ভোরে দেখা স্বপ্ন

ভোরে দেখা স্বপ্ন

কনস্টেবল ধাক্কা মেরে আমাকে কারাগারে ঢুকিয়ে দিলেন। আমার অনেকটা অস্বস্তি লাগছে। ঠিক যেন নতুন বউ শ্বশুরঘরে কাটানো প্রথম সময়কালের মত। আজ বুঝতে পারছি জেলকে শ্বশুরঘরের সাথে কেন তুলনা করা হয়। দরজার রড গুলো ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে থাকা টেবিল ফ্যান থেকে বাতাস বইছে। আজকার উত্তাপ
বড্ড শোষণীয়। আমার শরীর হতে পানির মত ঘাম ঝরছে। শান্তার সাথে কথা হওয়ার পর থেকে মন আনচান করছিল। এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটছে। আর আজ
ঘটেও গেলো। শান্তা হয়তো ওরদিক থেকে ঠিক।
.
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। পিছন ফিরে খেয়াল করলাম আমার সাথে আরো তিনজন আছেন। কিন্তু একটা বিষয় ভাবার মত। ওদের একজন সাহেবের মত শুয়ে আছে। দুজনে শুয়ে থাকা সাহেবের মাথা টিপে দিচ্ছে। তাদের দিকে আর মনযোগ দিলাম না। একটু দুরে গেলাম তাদের থেকে। কোণে চুপটি করে বসলাম।
.
যিনি শুয়ে ছিলেন তিনি উঠে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখে নিলেন কয়েকবার। আমার খানিক ভয় করছিল। গ্যাংস্টার মানুষ। না জানি কি করে বসে। আমি আবার কোনো ভুল করলাম না তো??
তিনি শার্টের কলার আগলা করে বললেন, তোমাকে দেখে তো মনে হয় না কোনো অপরাধ করতে পারো! তাহলে এখানে কি করে? একটু আগেও উনাকে বড্ড ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন উনার কথায় হাসি পাচ্ছে।
.
উনি কপট স্বরে বললেন, হাসার কি আছে? উনার কথায় কোনো প্রভাব পড়লো না আমার মাঝে। আমি তখনো হেসে চলেছি। একসময় থেমে গেলাম। উনি তো আমার বড়ভাই বয়সী। উনার কথায় আমার ঠাট্টাতামাসা করা আমার ঠিক হয় নি। অন্ততপক্ষে যখন নিজেকে থেকে কথা বলেছে। আমি নরম সুরে বললাম, ভাই মাফ করবেন কেমন। আসলে আপনার কথায় না হেসে পারলাম না।

– তোমার হাসি পাবে এমন কথা তো বলিনি আমি। তোমার পোশাকআশাক দেখে ভদ্র মনে হলো। দেখে মনে হচ্ছে না তুমি কোনো অপরাধ করতে পারো।
– বলেন কি ভাই?? কারো বাহিরে রূপসজ্জা দেখে কি বলা যায় সে কেমন??
– তা ঠিক। তবু তোমার মুখ যেন অন্য কথা বলছে! আচ্ছা তুমি করেছো টা কি শুনি? খুন? চুরি?? ডাকাতি অপহরণ?
– উহু তারচেয়ে বড় অপরাধ করেছি আমি। এজন্য আমাকে ফাসি দেয়া হলেও কম হবে!
.
আমার কথায় ওরা হঠ্যাৎ ই আগ্রহী হয়ে উঠল। সবাই তাকিয়ে আছে। বড়ভাই বলল, খুন করলে ফাসির সাজা হয়। কিন্তু তুমি তো খুন করনি। তাহলে??
– আমি মন ভেঙ্গেছি বহুত। খুন করলে তো মানুষ একবার ই খতম। কিন্তু ভাঙ্গা মন নিয়ে বেচে থাকা বড় দায়। মনের ক্ষতগুলো আমাদের প্রতিপদে মারে। বারংবার মারে। না দেয় হাসি মুখে বাচতে না মরতে। তাহলে এ থেকে আর বড় কোন অপরাধ কি আর হয়!
.
বড়ভাই চুপ করে রইলো।
হয়তো মন ভাঙ্গার দরদ উপলব্ধি করতে পারছে। গোলাকার এ দুনিয়ায় সবারি একবার হলেও মন ভাঙ্গে। কেউ মন ভাঙ্গার কষ্ট বুঝে আর অন্যের মন ভাঙ্গার সাহস পায় না। আর আবার কেউ বুঝেও মন ভাঙ্গার দৌড়ে উঠেপড়ে লাগে। আমি হলাম পরের কাতারের মানুষ। আর এটা ছিল আমার দ্বিতীয় অপরাধ!
.
বড়ভাই সিগারেট ধরিয়েছেন। পরপর কয়েকটা টান দিয়ে সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে দিল। শুরু থেকে নেশারঝোঁক কোনদিন ছিল না। এসএসসি পরীক্ষা যখন দেই তখন সিগারেটের স্বাদ প্রথম ও শেষবার পেয়েছিলাম। গোল্ডলিফ একটান দেয়াতে ভিতরকার সব হার্ডওয়্যার যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল। সপ্তাহ ধরে কাশতে কাশতে হাপিয়ে উঠেছিলাম। এরপর আর সিগারেট হাতে নেয়ার দুঃসাহস হয়নি। তাই বড়ভাই কে হাসি মুখে ফিরিয়ে দিলাম।
.
বড়ভাই কিছুটা অবাক হলো।
হয়তো এযুগে ননস্মোকার আমাবস্যার চাদের মত। বড়ভাই বলল, বুঝলে কথা বলতে গেলে কখনো আধুড়া রাখতে নেই। তুমি বল আমরা শুনতেছি। মন হালকা হবে। আমরাও রহস্যের নাহয় বেড়া পাড় হয়ে উঠে পড়বো।
.
ভার্সিটি জীবনের প্রথম দিন গুলো সত্যি অন্যরকম ছিল। একদিকে মাকে ফেলে শহরে আসা। অন্যদিকে অজানা এক জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সংগ্রাম।
আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। আমার জন্য ভোরে দেখা স্বপ্ন বাস্তব হওয়ার মত ছিল নিশাতের আমার জীবনে আগমন।
.
মেয়েটা যে আহামরি কিছু ছিল তা কিন্তু নয়। তবু আমার জন্য কোন রাজকন্যার থেকে কম ছিল না। নিশাত আমার জীবনটাকে নিজের হাতের ছোয়ায় বদলিয়ে ফেলে। আমিও তাই চেয়েছিলাম। ওর মত করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে। কিন্তু জীবনের সবচে বড় ভুল তখনি করে বসি। নিশাত আমার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া শুরু করে!
.
সাকিল কিছুদিনের মধ্যে নিশাতের আসল রুপ আমার সামনে তুলে ধরে। সাকিলকে নিশাত চিনতো না। আর সেখানে নিশাত মার খেয়ে যায়। এতকিছুর পরেও নিশাতের চোখে কোনো প্রায়শ্চিত্তের আভা দেখতে পাইনি। সাকিল আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি আবার কিছুনা করে বসি। মায়ের পরে কেউ যে আমার জন্য ভাবে সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। এসব মানুষ জীবনের অনুভূতির অপর নাম হয়। ঠুনকো কিছু আবেগপরায়ণ অনুভূতি তাদের সামনে কিছু ছিল না।
.
এতকিছুর পর আমার আবহাওয়া পরিবর্তনের বড্ড দরকার ছিল। সাকিল আমাকে টিকেট কেটে দেয়। কিছুদিন আগেও নিজের জীবনের ঠিক কতোটা মুল্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু মায়ের চোখের পানি দেখে ঠিকি তা বুঝতে পারি। ফিরে আসার দিনে জীবন এক নতুন মোড় নেয়। মেডিকেল মোড় হতে বাস উঠার কথা ছিল। রিক্সায় করে জাহাজের মোড় হয়ে যাচ্ছিলাম। পথেই ভিড়ের কারনে আটকা পড়ি। এক মহিলা এক্সিডেন্ট করেছে। পাশের লোক বলল মহিলা এই এলাকায় ভিক্ষা করে। মহিলার পাশে এক বাচ্চা কাঁদছিল। তার জন্য কারোই ভ্রুক্ষেপ নেই।
.
মাকে নিয়ে ঢাকা ফিরে আসি। সাথে আরো তিনটে জীবন ছিল। সেদিন মহিলা টির পাশে থাকা বাচ্চাটিকে দেখে বিবেক নাড়া দেয়। কদিন ধরে বাচ্চাটির রিলেটিভ খোজ করি। কিন্তু পাইনি। তবে কাকতালীয় হলেও সত্য যে এরপর আরো দুটো বাচ্চা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়। ফেলে আসতে পারিনি ওদের। মাকে নিয়েও আমার ভাবনার অন্ত ছিল না। তাই দেরী না করে সব্বাই কে নিয়ে ফিরে আসি!
.
সাকিল কে এসে সব বুঝিয়ে বলি। দুএকটা প্রাইভেট পড়িয়ে ওদের দেখাশোনা করা হয়ে উঠছিল না। একটা সময় পর আমি হাপিয়ে উঠি। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘোরপ্যাঁচ খাওয়া শুরু করে। কিভাবে ওদের একটা কমফোর্টেবল জীবন দিতে পারি।
.
নদীর মাঝপথে আমার নৌকো টলোমলো দেখে সাকিল একটা সাজেশন দেয়। আমি সেসময় না করে দেই। কিন্তু দিনের পর দিন বাচ্চাগুলো মুখের দিক চেয়ে নিজের বিবেকের কাছে হেরে যাই আমি। নিজের ইমানের সাথে বিট্রয় করি। তবু যেন বাচ্চা গুলো ভালো করে বাচতে পারে। তাদের তো কিছু দিন পর স্কুলে ভর্তি করাতে হতো। বইপত্র, ইউনিফর্ম কতকিছু ই দরকার পড়বে।
.
সাকিল মেয়ে পটানো তে একেবারে এক্সপার্ট। ওহ আমাকে টিউশন দেয়া শুরু করলো। কিভাবে মেয়ে পটিয়ে কাজ হাসিল করতে হয়। আমাদের টার্গেট ছিল সেইসব মেয়ে যারা আলালের ঘরে দুলাল। হাজার কয়েক টাকা গেলে যাদের লেশমাত্র আফসোস রবে না। আর তাই হলো। একসময় এমন হলো যে আমি একসময়ে কয়েকটা মেয়ে হ্যান্ডেল করছিলাম।
.
জীবন সহজে কোনকিছু পাওয়া যায় না। আর আমিও সেক্ষেত্রে সহজ পথটা বেছে নিয়েছিলাম। হয়তো আমার সামনে আরো পথ ছিল। একটু কঠিন হলে এর থেকে বিবেক বিরোধিত হওয়ার কথা ছিলনা। এই অনুভূতি সোহানার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে অনুভব করি। সোহানা ছিল আমার নেক্সট টার্গেট। ওকে বাকে আনতে বেশ ছক কষতে হয়েছিল। একসময় তো হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরের টার্গেট খোজা শুরু করলেও সোহানা আমার মনে জায়গা নিজে বানিয়ে নিয়েছিল। কিছুদিন পর সোহানাকে ভার্সিটির সামনে দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। আবার অন্যদিক হতে সোহানার আসাটা নরমাল ই ছিল। সাধারনত মেয়েদের পিছনে বেশ সময় ধরে ঘুরাঘুরি করলে একটু হলেও তাদের মায়া জন্মায়!
.
এরপর সোহানার ক্লোজড হতে সময় লাগেনি! মেয়েরা যে অল্প তে হাজার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে সোহানাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না! ওর সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো স্বপ্নের মত ছিল। মনে হচ্ছিল সময়টা দ্রুত ছুটে চলেছে। একসময় খেয়াল করি আগেকার মত আর মেয়েদের চিট করতে মন সায় দিচ্ছে না। আস্তে আস্তে এসব
একেবারে বন্ধ করে দিলাম। সাকিল সবি জানতো। ওহ নিজের ভুল বুঝতে পারে। সত্যি বলতে এখানে আমার স্বার্থ কম ছিল না। সাকিল তো শুধু বন্ধু হয়ে বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখিয়ে দিছে!
.
দেখতে দেখতে অনেকটা সময় চলে গেলো। কিছু দিন পরে ভার্সিটি জীবন শেষ হওয়ার পথে। তবু এ কদিন কিছু করে তো খেতে হবে। আর এবারও সাকিল পথ দেখাল। তবে আগেকার মত না। কোচিং সেন্টারে ফাইভের বাচ্চাদের পড়াতে হবে। খাটুনি বড্ড ছিল। ভার্সিটি ক্লাস খতম করে সন্ধে বেলা সিধা কোচিং সেন্টারে পড়াতে যেতে হতো। কোনোকোনো দিন কিছু খাওয়া করা হত না। মেয়েটা কেমন করে জানি বুঝতে পারে। রোজ নিজ হাতে কিছুনা কিছু বানিয়ে আনতো। একদিন তো কেঁদেই ফেলি। মেয়ে টা আমাকে এত ভালবাসে। ভোরের শিশির যেমনি ঘাসকে সজীব করে তুলে। আমারও ঠিক তাই হয়েছিল। সাদামাটা জীবনটা বর্ণীল হয়ে উঠেছিল।
.
এতটুকু বলে থেমে গেলাম। বড়ভাই হাতের সিগারেট থেকে তখনো ধুয়া উড়ছে। টান দিয়ে বলল, থামলে কেন? বলে ফেলো।

– তারপর আর কি আর দুটো মেয়ের মত সোহানাও নানান স্বপ্ন বুনতে শুরু করে আমাকে নিয়ে। সোহানার স্বপ্ন দেখা আমার হাতে ছিল না। কিন্তু পূরণ আমি ই করতে পারতাম। মনেরমত করে জীবনে সবকিছু হয় না। আর আমার ভয় ঠিক সেখানে ছিল। এই তো সেদিন শান্তার সাথে আমার দেখা হয়। যাদের সাথে চিট করেছি শান্তা ছিল তাদের মাঝে সবচে সিরিয়াস। কিন্তু সেটা ভালবাসা না আবেগ আমার ধারনার বাইরে ছিল। মেয়েটা কোনো ভণিতা না করে নতুন করে সব শুরু করার কথা বলে। কিন্তু ততক্ষণে আমার শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায় সোহানা ছিল। রাখতে পারিনি শান্তার কথা। খুঁটিনাটি সবি বুঝিয়ে বলি। মেয়েটাকে আমি যতদূর চিনেছি আজ এখানে আমার থাকা এক্সপেক্টেট ছিল।
.
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কখন যে ইমোশনাল হয়ে গেছি খেয়ালি করিনি! বড়ভাই আমার ঘাড়ে হাত রাখল। আমাকে মজবুত থাকতে বলছে। সময় বড্ড অদ্ভুত একটা জিনিস। মনের কাছে থাকা যে কাউকে পর করে দেয়। আবার অচেনা অপরিচিত কাউকে আপন বানিয়ে দেয়।
.
রাত অনেকটা হয়েছে।
কনস্টেবল এসে বড়ভাই কে কিছু প্যাকেট দিয়ে গেলো। হোটেল থেকে কেনা খাবার। বড়ভাই এর প্রভাব যে কম নয় তা বুঝতে আর বাকি থাকলো না। নাহলে কি আর জেলহাজত কে নিজের বাড়ির মত করে চালাতে পারে। বড়ভাই খাবার প্লেটে রাখতে রাখতে বলল, দেখো আমি কি বেকুব! সময় তো বড্ড হলো। তোমাকে খাওয়ার জন্যও বললাম না।

– না ভাই ঠিকাছে। আমার ক্ষুধা নেই। আপনারা খেয়ে নিন।
.
আমার কথা আর শুনে কে??
বড় ভাই দুটো তন্দুরি রুটি আর গোস্তের ঝোল আমার দিক এগিয়ে দিলো। আমার কেমন জানি লাগছিল। হঠ্যাৎ করে বড়ভাই হেসে ফেলল। তাতে আমি আরো লজ্জায় পড়ে গেলাম। বড়ভাই হেসে বলল, তোমার মত ছেলে আমি দেখি নি। পেটে জ্বালা রেখে লজ্জা করলে চলে না রে পাগলা।

– আচ্ছা খাচ্ছি ভাই। সাথে আপনিও বলুন নিজের সম্পর্কে।
– আমার সম্পর্কে নতুন করে আর কি বলবো। একসময় আমিও আশিক ছিলাম। তখন সবে কলেজে উঠেছি। মায়ার সাথে পরিচয় হয়। মেয়েটার নাম যে শুধু মায়া ছিল তা নয়। ওর মুখটা কতোটা যে মায়াবী ছিল কি বলবো! তাতেই আমার খেল খতম হয়ে যায়। ভালবাসি কথা টি বলতে হয়নি। আমরা একে অপরকে ভালবাসতাম সেটা সব্বাই বুঝতে পারতো। সবার মাঝে আমরা ছিলাম আলোচনার মুখ্য বিষয়। ওর হাত ধরতে গিয়ে মনে হতো আমি যেন হার্ট ফেইল করবো। ভাবতে পারো আজ আমি কত মেয়ের সাথে ফিজিক্যালি এ্যাটাচ! তবু যেন মায়ার জায়গাটা অপূর্ণ ই ছিল!

– কেন?? ভাবির সাথে আপনার কি হলো??
– কি আর হবে বল। মুখে বলবে ভালবাসি কিন্তু হাতে কলমে প্রমাণের সময় পালালে বাচে। ওর বাবা বিয়ে ঠিক করে। তখন মুখ ফুটে বলতে পারেনি বাবা আমি একজন কে ভালবাসি। একবার বলে দেখত। লেখাপড়া সব ছেড়ে দিতাম আমি। মার্কেটে বাবার দোকান ছিল। দোকান নাহয় আমি দেখাশুনা করতাম। নিজের স্বপ্ন উজাড় করে ওকে নিয়ে ঘর সাজাতাম!

– হুম সেটাই হয় তো সে চায় নি। কেউ কখনো চাইবে না তার ভালবাসার মানুষের স্বপ্ন গুলো আধুড়া থাকুক। আপনার ভালোই চেয়েছিল।
– কি হয়েছে আমার ভালো চেয়ে বল?? আজ আমি কি ওকে ছাড়া অনেক সফল। মেয়েদের কাছে ভালবাসা ছেলেখেলা ছাড়া কিচ্ছু না। তারা চায় অসময়ে একজন পাশে থাকুক। মনের মানুষ হিসেবে নয়। সিকিউরিটি হিসেবে। যে কিনা তার গন্তব্য অর্থাৎ টাকাওয়ালা বরের হাতে সম্মানের সহিত তুলে দেয়।
.
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
ইন্টারমিডিয়েট এর ইংলিশ টেক্সট বুকে কনফ্লিক্ট নামে এক চ্যাপ্টার আছে। স্টুডেন্ট কে পড়াতে গিয়ে জানতে পারি এক বিষয়ে সবার ভিন্নতর ধারনা জন্মায়। মানুষ নিজে যা ভাবে তাই ঠিক মনে করে। এতে কারো হাত থাকে না। আর বড়ভাই হয়তো নিজের জায়গা হতে ঠিক। কিন্তু মেয়েটির কোনো ভুল দেখছি না। এমন কিছু তে কে সঠিক কে ভুল বলা মুশকিল! তাই আমার চুপ করে থাকাটা শ্রেয়!
.
কিছুসময় পর খাওয়া শেষ হলো।
বড়ভাই আরেক টা সিগারেট ধরালো। টান দিয়ে বলল, তোমার বাড়ি তে কেউ চিন্তা করবে না?? আর ভাবি কি এসব জানে??? এই যে তুমি কি করতে? আজ এখানে আছো?

– ( একটু হেসে) শান্তা মেয়েটা যেমন তো সোহানা কে এসব না জানালে ওর পেটের ভাত হজম হবার নয়। আর মাকে বলা আছে বাইরে থাকবো। চিন্তা করার কথা নয়।
– ওহ ঠিকাছে। রাত পোহালে আমি সব ব্যবস্থা করে দিবো। তুমি বাড়ি তে যেতে পারবে।
– না আমি এভাবে পালাতে চাই নে। আমি ঠিক জামিনে বেড়িয়ে যাবো।
– ( কৌতূহল হয়ে) কে করবে জামিন?? আন্টি? নাকি সাকিল??
– উহু মা তো কিছু জানেই না। আর সাকিল গ্রামে গেছে!
– তাহলে?? ( অবাক হয়ে)
– হুম সোহানা ঠিক আমার জামিন করাবে। ওহ যখন জানবে আমি গ্রেফতার হয়েছি সোহানা ঠিক থাকতে পারবে না।
.

আমার কথায় বড়ভাই জোরে হাসতে লাগলো। যেন আমি হাস্যকর কিছু বলেছি। অনেকক্ষণ হাসার পর বলল, তুমি এখনো ঘোরের মধ্যে আছো! এই মেয়ে গুলো কে তুমি চিনো না। তুমি দেখে নিও, এই মেয়ে তোমার দিকে আর ফিরেও তাকাবে না। মেয়েদের ভালবাসা বলতে কিছু হয় না রে পাগলা।
– সেটা সময় ই বলে। আর এই ভাবনা আর এমন থাকবে না। ভালবাসা বলতে ছেলে মেয়ে বুঝে না। হয়ে গেলে সব্বাই সমানে অনুভব করে সেই অনুভূতি। এর কোনো ভাগ হয় না।
.
রাত অনেক হয়েছে।
আমি জানি বড়ভাই ঠিক তার ভাবনা পাল্টাবে। আমার সোহানার প্রতি নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করি। ওহ ঠিক বুঝবে। কিছুদিন ঠিক অভিমান করবে। পরে নিজে থেকে এসে কতোই না অভিযোগ করবে। বকা দিবে। পরে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিবে।
.
সবে চোখ বুজেছি।
বড়ভাই গান শুরু করলো।
♪♪ আমার ভিনদেশি তারা
একা রাতের ই আকাশে
♪♪ তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে………আজ ঘুম হয়ে যাও
চোখে আমার মন খারাপের রাতে ♪♪
আমি ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্য চলে যাচ্ছিলাম। ঠিক যেন সোহানা ঘুম হয়ে আমার চোখে হয়ে এসেছে। হাত বাড়িয়ে আমাকে নিরন্তর ডাকছে!
.
আজ দুদিন পার হয়ে গেছে।
সোহানা আসেনি। এসময়ে বড়ভাই অগণিত বার বলেছে উনার কথা শুনতে। কিন্তু আমি মানতে পারিনি। কিভাবে পারতাম নিজের ভালবাসা কে এভাবে হারিয়ে দিতে। আমার মন বলছে সোহানা আসবে। আসতেই হবে। ভালবাসা যে এভাবে হারতে পারেনা!
.
সন্ধে বেলা বড়ভাই চা বলে আনিয়েছে। সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে। তখনি কনস্টেবলের ডাক। বড়ভাই আর চায়ের কাপে চুমুক দিলো না। যেন ভুল কিছু শুনেছে। কনস্টেবল আবার বলল, অভ্র কে এখানে?? উনার জামিন হয়ে গেছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিছুদিন বড়ভাই অনেক আপন হয়ে গেছে। আমি কাছে গিয়ে সালাম করলাম। বড়ভাই আমার হাত বুলিয়ে দিলো। হ্যাঁ আজ ভালবাসার জয় হয়েছে। বড়ভাই ঠিক বুঝবে কেন মায়া আপু অমন করেছিল। ভালবাসা তো এমনি নিজের আগে তার কথা ভাবা। ভাবিও ঠিক তাই করেছিল।
.
সোহানার পিছন পিছন থানা থেকে বের হলাম। মেয়েটাকে ভবঘুরে দেখাচ্ছে। চোখের নিচে দাগ পড়েছে। বুঝাই যাচ্ছে ঘুময় নি। শরীরে যেন কোনো জোর নেই। আচ্ছা সোহানা না খেয়ে আছে না তো?? পিছন থেকে সোহানার হাত টেনে ধরলাম। সোহানা অভিমানী চোখে ফিরে তাকালো। হাত ছেড়ে দিলাম। বললাম, চলো কিছু খেয়ে নিবে।

– আপনি কি করে জানলেন আমি খাইনি। আপনি কি সবজান্তা নাকি??
.
মেয়েটা কভু বদলালো না। আগের মত বাচ্চা ভাবটা রয়ে গেছে। আমার প্রতি রাগ করলে আপনি করেও বলছে। এটা ভালোই তো। তবু রিয়াক্ট তো করছে। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। কিছুদূরে একটা বিরিয়ানি হাউজ দেখা যাচ্ছে। ওর হাত আবার ধরলাম। টেনে ওখানে  দুজনে গেলাম।
.
কেন জানি ইচ্ছে করছে সোহানাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেই। আশেপাশে তো অনেক লোক দেখছি। তাতে কি? আমাকে তো কতবার সোহানা  নিজ হাতে খাইয়ে দিছে। তাও আবার খোলামেলা পাবলিক প্লেসে। ওয়েটার বিরিয়ানির একটা প্লেট নিয়ে এলো। কাচ্চি বিরিয়ানি। ওর বড্ড পছন্দের। আমি চামচ ফিরিয়ে দিলাম। বিরিয়ানি এক কলমা সোহানার দিকে এগিয়ে দিলাম। দেখি মেয়েটা নিঃশব্দে কাঁদছে। আমি বললাম, খাও। হাত ব্যথা করবে তো বেশিক্ষণ ধরে থাকলে!

– তার আগে আপনি বলুন আমার সব কথা মানবেন। আমি যা বলবো করবেন।
– আচ্ছা আচ্ছা আগে খেয়ে নেও।
.
সোহানা এখনো আমার উপর অভিমান করে আছে। করুক একটু। ওর ঠোঁটের কোনে উচ্ছিষ্ট লেগে আছে। আমি হাত দিয়ে মুছে দিলাম। সোহানা কে পানি খাইয়ে দিলাম। সোহানা বলল, শুনেন যাদের সাথে আপনি অমন করেছেন সবার কাছে ক্ষমা চাইবেন। আর ওদের টাকাটাও ফেরত দিবেন। আমরা দুজনে চাকরি করলে তা মুশকিল হবে না।

– আচ্ছা ঠিকাছে।
– কি ঠিকাছে হা?? ভালো করে পরিশ্রম করেন এখন থেকে। শুধু মুখে বললে হবে না। আর শুনেন বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি নিয়ে আমি এক স্কুলে কথা বলেছি। আমার কাজিন ওখানকার টিচার। কোনো প্রবলেম হবে না। সবচে বড় কথা বাচ্চাদের বলবেন আমি ওদের মা হই।
.
আমি মেয়েটার কথা যত শুনছি অবাক না হয়ে পারছি না। মেয়েটা আমাকে এতোটা ভালবাসে। সত্যি কারো মনের মানুষ হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আজ আমি ভোরে কোনো স্বপ্ন দেখছি না। সেই স্বপ্ন বাস্তবে আমার সামনে বসে আছে!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত