মুখ ভার করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো বৃষ্টি। আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেই ফেললো , ” আমি তোমাকে ভালোবাসি”। ঘটনার
আকস্মিকতায় আমি ততক্ষনে বোকা বনে গেছি। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম কেউ দেখছে নাকি। কোনভাবে বৃষ্টির বাহুবন্ধন ছারিয়ে দৌড়ে পাশের ঘরে আম্মুর কাছে
গেলাম। সেখানে আম্মু আর বৃষ্টির মা গল্প করছিলেন। আমি আম্মুর কোলে যেয়ে কাঁদো কাদোঁ হয়ে বলে দিলাম, “আম্মু বৃষ্টি বলে ও নাকি আমাকে ভালোবাসে। আমাকে
ছারা নাকি বাঁচবে না। আমার এখন কি হবে আম্মু। ও কত পঁচা মেয়ে।” আমি হাউ মাউ করে কেঁদেই ফেললাম। আমার কান্না না থামিয়ে দুই মহিয়সী নারী তখন আমার
কথা শুনে অট্টহাসিতে ব্যাস্ত। আমার বয়স তখন সাত কি আট বছর আর বৃষ্টি পাঁচের আশেপাশে। সেই বয়সে আমি সুকুমার রায় কিংবা তিন গোয়েন্দা পড়ে বিশাল
জ্ঞানী আর বৃষ্টি সারাদিন বাংলা আর হিন্দি সিনেমা দেখে ভীষন রোমান্টিক মেয়ে। আমাকে দেখলেই গান শুরু করতো, ” তুম পাস আয়ে, ইউ মুজকো রায়ে…” বৃষ্টির
আচার আচরন তেমন পছন্দ না করলেও বৃষ্টিকে ছারা আমার কোন উপায় ছিল না। চারদেয়ালের বন্দী জীবনে বৃষ্টিই ছিল আমার খেলার সাথী অথবা বলা যেতে পারে
সবথেকে ভালো বন্ধু। আমি যখন ওকে হারকিউলিসের অভিযানের গল্প শোনাতে চাইতাম ও উল্টা আমাকে হিন্দী মুভির রিভিউ শুনিয়ে দিতো। খুব ভালো নাচতে
পারতো, হাত পা কোমড় দুলিয়ে নেচেও দেখাতো। মাঝে মাঝে গলার ওড়না ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কি একরকমের নাচ দিত যা সেই বয়সে আমার জ্ঞানের বাইরে ছিল। দু
একবার সর্প নাগিনের নাচ দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। আমার সুহৃদয় সম্পন্না আম্মাজান বৃষ্টিকে অতিশয় পছন্দ করতেন। বৃষ্টিকে ঘরে তোলার বেশ ইচ্ছেও
তার মাঝে দেখা যেতো। হয়ত নিজের মেয়ে ছিলনা বিধায় এই দুষ্ট মেয়েটিকে অনেক বেশি আদর করতেন। ছোট বেলা থেকে দেখেছি বৃষ্টি ওদের বাসায় না থেকে
আমাদের বাসাতেই থাকতো বেশি। বৃষ্টির বাবা মাঝে মাঝে রসিকতা করে বলতেন, “এখন থেকেই এই বাড়িতে ঘর সংসার বেঁধে ফেলেছো, যখন একেবারে তোমাকে এই
বাড়িতে পাঠিয়ে দেব তখনতো বাবা মা কে চিনবে না।” এই কথায় বৃষ্টি লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে আমার দিকে তাকিয়ে হাফ ইঞ্চির ঠোট দুই ইঞ্চি করে একটা হাসি
দিতো। ওর সেই হাসির রহস্য উদঘাটনের কোন আভাস আমি তখনো টিনটিন সিরিজে পাইনি। এভাবেই দেখতে দেখতে বেশ কিছু বছর কেটে যায়। আমি তখন দশম
শ্রেনীতে পড়ি আর ও ক্লাস সেভেনে। তখনো আমাকে জ্বালাতন করা থামেনি। ও যখন আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, ওকে দেখতে আমার কেমন যেন
কার্টুন কার্টুন মনে হতো। হাতে পায়ে লম্বা হলেও দুষ্টামি কমেনি ওর। একদিন পরীক্ষার আগে আমি কোচিং এ। ও কখন যে একটা লাভলেটার লিখে আমার টেবিলে রেখে
গেছে আমি জানতামই না। আমার বাবা কখনো আমার খোঁজ খবর না নিলেও সেদিন কি মনে করে আমার ঘরে যেয়ে এই ভয়ংকর মেয়ের লাভলেটার উদ্ধার করে।
আমি যখন বাসায় ফিরলাম দেখি যে দুই ফ্যামিলি একত্র হয়ে বসে আছে। আম্মু আমার দিকে লাভলেটারটা বাড়িয়ে দিলেন। চিঠির শেষে ছোট্ট করে প্যাচের হাতে লেখা,
” ইতি , তোমার ভালোবাসার বৃষ্টি।” আমি এবারও ঘটনার কিছু বুঝতে না পেরে কেঁদেই ফেললাম, একটু পরে দেখি বৃষ্টিও আমার সাথে কান্নাকাটি জুরে দিয়েছে। দুজনকে
কান্না করতে দেখে দুজন বাবা আর দুজন মা কিভাবে এত হাসতে পারে সেটাও আমি এখনো বুঝতে পারি না। এরই মাঝে বছর দুয়েক পেরিয়ে যায়। আমি কলেজে তখন
ভবিষ্যত গড়ায় ব্যাস্ত। নিক্তি আর ক্যালভিন স্কেলের সুক্ষ রিড খাতায় টুকে স্যারকে দেখিয়ে মার্ক বাড়ানো ছারা তখন আর কোন লক্ষ্য স্থির করতে পারছিলাম না। হঠাৎ
করেই একদিন আমার জন্মদিনে বৃষ্টির দেয়া গিফট দেখে ওর কথা মনে পরে গেলো। কিছুদিন থেকে যে ও আমাকে জ্বালাতন করছে না সেটা আমি বুঝতেই পারিনি।
কেন যেন ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে হলো সেদিন। আর সেদিন বিকেলেই আমার জীবনের সব থেকে বড় হৃদকম্প হয়েছিল, রিকটার স্কেলে পরিমাপ করলে যার মাত্রা নয়
ছারিয়ে যাবে। সেদিন বিকেলে ছাদে বসে আমি ভাবছিলাম বৃষ্টির আবার অসুখ করলো নাকি। নইলে যে মেয়ে সারাদিন আমার পাশে ঘুর ঘুর করে সে হঠাৎ করে কোথায়
চলে যাবে? হঠাৎ করেই দেখি কোন একটা মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমি যেদিকটায় তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে তাকিয়ে আছে। পড়নে লাল পারের শাড়ি, ঠোঁটে হালকা
লাল লিপস্টিক, চোখে বেশ করে কাজল দেয়া, চুল ছেরে দেয়াতে মেয়েটাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিলো। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম এইটা বৃষ্টি। আমি পুরাই
আহাম্মক হয়ে গেলাম। এই কয়দিনে বৃষ্টি কত বড় হয়ে গেছে,আবার তার উপরে পুরাই অপ্সরী ছারিয়ে গেছে! আমি কাছে যেয়ে আস্তে করে বললাম,” বৃষ্টি, তোকে আজ
দেখতে খুব সুন্দর লাগছেরে, মনে হচ্ছে আধোনীল আর আধো গোধূলীর আকাশ থেকে কোন রাজকন্যা নেমে এসেছে” ; লজ্জায় টমেটোর মত মুখ করে দৌড়ে পালিয়ে
যায় বৃষ্টি। এরপর আমার ধার