‘তুমি কিন্তু সন্ধ্যাবেলা সুং গার্ডেনে চলে এসো, ঠিক সাতটায়।’ ছেলেটা যখন মেয়েটাকে কথাগুলো বলছিল, ওর গলায় একটা খুশির ছোঁয়া ছিল। মেয়েটা জানে আজ
মাসের এক তারিখ, ও নিশ্চয়ই বেতন পেয়েছে। মাস চারেক হয়েছে ওদের বিয়ে হয়েছে। প্রতি মাসের এক তারিখে ওরা দুজন এই একই রেস্টুরেন্টে চাইনিজ খায়। এটা
এখন একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছে। মোহাম্মদপুরের এক গলির মধ্যে রেস্টুরেন্ট। লোক জন তেমন একটা হয় না। দামও বেশ সস্তা অন্য জায়গার তুলনায়। কিন্তু মেয়েটার
বুকে খচখচ করে। এতো গুলো টাকা। ওদের আর কিছুদিন পরে একটা বাবু হবে। এদিকে ওরা বিদেশে পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করছে। প্লেনের টিকেটেই তো কতোগুলো
টাকা লাগবে। তাছাড়া ইউনিভার্সিটি গুলোতে অ্যাপ্লাই করতেও অনেক টাকা লাগছে।
ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা না করতে পারে না। ও এতো খুশী হয়ে যায় এই এক তারিখে। সারাদিনের কাজের শেষে মেয়েটা যতই ক্লান্ত থাকুক ও ঠিকই
সেজেগুজে যায় রেস্টুরেন্টে। অল্প আলোতে খুনসুটি করে, স্বামীকে আহ্লাদী গলায় বলে ‘আমার খুব পেট ভরা ভরা লাগছে, দুটো আইটেমের বেশি অর্ডার দিও না,
খাওয়া নষ্ট হবে।’ ছেলেটা সবই বুঝে, নিজের উপরে আরও রাগ লাগে ওর।
পোয়াতি বউটাকে খাওয়ানো বলতে সারা মাসে এই একদিনই। ওর না জানি আরও কতো শখ আহ্লাদ হয়। চটপটি, ফুচকা খেতে ও খুব ভালোবাসে। তাই ডাক্তার দেখিয়ে
আসার সময় মনে করে সে অবশ্যই চটপটি ওয়ালার কাছে নিয়ে যায় বউকে। চটপটির গাড়ির হ্যাজাক বাতির আলোয় বউটার মুখ খুশিতে ঝলমল করে। মনে হয় যেন
অমৃত খাচ্ছে। ওর কী যে ভালো লাগে সেই মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। একটুও সাজে নাই, শুধু হাল্কা কাজলের টান, তাতেই কি যে মিষ্টি লাগে। পাগলি বউটা এতো
অল্পেই খুশি, সে আসলেই খুব ভাগ্যবান।
মাসের এক তারিখে সুং গার্ডেন থেকে ফিরে তারা দুজনে গভীর রাত পর্যন্ত হিসাব করে, ব্যাঙ্কে কতো জমল। ভাগ্যিস বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, বাবার একটা মাথা
গুঁজবার ঠাই আছে। কিন্তু তারপরেও দুজনের টাকা পাই পাই করে গুনেও হয় না, এখনো অনেক টাকা লাগবে প্লেনের টিকেটের। বিদেশের কথা বলতে বলতে ছেলেটার
চোখে দূর দেশের স্বপ্নের ছায়া দেখে মেয়েটা। ছেলেটা বড় এক রোখা, কারো কাছে হাত পাতবে না। নিজের স্বপ্নকে নিজেই গড়বে তিল তিল করে।
সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বিশ্রী ঝগড়া হয়ে গেলো দুজনের। প্রেগ্নেন্সির শেষের দিকে এসে মেয়েটার মেজাজ অকারণে খারাপ হয়ে থাকে, এদিকে টাকার চিন্তায়
ছেলেটারও মাথা খারাপ। দুপুরে বার বার ফোন দিয়েও মেয়েটা ধরল না। নিশ্চয়ই পাশের গলিতে খালার বাসায় যেয়ে বসে আছে। কতক্ষণ আর রাগ করে থাকবে? রাগ
কমলে ঠিকই চলে আসবে। বেচারা বউটাকে খামখা বকেছে। এসময়ে মেয়েদের শরীরে কতো সমস্যা, রাতে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারে না। এখন তো ওর নিজেরই
অনেক খারাপ লাগছে। কি ভেবে অফিস ফেরত কৃষি মার্কেটে একটা সস্তা শাড়ির দোকানে নেমে পড়ে ছেলেটা। লাল ডুরে শাড়িটা ওর খুব পছন্দ হবে, আবার সবুজটাও
খুব মিষ্টি লাগছে। অনেক ভেবে লালটাই নিয়ে নিল, টাকার কথা একদম মাথায় আসে নি। শাড়িটা হাতে নিয়ে মনটা খুশি খুশি লাগছে। খালা শাশুড়ির বাড়িতে এসে
বসলো না, ছটফট করছে । অনেক কসরত করে শাড়ির প্যাকেটটা লুকিয়ে রেখেছে। অনেক জোরাজুরিতেও শুধু চা নাস্তা খেয়ে বউকে নিয়ে বিদায় নিল। রিকশায় উঠে
ম্যাজিশিয়ানের মতো শাড়িটা বের করতেই মেয়েটার চোখ ঝলমল করে উঠলো, আর তার পরেই সেই চোখে হাল্কা মেঘের ছায়া ‘ এসময়ে এতোগুলো টাকা খরচ করলে?
তুমি যে কী করো না। কবে আর বুঝবে বল তো।’ ওর খুশি কিন্তু ও লুকাতে পারছে না।
ওদের ডেট ঘনিয়ে এসেছে। যে কোন দিন হাসপাতালে যেতে হবে। এদিকে ছেলেটার একটা আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুখবরও এসেছে। টিকেটের টাকা ওরা
প্রায় জমিয়ে ফেলেছে। এখন খালি অপেক্ষার পালা। দুজনেই একরাশ স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছে।
আজ অফিসে এসে ছেলেটা আরও একটা সুখবর পেলো, একটা বাড়তি বোনাসের সুখবর। টিকেটের টাকাটা হয়ে গেলো। তাদের অনাগত সন্তান তাদের জন্য এই
সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি থেকে খবর পেলো হাসপাতালে যেতে হবে। চলে এসেছে সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। বউটা না জানি কি কষ্ট পাচ্ছে। তাকে খুব তাড়াতাড়ি পৌছাতে হবে, টাকার মায়া না করে সে একটা ক্যাব নিয়ে নেয়।
হাসপাতালে যেয়ে ছেলেটা দেখল অবস্থা সুবিধার না। মেয়েটাকে এখনই অপারেশন টেবিলে নিতে হবে। কিছুই ভাববার সময় নেই। অপারেশন থিয়েটারে যেতে যেতে
তীব্র ব্যাথায় বাঁকা হয়ে যেতে যেতে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মেয়েটা স্বামীর দিকে আকুল হয়ে বলছিল ‘এতো গুলো টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে?’ ছেলেটা মেয়েটার হাত
শক্ত করে ধরেছিল, মৃদু হেসে বলেছিল ‘তুমি একদম ভেবো না। টাকা ঠিকই জোগাড় হয়ে যাবে। ‘
ছেলেটা কথা রেখেছিল, বিদেশে যাওয়ার জন্য জমানো টাকাটা কাজে এসেছিল। নাই বা হোল স্বপ্নের দেশে যাওয়া। আরেকটা স্বপ্ন তার ঘরে আসছে, সেই স্বপ্নটাকে ধীরে
ধীরে বড় করতে হবে মনের মতো।
অপারেশনের এক দিন পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে মেয়েটা, তার পাশে শুয়ে আছে ছোট্ট এক রাজপুত্র। মেয়েটা হাসছে, ওকে দেখাচ্ছে রূপকথার রাজরানীর
মত। ওর হাতে এক জোড়া রুপোর ঝুমকা, সকালর রোদ পড়ে ঝুমকা জোড়া ঝিকমিক করছে। কবে যেন ছেলেটাকে বলেছিল, তার খুব ঝুমকা পছন্দ। হাসপাতালের
বিল চুকিয়ে সোনার ঝুমকা কেনার টাকা আর থাকবে না। হোক না রুপোর, তবুও তো ঝুমকা।