তোমার জন্য

তোমার জন্য

ভোর বেলার দিকে হঠাৎ কিছু একটার শব্দ শুনতে পেলাম। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম শব্দটার উৎস খোঁজার জন্য। বেশ কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর আবিষ্কার করলাম ওটা আমার মোবাইলের আ্যলার্মের শব্দ। নাহ্। খুব বিরক্ত লাগছে শব্দটা। কোনোদিনই ঠিকমত উঠি না। তাও শখের বসে রাতে আ্যলার্ম দিয়ে রাখি। আর এজন্য প্রায় প্রতিদিন সকালে উঠেই ইনসার ঝাড়ি খেতে হয়। ও, আপনাদের বলা হয়নি। ইনসা হলো, আমার বিয়ে করা একমাত্র আদুরে,রাগী বউ। যা হোক,আ্যলার্মটা বন্ধ করা দরকার। উঠতে গিয়েও উঠতে পারলাম না। দেখি বুকের উপর ইনসা আমাকে জাপটে ধরে বিড়াল ছানার মতো ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে ঠিক মত তাকাতেও পারছি না। তাও আবার শীতের সকাল। এর মধ্যে উঠতে ইচ্ছা করে! হাতটা বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে আ্যলার্মটা বন্ধ করলাম। ইনসার গালটা আলতো করে ধরে কপালে একটা চুমু দিলাম। কেমন যেন একটু কেঁপে উঠলো ইনসা। তারপর আবার ঘুমিয়ে গেল। যাক বাবা,বাঁচা গেল। এখন যদি ও কোনোরকমে টের পেত, তাহলে নিজেও উঠতো আর আমাকেও উঠিয়ে ছাড়তো। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় কি সুন্দর লাগছে আমার পরীটাকে! ওকে জড়িয়ে ধরে দুজনে আবার ঘুমপুরীর দেশে হারিয়ে গেলাম। কত পরে জানিনা, চোখ খুললাম ইনসার ডাকে।
-এই, ওঠো। অনেক সকাল হয়ে গেছে।
কম্বলের নিচ থেকে মুখ বের করে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৭:১৮ বাজে।
-মাত্র ৭ টা বাজে তো। আরেকটু ঘুমাই।
-না, প্রতিদিন আ্যলার্ম দিয়ে রাখো। উঠতে তো পারো না। তাহলে এত সকালে আ্যলার্ম দাও কেন?
-এমনি।
বলেই আমার ঘুমিয়ে গেলাম। ইনসার ডাক চলতেই থাকলো। একটু পরে আমার হাত ধরে টানাটানি করা শুরু করে দিলো।
-আহহহহ্, ঠান্ডা! হাত ছাড়ো না বাবু,আরেকটু ঘুমাই। একটু পরেই উঠছি।
-না, এখনিই উঠবা তুমি। ওঠো বলছি।
-আরেকটু ঘুমাই,প্লিজ। আজকে তো শুক্রবার।
-শুক্রবার তো কি? এত সকাল পর্যন্ত কেউ ঘুমায়?
-বেশিক্ষণ না। আর মাত্র ঘন্টা দুয়েক।
-কি!!!!!! আচ্ছা,দাঁড়াও, ঘুম বের করছি তোমার।
এই বলে ইনসা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আমিও এই সুযোগে ভাবলাম আরেকটু ঘুমিয়ে নেই। ঘুমাতে ঘুমাতে খানিকক্ষণ পর মনে হলো কেউ আমার কম্বলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রথমে ভাবলাম হয়ত স্বপ্ন দেখছি। তারপর হাতটা সোজা আমার গেঞ্জির নিচ দিয়ে আমার পেটের উপর এসে পড়লো। মনে হলো যেন ৪০০ ভোল্টের শক খেলাম। এত ঠান্ডা হাত! নাহ্,এটা কোনো স্বপ্ন নয়। ইনসার দুষ্টামি। আমাকে উঠাতে না পেরে নিজের হাত ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে এসে আমার গায়ের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে।
-আআআআআআহহহহহহহহহহ…..!!!!!!
-ওঠো বলছি। না হলে কিন্তু এবার ঠান্ডা পানি সোজা গায়ে ঢেলে দেবো।
-উঠছি উঠছি। হাত সরাও! ঠান্ডা!!!!
তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে প্রায় খাট থেকে এক প্রকার পড়েই গেলাম। এদিকে ইনসা আমাকে দেখে খিল খিল করে হাসছে। কি রকম বউ রে বাবা! একটু শান্তিমতো ঘুমাতেও দেবে না!
-যাও, ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি নাস্তা দিচ্ছি। (ইনসা)
-যাচ্ছি। (আমি)
রাগী মুখ নিয়ে বললাম। কিন্তু ইনসা আমার রাগের কোনো পাত্তা নিয়ে হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। নাহ্, এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না! প্রায়ই এরকম উল্টাপাল্টা কাজ করে বসবে। আবার আমি কিছু বললে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তাই কিছু বলি না। কিন্তু মাঝে মধ্যে ইচ্ছা করেই ওকে রাগাই। ওকে রাগাতে ভাল লাগে না,ওর রাগ ভাঙ্গাতে ভাল লাগে তাই। যা হোক,এবার ফ্রেশ হওয়া দরকার। ওয়াশরুমে চলে গেলাম। বের হয়ে দেখি ইনসা বিছানা গোছাচ্ছে। আমি আর কিছু না বলে ডাইনিং এ চলে আসলাম। এসে দেখি নাস্তা রেডি। কিন্তু ইনসা এখনো আসছে না কেন! ওকে ছাড়া তো খেতে পারি না। যা হোক,খানিকক্ষণ পর মহারাণী আসলেন।
-কি হলো? খাওনি এখনো?
-তুমি না আসলে খাবো কি করে?
-হুমম। বুঝেছি। খাইয়ে দেওয়া লাগবে।
-বুঝেছো যখন দেরি করছো কেনো? ক্ষিদা লেগেছে তো!
-পারবো না, খাইয়ে দিতে। আমার অনেক কাজ পরে আছে। নিজে পারলে খাও, না হলে থাক।
-কি!!! ঠিক আছে। যাও,লাগবে না তোমাকে। আমি নিজেই খাচ্ছি।
আর কিছু না বলে ইনসা চলে গেল। আমি আর কি করবো! নিজে নিজেই খেতে হলো। দুপুরে নামাজ পড়ে এসে খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় পা ছড়িয়ে টিভি দেখতে বসে গেলাম। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ থাকলো না কপালে। ইনসা রুমে ঢুকলো।
-কি ব্যাপার? তুমি শুয়ে শুয়ে টিভা দেখছো কেনো? (ইনসা)
-তো কি করবো? কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো নাকি? (আমি)
-হুমম। ঘুরতে তো যাওয়ার কথা ছিলোই। ভুলো গেছো?
-ও,ঠিক আছে। বিকাল হোক। যাবো তো।
-আরেকটা কাজ করার কথা আছে। যেটা তুমি প্রত্যেক শুক্রবারে করো। আসলে তুমি করো না,আমি জোর করে তোমাকে দিয়ে করিয়ে নেই।
-কি কাজ?
-দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।
এই বলে ইনসা রুম থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার রুমে এসে কোনো কিছু না বলেই আমার কোলের উপর ধপাস করে বসে পড়লো। হাতে একটা নেইলপলিশের কৌটা।
-কি হলো? (আমি)
-ভুলে গেছো? আমি কি বলেছি? প্রত্যেক শুক্রবারে আমাকে নেইলপলিশ পড়িয়ে দিতে হবে।
-আমি ঠিকমতো জগ থেকে গ্লাসে পানিও ঢালতে পারিনা! আর তুমি আমাকে প্রতিদিন নেইলপলিশ পড়িয়ে দিতে বলো!
-প্রতিদিন কোথায় বলি? একদিনই তো।
-নিজে পড়তে কি হয়? আমাকেই পড়িয়ে দেওয়া লাগবে কেনো?
-এমনি। তোমার কোলে বসে নেইলপলিশ পড়তে ভালো লাগে,তাই।
-উফফফফফ!!!!!!!
-এসব বলে কোনো লাভ নেই,বুঝলেন! তাড়াতাড়ি নেইলপলিশ লাগিয়ে দাও।
আমি ইনসার এক হাত ধরে নেইলপলিশ লাগিয়ে দিচ্ছি। আর ও টিভির রিমোট টা নিয়ে চ্যানেল পাল্টাচ্ছে। নেইলপলিশ লাগাতে লাগাতে ইনসার গলায় একটা চুমু দিলাম। ইনসা ধমক দিয়ে বললো,
-এই,দুষ্টামি না করে ঠিকমতো কাজ করো।
-ওকে ম্যাডাম।
-আজকে কোথায় ঘুরতে যাবা?
-দেখি। তোমার পছন্দের কোনো জায়গা আছে?
-না,সেরকম জায়গা তো নেই। চলো না,কোনো নদীর পাড়ে যাই।
-ঠিক আছে,যাবো।
-থ্যাংক ইউ।
এবার ইনসা মুখ ঘুরিয়ে আমার গালে চুমু দিলো।
-এবার কিন্তু তুমি দুষ্টামি শুরু করেছো। (আমি)
-তাতে কি? আমি সব কিছু করবো। কিন্তু তুমি ইচ্ছা করলেও সব কিছু করতে পারবে না।
-তাই?
-হুমম।
বেশ কিছুক্ষণ পর যখন ইনসার হাতে নেইলপলিশ লাগানো শেষ হলো, তখন তাকিয়ে দেখি পাগলিটা আমার বুকে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ইনসা ঘুমিয়ে গেলে ওকে আমি কখনোই ডাকি না। কারণ,ঘুমন্ত অবস্থায় আমার পরীটাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে। ইচ্ছা করে,এক দৃষ্টিতে সারাদিন তাকিয়ে থাকি। টিভিটা বন্ধ করলাম। ওকে কোল থেকে আস্তে করে নামিয়ে খাটের উপর শুইয়ে দিলাম। একটু ঘুমিয়ে নিক। বিকালে ডেকে দেবো। আমি পাশে শুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ওর নিষ্পাপ মুখটাকে দেখছি। মনে হচ্ছে,একরাশ খুশি ওর মুখে ঝলমল করছে। বিছানা থেকে উঠে একটু বারান্দায় আসলাম। বিকেল প্রায় হয়ে এসেছে। এমন সময় কেউ আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। বুঝতে পারলাম এটা কার কাজ।
-আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম, আমাকে ডাক দাও নি কেন? (ইনসা)
-এমনি।
-আচ্ছা,ঠিক আছে। এখন চলো।
-হুমম,চলো। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি রেডি হচ্ছি।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
ইনসাকে নিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরির পর সন্ধ্যার বেশ পরে বাসায় আসলাম। কিন্তু বাসায় আসার পর আমার উপর তো মহারাণীর সেই রাগ। আমার অপরাধ হলো,আমি নাকি ওকে নিয়ে ঘোরার সময় অন্য মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আসলে,”তাকিয়ে ছিলাম” কথাটা সত্যি না। ওকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাশ দিয়ে একটা মেয়ে যাচ্ছিলো। চোখে চোখ পড়ে গিয়েছিলো। আর এটাই ইনসা দেখে ফেলেছে।এখন তো সেই লেভেলে ক্ষেপে আছে। যেভাবেই হোক ওর রাগ ভাঙ্গাতে হবে। তা না হলে রাতে খাওয়া জুটবে না। কিন্তু গেল কোথায় ও! খুঁজতে খুঁজতে দেখি বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। গিয়ে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু এক ঝটকা দিয়ে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাশে সরে গেল। হুমম,বেশ ভালোই রাগ হয়েছে দেখছি। অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
-জানপাখি……
-ইনসা চুপ করে আছে। কোনো কথা নেই….
-ময়নাপাখি……
-এখনও চুপ করে আছে….
-টিয়াপাখি……ক্ষিদা লাগছে। খেতে দাও না।
-পারবো না।
যাক,মুখ থেকে কথা তো অন্তত বের করতে পেরেছি।
-তো আমি কি না খেয়ে থাকবো?
-থাকবে।
-আমার অপরাধ টা কি? সোনাপাখি……
-তোমার অপরাধ তুমি নিজেই জানো। ঢং করো না। যাও, এখান থেকে।
-আমি না খেয়ে থাকলে তোমার ভাল লাগবে?
-ইনসা চুপ করে আছে…..
-চলো না,একসাথে খাই। আর কোনোদিন এরকম হবে না। বিশ্বাস করো!
-আর যদি কোনোদিন দেখেছি এরকম কিছু,সেদিন তোমার খবর আছে।
-ইয়াহু…..তাহলে এখন একটু হাসো।
-পারবো না।
দেখতে পেলাম ইনসা মিটমিট করে হাসছে। কিন্তু ও খিল খিল করে না হাসলে আমার ভালো লাগে না। আমার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে। আর কোনো কথা না বলে ইনসাকে কোলে তুলে নিলাম। এবারে আমার গলা জড়িয়ে ধরে খিল খিল করে হেসে দিলো ইনসা। যদিও এখন রাত হয়ে গেছে, তারপরও মনে হলো সূর্যের ঝকঝকে আভাতে ওর মুখটা ভরে উঠেছে। যেটা পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে আমার সবচাইতে প্রিয় জিনিস……….

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত