তুমি আসবে বলে

তুমি আসবে বলে
রাত তিনটে নাগাদ, আমি আমার হবু স্বামীর মৃত্যুর খবর পাই। বিয়ে ঠিক হবার তিনমাস পর! সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার আমার, নানার বাড়িতেই বড় হওয়া। সেই সুবাদে পড়াশোনা ও সেখানে।
মামা চিন্তা করে দেখলেন, এতো অর্থ-সম্পত্তি অন্যের মেয়ে কেন ভোগ করবে? চোখের সামনেই উপযুক্ত মেয়ে রেখে আর বাহিরে খুঁজতে যাওয়া কেন? বিয়ের ঠিক দু’মাস আগে থেকেই বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড। বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে। কোনো কিছুর ঘাটতি যেন না থাকে। তো যার জন্যে এতো আয়োজন, সেই মহাজন আছেন প্রবাসে। আমার হবু স্বামীর কথাই বলছিলাম। দীর্ঘ আট বছর পর দেশে আসার কথা। রায়বাঘিনী ননদিনী এসে একদিন আমায় জানালেন- ‘এই যে ভাইয়ের হবু বউ। কান খুলে শুনে রাখেন, বাবা কিন্তু সাঈদ এর সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করতে যাচ্ছেন। আপনি আবার অন্য কাউকে মন টন দিয়ে বসবেন না যেন!’ মাগরিবের পর সাঈদ আমার ফোনে কল করলো। আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। চলে গেলাম ছাদে, কথা বলার জন্যে; ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হলো। ‘শুনলাম, তুমি নাকি ভালো গান করো। শুনাবে নাকি আমাকে একটা?
আমি মৃদু হেসে বললাম- ‘আপনাকে এমনি এমনি শুনাবো নাকি, তার বদলে বিশেষ কিছু চাই আমার’! ‘তা কলেজের ফাংশনে যখন গাও, তখন? ‘তখন তো আমি পুরষ্কার পাই। গাইবো না? কথায় পেরে না উঠে সাঈদ বলতে লাগলো- ‘আচ্ছা আচ্ছা, অতো কিছু তো নেই আমার, একটা লাল গোলাপ দিবো। তাতে চলবে? আমি কিছুই বললাম না, কারণ লাল গোলাপ আমার পছন্দ নয়। আমি ঝিঝি পোকার তালে গান ধরলাম- ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’! খানিকবাদে গানটির অডিও ক্লিপ আমার কানে আসতে লাগলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম- ‘গান টা রেকর্ড করা হলো কখন? সে উত্তরে বললো- ‘ইসসস! এটা তুমি গেয়েছো নাকি? তোমার কন্ঠ এতো সুন্দর? এটা মূল শিল্পীর গান! এশার আজান দিলে সাঈদ নামাজে চলে যায়, আমি বালিশ চেপে মুখ লুকাই। লজ্জা পাচ্ছি আমি, স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছি মানুষ টাকে নিয়ে।
প্রথম কোনো পুরুষ কে নিয়ে ভাবতে থাকি আমি। মাঝেমধ্যে ও আমায় জিজ্ঞেস করে- ‘বাংলাদেশ টা কেমন হয়েছে? আমি খুব শীঘ্রই দেশে ফিরবো। নাড়ীর টানে, আর নারীর টানে! কতো কি প্ল্যান করেছি দুজন, রাতের পর রাত। একবার হলো কী, সারাটা দিন গেলো, কোনো খোঁজ নেই তাঁর। আমি চিন্তায় অস্থির। কি হলো মানুষ টার? এভাবে তো কখনো আমায় না বলে কিছু করে না। বাসার সবাই চিন্তা করছে। আমি মুনাজাতে বসে কান্না করছি, ‘আল্লাহ, আর যাই হোক মানুষ টাকে সুস্থ রেখো তুমি! রাতে ফোন করে জানালো, তাঁর বন্ধুর এক্সিডেন্ট করেছিলো। তাই নিয়ে ছুটোছুটি করতে হয়েছে সারাদিন। আমি বুক ফেটে কান্না করলাম সেই রাতে, সাঈদ চুপটি করে শুনলো শুধু। আর বলছিলো- এমন করেনা মনা, আমি খুব শীঘ্রই দেশে ফিরবো তো। কত স্বপ্ন আছে আমাদের, সেগুলো সাজাতে হবে না?
আমার খুব রাগ হলো। পরদিন রাতে আমি আর কিচ্ছুটি খেলাম না। সাঈদ কে কল ও করলাম না। ঘুমিয়ে পড়েছি কখন খেয়াল নেই। হঠাৎ, মাঝরাতে কান্নার আওয়াজ। খবর এসেছে, সাঈদ এর মৃত্যুর খবর। হার্ট অ্যাটাক করেছিলো, হসপিটাল নেয়ার আগেই সব শেষ! ইসস, কী কষ্ট টাই না হয়েছিলো সে সময়ে! রাতে তো আমার সাথে কথাও হয়নি, না জানি কী কী বলতো আমায়! এসব ভেবে ভেবে আমার পাগল হয়ে যাবার দশা! কিন্তু কিছু মানুষ কে শত কষ্ট বুকে নিয়েও সুস্থ থাকতে হয়। তিলে তিলে শেষ হবার জন্যে! আজ সাত বছর পেরুলো। আমি ভুলতে পারিনা, গাইতে পারিনা সেই গান; যেই গান শেষবার সাঈদ কে শুনিয়েছিলাম! সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাওয়া মানুষ টির কথা ভেবে, সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়া কি খুব কষ্টের? নাকি তাকে নিয়ে পড়ে থাকাটা খুব বেশি জরুরী!
আমি জানি না, তবে না পাওয়া গল্পের কথা ভেবে একটি যুগ দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যায়। হয়তো সমাজ আর পরিবারের মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু, গল্পের চরিত্র গুলো তা বেশ পারে! আজ সাঈদ এর মৃত্যু বার্ষিকী। আমি প্রতি বছরের মতো, এবারো তাঁর বোন কে গিয়ে জোর গলায় প্রশ্ন করলাম- ‘আপনার ভাইয়ের জন্যে তো আজো অন্য কাউকে মন দিলাম না আমি। তবে কোথায়? কোথায় আপনার ভাই? সুমি আকাশ পানে চায়, চোখের জল ফেলে; ভিতরে কুড়ে কুড়ে শেষ হয়। আমার অবিবাহিত জীবনের জন্যে সে নিজেকেই দায়ী করে। অথচ আমিতো জানি, প্রকৃতি আমায় দুহাত ভরে ভালোবাসা দিয়েছিলো; তবে স্বপ্ন গুলো আমার ছিলো না!
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত