অনিক আজকে ক্লাসে যায়নি। জীবনে এই প্রথম ক্লাস ফাঁকি দিল। তাই তার মন সমান দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে।
ভাল অংশটা অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। বারবার বলছে, “কাজটা করা মোটেই উচিৎ হয়নি। এখনই ক্লাসে ঢুকে যাও। প্রফেসর যদি
দেরীর কারন জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলবে কার পার্কিং স্পট পেতে দেরী হয়েছে।”
অতি সামান্য মিথ্যা বলা হবে, কি আর করার?
আরেক অংশ বলছে, “খুব ভাল করেছিস! পুতুপুতু ভদ্রলোক হয়ে কোন লাভ আছে? মাঝে মাঝে দুয়েকটা ভুল কাজ না করলে
চলবে? একদিন ক্লাস ফাঁকি দিলেই তুই ফেল করে ফেলবি নাকি? এত ফেলটুস ছাত্রতো তুই না। স্টুডেন্ট লাইফটা এঞ্জয় কর ব্যাটা!”
আপাতত সে খারাপ অংশটার কথাই শুনলো। ঘুরে ঘুরে কলেজ ক্যাম্পাস দেখতে লাগলো।
বিশাল ক্যাম্পাস! অ্যামেরিকার সবকিছু এমনিতেই বিশাল! তারমধ্যেও টেক্সাসের সবকিছু আরও বিশাল। এখানে জমির অভাব
নেই, তাই ইচ্ছামতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে সব বিল্ডিং বানানো হয়। আমাদের বসুন্ধরা সিটি বা যমুনা ফিউচার পার্কে যে পরিমান জমি
ব্যবহার করা হয়েছে, তারচেয়ে বেশি জমি এখানকার স্রেফ একটা ওয়ালমার্টের পার্কিং স্পটেই ব্যবহার করা হয়। মূল বিল্ডিংকে না
হয় গণনার বাইরেই রাখলাম। স্কুল কলেজেরও একই দশা। বিশাল বিশাল ক্লাসরুম, বিশাল বিশাল করিডোর। সাধে কি আর
এখানকার মেয়েরা বুকের মধ্যে “Everything is big in Texas” লেখা টিশার্ট পরে ঘুরে? অবশ্য দুষ্টু ছেলেরা এর ভিন্ন অর্থ ভেবে
নেয়।
অনিক সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে অ্যামেরিকা এসেছে। পরিবারের সাথে ইমিগ্র্যান্ট ভিসায়। তাদের বেশ কিছু আত্মীয় টেক্সাসে
থাকেন। নতুন দেশ, তাই পরিচিত মানুষদের পাশে পেলে সুবিধা হবে ভেবে তারা টেক্সাসে এসে উঠেছে। থাকে বিখ্যাত নগরী
ডালাসের পাশের শহর প্লেনোতে।
পড়ালেখা করার জন্য ভর্তি হয়েছে কলিন কাউন্টি কমিউনিটি কলেজে। দুইবছর পর ইউনিভার্সিটিতে ক্রেডি
ট ট্রান্সফার নিয়ে যাবে। সেখানে দুইবছর পড়লেই ব্যাচেলরস ডিগ্রী পাশ করে ফেলবে।
এখানে ইউনিভার্সিটিগুলোতে টিউশন ফীস সাংঘাতিক এক্সপেন্সিভ! প্রতি সেমেস্টারে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার ডলার লেগে
যায়। সেই তুলনায় কমিউনিটি কলেজগুলোয় নামমাত্র টিউশনে পড়া যায়। চার সাবজেক্টে শোধ করতে হয় মাত্র চারশো ডলার।
কাজেই প্রথম দুইবছর কোর কোর্সগুলো কলেজে নিয়ে নিলে অনেক টাকা সাশ্রয় হয়।
“কিরে, একাএকা ঘুরঘুর করছিস যে? ক্লাস নেই?”
অনিক চমকে তাকালো। জিসান ভাইয়া! অনিকের চাচাতো ভাই। সর্বনাশ! ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে কথাটা যদি বাসায় বলে দেয়, তাহলে বাবা মা কেয়ামত নামিয়ে ফেলবেন!
“ইয়ে, মানে, ইয়ে…..এখন ক্লাস নেই। আরও একঘন্টা পরে।”
অনিক দ্রুত ‘বাক্য রচনা করলো।’ মিথ্যা কথা সে একদমই বলতে পারেনা।
“ও আচ্ছা।”
জিসান ভাইয়ের গলা নির্বিকার।
“ভালই হলো, আমারও ক্লাস শুরু হতে দেরী আছে। চল ক্যাফেতে যাওয়া যাক।”
“চলো যাই।”
অনিকের মনে খুব আনন্দ হলো। নিষিদ্ধ কাজে সবসময়েই আনন্দ থাকে। যাক! জিসান ভাইয়া তার কথা বিশ্বাস করেছে। তার
শরীর শিহরিত হচ্ছে। প্রথমে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে, এখন মিথ্যা বলে পারও পেয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, “জগতের সকল আনন্দ পাপে” – কথাটা মিথ্যা নয়!
ইসলামে একেই বলে “শয়তানের ওয়াসওয়াসা।”
“কী খাবি বল?”
“তুমি যা খাবে সেটাই খাব। আমার কোন ধারনা নেই।”
“ফিলি চিজ স্টেক স্যান্ডউইচ খাওয়া যাক। খেয়ে দেখ কেমন। সাথে কার্লি ফ্রাইজ নিচ্ছি। এদের কার্লি ফ্রাইজ বিখ্যাত।”
“সাথে কোক নিবেনা?”
জিসান ভাই ভর্ত্সনা করলেন, “খবরদার! এখানে কোন ফাস্টফুডে গিয়ে ফাউন্টেন ড্রিংকস কেনার বেকুবামি করবিনা। এক গ্লাস
কোক এরা দেড়-দুই ডলার চার্জ করে, আর বাইরে পাঁচ ডলারে চব্বিশ ক্যান কোক পাওয়া যায়। কি পরিমাণ প্রফিট মেক করে বুঝতে পারছিস?”
অনিক মাথা উপর নিচ নাড়ে।
“অ্যাকাউন্টিং-ফাইনেন্স নিয়ে পড়াশোনা করিতো, তাই ‘কস্ট কাটিং’ রক্তে মিশে গেছে। তুই আবার আমাকে কিপ্টে ভেবে বসিস না।”
অনিক বিব্রত হাসি হেসে বলে, “না না, ছিঃ ছিঃ! কিপ্টা ভাববো কেন?”
তারা দুজনে ক্যাফেতে বসে নাস্তা খেতে লাগলো।
জিসান ভাই ঠিকই বলেছিলেন। খাবার আসলেই মজার আছে। বিশেষ করে কার্লি ফ্রাইজ। আলুকে যে এইভাবে স্প্রিংয়ের মতন
প্যাঁচিয়ে কেটে তেলে ভাজা যায়, এই ধারণাই তার ছিল না। কত কিছু যে দেখার আছে এই দেশে!
“তা, নতুন দেশে নতুন ক্লাস করতে কেমন লাগছে?”
“ভালই।”
“প্রফেসরদের সব কথা বুঝতে পারিস?”
“অ্যাকসেন্ট বুঝতে একটু সময় লাগছে।”
“সেটা কোন ব্যপার না। কয়েকদিন ক্লাস করলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন বল, কোন মেয়ের সাথে পরিচয় টরিচয়
হয়েছে? প্রেমের কথা বলছি আর কী। হাহাহা।”
অনিক ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল।
“আরে না, ছিঃ ছিঃ! মেয়েদের সাথে পরিচয় হবে কেন?”
জিসান হাসি থামিয়ে সামনে ঝুকে এসে বেশ সিরিয়াস গলায় বলল, “তাহলে কি তোর ছেলেদের ভাল লাগে? I see. কোন সমস্যা
নাই, আমি টিপিক্যাল বাঙ্গালিদের মত না। I completely understand. ইনফ্যাক্ট আমারই কয়েকজন ‘গে’ বন্ধু আছে, তোর ‘হুকাপ’ করিয়ে দিব।”
অনিক সাথে সাথে জিভ কেটে বলল, “আল্লাহ! ছিঃ ছিঃ ভাইয়া! তুমি ভুল বুঝছো। মানে আমি ‘গে’ না, মানে আমার মেয়েদের
সাথে মিশতে লজ্জা লাগে আর কী। কথা বলতে পারিনা, জিহ্বা জড়িয়ে যায়।”
জিসান ভাই আবারও হাসিমুখে বললেন, “ও আচ্ছা বুঝেছি। টিপিক্যাল বাঙ্গালি ভদ্র ছেলে, তাই তো? সামনা সামনি মেয়েদের
সাথে কথা বলবে না, কিন্তু আড়ালে চোখে এক্সরে মেশিন নিয়ে ঘুরবে! কিন্তু তোমাকে যে ভদ্রতার মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসতে
হবে বাছাধন! এদেশে এসে যদি তুমি কারও সাথে কথা না বলো, সেটাকেই বরং অভদ্রতা বলবে। এদেশের মেয়েরা একদমই
দেশের মেয়েদের মত না। এখানে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মেয়ের সাথে যদি তোর চোখাচোখি হয়, তাহলে দেখবি ও তোর দিকে
তাকিয়ে মুচকি হাসবে। এরমানে কিন্তু এই না যে সে তোর প্রেমে পড়ে গেছে। উল্টো না হাসলে বরং অভদ্রতা ধরা হয়।”
অনিক লজ্জিতভাবে মাথা নাড়ে।
কথা সত্য। কলেজে স্বল্পবসনা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী মেয়েদের ছড়াছড়ি। সে বাঙ্গালি কায়দায় ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে
তাকিয়ে থাকে। এর মাঝে চোখাচোখি হলে মেয়েরা তার দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হাসে। সে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেয়।
দেশের মেয়েরা এই কাজ কখনও করেনা। তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা ছেলেটিকে যদি মনে মনে তারা পছন্দও করে, তবু তার
দিকে এমন একটা দৃষ্টি দিবে যেন খুব বিরক্ত হয়েছে। ওদেরই বা দোষ কী? ওরা হাসলে ছেলেরা নির্ঘাৎ ভেবে বসবে, মেয়েটা তার
সাথে ‘লাইন মারছে।’ এমনিতেই বাঙালি পুরুষের হ্যাংলামো স্বভাব নিয়ে যা একটা বদনাম আছে!
ঠিক এই সময়ে তাদের পাশ দিয়ে হুইল চেয়ারে করে দুইজন ছেলে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়। অনিককে তাদের দিকে
তাকিয়ে থাকতে দেখে জিসান ভাই জিজ্ঞেস করেন, “কি দেখছিস?”
অনিক বলল, “একটা ব্যপার লক্ষ্য করলাম। এখানে অনেক প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী আছে। আমার প্রতিটা ক্লাসেই দুই তিনজন করে আছে। আমাদের দেশের সাধারণ স্কুল কলেজে এতোটা দেখা যায়না।”
জিসান ভাই ভুরু কুঁচকে বললেন, “প্রতিবন্ধীদের সাথে পড়ালেখা করতে কি তোর কোন আপত্তি আছে?”
অনিক সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলে, “না না না, আমার আপত্তি থাকবে কেন? বলছি যে এইদেশে এত প্রতিবন্ধী, অথচ আমাদের দেশে কিন্তু তেমন নেই।”
জিসান ভাই এবারে গলার স্বর পাল্টে বললেন, “অ্যামেরিকার জনসংখ্যার কতভাগ মানুষ প্রতিবন্ধী জানো?”
অনিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে জানেনা।
“শতকরা বারো ভাগের মতন। আমাদের দেশের হিসেব জানো?”
অনিক এইবারও চুপ।
“সঠিক হিসাব আমিও জানিনা, তবে সেটা যে অ্যামেরিকার চেয়ে কম হবেনা, সেটা আমি নিশ্চিত। এখন কথা হচ্ছে, কেন আমরা
সাধারণ স্কুল কলেজে, বা অফিস আদালতে প্রতিবন্ধীদের দেখি না? প্রতিবন্ধী কেবল রাস্তায় দেখা যায়, ভিক্ষা করতে। আর বাকি
যারা ভিক্ষা করেননা, তাঁরা না পারতে ঘর থেকেই বেরোন না। মনে প্রশ্ন জাগে না, কেন?”
অনিক বুঝতে পারছে জিসান ভাই উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন। গলার স্বর ক্রমেই সিরিয়াস হচ্ছে। ‘তুই’ বাদ দিয়ে ‘তুমি তুমি’ করে
বলছেন। সে বুঝতে পারছে না কথার প্রসঙ্গ পাল্টানো উচিৎ হবে কিনা। আর উচিৎ হলেও সেটা কিভাবে?
“আমি যখন দেশে পড়াশোনা করতাম, তখন শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুলে পড়েছি। শহরের সবচেয়ে ভাল কলেজেও আমার পড়ার
সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ্য শিক্ষা জীবনে একটাও প্রতিবন্ধী ছেলে অথবা মেয়েকে ক্লাসমেট হিসেবে পাইনি। ওরা ক্লাস করবে
কিভাবে? ওদের ভর্তিই হতে দেয়া হতো না। আমার মা নিজে ছিলেন এক প্রাইভেট স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। কোন শারীরিক প্রতিবন্ধী
যখন ভর্তি হতে আসতো, তখন অন্যান্য গার্জিয়ানরা তাঁর উপর প্রেশার দিত তাকে ভর্তি না করতে। এতে নাকি তাদের বাচ্চাদের
উপর নেগেটিভ প্রভাব পড়বে। একটি ছেলে হাঁটতে পারেনা বলে হুইল চেয়ার ব্যবহার করছে, এতে নেগেটিভ প্রভাব পড়ার কি
আছে? মাই ফুট!”
জিসান ভাই গলা ভিজাতে বরফ কুচি ভর্তি পানির গ্লাসে চুমুক দিল। অনিক এখনও বুঝতে পারছে না সে কি বলবে। তার নিজের
অভিজ্ঞতাও তেমন। ছোটবেলায় তাদের পাশের বাড়িতে একটি অন্ধ ছেলে থাকতো। প্রতি বিকেলে তাদের একতলার বারান্দায়
বসে কান পেতে বাইরের শিশুদের খেলাধুলার শব্দ শুনতো। আপন মনেই হাসতো। মুখ দিয়ে মাঝে মাঝে লালা গড়িয়ে পরতো।
বোধয় সে মাথায় হালকা সমস্যাও ছিল। তবে অবশ্যই, ভায়োলেন্ট কোন স্বভাব তার মধ্যে কখনও কেউ লক্ষ্য করেনি।
শিশুদের মন সরল হয়ে থাকে। জগতের কোন জটিলতাই তাঁদের মস্তিষ্কে সহজে ঢুকেনা। তাই একদিন অনিকরা দল বেঁধে
ছেলেটির সাথে বন্ধুত্ব করতে গেল। নতুন বন্ধু পেয়ে ছেলেটার যে কী আনন্দ!
কিন্তু রাতে খাবার টেবিলে নতুন বন্ধুর কথা অনিক তাঁর মা বাবাকে বলতেই তাঁরা দুজনই ভীষণ ক্ষেপে গেলেন।
বাবা বলে উঠলেন, “খবরদার! তোমাকে যদি আর কোনদিন ঐ পাগলটার সাথে কথা বলতে দেখি, থাবড়ায়ে দাঁত ফালায় দিব!”
বাবাকে এত কুৎসিতভাবে কথা বলতে সে কখনই শুনেনি।
মার গলা অবশ্য কোমল ছিল, কিন্তু বক্তব্য একই।
“সুন্দর সুন্দর ছেলেদের সাথে মেলামেশা করবে। ভাল ভাল ছাত্রদের সাথে মিশবে। কানা পাগল ছাগল ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব
করলে তুমি পড়ালেখায় ভাল করবে কিভাবে? আর পড়ালেখা ভাল না করলে বড় হয়ে রিকশা চালাতে হবে।”
মার কথাও কেমন অদ্ভূত! “ভাল ছাত্রদের সাথে মিশবে।” কোন ছেলে যদি তার সাথে কথা বলতে আসে, সে কি হাই হ্যালোর
আগে ছেলের রিপোর্ট কার্ড দেখতে চাইবে? এভাবে বন্ধুত্ব হবে? হওয়া সম্ভব?
আরেকদিন বলেছিলেন, “তুমি আজেবাজে ছেলেদের সাথে মেলামেশা কর কেন? জুনায়েদের সাথে মিশতে পারো না?”
অনিকের তখন পাড়ার খেলার সঙ্গীদের বেশির ভাগেরই বাবা হয় দোকানদার, নাহয় ছোটখাট চাকরি করেন। মায়ের ভাষায় তাঁরা
আজেবাজে ছেলে।
এদিকে জুনায়েদ তার সহপাঠি, বেশ ভাল ছাত্র এবং তারচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো তার বাবা ছিলেন শহরের পুলিশ কমিশনার।
এবং যে কারনে অহংকারে মাটিতে তার পা পরতো না। কেউ যদি আগ বাড়িয়ে তার সাথে কথা বলতে যেত সে এমনভাবে জবাব
দিত যে ইচ্ছা করতো পা থেকে স্যান্ডেলটা খুলে গালে ছাপ বসিয়ে দিতে। অথচ মায়ের কথানুযায়ী, ভাল ছেলে তারাই যাদের বাবা
বড় বড় চাকরি করেন!
যাই হোক, পরদিন বিকেলে অন্ধ ছেলেটা ‘নতুন বন্ধুদের’ সাড়াশব্দ পেয়ে তাদের নাম ধরে ডাকছিল। কিন্তু কেউই এগিয়ে যায়
নি। সবাই অনিকের মতই বাড়িতে বকা খেয়েছিল।
এরপরও সেই ছেলেটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের খেলাধুলার শব্দ শুনে আপনমনে হাসতো। যতদিন তারা সেই বাড়িতে ভাড়াটে
ছিল, ততদিন এই ঘটনা ঘটতো।
“ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়েছে প্রতিবন্ধীদের প্রতি “করুণা” করতে। ভালবাসতে শেখানো হয়নি। ওদের করুণা
করতে হবে কেন? সঠিক এক্সেস পেলে আমাদের ছাড়িয়ে যাবার ক্ষমতা তারা রাখে, এটা কি কেউ জানেনা? আসল প্রতিবন্ধী
আমাদের দেশের সমাজ। বুঝলি?”
যাক, জিসান ভাইর উত্তেজনা কমতে শুরু করেছে। তিনি আবার ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’তে নেমে এসেছেন। শুভ লক্ষণ!
“দেশের বেশিরভাগ স্কুল কলেজে তুই দেখবি সিঁড়ির পাশাপাশি কোন ‘Ramp’ নেই। এলিভেটর থাকাতো দূর কল্পনা। যে হুইল
চেয়ার ছাড়া চলতে পারেনা, সে ওসব বিল্ডিংয়ের উপরতলায় উঠবে কি করে? অফিস আদালতেও একই সিস্টেম। এইসব বিল্ডিং
বানাবার সময়ে প্রতিবন্ধীদের সুবিধা অসুবিধার কথা কেউ মাথাতেই রাখেনা। আরে, একটা লোকের চোখ নষ্ট হতে পারে, সে
হয়তো হাঁটতে পারে না, হয়তো কথা বলতে গেলে মুখ দিয়ে শব্দ বেরোয় না, কিন্তু তাই বলে তাঁর ব্রেইনতো মরে যায়নি। সে কেন
আর সব সাধারণ ছেলেমেয়েদের সাথে একই স্কুলে, একই কলেজে পড়তে পারবে না? আমাদের দেশে কয়জন প্রতিবন্ধী
উচ্চশিক্ষিত হবার সুযোগ পান? অথচ এই দেশে সবার আগে প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রাখা হয়। ডিজেবল পার্কিংয়ে সুস্থ কেউ
কোন অবস্থাতেই গাড়ি পার্ক করতে পারবে না। চাকরির ক্ষেত্রে ডিজেবিলিটি কোন অবস্থাতেই প্রতিবন্ধকতা নয়। সব প্রতিষ্ঠানেই
সিঁড়ির পাশাপাশি ramp’র ব্যবস্থা থাকে। এলিভেটর থাকে। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসে সীট বরাদ্দ থাকে। কিন্তু
ভিড়ের বাসে সেই লোক উঠবেন কী করে সেইটা নিয়ে কেউ ভেবেছে? এখানে বাস ট্রেনেও ওদের ওঠার সুন্দর ব্যবস্থা থাকে। স্যুইচ
টিপলেই ইলেক্ট্রনিক Ramp বেরিয়ে আসে যাতে কারও সাহায্য ছাড়াই হুইল চেয়ার উপরে তোলা যায়। স্টিফেন হকিংয়ের ভাগ্য
ভাল যে তিনি ইংল্যান্ডে জন্মেছেন। আমাদের দেশে জন্মালে উনি কিছুই করতে পারতেন না। কে জানে, বনানী গোরস্থানের বাইরে
কতটা সম্ভাব্য স্টিফেন হকিং “আল্লাহ আল্লাহ” করে ভিক্ষা করে জীবন কাটাচ্ছে!”
জিসান ভাইয়ের দীর্ঘ বক্তৃতায় অনিক হেসে দিল। সে কল্পনার চোখে দেখেও ফেলেছে নিউটন-আইনস্টাইনের পর বিশ্বের সেরা
বিজ্ঞানী হকিং সাহেব মাথায় ছেড়া টুপি পড়ে জিকির করতে করতে ভিক্ষা করছেন।
“হাসছিস কেন? আমি মোটেও জোক করছি না। আমি কিন্তু সিরিয়াস।”
জিসান ভাইয়ের গলায় স্পষ্ট বিরক্তি।
“স্যরি ভাইয়া। তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। এই হাসি সেই কারনে নয়।”
তিনি আবার পুরানো স্বরে ফিরে গেলেন।
“একজন মানুষের একটি অঙ্গহানী ঘটলে যে তার জীবন থেমে যেতে পারেনা, এই উপলব্ধি এদেশের মানুষেরা পায়। আমাদের
দেশের সমাজ উল্টো সেই প্রতিবন্ধীকে চিরদিনের জন্য ‘পঙ্গু’ বানিয়ে দেয়। সে একা একা কিছুই করতে পারবেনা, অন্যের উপর
নির্ভরশীল হতে হবে। বারবার তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া তুমি সমাজের বোঝা! আরে, দেশের মোট জনসংখ্যার বারো তের পার্সেন্ট
মানুষকে তোমরা জোর করে শুইয়ে বসিয়ে রাখছো, দেশ এগুবে কি করে? ওয়েস্টার্ন ইকনোমি যে বিশ্বের সেরা, সেখানে কী
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অবদান নেই? অবশ্যই আছে। এবং সেটা এরা স্বীকারও করে।”
অনিক ভেবে পাচ্ছেনা জিসান ভাই আজ হঠাৎ এমন জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন কেন? প্রতিটা বাক্য যেন তাঁর বুক নিংড়ে
বেরুচ্ছে।
ঠিক তখনই একটি পরমা সুন্দরী মেয়ে এসে পেছন থেকে জিসান ভাইয়ের চোখ চেপে ধরলো। জিসান ভাই হাত ধরে তাকে
সামনে নিয়ে এলেন। তারপর উৎফুল্ল ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন, যার অর্থ “হাই!”
অনিকের বুক মুচড়ে উঠলো। এই দেশের কলেজ পড়ুয়া বেশিরভাগ মেয়েকেই তার অপ্সরা বলে ভ্রম হয়। চেহারায় কোন আলগা
মেকাপ নেই। অতি সাধারন জিন্স এবং টিশার্ট গায়ে জড়ানো। বয়সের যে সৌন্দর্য্য আছে সেটাই ফুটে বেরুয়। এই মেয়েও ব্যতিক্রম নয়। যেন জান্নাতের সাক্ষাৎ হুর!
আহারে! তাকেও যদি কখনও এমন সুন্দরী কেউ কোনদিন এসে চোখ চেপে ধরতো! এই জীবনে বোধয় আর সেটা সম্ভব হবেনা।
টেনেটুনে যদি বেহেস্তে যেতে পারে তাহলে যদি তার ভাগ্যেও কিছু হুর জোটে!
জিসান ভাই বললেন, “পরিচয় করিয়ে দেই, অনিক এ হচ্ছে ডারলা, আমার বান্ধবী।”
তারপর তিনি ডারলাকে ইশারায় কিছু একটা বললেন। ডারলা তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে “হাই” বলল।
শৈশবে এক বর্ষাকালে অনিক তার গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। সেদিন মধ্যদুপুরে আকাশ অন্ধকার করে টিনের চালে ঝমঝম সুরে বৃষ্টি নেমেছিল। মেয়েটির হাসি সেই বৃষ্টির কথা মনে করিয়ে দেয়।
অনিক লজ্জা মাখানো স্বরে বলল, “হ্যালো! তোমার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম।”
এবং যথারীতি শেষের দিকে এসে লজ্জায় তার জিহ্বা জড়িয়ে এলো।
জিসান ভাই সরল গলায় বললেন, “ও কথা বলতে পারে না। শুনতেও পায়না।”
ডারলা কি বুঝলো সেই জানে, সে আবারও হাসলো। অনিকের বুকটা আবার মুচড়ে উঠলো। এবার অবশ্যি ভিন্ন কারনে।
তাহলে এই সেই মেয়ে যাকে নিয়ে তাদের পরিবারে তোলপাড় চলছে।
সেদিন আম্মা, চাচি, ফুপুরা মিলে একটা ‘রুদ্ধদ্বার বৈঠকে’ বসেছিলেন। সে পানি খেতে দরজার পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনেছে
জিসান ভাই নাকি এক শ্বেতাঙ্গিনী পেত্নীর প্রেমে পড়েছেন। মেয়েটা বিদেশিনী, ইহুদি-নাসারা ধর্মী এসবের সাথেও তাঁর আরও একটা বড় খুঁত, সে শারীরিক প্রতিবন্ধী। “বোবা – বয়রা!”
মেয়েটি নাকি জিসান ভাইকে জাদু করেছে। নাহলে কেন কিছুতেই এতএত সব খুঁত তার চোখে পড়ছে না? কেন সেই মেয়ের কাছ থেকে তাকে ছাড়ানো যাচ্ছে না?
অনিক উপলব্ধি করলো এই মেয়ে যদি পেত্নী হয়ে থাকে তাহলে তাঁর জন্য রাক্ষস হতে হাজারটা ছেলে রাজি হবে। এবং অবশ্যই এই মেয়ে জাদু জানে। এই হাসিকে জাদু না বললে আর কি বলা হবে?
তবে এও ঠিক – বাস্তবতা হচ্ছে প্রেমের ক্ষেত্রে কেবল রূপই বিবেচনায় আসে না। পরমা সুন্দরী মেয়েটিকেও অতি সাধারণ দর্শন
কোন ছেলে অনায়াসে দূরে ঠেলে দেয় মেয়েটির পোলিও হয়েছে বলে। অনেক সুন্দরী মেয়ের তোতলামি স্বভাবের কারনে বিয়ে
আটকে থাকতে অনিক নিজেই দেখেছে। চোখে চশমা পরাটাকেই যেখানে অনেকে “অযোগ্যতা” হিসেবে মাপে – সেখানে প্রতিবন্ধী হওয়াতো বিন্দুতে সিন্ধু!
এই যে ডারলা মেয়েটি – যার প্রথম দেখাতেই অনিক প্রেমে পিছলা খেল – সে কী পারবে এমন একটি মেয়েকে বিয়ে করতে? অবশ্যই নয়। স্ত্রীর সাথে দুই চারটা ভাবের কথাই যদি আদান প্রদান না হলো, তাহলে কিসের বিবাহ?
জিসান ভাই কিছুক্ষণ ইশারায় কথা বললেন ডারলার সাথে। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজও একটি ভাষা, এবং বোঝা যাচ্ছে যে জিসান ভাই
সেটা ভালই রপ্ত করেছেন। দিব্যি কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। বোধয় রসিকতা করছেন, ডারলা কিছুতেই হাসি থামাতে পারছে না।
দুইজনের কথোপকথন দেখতে ভালই লাগছে। দুজনকে মানিয়েছেও দারুন। দুজনের চেহারা থেকেই যেন আলো ঠিকরে
বেরুচ্ছে। অনিক আরেকবার ডারলার হাসিতে মুগ্ধ হলো!
হাস্যমুখী মেয়েটিকে দেখেই ব্যাকগ্রাউন্ডে যেন ফিরোজা বেগম গেয়ে উঠলেন, “মোমের পুতুল, মোমের দেশে যায় নেচে যায়…”
জিসান ভাই বললেন, “এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছিস কেন? ভাবি পছন্দ হয় নাই?”
অনিক বলে ফেলল, “অবশ্যই পছন্দ হয়েছে! আমি নিজেই ভাবির প্রেমে পড়ে গেছি!”
জিসান ভাই সেটা হয়তো ডারলাকে ইশারায় বললেন। ডারলাও কিছু একটা বলল, জিসান ভাই হাসতে হাসতে বললেন, “ও বলছে,
বড্ড দেরী করে ফেলেছিস। তার কোন বোন নেই। এখন আরেকটা বোন জন্ম দেয়ার জন্য তার মার বয়স পেরিয়ে গেছে।”
অনিক হো হো করে হেসে দিল। হবু ভাবির রসবোধ তার ভালই লেগেছে। অ্যামেরিকানদের রসবোধের ব্যপারে অনেক কথা সে
শুনেছে, তবে সেটার সাথে তার এখনও সেরকম পরিচয় ঘটেনি। আজই প্রথম ঘটলো।
ডারলা ইশারায় জানালো যে সে এখুনি আসছে।
ও সরে যেতেই জিসান ভাই বললেন, “এই মেয়ের সাথে আমাকে পালিয়ে বিয়ে করতে হবে, বুঝলি। আমার পরিবার কোনদিন
মেনে নিবে না। কারন সে কথা বলতে পারেনা। আরে বাপ, ও কথা বলতে পারলেই বা কী এমন ঘোড়ার আন্ডা ফলে যেত? আমার
মায়ের ইংরেজির দৌড় জানিস না? একটা বাক্য বলতে গেলেই বত্রিশটা দাঁত ভেঙ্গে ফেলেন – ডেন্টিস্ট ডাকতে হয় এমন অবস্থা।
সেইতো বৌয়ের সাথে ইশারাতেই কথা বলতে হতো! আর তাছাড়া ডারলাতো বলছে না যে তোমরা তার মত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা
বলতে পারো না, কাজেই তোমরাও প্রতিবন্ধী! এখন আমি যদি তার সাথে দিব্যি ইশারায় কথা বলতে পারি, সে যদি আমার সাথে কমিউনিকেট করতে পারে, তাহলে বাকিদের প্রবলেমটা কি?”
অনিক নিজের মত পাল্টে বলল, “ঠিকই বলেছ। কিন্তু তাঁর সাথে তোমার কোথায় পরিচয় হয়েছে?”
অনেক যেন চমৎকার একটি স্বপ্নদৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছে এমন কন্ঠে বলল, “ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টিং ক্লাসে। আমার পাশেই
বসেছিল। লেকচারার যা বলছিলেন, সব তার ল্যাপটপে লিখিত আকারে ফুটে উঠছিল। একদম দাড়ি কমা সহ। দারুন
সফটওয়্যার! সেটা দেখেই ইন্টারেস্টেড হয়ে কথা বলতে এগিয়ে যাই। আসলে ওটা ছিল স্রেফ একটা বাহানা। প্রথম দেখাতেই
প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি। তারপর জানলাম সে কথা বলতে পারেনা। ব্যপারটা জেনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম! আহা! কী
মানসিক শক্তি! ওর চেয়ে সুন্দরী মেয়েতো এখানে হাজারে হাজারে পাওয়া যায়, কিন্তু এমন ফাইটিং স্পিরিট কয়টা মেয়ের মধ্যে
দেখা যায়? প্রথম দর্শনেতো প্রেমে পড়েইছিলাম, এইবার একদম আছার খেয়ে কোমরটাও ভেঙ্গে ফেললাম। তার প্রতি রেসপেক্টটা
এত বেড়ে গেল! এরপরের সেমেস্টারেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস নিয়ে নিলাম। তার জন্মদিনে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলে তাকে
চমকে দিলাম। সেদিনই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে তাকে ভালবাসা প্রপোজ করলাম। ও আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। ফেরাবে কিভাবে?
আমি কী ফেলার মতন পাত্র? হাহাহা। তবে সত্যি বলতে, যখন সে আমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করলো, আমার মনে হয়েছিল সুখে
বুঝিবা আমি মরেই যাব! কিসের প্রেমের কবিতা আর কিসের রোমান্টিক গল্প! প্রেম বুঝতে হলে আগে প্রেমে পড়তে হয়।
তুলনাহীন! কোন লেখকের, কোন কবির, কোন অভিনেতার সাধ্য নেই সেটাকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার।”
জিসান ভাই তাহলে এই মেয়ের কারনেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ক্লাস নিয়েছিলেন? অনিক তখন ভেবেছিল স্প্যানিশ না শিখে শুধু
শুধু এই ভাষা শিখে কি লাভটা হবে?
“ও কিন্তু ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী! সিজিপিএ এখনও ফোর! তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে! হাহাহা।”
অনিক হেসে বলল, “সিজিপিএ ফোর! বাবারে! তোমার কত?”
জিসান ভাই কৃত্রিম রাগী গলায় বললেন, “বেকুব ছেলে কোথাকার! খবরদার কোন ছেলের কাছে জীবনেও তার সিজিপিএ জানতে চাবি না। মার খেয়ে বসতে পারিস!”
হাসির মাঝেই ডারলা ফিরে এলো। হাতে সালাডের প্লেট। লাঞ্চে সালাড খাবে। শুধু লতাপাতা খেয়ে কারও পেট ভরে? অ্যামেরিকানরা স্বাস্থ্য সচেতন। ওদের হয়তো ভরে। বাঙ্গালিদের কাছে ভাত ছাড়া অন্য যেকোন কিছুই ‘নাস্তা।’ একবার অনিকের প্লেট ভর্তি ভাত দেখে তাঁর সহপাঠি আঁতকে উঠে বলেছিল, “সর্বনাশ! তুমি দেখি ঘোরার মতই চাল খাও!”
অথচ সাধারন বাঙালি এরচেয়ে বেশি ভাত খায়।
তাঁরা দুজন ইশারায় প্রেম করতে লাগলেন। অনিক বুঝতে পারলো তার উঠে যাবার সময় এসেছে। সে ক্লাসের বাহানায় উঠে এলো।
ডারলা তাকে ইশারায় বলল, “আবার দেখা হবে।”
সেও বলল, “অবশ্যই।”
এটা সত্য ডারলা প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ার মতন একটি মেয়ে। এবং এও সত্য যে যখন কোন সুস্থ্য ছেলে জানতে পারবে মেয়েটি মূক ও বধির, তখনই তার প্রেম উড়ে চলে যাবে। রূপবতী নারীর অভাব এইদেশে অন্তত নেই। জিসান ভাই দেখতেও কম আকর্ষনীয় নন।
অাহ্! একেই বলে প্রেম! বেপরোয়া – যা সমাজ, পরিবার এমনকি নিজেরও মনের বাঁধা ডিঙ্গিয়ে সরাসরি গিয়ে প্রেমিকার হৃদপিন্ড বিদ্ধ করে। কারও সাধ্য নেই একে ঠেকায়।
এ এমন এক প্রেম যা একটি সম্পূর্ণ সুস্থ্য ছেলেকেও ইশারায় কথা বলা শেখায় এবং বাকিটা জীবন সঙ্গিনীর সাথে একজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীর ভূমিকা পালনেও বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহিত করেনা।
অনিক যেন এই প্রথম কাউকে ভালবাসতে দেখলো, কাউকে হৃদয় ছুঁতে দেখলো। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এখানে গৌন। জিসান ভাই এখন এই মেয়েটির সান্নিধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ! এমনই সুখ যে একদম মরেই যেতে ইচ্ছে করে!
অনিকের হঠাৎ বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়ে গেল। সমাজে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করার জন্য তখন বিদ্যাসাগর মশাই জোর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। একটা সময়ে তিনি তাঁর নিজের একমাত্র পুত্রের বিয়েও কিন্তু একজন বিধবার সাথেই দেন।
হাজার বছরের বাঙালিকে বিদ্যাসাগর মশাইরাই ধরে ধরে মানুষ করেছেন।
অনিকের মনে হলো আল্লাহ যুগেযুগে বিদ্যাসাগর মশাইদের ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনেন। এইযুগে হয়তো জিসান ভাইয়ের রূপে ফিরিয়েছেন। এই সমস্ত লোকেদেরই মন থেকে সালাম দিতে ইচ্ছে করে।
অনিক পেছনে ফিরে তাকালো। তারা দুজন গুটুর গুটুর প্রেম করছেন। ভাই রসিকতা করেই চলেছেন, হবু ভাবী হেসেই চলেছেন। হাসির দমকে তাঁর আর সালাড খাওয়া হচ্ছে না।
আহা! কি পবিত্র দৃশ্য!
অনিক মনে মনে বলল, “পুরো পৃথিবীও যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যায়, আমি তোমাদের সাথে থাকব। তোমাদের প্রেমকে সালাম!”