ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চে বসে আছি। আজকে আমার প্রথম ক্লাস। নতুন কলেজ , নতুন ক্লাস, নতুন বন্ধু, নতুন শিক্ষক এক কথায় সব নতুন। আপনাদের তো আমার পরিচয় দিতে ভুলেই গেছি, আমি স্বপ্নীল, বাবা মায়ের একমাত্র আদুরে সন্তান। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হয়েছি। বরাবরই আমার পরীক্ষার ফলাফল বেশ ভালো তাই সবার কাছে প্রিয়পাত্র।
যেমন বাবা, মা, পরিবারের সবার কাছে তেমনি স্কুলের শিক্ষকগণ এবং বন্ধুদের কাছেও। মূল কথায় আসা যাক,,, বসে আছি গালে হাত দিয়ে পাশে বসে বন্ধুরা বকবক করছে। তখনই আমার নজর গেলো এক সুন্দরীর দিকে। সে হাসিমুখে ক্লাসে প্রবেশ করলো। দুধে আলতা গাঁয়ের রং তার হরিণের মতো টানা টানা চোখ সহজেই যে কাউকে ঘায়েল করতে পারবে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। দীর্ঘ লম্বা ঘন কালো চুল বেণুনী করা। হালকা গোলাপি রঙের থ্রি পীছে মেয়েটিকে অপ্সরীর মতো লাগছে। আমার চোখ আঁটকে গেছে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে। মেয়েটি গিয়ে ফার্স্ট বেঞ্চের কর্ণারে বসলো। একটু পরে শুরু হলো নবীণ বরণ অনুষ্ঠান। আমি একটু পর পর মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছি। আমার পাশে বসে থাকা নোমান ব্যাপারটি লক্ষ্য করে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,,
– কি রে, এভাবে কি দেখছিস বারবার ঐ দিকে তাকিয়ে?
– কই কিছু না তো,,,
– মিথ্যা বলিস না, আমি লক্ষ্য করেছি তুই বারবার বর্ণের দিকে তাকাচ্ছিস।
– মেয়েটির নাম কি বর্ণ?
– হ্যাঁ, সবার ক্রাশ বলতে পারিস। কিন্তু মেয়েটির অনেক অহংকার, কাউকে পাত্তা দেয় না।
– তাই বুঝি। বাদ দে এসব অনুষ্ঠানে মনোযোগ দে,,,
সেদিন তো নোমানকে কাটিয়ে আসতে পেরেছিলাম কিন্তু বেশিদিন কথাটা চাপিয়ে রাখতে পারলাম না। বিশ্বাস করে কায়েস আর অনন্তর কাছে বলেছিলাম যে, আমি বর্ণকে পছন্দ করি। ওরা কথাটা পাঁচ কান দশ কান করে দিলো আর যার ভয় ছিলো তাই হলো, বর্ন সব জেনে গেলো। একবার বর্ণ এক সিনিয়র ভাইকে সবার সামনে কষে থাপ্পড় মেরেছিলো প্রেমপত্র দেওয়ার জন্য। আমি ভয়ে টানা সাতদিন কলেজে যাইনি। টানা সাতদিন পরে কলেজে গেলাম। মন আমার ধুকপুক ধুকপুক করছে ভয়ে। না জানি বর্ণর সামনে গেলে আমাকে কি করবে! ভয়ে ভয়ে ক্লাসে প্রবেশ করলাম আর তখনই ক্লাসের সবাই আমার নাম ধরে জোরে চিৎকার করা শুরু করে দিলো। ভয়ে আমি ঘেমে একাকার। ভয়ে ভয়ে ফার্স্ট বেঞ্চে বসলাম। নোমান দৌড়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,,
– বন্ধু তোকে বর্ণ এই কয়দিন খুঁজেছে!
– কিন্তু কেনো?
– ও আসলেই বুঝতে পারবি,, রেডি থাক।
কথাটা বলে নোমান চলে গেলো। ক্লাস শুরু হবার পাঁচ মিনিট আগে বর্ণ আসলো। একে একে সব পিরিয়ড শেষ হলো। ছুটির ঘন্টা বাজার দশ মিনিট আগে আমি সব গুছিয়ে নিলাম কারণ ছুটির ঘন্টা পরার সাথে সাথে দৌড় দিবো যাতে বর্ণ আমাকে ধরে কিছু বলতে না পারে। কিন্তু হলো তার উল্টো, ছুটির ঘন্টা পরতেই স্যার বের হওয়ার সাথে সাথে একটি হাত আমার কাঁধ স্পর্শ করলো। আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, বর্ণ দাঁড়িয়ে আছে। বর্ণ রেগেমেগে বললো,,
– আমাকে ভালোবাসো?
– না না নাতো,,
– ভালোবাসো আর সামনে এসে বলার মতো সৎ সাহসটুকু নেই,,, কাপুরুষ কোথাকার!
– আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ,,
– যেদিন সবার সামনে এসে আমাকে প্রোপোজ করতে পারবে সেদিন আমার সামনে এসো আর ঐদিন ক্ষমা পাবে তার আগে না।
বর্ণ এমন কিছু বলবে আমি কেনো কেউ ভাবতে পারেনি। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বর্ণ চলে গেলো। আমি ভাবতেও পারিনি বর্ণ এমন কিছু বলবে? সবাই ড্রামা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো কিন্তু হলো তার উল্টো। অনন্ত আর কায়েস এসে বললো,,
– দোস্ত ভুলেও ওর সামনে গিয়ে প্রোপোজ করতে যাস না মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে।
– হ্যাঁ বন্ধু অনন্ত একদম ঠিক বলেছে।
ওদের কথাটা যেনো আমার মাথায় বারবার ঘুরছে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি আর বর্ণ খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। শুরু হলো আমাদের বন্ধুত্ব। তারপর খুব ভালো বন্ধু সেই থেকে প্রেম। হ্যাঁ আমি ওর কথা রেখেছিলাম, সবার সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গোলাপের তোড়া নিয়ে বলেছিলাম,,,
– হবে কি আমার পথ চলার সঙ্গী?
সেদিন বর্নের চোখ ছলছল করেছিলো। ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে সায় দিয়েছিলো আমার প্রস্তাবে। দেখতে দেখতে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা এবং অনার্স শেষ করলাম। পাগলিটা আমাকো ছাড়া কিছুই বোঝে না। কিন্তু সুখ জিনিসটা যে ক্ষণিকের। ওর বাসা থেকে চাপ শুরু হলো বিয়ের। আমি দিনরাত এক করে দিচ্ছি চাকরির খোঁজে কিন্তু পেলাম না এদিকে বর্ণের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমারও কিচ্ছু করার নেই কারণ ওর বাসায় বললেও কাজ হতো না, কোনো বাবা, মা চায় না তার মেয়েকে কোনো বেকার ছেলের হাতে তুলে দিতে। আমি অনেকটা ডিপ্রেশনে চলো গেলাম। একদিকে প্রিয়তমাকে হারানোর বেদনা অন্যদিকে বেকারত্বের গ্লানি। বর্ণের বিয়ের দিন রাতে আমার বাসার সামনে এসে আমাকে কল করে, আমি দৌড়ে গেলাম ওর কাছে। দুজন দুজনকে ছাড়া এক মূহুর্ত কাটাতে পারিনা তারপর তো সারাজীবন। তাই দুজনে ঠিক করলাম পালিয়ে যাবো। হ্যাঁ, যেই ভাবনা সেই কাজ। পরিবারের নাগালের বাহিরে গিয়ে দুজনে বিয়ে করলাম।
বড়লোক ঘরের সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া মেয়েটা আজকে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করছে। যে কিনা দামি দামি পোশাক, কসমেটিকস ব্যবহারে অভ্যস্থ ছিলো সে আজকে সামান্য কয় টাকার গজ কাপড়ের থ্রি পীছ পড়ছে। আমি টিউশনি করি সেই টাকায় কোনোরকম দিন চলছে একটি জীর্ণ কুটিরে। কিন্তু এতো অভাবের মাঝেও বর্ণের মুখে আমি বিরক্ত বা কষ্টের ছাপ দেখতে পাইনি। একদিন বর্ণ তার সাথে আনা গহনাগুলো আমার হাতে দিয়ে বললো,,
– এই গয়নাগুলো বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে তোমার কোর্স কমপ্লিট করো।
প্রথমে রাজি হইনি কিন্তু ওর জোরাজুরিতে আর নিষেধ করতে পারলাম না। আমি আমার লেখাপড়া চালিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে আমি পিএইচডি শেষ করলাম ব্যাবসায় শিক্ষার ওপর। আজ আমি এ শহরের ধনী ব্যাবসায়ীদের মধ্যে একজন। আমার বর্ণ এক মেয়ের জননী। অর্ণিলা আমাদের একমাত্র মেয়ে। আমাদের পরিবারে সুখ শান্তি কোনোকিছুরই কমতি নেই। এতো ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করে আমার পাশে সবসময় ছায়ার মতো ছিলো বর্ণ। সবসময় উৎসাহ, অণুপ্রেরণা দিয়েছে আমাকে। আমার প্রথম প্রেম সার্থক হয়েছে। ডায়রিটা লেখা শেষ করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বর্ণ এসে আমার কাঁধ মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। আমিও ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,,
– দেখো চাঁদটা কতো সুন্দর,,
– হ্যাঁ অনেক সুন্দর,,
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা