পাঁচ মিনিটের অডিও ক্লিপটি অন করতে ভয়ে হাত কাঁপছিল। যেই মানুষটা আর পৃথিবীতে নেই, সে আমার জন্য কি রেকর্ডিং করে রেখেছিল। আমায় কি এমন বলেছে, এই ভাবনায় মনের মাঝে অজানা ভয় কাজ করছিল। তবু মনে সাহস সঞ্চয় করে রেকর্ডিং প্লে করলাম, নাবিলার প্রতিটা কথার টোন শরীরে এসে বিধছিল। মনে হচ্ছিল, আমি এক অন্য জগতে, পৃথিবীর মোহ আর কাজ করছে না, চারপাশ একেবারে নিস্তব্ধ, অথচ আমার চোখ বেয়ে অঝোরে বৃষ্টি নামছে।
আজ ১৬ই জুলাই। একমাস পূর্ণ হল। নাবিলা আর এই পৃথিবীতে নেই। বড্ড দ্রুতই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। কিছু মানুষকে অনেক আগেই চলে যেতে হয়। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে তাকে স্মরণ করার মানুষের সংখ্যাও অপ্রতুল। তার বাবা মা থেকেও নেই। বাবা-মার পূর্ণাঙ্গ সানিধ্য পাই নি। এ পৃথিবীতে সমাজের বৈধ নিয়মের বাইরে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেককিছুই ঘটে। মামার বাড়িতে বেড়ে উঠে। খুব বেশি আদর পাই নি। ভীষণ দুঃখী একটা মেয়ে। দুঃখকে জীবনের অংশ হিসেবে নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে সংগ্রাম করতেছিল। কিছু অর্জনের চেষ্টা করছিল।
হঠাৎ নাবিলার আইডি এক্টিভ দেখে নক করলাম, আপনি কে? নাবিলার আইডি ব্যবহার করছেন? যে মানুষটা পৃথিবীতে নেই তার আইডি চালানো ঠিক হচ্ছে না। রিপ্লাই আসলো, উনি নাবিলার খালামনি। নাবিলা আমার জন্য একটা অডিও ক্লিপ রেখে গিয়েছে, এটা দেবার জন্যই আইডি এক্টিভ করা। আর নাবিলা উনাকে বলে গিয়েছিল, তার মৃত্যুর পর আমাকে রেকর্ডিংটা দিতে। অডিও মেসেজটা দিয়ে আইডিটা ডিএক্টিভ করে দিবেন।
জানুয়ারী, ২০২০
নাবিলার সাথে প্রথম পরিচয়। ফেসবুকে আমার কমেন্ট পড়ে সেখান থেকে ইনবক্স। তারপর শুরু হয় বন্ধুত্ব। প্রতিদিন দুজনে দু’জনার কষ্টের কথাশুনো শেয়ার করতাম। দুজন একে অপরকে সাপোর্ট দিতাম। তবে ওর কষ্টগুলোর কাছে আমার কষ্টগুলো নগন্য। তখন আমি ডিপ্লোমা পাশ করে ডিপ্রেশনে, নামমাত্র জব করি। বিএসসি করবো, বাট বাসায় আর্থিক টানাপোড়ন। এছাড়া পারিবারিক ঝামেলা আর প্রথম প্রেমে দাগা, সব মিলিয়ে একজন কথা শ্রোতা খুঁজতাম, যার সাথে মনের কথাগুলো শেয়ার করা যায়। আর কপালগুনে মিলে যায় পিতা মাতার আদর বঞ্চিত এক অভাগী মেয়ে।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি, নাবিলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। রিপোর্ট আসে, তার একটা কিডনী ড্যামেজ হয়ে গেছে, আরেকটাও সামান্য ইনফেক্টেড। পরবর্তীতে বিকল কিডনী অপারেশন করে কেটে বাদ দিতে হয়। প্রথম রিপোর্টের একটা অংশ নাবিলা জানতে পারে বেশ পরে। তার পরিবার সেই খবরটা লুকোয়। কিন্তু সময় সত্যটা বলে দেয়। মরণঘাতী ফুসফুস ক্যান্সারেও আক্রান্ত ছিল। পরবর্তীতে ডায়াবেটিকসেরও সমস্যা ছিল। তার শরীর যেন সব জটিল রোগের বাসা। ক্রমশ ডাক্তারবাড়ি যাওয়া তার নিত্য রুটিন হয়ে দাঁড়ালো। তার নিদারুণ কষ্টগুলো শোনার ভাগীদার ছিলাম একমাত্র আমি। আমার কাছে সবকিছুই নির্দ্বিধায় শেয়ার করতো। একজন অসুস্থ মানুষের দেহের কষ্টের চাইতে মানসিক কষ্ট কত বেশি, তা আমি তার মুখে শুনতাম। আমার করার কিছুই ছিল না, তবুও মেন্টালি সাপোর্ট দিতাম, এসব কিছুই হবে না। মিথ্যে আশ্বাস দিতাম, তুমি একদিন ঠিক হয়ে যাবে। সে বাস্তবতা বুঝতো। তবুও সে আর দশটা মেয়ের মত
স্বপ্ন দেখতো, সাজানো গোছানো একটা ছোট্ট সংসার হবে। একটা বাবু হবে। আর কত কিছু..! মাঝে মাঝে বলতো, আমি জানি এসব স্বপ্ন কখনই পূর্ন হবে না, বেশ মন খারাপ করত। এত রোগশোকের মাঝে নিজে চেষ্টা করছিল, কিছু একটা করবে, তার বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রী থেকে সাপোর্ট পেত। ছোট একটা দোকান নিয়েছিল, সেখানে কাপড়ের উপর স্বপ্ন বুনতো।অ্যাম্বোডারির কাজ করতো। মেয়েদের কাজ শেখাতো। আট দশজন মেয়ের কর্মসংস্থানও তৈরি করেছিল। বেশ ভালোই চলছিল। ১৪ই ফেব্রুয়ারি, সে তার দোকানে ফুল তুলেছিল। ফুল বিক্রির সম্পূর্ণ লভ্যাংশ দিয়ে পথশিশুদের খাইয়েছিল। তার চিন্তনশৈলী ছিল অন্যরকম। স্বপ্ন দেখতো শিশু নিয়ে কিছু একটা করবে। কিন্তু প্রকৃতি সবার মনোবাঞ্ছা পূরণ করে না। কষ্টে রাঙিয়ে দেয় জীবন।
নাবিলা ইদের আগে বলেছিলে, এই বছরটাই শেষ। হয়ত এটাই তার শেষ ইদ। এসব শুনে আমার রাগ হত, একটা মানুষ কত সহজে মৃত্যুর কথা বলতে পারে?? ভরসা দিতাম, কিচ্ছু হবে না, কিন্তু ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর। চলে যেতে হবে এমনটাই পৃথিবীর নিয়ম। তার অসুস্থতা ক্রমশ বাড়ে, আমাদের মাঝে যোগাযোগটা মন্থর হয়ে যায়। মাঝে তো একমাস একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার আসে, কথা হয় শুধু ফেসবুকে। শেষ একমাস কথা খুবই কম হত। সে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছিলো। আমাদের মাঝে একটু দুরুত্ব তৈরি হয়। দুরত্ব তৈরি পেছনে আমারই দোষ ছিল। সে শুধু মৃত্যুর দিন গুনতো, আর আমি ভাল থাকার পথ খুঁজতাম। ভাল থাকার অভিলাষে একসময় আমিও স্বার্থপরের দুরে সরতে থাকি। সর্বশেষ কথা হয় ৭ জুন। ঐ দিন সে আমার নাম্বার নিয়েছিল। ৯ জুন আইডি ডিএক্টিভ হয়। তারপর আর কোন কথা হয় নি।
২২ই জুন আমার ফোনে মেসেজ আসলো, ১৬ই জুন নাবিলা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নাবিলার মামী আমাকে জানালো, তার ডায়রিতে আমার নাম্বার সেভ ছিল। সেই সময়ের অনুভূতি ব্যাখা করার ভাষা আমার নেই। শুধু চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। এতটা শূন্যতা কাজ করছিল, মনে হচ্ছিল, ফোনের ওপারে সে এখনও জীবিত আছে। হঠাৎ একদিন মেসেজ করে বলবে, বাঁধন কেমন আছো? ৮ই জুলাই নাবিলার খালামনি রেকর্ডিংটা দেন। নাবিলার সাথে কখনও দেখা হয় নি, অনেক দুরের শহরে থাকতো। কিন্তু একটা সম্পর্কে তৈরি করে দিয়ে চলে দিয়ে চলে গেল। কিছু ভালবাসা, কিছু সম্পর্ক অধরা থেকে যায়। তার রেখে যাওয়া পাঁচ মিনিট কথা বলার অনুভুতি কলমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
ভয়েস ক্লিপঃ বাঁধন, কেমন আছো? বাঁধন, আমার না কয়েকদিন ধরে জ্বর ছিল, কাশি ছিল। সন্দেহবশত করোনা পজেটিভের জন্য টেস্ট করাইতে দিয়েছিলাম। আজকে রিপোর্ট আসছে, রিপোর্টটা এই মুহূর্তে আমার হাতে, আমার করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে। জানো, আজকে সকাল থেকে আমি কোন ঘ্রাণ পাই না, কোনকিছুর অনুভূতি নাই। চোখগুলো কেমন ফুলে ফুলে গেছে। বাঁধন, তোমার সাথে অনেক অন্যায় করছি গো, যদি পারো, মাপ করে দিও। মাপ করতে বলছি এই কারণে, কেন জানি মনে হচ্ছে এইটা আমার শেষ যাত্রা। আর হয়ত কোন কোন দিন দেখা হবে না, কথা হবে না। ভালো থাইকো কেমন। আর শুনো, কখনো সুইসাইডের কথা চিন্তা করবা না। জীবনের শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবা, হার মানবা না। হেরে যায় কাপুরুষেরা। আমি তো জানি, আমার বাঁধন বীরপুরুষ। কখনো হারার চিন্তা করবা না। দেখো না, হয়ত ভালকিছু তোমার কপালে থাকতেও পারে, তোমার তো ভাগ্য উপরওয়ালা ঠিক করে দিছে। সো, উপরওয়ালার উপর একটু ভরসা রাখো, হাল ছেড়ে দিও না।
আমি তোমারে ভালবাসতাম গো, কিন্তু ভালবাসাটা প্রকাশ করতে পারি নাই। এটা আমার ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার জন্য সরি। মাপ করে দিও, আমার এই রেকর্ডিংটা যখন তোমার কাছে যাবে, হয়ত আমি পৃথিবীতে থাকবো না। আর যে আমার রেকর্ডিংটা তোমারে দেবে, সে আমার খালামনি। আমি শেষবেলায় আমার খালামনির কাছে মোবাইলটা দিয়া যাবো, ও তোমারে পৌছায় দিবে, আমার শেষবলা কথাগুলো। নামাজ পইড়ো। আর শুনো, ঐ বাজে পেজগুলোতে আর যাইয়ো না, ঐগুলো শরীর নষ্ট করে ফেলায়, বুঝছো। নিজের খেয়াল রাইখো, ভালো থেকো, সুস্থ থেকো, মন খারাপ করবা না। আমার যদি কিছু হয়ে যায়, কান্নাকাটি করবা না। নিজে কখনো একা ভাববা না, আমি আছি, আমি তোমার আশেপাশে আছি, থাকবো, আমি তোমার মনের মধ্যে আছি। আর কি বলবো? I Am Sorry, Love u, Love u lot.
মৃত্যুর রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে মুঠোফোনে আমার জন্য বিদায় বার্তা জমা করে রেখেছিল। সে হয়ত বুঝতে পেরেছিল, এটাই তার শেষ সময়। জীবনের অদ্ভুত সমীকরণে একে অপরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। তবে বাস্তবতায় সেটা অপ্রকাশিত রয়ে যায়। এখন কেন জানি শূন্যতা কাজ সবসময়। মনে হয়, কেউ একজন অগোচরে আমায় দেখছে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা