সমাপ্তির গল্প

সমাপ্তির গল্প

দশ মাস পর দেশে ফিরেছে রায়হান । পিএইচডি কমপ্লিট করতে আরো এক বছর লাগবে ওর । বাসায় এসে রীতিমত লজ্জায় পড়ে গেছে । নতুন বাবা হয়েছে । ছেলের জন্য হাবিজাবি কিনে এনেছে । আর সবার জন্য কেনাকাটা করার সময় হয়ে ওঠেনি । এখন বড় আপা দুলাভাই আর ভাবী ওকে মাস্ট খেপাবে । পার্টটাইম জব করে নিজের খরচ থেকে বাঁচিয়ে দেশে পাঠানো সম্ভব হয়না রায়হানের। আইরিন নিজে একটা স্কুলে চাকরি করে হাত খরচটা মেটায় । রায়হান মাঝে মাঝেই আইরিনকে ফোন করে বলে , পুরোপুরি এস্টাবলিশড না হয়ে হুট করে তোমাকে বিয়ে করে ফেলাটা বোকামি হয়ে গেছে । সুন্দরী বৌ গা ভর্তি জড়োয়া গয়না গড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে আপাতত ফকিরি দশায় আছি দেখে দিতে পারছিনা । কিন্তু ভবিষ্যতে দেখে নিও… … । আইরিন খিলখিল করে হাসে স্বামীর কথা শুনে । হাসির শব্দ রায়হানের বুকে এসে বাজে । ফোনের ওপ্রান্তের মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব । বলতে ইচ্ছে করে বধূ গা ভর্তি গয়নার দরকার নেই তোমার ,বুকে রিনঝিন কাঁপন তোলা তোমার ঐ হাসিটাই তোমার অলংকার ।

বৌ ছেলের সাথে এখনো দেখা হয়নি ওর। বসার ঘরে বসে ঘামছে রায়হান । ভীষন লজ্জা লাগছে । এমনিতে ছোটবেলা থেকে মুখচোরা। এখন বাবা হয়ে গেছে এই লজ্জায় বাবার সামনে বসে মাথা তুলে কথা বলতে পারছেনা। কেমন একটা লজ্জায় কথা বলতে গেলেই কথা জড়িয়ে যাচ্ছে । সে নিজেও কারো বাবা হয়ে গেছে আনবিলিভেবল ! কি ভীষন লজ্জার ব্যাপার ! পাশের রুম থেকে বিড়াল ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। মহাকৌতুহলে রুমের পর্দার ফাঁক ফোকঁর দিয়ে কাউকে দেখা যায় কিনা দেখার চেষ্টা করল রায়হান। কত কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে । ইচ্ছে করছে এক ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসে । বিশ্বাস করতে পারছেনা এখনো আস্ত একটা ছেলের বাপ হয়ে গেছে ও !
আরিফ সাহেব গম্ভীর মুখে পেপার পড়তে পড়তে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন । মাঝে একটা দুইটা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন ছেলের উদ্দেশ্যে । তাঁর ছোট ছেলেটা ভীষন ভয় পায় তাঁকে । এটা বুঝে যেন আরো রাশভারি আচরন করেন ছেলের সামনে । যেমন এই মুহুর্তে তার ইচ্ছে করছে রায়হানকে ছোটবেলার মত কোলে বসিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন । কিন্তু তিনি পারছেন না । ভিতরে কষ্ট হচ্ছে । তবু মুখ থেকে গাম্ভীর্য সরিয়ে ঝলমলে হাসিতে বলতে পারছেন না রায়হান বাবা একটু বুকে আয় ।

ছেলে বাসায় ঢোকার পর মহাখুশিতে ভেতরটা ধুকপুক করা সত্ত্বেও ভাবলেশহীন কন্ঠে বলেছেন ,এলে ? ভালো করেছো । বসো ।
যেন পাশের বাসা থেকে কেউ বেড়াতে আসায় অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন । বুঝতে দিলেন না এতক্ষন ধরে ছেলের অপেক্ষায় ,ছেলেকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে এঘর ওঘর করেছেন । তার আশা ছিলো ছেলে হয়ত মনের ভাবটা বুঝবে । বুঝে তাঁর ভাঙা বুকটাতে মাথা গুজবে , ভেতরের উল্লাস আর্তনাদ কান পেতে শুনবে । কিন্তু সম্পর্কের বরফ গলিয়ে ছেলেতো কাছিয়ে এলোনা !

রায়হান উশখুশ করছিল । হঠাত্‍ বলে উঠল , বাবা আমি ভেতরের ঘর থেকে আসি । আপনি বসেন ।

আরিফ সাহেবের ভেতরটা একটু দমে গেল । দীর্ঘ একটাক্ষন ছেলের মুখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে বললেন , ঠিক আছে যাও ।

আইরিনের ঠোঁটের কোনে হাসির আভা ।
-তারপর এতক্ষনে বৌ বাচ্চার কথা মনে পড়ল ।
-কি করব ! তোমার শ্বশুরের সামনে থেকে উঠা যায় ! তারপর এইটা কে ?
লাল টুকটুকে আধহাত সমান মানুষটাকে দেখে মহাবিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে ফেলেছে রায়হান ।
-আমার কপাল ! নিজের ছেলেকে দেখে চিনতে পারছোনা !
-এইটা আমার ছেলে ? এত ছোট ! হাউ পসিবল ?!
রায়হান বিছানার কাছে এসে ছেলের মুখের উপর ঝুঁকল । ছোটখাট একটা হাই তুলে ছোটখাট মানুষটা হাত বাড়িয়ে ওর চশমা ধরে ফেলল ।
আইরিন রাগ রাগ হয়ে বললো , তুমি কি ভেবেছিলে তোমার বৌ একশ কেজি ওজনের গ্র্যাজুয়েট করা কোনো ছেলের জন্ম দিয়েছে ?
রায়হান হেসে ফেলল ।
-এই ব্যাটা তুই ও কি তোর আম্মুর মত বদরাগী হবি নাকিরে ?
আর কি আশ্চর্য জবাবে এঝে এঝে বোলে বিচিত্র শব্দ করে উঠল মানুষটা । রায়হান অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ।
-আইরিন আনবিলিভেবল এইটা আমার ছেলে ! আমি এটার বাবা বিশ্বাসই করতে পারছিনা !
-কি পাগল !
আইরিন হাসে “কোলে নিবা ?”
-কোলে ? নেব !
রায়হান মাথা চুলকায় , ইয়ে মানে যদি পড়ে যায় ?
-পড়বেনা ।
আইরিন হাসি চেপে রেখেছে । রায়হান মহাচিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবছে কোন এঙ্গেলে কোলে নিলে ছোটখাট মানুষটা ওর কোল থেকে গড়িয়ে পড়ে যাবেনা ।
আইরিন সাবধানে ছেলেকে ওর বাবার কোলে তুলে দিল ।
রায়হান টের পায় ভেতরে অন্যরকম একটা অনুভূতির জন্ম হচ্ছে । ছেলেটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে । সারাজীবন বুকের ভেতরে আগলে রাখার আকুলতায় ভেতরটা ছটফট করছে ।
আরো একটা কিসের তৃষ্ণা যেন জেগে উঠছে ভেতরে। কিসের রায়হান ঠিক বুঝতে পারছেনা ।

আরিফ সাহেব মন খারাপ করে ছাদে উঠে এসেছেন । কবুতরগুলোকে খাওয়াচ্ছেন । মন খারাপ হলেই স্ত্রীর কথা মনে পড়ে ওনার । সেসময় মন খারাপ হলে হানিফা কাছে এসে আবোল তাবোল বকত । মন ভাল করে দেয়ার চেষ্টা চালাত হাস্যকরভাবে। ব্যথায় টনটন করছে ভেতরটা । কি হতো ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলে । একদিনইতো । এতো বাধো বাধো ঠেকে কেনো ছেলের সামনে !

পিছনে কে যেন এসে দাড়িয়েছে । আরিফ সাহেব ঝাপসা চোখে পেছন ফিরলেন । আর রায়হান সাথে সাথে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
আরিফ সাহেব থতমত খেয়ে গেছেন । তারপর টের পেলেন চোখের পানিতে তার শার্ট ভিজে যাচ্ছে । বোকা ছেলেটা কাঁদছে । কাঁদুক ! আহারে খোকা । ছেলেটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করতে লাগলো আরিফ সাহেবের ।
কবুতরের দল ঝাঁক বেঁধে উড়ে গেল ।
অদ্ভুত নীল আকাশটায় মেঘের সাথে মিলে মিশে একাকার ওরা ।
আর সেই নীল আকাশটার ঠিক নিচে পুরনো বিল্ডিংটার ছাদে একটা গল্পের সমাপ্তি হচ্ছে ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত