ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিক। বাংলাদেশের আবহাওয়া এসময় অনেক নিচে চলে আসে। অনেক সময় কুয়াশার জন্য দিনের বেলা সূর্যের মুখ পর্যন্ত দেখা যায় না।
আজকে ঠিক তেমনই একটা দিন । প্রচন্ড ঠান্ডায় হাত পা বরফ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। রাতের বেলা খেয়ে ঘুমাইতে গেছি।
.
মাঝ রাতে ফোনের রিংটনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুমের ঘোরে ফোনটা রিসিভ করলাম
–হ্যালো……….
–কিরে কি করিস, ঘুমাতেছিস ?
.
ফয়িন্নি রাত তিনটার সময় ফোন করে জিজ্ঞেস করতেছে ঘুমাই কিনা…! এরকম শীতের মাঝ রাতে ফোন করলে কার না মেজাজ খারাপ হয় আপনারাই বলেন ? অনেকটা রাগত কন্ঠে বললাম
.
-না ঘুমাইনা। আমিতোরোতের বেলা ঘুমাইনা। রাতের বেলা খোলা আকাশের নিচে হেটে বেড়াই আর মনের সুখে বিড়ি খাই ।তুই ও আয় দুজনে এক সাথে হাটবো আর সিগারেট ফুকাবো।
-বাহ তুইতো ভীষণ মিষ্টি করে বকা দিতে পারিস। হিহিহি ঘুমিয়ে যা অনেক রাত হয়ছে।
.
আল্লাহ্ কারে বলবো এই দুঃখ-কষ্টের কথা। এই ঠান্ডার মধ্যে রাত তিনটার সময় ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলছে ঘুমিয়ে যা। এমন জ্বল-জ্যান্ত একটা শয়তান কারো
খালাতো বোন হলে তার জীবন ত্যাজপাতা হতে বেশিক্ষন সময় লাগবেনা ! এই শয়তান ডয়নি মেয়েটার নাম মৌ । আমার বড় খালার মেয়ে। আমার থেকে এক বছরের
ছোট । আর ছোট হলেই বা কি হবে ? আমার এক ক্লাস সিনিয়র । ছোট বেলা থেকেই মাইর-পিট করে বড় হইছি দুইজন । আমি ওরে একটা মারলে ও দ্বিগুন মারে
আমারে । যেন টম জেরির বাস্তব চরিত্র। একবার মৌ আমাকে চর মেরে অজ্ঞান করেও দিয়েছিল ! অথচ একটা দিনও ভাল থাকিনা মৌ কে ছাড়া । জীবনে যেদিন থেকে
বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকেই ওরে অন্ধের মত ভালবাসি । মনে হয় যেন ওকে দিয়েই আমার জীবনে পথ শুরু। যত স্বপ্ন,ভাবনা,আবেগ আর প্রতিটা নিশ্বাসের একেকটা
বিন্দু মুহূর্ত সবটাতেই যেন মৌ মিশে থাকে । প্রতি ভ্যালেন্টাইন ডে’তে ঘুরতে যাই দুইজন মিলে। এবারও যাব,তবে অন্য রকম সাজে। এত দিন মনে পুষে রাখা কথাগুলা
বলে দিব মৌকে। বলে দিব কতটা ভালবাসি । সারাদিন কত হাজারও কথা বলি কিন্তু অথচ এই ছোট্ট একটা কথাই বলতে পারি না । গত একমাস ধরে প্রাকটিস করছি
কীভাবে এই একটা কথা বলবো । আমি জানি যে ভাবেই বলিনা কেন মৌ আমাকে ফিরিয়ে দিবে না । আবার দিতেও পারে হয়তো । ভালোবাসা বিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়
আবার বাস্তবতা তা এক নিমিষেই ভেঙ্গে দেয় । সেই মুহূর্তটা মনে হয় আর খুব দূরে নয় । ভালবাসা দিবসে মৌয়ের সাথে ঘুরতে অনেক পরিকল্পনা করে রাখছি ।
অনেক আগ্রহ নিয়ে রাতের বেলায় মৌ ফোন দিলাম । নাম্বারটা ওয়েটিং । বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠল। আমি কোন দিনই মৌএর ফোন ওয়েটিংয়ে পাইনি।
একটু ভয় ভয় লাগলো ব্যাপারটা । পাত্তা দিলাম না ভয়টার, মৌএর ফ্রেন্ডের অভাব নাই । অনেক ভাল ছাত্রী। আর ভাল ছাত্রীদের সাথে সবাই বন্ধুত্ব করতে চায়। কোন ফ্রেন্ডের সাথে হয়ত কথা বলতেছে । তাই ভয়টাকে উড়িয়ে দিলাম ।
.
প্রায় এক ঘন্টা ঘণ্টা হয়ে গেছে কিন্ত মৌ এখনো ফোনে কথা বলতেছে । এর কিছুটা সময় অপেক্ষা করে
আবার ফোন দিলাম । এবারও ওয়েটিং । ভয়টাকে এবার আর লুকোতেপারলাম না । রাগ করে আর সে রাতে মৌ কে আর ফোন দেইনি । সারা রাত নির্ঘুম কাটালাম ওর ফোনের অপেক্ষায়!
.
আগামী কাল ভালবাসা দিবস । সারা দিন পার হয়ে গেলেও ওর কোন খবর নেই । জীবনে প্রথমবার কষ্টে গা ভিজালাম । সারা দিন পার হয়ে রাত দশটা বাজলেও মৌ-এর সাথে কথা হলো না। । এবার থাকতে না পেরে ফোন দিলাম মৌকে । চার চার বার ফোন দেয়োর পর ধরলো না । পঞ্চমবার ফোন দিলাম ওকে। এবার রিসিভ করলো
–কিরে এত কথা কার সাথে বলিস ? প্রায় সবসময় তোর ফোন ওয়েটিং থাকে ?
–কথা বলতেছিলাম তাই ওয়েটিং ছিল । আসলে তোকে তো বলাই হয়নি বিষয় টা।
–কোন বিষয় ?
–আমি তো প্রেমে পড়েছি । ছেলেটার নাম সুমন । ফেসবুকে পরিচয় হয়ছে । কথা হয় কিছু দিন হল । গত দুদিন আগে ভিডিও কল করেছিলাম । প্রথম দেখাতেই আমাকে আই লাভ ইউ বলেছে । দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম । কালকে দেখা করবো । প্লিজ তুই আমার সাথে যাবি বল ? (অনেক উচ্ছাসিত কন্ঠে)
— আরে আমি কেন ? তুই একাই যাবি ? আমাকে আবার এর মধ্যে টানতেছিস কেন ? (আমি মৌ কে আর মৌ আর একজনকে ভালবাসে । আবার আমাকে ওর সাথে যেতে বলতেছে ওর প্রেমিকের সাথে দেখা করতে অবশ্য কারণটা স্বাভাবিক ওর বেস্ট ফ্রেন্ড আমি)
.
মৌ এর ওই উচ্ছ্বাস হাসি মুখ দেখে নিজের চোখের জ্বল টুকুকে মুহূর্তেই নিঃশব্দে কবর দিলাম। উইশ করলাম মৌ কে আর সারা রাত কেদে কেদে পার করলাম । দিন গুলোও অনেক কষ্টে কাটতেছিল ।
.
আজ ১৪ই ফ্রেব্রুয়ারি । সন্ধ্যা ৭টা । আধো আলো-ছায়া একটা পার্কে মৌ এর সাথে ওর সেইহ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ডের জন্য প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি ! আমার
পছন্দের একটা হাত ঘড়ি মৌ কিনে নিয়ে আসছে ওই ছেলের জন্য । বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছে অনেক । যাকে বছর এর পর বছর ধরে আপন করে পাবার স্বপ্ন বুনে
আসছি আজ ঠিক তাকেই হারানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বসে আছি ! কি আশ্চর্য মানুষ আমি । ভালবাসার মানুষকে এক বিন্দু হাসি উপহার দেয়ার জন্য
চোখে সমুদ্র সমান কান্না নিয়ে অনায়াসে হাসির অভিনয় করে যাচ্ছি আমি । কান্নাটা চেপে রাখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে । আজকের দিনটা নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখছিলাম আমার সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল ।
–মৌ আমাকে উঠতে হবে । তোর ফয়িন্নি মার্কা বয়ফ্রেন্ড মনে হয় আজকে আর আর আসবে না । মনে হয় অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে ইটিশ-পিটিশ করতেছে । তোর কথা মনে হয় ভুলে গেছে । আসবে না ।
–আসবে আসবে । আর ফয়িন্নি বলবি না বলে দিলাম ! সে আমার স্বপ্নের রাজা আমার প্রেম আমার ভালবাসা । ইসস ইচ্ছে করে উম্মমাহ দেই বলেই মৌ একটু হাসল একটু!
.
আবেগটা আবার আড়াল করলাম।
— যা খুশি করিস ও আসলে । আমার কাজ আছে আমি যাচ্ছি !
.
–যাবি যা । ঘড়ি টা তো তাহলে আর তাকে হবে না ।
–কেন ?
–তুই গেলে দিব কাকে ?
–কেন যার জন্য অপেক্ষা করতেছিস তাকে দিবি ?
–আমি আবার কার জন্য অপেক্ষা করবো তুই ছাড়া বল ???
–মানে কি ? মাথা ঠিক আছে তোর ?
–না ঠিক নাই । থাকলে কি আর প্রেমিক কে নিয়ে এক ঘণ্টা বসে আছি কীভাবে ঘড়ি টা পড়িয়ে দিব ?
.
একটা কথাও মাথায় ঢুকতেছে না আমার । মৌ কি আমাকে বলতেছে আর কি বুঝাতে চাচ্ছে ? পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি ? সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে আমার । ও আমার হাত ধরে বেঞ্চ থেকে টেনে তুলে ঘড়িটা পড়িয়ে দিল ।
.
–দেখ তুই আমার সেই বয়ফ্রেন্ড, তোকে বলছিলাম না তোর পছন্দ ছাড়া বিয়ে করবো না ! এখন তাড়াতাড়ি বল আমাকে পছন্দ হয়ছে কিনা ?
.
কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিনা।
স্বপ্নের মত লাগছে মৌ এর কথাগুলা।
.
ওর চোখের দিকে তাকাতেই চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝড়তে লাগলো।
–কিরে গাধা কাঁদছিস কেন তুই ? পছন্দ হয় নাই আমাকে ?
–না হয় নাই । অনেক খারাপ মেয়ে তুই । গত কদিনে আমাকে শুধু কাঁদেইছিস আর কষ্ট দিয়েছিস ! এত নাটক করার কি দরকার ছিল ? আর কথাই বলবো না তোর সাথে।
–এটাতো পুরনো কথা । নতুন কিছু থাকলে বল।
–ভালোবাসি তোরে অনেক ভালবাসি। এবার হয়ছে ???
.
শরীরের সব টুকু শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম মৌ কে । পার্কের অন্যান্য কাপলরা সবাই তাকিয়ে আছে বলে মেী আমাকে ছাড়তে বলল । আমি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম । বললাম
.
দেখলে দেখুক সবাই । সারা জীবন তোকে এভাবেই শক্ত করে জড়িয়ে থাকবো তোকে । আর কোন দিন হাঁরাতে দিবনা । নিজের করে আগলে রাখব সবসময়।
–সেই সুযোগটা হয়তো আর পাবি না । আর দুই মিনিট তুই আমকে এভাবে ধরে রাখলে নিশ্চিত দম বন্ধ হয়ে মারা যাব । মৌ এর কথায় মুচকি হাসলাম আমি !
.
ভালবাসার এই স্বপ্নিল সুখ গুলো হয়তো একি সাথে হাসায় কাঁদায় । আবার নতুন করে এক আকাশ স্বপ্ন বুনতে শেখায়। আর বলতে শেখায়
.
ভালবাসি ।