শীতের দিনে অন্ধকারটা এতো দ্রুত নামে,,,,মাঝে মাঝে খুব অবিশ্বাস্য লাগে,,, পুরোটা দিনের সময়গুলো কোন ফাঁকে যে উড়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না,,,।।
,
মগভর্তি লাল চা নিয়ে শোবার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি,,, যদিও বারান্দায় দাঁড়িয়ে এখন আর আগের মতোন আনন্দ পাই না,,, সেই ছোটবেলায় এখানে দাঁড়ালেই বিশাল একটা আকাশ দেখতে পেতাম,,, আর এখন পাশের বাসার লাল দালানটাই শুধু দেখি,,,কী অদ্ভুত পরিবর্তন !!!
অবশ্য এতোক্ষণে সন্ধ্যার আবছায়াটা পুরোপুরি অন্ধকারে রূপ নিয়েছে,,, যে
কারণে বারান্দা দিয়ে কিছুই দেখার নেই,, আমি মগে চুমুক দিচ্ছিলাম,,,এ সময় দিনা এসে সামনে দাঁড়ায়,,, বলে…….
.
–‘আপু, তোমার জন্য শাকিব খান অপেক্ষা করছে।’
.
আমি চোখ বড় করে তাকাই,,,,,
.
–কে !!! (‘শাকিব খান- বাংলা সিনেমার অবশ্যিক হিরো।
যাঁকে ছাড়া এখন কোনো সিনেমাই হিট হয় না।’)
,
এবার আর দিনার কথায় পাত্তা দিলাম না। মুখে ভেঙ্গচি কেটে বললাম,,,,,,,,
.
— ফাজলামো রাখ। কি বলতে চাস, বল।’
.
দিনা এবার টেলিভিশনে খবর পড়ার মতোন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে,,,,,,
.
–বলিতে চাহিয়াছি- তোমার স্বপন এবং কল্পনার নায়ক জনাব শাকিব খান ওরফে রোশান রায়হান, এই মুহূর্তে তিনি ছাদে তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন।’
.
চায়ে চুমুক না দিয়ে চোখ পিটপিট করে ওর দিকে তাকাই,,,,,
.
–মানে কি?’
.
–আহ! আপু! ঢং কোরো না তো! তলে তলে কতো জল খেয়েছো,,,
পরে শুনবো। মানুষটা তোমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করতেছে,
যাও।’
..
আমি অবাক হয়ে যাই,,, হ্যাঁ,
রোশানের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখন কিছুটা আন্তরিক ধরে নেয়া যেতে পারে,,, প্রায় আমাদের দেখা হয়,,,কথা হয়,,, দু-চারবার বাসায়ও এসেছিলো,,,,
কিন্তু এসবের মানে তো এই নয় যে,, আমরা একে অপরের প্রতি
দুর্বল হয়ে যাচ্ছি,,,আবার এ রকম একটা সময়ে সে ছাদে ডাকবে…..
দিনার দিকে তাকিয়ে দ্বিধা নিয়ে বললাম,,,,,
.
–‘যাবো?’
..
এক মুহূর্তেই ছোট বোনটা যেনো মুরুব্বি হয়ে গেছে!! চোখ-মুখ কঠোর করে শাসনের সুরে বললো,,,,,
.
–যাবা না কেনো?
একটা মানুষ ডেকেছেন- তাঁর ডাকে সাড়া না দেবার মতোন,
এমন কোনো কারণ তো তোমার নেই।
..
..
আমি অনুচ্ছ স্বরে বললাম,,,,,
.
–ওকেই বাসায় ডাকি?’
..
দিনা নিজের কাঁধ দুটো ঝুলিয়ে দেয়,,,,
.
–ধ্যাৎ! আপু,,তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে,
তুমি ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানো না,,,কিন্তু রোশান ভাইয়ার সঙ্গে তলে তলে তোমার কতোদূর এগিয়েছে,,
ঠিকই তো বুঝতে পারতেছি।
এখন আর আমার সামনে ওসব
লুকোতে হবে না। যাও, যাও!
.
–একটা চড় খাবি! (বলে দিনার কান টেনে ধরলাম।) ‘ওর সঙ্গে আমার কিছুই হয়নি। যাকে-তাকে দেখে তোর প্রেমে পড়ার স্বভাব থাকতে পারে,,
আমার নেই!’
,,
,,
ছাদের যে কোণে বাতি জ্বলছে, তার থেকে অনেকটা সরে দাঁড়িয়ে আছে রোশান।
মানুষটা এদিকে পিঠ দিয়ে,,
অনেক দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। আমি তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন,,,,,,,,
.
–‘তিনা,,, আপনি কি কখনো অন্ধকার দেখেছেন?’
.
তার এমন কথায় হেসে ফেললাম,,,
.
–এটা কেমন প্রশ্ন হলো ??? ওই যে আলো,, তার বিপরীতে যেদিকে তাকাই, সবখানেই তো ঘোর অমানিশা।’
.
–হুম… জানি,,, আমার প্রশ্নটা ছিলো বোকার মতোন। তবু করেছি,,, কারণ- আমি আসলে
জানতে চাইছি, অন্ধকারের ভেতরও যে এক ধরনের আলো আছে,,,এটা কি আপনি দেখেছেন? স্বাভাবিক অন্ধকার আমরা সবাই দেখি,,,
এর ভেতরও যে একটা আলো থাকে,,, সেটা কিন্তু অনেকেই জানে না।’
,,,
রোশান এমনভাবে ঘুরে দাঁড়ালো,
আলোর খুব কম অংশই তাঁর মুখে পড়েছে,,,, আমি সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম,,,,,,
.
–আপনার এসব রহস্য কথা আমার মাথায় ঢুকছে না।
কি জন্য ডেকেছেন, বরং তাই বলুন।’
,,
আমার কথায় মানুষটা এমন করে হেসে ওঠে,,,অবাক হয়ে যাই।
একটু পর হাসি থামিয়ে বলেন,,,,,,
.
–‘আসল কথা তাহলে বলেই ফেলি- ছাদে এসে দেখি দিনা ফোনে কথা বলতেছে। বেচারি আমাকে দেখেই বলে,,,,
..
–“ভাইয়া,
আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে ইচ্ছে করতেছে।”
..
ওর কথা শুনে ভাবনায় পড়ে গেলাম;
বললাম,,,
.
–“দাও!” এরপর দেখলাম,
কিছু না বলেই সে নিচে চলে গেছে।’
,,
রোশান থামতেই বলি,,,,,
.
–‘তারপর?’
.
–তারপর আর কিছু না-এই যে,
আপনি এলেন।’
,,
আমি বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেয়ার পর, এরপর সেটা ফেলতে ভুলে যাই! অনেকক্ষণ দম আটকে থাকার পর দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে বললাম,,,,,,
.
–‘তারমানে,,এই যে আমি
এখানে দাঁড়িয়ে আছি- আপনার জন্য এটাই দিনার সারপ্রাইজ?’
..
খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে রোশান ওপর-নিচ মাথা নাড়ে,,,,,
.
–‘তাই তো দেখতে পাচ্ছি !! …সত্যি বলছি,
আমার জীবনের এটা একটা সেরা চমক।’
,,
নিজের ভেতর কেমন বিব্রত বোধ হচ্ছে। তবু শুকনো মুখে রোশানকে একটা হাসি উপহার দিই,,,,আর মনে মনে দিনার চোদ্দোগুষ্ঠি উদ্ধার করতে থাকি !! বদমাশটা এ রকম একটা নাটক কেনো করলো?
মানুষটা আমার মনের অনুভূতি টের পেয়ে গেলো কিনা, কে জানে! বললো,,,,,,,,
.
–স্যরি! আসলে…
ইয়ে মানে… আপনি যদি পুরো ব্যাপারটায় কিছু মনে করে থাকেন, দিনার হয়ে আমিই স্যরি বলতেছি। ও তো ছোট,
বিষয়টাকে ওর দুষ্টুমি ধরে আমাদের দুজনকেই ক্ষমা করে দেন।’
..
প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম,,,,
.
–‘সবই ঠিক আছে। দিনা তো বলে যায়নি, নিচে গিয়ে সে আমাকেই পাঠাচ্ছে। তাহলে,
পেছনে না তাকিয়েও আপনি বুঝলেন কী করে, আমিই এসে দাঁড়িয়েছি।’
..
রোশান হাসে,,,
.
— ‘খুব সোজা। বলতে পারেন, এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার! দিনার সারপ্রাইজের কথা শুনে,
আপনি ছাড়া আমার মাথায় আর কিছুই আসেনি।
.
–তার মানে…..(বলতে বলতে দিনার ওপর রাগ হয়। মানুষটার ওপরও রাগ করতে ইচ্ছে করছে)…… ‘তার মানে, মনে মনে আমাকেই প্রত্যাশা করেছিলেন?’
.
–আপনি আবার কী মনে করেন…
তবু সত্যিটা স্বীকার করতে হচ্ছে- হ্যাঁ,,,আপনি ছাড়া আমার কল্পনার ত্রিসীমানায় আর কিছু তো ছিলো না!’
..
..
মানুষটার ওপর এবার আরো বেশি খুব রাগ করতে ইচ্ছে হলো,,,কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার- অনেক চেষ্টা করেও নিজের ভেতর রাগের কোনো অনুভূতি টের পাচ্ছি না!!!!এর অর্থ কি???
.
রোশান যা মনে মনে চাইছে, তা আমার অবচেতন মনও চায়??? হায় খোদা!!
মানুষটা আমার একেবারে সামনে চলে আসে,,, বলে,,,,,,
.
–‘তিনা, কেনো জানি না- আজ আমার খুব সাহসী হয়ে যেতে ইচ্ছে করতেছে।’ ((এটুকুন বলেই মাথার ওপর তাকায়))আবার বলে,,,, ‘এ রাতের আকাশটা দেখুন- চাঁদ নেই,,, এমন কি একটা নক্ষত্রও নেই। চাঁদের হিসাব জানি না,
আজ অমাবশ্যা কি?’
আবার চুপ হয়ে যায় মানুষটা।
বেশ কয়েকটা মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে থেকে আমার চোখের গভীরতা মাপে। বলে,,,,,
,
–‘কিছু অন্ধকার ঘোর অমানিশায় ঢাকা পড়ে থাকে। আবার কিছু অন্ধকারে জীবনের আলো খুঁজে পাওয়া যায়। তিনা,,,
আপনি কি আমার সেই আলো হবেন?’
..
..
রোশানের মতোন, আমিও মাথার ওপরে তাকিয়ে অন্ধকারে আকাশ খুঁজি,,, আলো খুঁজি,,,কিছু দেখতে না পেয়ে চোখের পাতাগুলো এক করে ফেলি,,,
মনের চোখে সে আলোটা দেখতে পাবার আশায় বলি,,,,,,,,
..
–আপনি তো এখনো সাহসী হতে পারলেন না- কেউ যখন কাউকে তার আলো হবার প্রস্তাব দেয়,,
তখন তাকে তুমি করে বলতে হয়!’
,,
রোশান আরো কাছে আসে,,ওর নিঃশ্বাসের শব্দটাও এখন শুনতে পাচ্ছি,,, কিছু বললো না,,
শুধু আমার হাত দুটো টেনে নিয়ে নিজের মুঠোয় রাখে,,,
আমি তখনো চোখ মেলি না,,,
আবেগীয় অনুভূতিগুলো চারপাশে তুলোর মতোন উড়ছে যেনো,,,, চোখ বুজে থেকে আমি
তা ছুয়ে দিতে যাই,,,আর কিছুটা অনুচ্ছ শব্দে, ফিসফাস করে অজানাকে বলি- ওগো
অন্ধকার, তুমি আমাকে আলো দিলে,,,,,,,,,।।
,,
……………………………………….সমাপ্ত………………………………………
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা