৫দিনই কেন? কমিয়ে ৫২সপ্তাহ করে ফেল”
হঠাৎ শোভনের ফোন বেজে উঠল। শোভন ফোন ধরে বলল, “এই তো বের হচ্ছি”
রঞ্জুর দিকে ফিরে বলল, “একটা আর্জেন্ট কাজ আছে। তোর কথা তো শোনাই হল না। বন্ধু, কল দিস মাঝেমাঝে”।
রঞ্জু মনে মনে বলল, “আমার কথা না শোনাই ভাল। মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে, তা যেন কেউ আঁচও না করতে পারে”
আরেকদিন আশিকসাহেব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেন, “কাল দেখলাম ‘কাভি আল্ভিদা না কেহনা’।
ইদানীং এক্সট্রা-মেরিটাল এফেয়ারকে কেন্দ্র করেই ইন্ডিয়ান ফিল্মগুলো হচ্ছে”
ইমরান সাহেব বলে উঠেন, “কলকাতার বেশিরভাগ আর্টফিল্মগুলোই এখন ফোকাস করে ব্যাপারটাকে।
এই ধরনের মুভিগুলো বানায় কেন? আল্লাহ যে কবে এদের হেদায়েত দেবে?”
আশিক সাহেব বলেন, “ফিল্মমেকাররা ব্যাপারটাকে উৎসাহিত করছে না, ইমরানভাই। তারা সমাজের বাস্তবতাকে শো করছে।
আমরা নাইন-টেনে ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে মন্তু ও টুনিকে নিয়ে পড়েছি। আবার ইন্টারমিডিয়েটে পড়েছি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’”
হাসিব সাহেব বলেন, “কোনকিছু দেখালেই যে তা করতে হবে এমন তো নয়”
ইমরান সাহেব বলেন, “টেক্সট থেকে দুটোই বাদ দেয়া উচিৎ। রঞ্জু, তুমি কিছু বলো”
তন্বী বলে ওঠে, “ইমরানভাই, আমাদের অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষজনের একটা মূলসমস্যা হল আমরা নেগেটিভ ব্যাপারগুলোকেই গ্রহণ করি।
পজিটিভ ব্যাপারগুলো দেখিও না। ‘হাজার বছর ধরে’ ও ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ দুটি অসাধারণ উপন্যাস। একটা গ্রামবাংলার মানুষ ও আরেকটা জেলে-”
“পড়েছি পড়েছি ওসব” বলেন ইমরান সাহেব।
“আচ্ছা, আমিও জানি, সবাই পড়েছে। লক্ষ করুন, আমরা পাশ্চাত্য থেকে কী গ্রহণ করছি, আর কি গ্রহণ করছি না।
এক এক জায়গার লাইফ-স্টাইল এক-একরকম। শীতের দেশের মানুষেরা ড্রিঙ্কস করে বডি টেম্পারেচারকে মেইন্টেইন করার জন্য।
আর আমাদের দেশের মানুষ? নেশার জন্য। আমরা পাশ্চাত্যের পোশাক-আশাক গ্রহণ করছি, কিন্তু আমরা ওদের ব্যবহার-শিষ্টাচার গ্রহণ করি নি।
ওদের পোশাক ওদের আবহাওয়া ও ঐতিহ্যের সাথে খাপ খায়, যা আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির সাথে যায় না।
ওদের ব্যবহার কতোটা সভ্য, ওরা কতোটা জেন্টেল তা কি আমরা চিন্তা করি?
আমাদের ছাত্ররা কিছু হলেই বাস-গাড়ি ভাংচুর করে, অন্ধ ধার্মিকেরা মন্দির-প্যাগোডা ভাংচুর করে, রোগীরা হাসপাতাল ভাংচুর করে।
পাশ্চাত্যের পোশাকটাই হয়ত শুধু উগ্র, কিন্তু প্রাচ্যের মানুষের মনটাও কি উগ্র নয়?”
রঞ্জু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। সবাই মতামত দিল, রঞ্জুরও কিছু বলা উচিৎ। রঞ্জু বলে বসলো, “‘কাভি আল্ভিদা না ক্যাহনা’ মুভিটা কিন্তু ভালই।
কারণ ভালবাসা যে বিয়ের আগেই হবে, এমন তো নাও হতে পারে। বিয়ের পরও অন্য কাউকে ভাল লাগতে পারে। ভালবাসাও হতে পারে।
মানুষ তার সোলমেটকে খুঁজে পেতে পারে দেরীতে। তাই নয় কি?”
আশিক সাহেব, হাসিব সাহেব ও তন্বী নিজেরা নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে চুপ হয়ে রইল।
ইমরানসাহেবের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে পড়লেন। আর কেউ কোন কথা বলল না।
রঞ্জু হঠাৎ করেই রবিঠাকুরের ভক্ত হয়ে গেল। ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থের ‘অপরিচিতা’গল্পটি যত পড়ে তত অবাক হয়।
মানুষের জীবন কত বিচিত্র! এরমধ্যে একদিন রঞ্জুর স্বপ্নে তন্বী আসে। তবে বাসন্তী রঙের শাড়িতে নয়, লাল রঙের শাড়ীতে।
বাতাসে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল তন্বীর খোলা চুল। দুজনে এক নৌকার দুইপ্রান্তে বসেছিল।
কোন মাঝি ছিল না? তবে কি রঞ্জুই মাঝি ছিল নাকি? নৌকার দুপাশে অসংখ্য কচুরিপানা। আকাশে মেঘ ছিল।
মেঘগুলো বুঝি রঞ্জুর ও তন্বীর ভালবাসার অসম্ভাব্যতাকে নির্দেশ করছে?
আরেকদিন আশিকসাহেবকে ভীষণ বিরক্ত দেখাচ্ছিল। ইমরানসাহেব প্রশ্ন করলেন, “কী হল?”
“আর ভাল লাগে না। কিছুদিন আগেই একটা শাড়ি কিনে দিলাম। সামনে আবার ৩টা বিয়ের দাওয়াত পড়েছে।
আবার শপিংএ যেতে হবে শাড়ি ও অরনামেন্টস কিনতে”
হাসিব সাহেব বলেন, “আশিকভাই, ভাবী যে সুন্দরী… এটুকু না করলে কিভাবে হবে, বস?”
“হুম, তা বটে। আমি প্রায় ৪০-৫০টা মেয়ে দেখেছিলাম। তার মধ্য থেকে ওকেই ভাল লেগেছিল।
প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম, বিয়ে যদি করি তবে একেই করবো”
“হুম। সবমেয়েরাই কী দুদিন পরপর এটা-ওটার জন্য হাজবেন্ডদেরকে অস্থির করে তোলে নাকি?”
রঞ্জু সব শুনছিল। কী বলা উচিৎ হবে বুঝতে পারছিল না। তন্বী বলতে শুরু করে, “আশিক ভাই, প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা।
তাদের চাহিদাগুলোও আলাদা। প্রতিটা মানুষের বিশেষ কিছু ব্যাপারে প্যাশন কাজ করে।
কারো গীটারের প্রতি প্যাশন, তো কারো থিয়েটারের প্রতি। সেরকমভাবেই সাজগোজ বা মেকআপও একধরনের প্যাশন।
মেকআপকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেও ভেবে দেখুন তো, সাজবিহীন ভাবীকে কোন অনুষ্ঠানে নিতে ইচ্ছে করবে কিনা?
প্যাশন যেমনই হোক, সেটা শুধুমাত্র আনহেলদি না হলে আমাদের উচিৎ শ্রদ্ধা করা।
আমরা সবাই অন্যের উপর নিজের ইচ্ছাকে চাপানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ি, আমরা ভুলে যাই সামনের মানুষটার ইচ্ছা-আকাংক্ষার কথা।
ভাবী অনেক প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হওয়ায় তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে সাজগোজের প্যাশন ডেভেলপ করেছে।
আপনি যখন তাকে প্রথম দেখেছিলেন, তার প্যাশনটাও আপনার চোখে পড়ার কথা, তাই না?”
“তোমার সাথে কথায় পারা কঠিন। ইউ অলঅয়েজ ফাইন্ড লজিক ইন এভরিথিং” বলে আশিকসাহেব।
রঞ্জু প্রায়ই এই ধরনের আলোচনায় কিচু বলতে পারে না। আচ্ছা তন্বীর প্যাশন কী? প্যাশনটা অবশ্য বোঝার চেস্টাও করে নি আগে।
বুঝতে পারলে হয়ত রঞ্জু ও তন্বীর গল্পটা ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু গল্পগুলোর ভিন্ন হয়ে ওঠা হয় না…
বেশকিছুদিন ধরেই রঞ্জু লক্ষ করে, তন্বী কানে হেডফোন দিয়ে রাখে পুরোটা সময়। আগে মাঝেমধ্যে দেখেছে হেডফোন কানে দিয়ে গান শুনতে।
তন্বী কি তবে গান শুনতে ভালবাসে?
রঞ্জুর ভাবনার মাঝেই হাসিবসাহেব তন্বীকে বলেন, “ব্যাপার কী? বেশ কিছুদিন ধরেই খেয়াল করছি। কী শোনো এতো?”
“কবিতা”
“কার কবিতা?”
“অনেকের। পূর্ণেন্দু পত্রী, নির্মলেন্দু গুন, হেলাল হাফিজ, আরো অনেকের”
“আবৃত্তিকার কে? শিমুল মোস্তফা?”
“না। নব্য আবৃত্তিকার। চিনবেন না” বলেই মৃদু হাসে তন্বী।
রঞ্জুর স্কুললাইফের কথা মনে পড়ে। আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় হয় রঞ্জু নয়ত শোভন প্রথম হত।
ইচ্ছে করছিল, নিজের আবৃত্তি প্রতিভা তন্বীর কাছে জাহির করতে। কিন্তু সুযোগ কোথায়? রঞ্জু তন্বীর সাথে ঠিক করে কথাই বলতে পারে না।
ভীষণ ক্ষুদ্র মনে হয় নিজেকে তন্বীর কাছে। স্কুললাইফের পরে এই প্রতিভাচর্চার সুযোগ হয় নি রঞ্জুর। কেউ কখনো আর শুনতেও চায় নি।
কাজের ব্যস্ততার জন্য নিজেকে অনেক বঞ্চিত করেছে রঞ্জু। সোশ্যাল মিডিয়াতে তেমন এক্টিভও না সে।
অনেকদিন পর কম্পিউটারটা অন করে গান ছাড়ে-
“আমি তোমায় না দেখি, তুমি আমার না হও
আমি যত দূরে যাই, তুমি কাছে রও।।
আমি স্বপ্নে তোমায় দেখি ঘুমিয়ে যখন রই
স্মৃতিতে এসো তুমি যদি দিশেহারা হই
একা হয়ে যাই আমি স্বপ্ন স্মৃতি ছাড়া
তুমি ছাড়া মনে হয় আমি তো আমি নই।।”
ফেসবুকে ঢুকে দেখে অনেক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট জমে আছে। শোভনের রিকোয়েস্টও দেখে।
ভাগ্যিস ফেসবুকটা ছিল, নয়ত পুরোনো বন্ধুদের হয়ত খুঁজেই পাওয়া যেত না। শোভনের প্রফাইল পিকচার দেখেই চমকে উঠল রঞ্জু।
শোভনের পাশের বালিকাটি তার পরিচিতা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
পরদিন অফিসে গিয়ে তন্বীকে রঞ্জু বলে, “তন্বী, আপনার কবিতার আবৃত্তিকারের নাম কি শোভন?”
“হুম” বলে মুচকি হাসে তন্বী। তারপর বলে, “আপনার বন্ধু শোভন”
“বলেন নি যে?”
“আপনিও কখনো জিজ্ঞাসা করেন নি। ভাবী ভালো আছে?”
রঞ্জু দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “হুম আছে। ভাল আছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“কী?”
“আপনার কী আমার উপর কোন আক্রোশ বা রাগ আছে?”
বিস্মিত হয়ে তন্বী বলে, “আক্রোশ! একচুয়ালি আই এম গ্রেটফুল টু ইউ… নট অনলি টু ইউ, টু আ লট অফ গাইজ। আমি ভীষণ ভাল আছি।
আপনার বন্ধু আমার গত জন্মদিনে আমাকে ৫২টা কবিতা আবৃত্তি করে রেকর্ড করে গিফট করেছে, অন্যরকম একটা ব্যাপার, তাই না?
সবার সবাইকে ভাল লাগবে, এমন তো কথা নাই। আমাকেও আপনার ভাল লাগে নি” বলে নিজের কাজে মনোযোগ দিল তন্বী।
রঞ্জুর কিছুই বলার নেই। অপরিচিতা পরিচিতা হয়ে কখন যে প্রিয় হয়ে উঠেছিল, রঞ্জু জানে না…