অতঃপর ভালোবাসা

অতঃপর ভালোবাসা
হঠাৎ করে এত দিন পর আমার বন্ধু রাফিকে আমার অফিসে দেখে অনেক অবাক হয়ে বললাম,
— কি রে, তুই দেশে আসলি কবে? আর কিছু না জানিয়ে হুট করে আমার অফিসে আসলি যে? রাফি চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
~দেশে এসেছিলাম বিয়ে করতে। কিন্তু তোর বিষয়ে যা শুনলাম এখন বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছি আমি রাফির হাতটা ধরে বললাম,
— দেখ, তুই আমার ছোট বেলার বন্ধু। আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি তুই বিয়ে করিস না। বিয়ের পর তোর জীবনটা সবুজপাতা থেকে তেজপাতা হয়ে যাবে। শান্তিতে মোবাইল টিপতে পারবি না বউ সন্দেহ করবে।কোন কারণে অফিস থেকে বাসায় যেতে দেরি করবি বউ কথা শুনাবে। বৃষ্টির দিন রোমান্টিক আবহাওয়াতে ভালোবেসে বউয়ের একটু কাছে যাবি বউ বলবে, তোমার গায়ে ঘামের গন্ধ দূরে যাও। এমনকি রাতে যদি ঘুমানোর সময় নাক ডাকিস এতেও বউ ঝামেলা করবে। আর বউ যদি আমার বউয়ের মত রাগী হয় তাহলে নাক ডাকার অপরাধে তোকে বালিস চাপা দিয়ে মেরেও ফেলতে পারে আমার কথা শুনে রাফি টেবিলের উপর রাখা গ্লাসের সবটুকু পানি একদমে খেয়ে বললো,
~সর্বনাশ! মেরেও ফেলতে পারে? আমি তখন বললাম,
— মেয়েদের কোন বিশ্বাস নেই ওরা সব পারে। এজন্যই তো বউকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছি। দুই বছর সংসার করে আমার জীবন বিষাদময় হয়ে গিয়েছিলো। এখন জীবনে কোন ঝামেলা নেই। শুধু শান্তি আর শান্তি রাফি আমার কথা শুনে নিরব হয়ে রইলো। আমি তখন বললাম, দুপুরে মনে হয় খেয়ে আসিস নি? চল বাহিরে কোন রেস্টুরেন্টে থেকে খেয়ে আসি রেস্টুরেন্টে ঢুকার সময় খেয়াল করলাম শেষের টেবিলে আমার প্রাক্তন স্ত্রী শ্রাবণী একা বসে আছে। সবুজ শাড়ি খোলা চুল আর নাকে পাথরের সাদা ছোট নাকফুল। নাকফুলটা দেখে মনে হচ্ছে রাতের আকাশ থেকে একটা তারা চুরি করে এনে শ্রাবণী ওর নাকে বসিয়েছে। আমি রাফিকে বললাম, তুই একটু বস। আমি আসছি শ্রাবণীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ও অবাক হয়ে বললো,
– তুমি এইখানে? আমি ওর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম,
— দুপুরে খেতে এসেছি। কিন্তু তুমি এইখানে কেন? শ্রাবণী মাথা নিচু করে বললো,
– ছেলে আমায় দেখতে আসবে । দেখে পছন্দ হলে কালকেই আংটি পরিয়ে দিবে আমি মুচকি হেসে বললাম,
— না জানি কার কপালটা পুড়লো শ্রাবণী কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
– মানে! আমি তখন শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আমি ১০০% নিশ্চিত ছেলে তোমাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলবে। কিন্তু এই পছন্দ করাটাই ছেলের জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল হবে। ছেলে তো জানে না তুমি মাকাল ফল। বাহিরে থেকে দেখতে যতটা সুন্দর ভিতরটা ঠিক ততটাই কুৎসিত শ্রাবণী রাগে লাল হয়ে গিয়ে বললো,
– পিয়াস, তোমার সাথে ঝগড়া করার কোন রুচি আমার নেই। তা বাসার খাবার রেখে রেস্টুরেন্টে খাও কেন? তুমি তো বাহিরের খাবার খেতে পারতে না আমি তখন বললাম,
— আর বলো না। কাজের মেয়েটা ওর বাবার অসুখের কথা বলে সেই যে গ্রামের বাড়ি গেলো আর ফিরে এলো না। তাই বাধ্য হয়েই বাহিরে খেতে হয় আমার কথা শুনে শ্রাবণী ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
– চলে গিয়েছে, না কি চলে যেতে বাধ্য হয়েছে? তোমাকে আমি হারে হারে চিনি। রোমান্টিক আবহাওয়া পেলে তুমি কাজের মেয়েকের বাদ দিবে না। লুচু কোথাকার কথাটা শুনে মেজাজ এত পরিমাণে খারাপ হলো। নিজের রাগটাকে কোন রকম কন্ট্রোল করে বললাম,
— দেখো শ্রাবণী, তোমার সাথে ঝগড়া করার কোন রুচি আমার নেই। তাই আর কিছু বললাম না এমন সময় শ্রাবণীর ফোনে একটা মেসেজ আসলো। শ্রাবণী মেসেজটা পড়ছিলো আর ওর চোখ দিয়ে পানি পরছিলো। আমি ওকে বললাম,
–কোন খারাপ কিছু? শ্রাবণী ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বললো,
– তুমি কি করে বুঝবে একটা ডিভোর্সি মেয়ের জ্বালা কত? এই সমাজ সব সময় ডিভোর্স হওয়ার জন্য মেয়েদেরকে দায়ী করে। পড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন এমনকি নিজের ঘরের মানুষরাও নানা রকম কথা শুনায়। বিয়ের আগে বয়ফ্রেন্ডের সাথে দিনের পর দিন শারীরিক সম্পর্ক করা মেয়েটাকেও সমাজ ভালো চোখে দেখে । কিন্তু একটা মেয়ে বিয়ের পর কোন কারণে ডিভোর্স হয়ে গেলে সেই মেয়েটাকে সমাজ নষ্ট চোখেই দেখে। সবাই তখন সুযোগের অপেক্ষায় থাকে শ্রাবণীর ফোনে আসা মেসেজগুলো পড়লাম। আমি শ্রাবণীকে এই মুহুর্তে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। চুপচাপ রেস্টুরেন্টে থেকে বাহিরে বের হয়ে একমনে সিগারেট টানতে লাগলাম। রাফি যখন আমার কাঁধে হাত রাখলো আমি তখন ওকে বললাম,
— তোকে বলেছিলাম আমি শান্তিতে আছি কিন্তু বিশ্বাস কর আমি শান্তিতে নেই। প্রতিদিন অফিস থেকে বাসার ভিতর ঢুকলে মনে হয় আমি কবরস্থানে ঢুকেছি। বাসার ভিতরের নিরবতায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন আমি জুতা ঠিক জায়গায় রাখি, আলমারি থেকে কাপড় বের করার সময় অন্য কাপড় একদম এলোমেলো করি না, আমার ঘামে ভেজা কাপড় গুলোও সাথে সাথে ধুয়ে দেই, আর এমন কি আমি রাতে ঘুমানোর সময় নাক ডাকি না। ডাক্তারের থেকে ট্রিটমেন্ট নিয়ে ভালো হয়ে গেছি। অথচ এই জিনিসগুলো নিয়েই প্রতিদিন শ্রাবণীর সাথে আমার ঝগড়া হতো। আগে সব সময় মনে হতো কবে আমি এই ঝগড়া থেকে মুক্তি পাবো কিন্তু মুক্তি পাবার পর মনে হলো আমি এই ঝগড়াটাকেই মনের অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছি রাফি তখন হাসতে হাসতে বললো,
~তো, এখন আমি কি করবো? আমি বললাম,
— সারাটা জীবন ঝগড়া করার জন্য হলেও তোর বিয়ে করা উচিত রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকে দেখি শ্রাবণী একটা মধ্যবয়সী লোকের সামনে বসে আছে। আমি শ্রাবণীকে বললাম,
— এই আংকেল টাইপের লোকটাই কি পাত্র? শ্রাবণী রেগে গিয়ে বললো,
– ডিভোর্সি মেয়ের জন্য এতচেয়ে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না? আমি তখন শ্রাবণীর হাতটা ধরে বললাম,
— আমায় মাফ করে দাও। আমি পুরো পৃথিবীর বিনিময়ে হলেও তোমাকে চাই। বিশ্বাস করো আমার আগের সব বদ অভ্যাস গুলো আমি পাল্টে ফেলেছি৷ সব বদ অভ্যাস গুলো মরে গেছে শ্রাবণী তখন বললো,
– সত্যি মরে গেছে? আমি বললাম,
— হ্যাঁ শ্রাবণী তখন আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
– তাহলে তো হবে না। তুমি জানো আমার এখন ঘর আলমারি গোছানো দেখলে রাগ লাগে, জুতা গুলো এক জায়গায় জড়ো থাকতে দেখলে রাগ লাগে, সকালে ঘুম ভেঙে গেলে খারাপ লাগে, তোমার নাক ডাকার শব্দ না শুনলে আমার ঘুম আসে না, এমনকি বৃষ্টির দিনে তোমার ঘামে ভেজা শরীরের ঘ্রাণের জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠে। তোমার এই বদ অভ্যাস গুলোর সাথে থাকতে থাকতে মনের অজান্তেই তোমার বদ অভ্যাস গুলোকে ভালোবেসে ফেলেছি। এখন যদি তুমি অভ্যাস গুলো পাল্টে ফেলো তাহলে তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না। দুঃখিত, আমি তোমার হতে পারবো না এখন বিকাল। পশ্চিমা আকাশে সূর্য হালকা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। শ্রাবণী আর আমি পাশাপাশি হেটে যাচ্ছি আর ওকে বারবার বুঝাবার চেষ্টা করছি আমার ভিতর আগের বদ অভ্যাস গুলো এখনো বেঁচে আছে শুধু কয়েকদিনের জন্য অভ্যাস গুলো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো..
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত