কিছু ভালোবাসা

কিছু ভালোবাসা
বাম ‘পা’ বাঁকা জন্মের পর থেকেই বউয়ের, সেটা বাসর রাতে জানতে পারলাম। এমন একটা মেয়ে’র সাথে বিয়ে হবে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।যে মেয়ে হাঁটতে পারেনা সঠিক ভাবে তাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেকটা। অপারেশন করেও এখন আর কাজ হবে না। জন্মের পর থেকেই বা’পা একটু বাঁকা।তাই হাঁটার সময় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় ওর।বিরক্ত লাগে যখন অমন ভাবে হাঁটতে দেখি।এক কথায় যাকে বলে প্রতিবন্ধী বউ। আম্মার উপরের রাগ মাঝে-মাঝে বউকে দেখালেও মেয়েটা কিছু বলতো না।চুপচাপ শুনে বোবার মতো। হয়তো আড়ালে আড়ালে কাঁদে স্বামীর ভালোবাসা না পাওয়ায়। আম্মার সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দিছি প্রায়।খুব বেশি কথা হয়না।ডাইনিং টেবিলে খাবার সময় ওই একটু কথা বলি তার বেশি না।তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে মেয়েটা।
– আপনাকে ডাউল দেবো কি? প্রথম প্রথম হাঁটার ধরণ পছন্দ ছিল না।ইদানিং ওর কথা শুনলেও গা জ্বলে।মাথা নিচু করে তারাহুরা করে খেতে খেতে বলি।
– লাগবে না। আবারও মেয়েটা সুন্দর একটা হাসি হাসে।এতো অপমান করি তবুও যেন তার লজ্জা হয়না।
– ভালো হয়েছে।মা আজ রান্না করছে।নিন না একটু। ডান হাত দিয়ে কষে একটা থাপ্পর দিলাম গালে।রাগে মাথা ভন-ভন করছে।একই কথা বার বার বলতে ইচ্ছা করেনা আমার, রিরক্ত লাগে।মেয়েটার বা’পাশের গালে এটো ভাত লেগে আছে।পরিষ্কার ভাবেই গালে ফুঁটে উঠেছে পাঁচ আঙ্গুলের দাঁগ।মোমের মতো মুখ লাল হয়ে গেছে।কয়েক ফোটা জল চুইয়ে পরে তার গাল বেয়ে।একটুও মায়া হলো না আমার।বিরবির করে বলে উঠলাম যত্তসব নেকা কান্না কাটি। চোখের জল শাড়ীর আঁচলে মুছে সেই মুচকি হাসিটা হাসে।ভুলেই যেন গেছে, কিছু সময় আগে তাকে একটা থাপ্পর মেরেছিলাম।আম্মা খেতে খেতে বলল।
– আচ্ছা সোহান।মানুষ কি সব দিক দিয়ে পারর্ফেক্ট হয় তুই নিজেই বল।এমন লক্ষী মেয়ে আর একটাও পাবিনা।রান্না থেকে শুরু করে রূপে গুণে সব কিছুতেই পারর্ফেক্ট অথচ তুই বউমাকে অপমান করতেই থাকিস।
– দেখ আম্মা।ও এখন আমার বউ আর মোটেও সুন্দরী না।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে।
আম্মা আর কিছু বলল না চুপসে গেলো তার মুখটা। টং দোকানে আব্বা চায়ের কাপে মুখ লাগাতেই পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো ”কত টাকা যৌতুক নিয়ে পা ভাঙ্গা মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনছেন?” চায়ের কাপে আর ঠোট লাগানো হলো না।’চা’ এর দাম দিয়ে উঠে এলো টং দেকান থেকে।হাট – বাজার করতে গেলেও একই কথা “শুনলাম আপনার ছেলের বউ নাকি পা ভাঙ্গা”। দুপুর একটা বাজে তখন ফোনটা বেজে উঠলো।ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে ভেসে এলো কানে ” দুপুরে খেয়ে নিবেন কিন্তু” বিরক্ত ভড়া মুখ নিয়ে ফোন কল কেটে দিই ”যত্তসব আদিক্ষেতা দেখানো”। কাজের চাপে অনেক রাত করে ফিরতে হলো।ডোরবেল তিন বার চাপার পরও খুলল না।আবারও রাগে উঠতে শুরু করে।চার বার ডোরবেল চাপার পর হাই তুলে খুলে দিলো।খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বলি।
– এতো সময় লাগে দরজা খুলতে।সারা দিন কি ঘুমাস নাকি?
মাথা নিচু করে মৃদু কন্ঠে বলে ”বুঝতে পারিনি কখন ঘুমিয়ে গেছি।আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসেন।আমি টেবিলে খাবার বেরে দিচ্ছি।” রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিলাম। আয়নার সামনে সাজুগুজু করছে মেয়েটা।হালকা একটু সাজলে সব মেয়েদেরই সুন্দর লাগে।সত্যিই আমার ইচ্ছা করছিল তাকে আরও একটু প্রাণ ভড়ে দেখি।কোমর ছুয়ে গেছে তার চুল গুলো, কোমলার কোয়ার মতো সুন্দর দুটি ঠোট।না, না! এ..আমি কি ভাবছি।পায়ের দিকে তাকাতেই বিরক্ত লাগলো আবারও। পা এখনো আগের মতোই বাঁকা।পরে গেলে কেউ যেমন ঠিক ভাবে দাড়িতে পারেনা ঠিক তেমনটাই দেখতে লাগে দাড়িয়ে থাকলে। আব্বার জন্য চিনি কম চা, ঔষধ সময় সময় মতো দেওয়া।ইদানিং আর বাইরে টং দোকানে চা খেতেও যেতে হয় আব্বার।আম্মার কাজেও অনেক হেল্প করে।বলতে গেলে রাজরানী করে রেখেছে আম্মাকে।তার কাজে খুশি ছিলাম না শুধু আমি।প্রত্যেকটা কাজেই খুটিয়ে খুটিয়ে ভুল খুঁজতাম সব সময়।
এমনই একদিন বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরছিলাম অফিস শেষে।সর্দি জ্বরে বার বার শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠছে।কয়েকটা চাদর মুরি দিয়ে থাকলেও প্রচন্ড শীতে ঠক ঠক করে কাপছিলাম।টিস্যু পেপার শেষ কিন্তু মেয়েটা নিজের শাড়ীর আঁচলে সর্দি পরিষ্কার করে দিচ্ছে।আমি ওর জায়গায় থাকলে হয়তো এমনটা করতাম না।যে মানুষকে পঙ্গু ভেবে কখনো ভালোবাসার চোখে দেখিনি সেই মেয়ে আজ সারা রাত জেগে আমাকে সেবা করছে।অবাক হয়ে ছিলাম কম অত্যাচার করি নাই বউকে তবুও আমাকে এতো ভালোবাসে।বউ আসলেই বউই হয়।তার কোনো তুলনা হয়না। ভোর সকালে কপালে শীতল ঠোটের ছোঁয়া পেলাম। জানতামও না আমাকে প্রতি সকালে একটা করে কিস করে।সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গেনি তাই হয়তো জানতাম না।আজ জেনে গেলাম কতটা ভালোবাসে।কিছু সময় পর গোসল করে বের হতেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম।
– বউ…ও বউ গোসলের পর তোমাকে এতো সুন্দর লাগে কেন।একদম স্বপ্নের রাজকন্যার মতো। খুব করে কাঁদে আমার বউটা।এই কান্না যে কষ্টের না, আনন্দের কান্না।স্বামীকে নিজের করে পাওয়ার কান্না।চোখের জল মুছে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরি “আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও বউ।স্যরি তোমাকে কত অবহেলা করেছি।কত অপমান করেছি।নিজেকে আজ খুবই অপরাধী মনে হয়”।
পাশের বাসার চিৎকার চেচামি শুনে পরিবারের সবাই বাইরে দাড়াতেই দেখি সেই টং দোকানে আব্বাকে অপমান করা লোকটার উপর তার ছেলের বউ ঝগড়া করছে, রাগ দেখাচ্ছে। আব্বা জান মুচকি হাসি হাসে আর বলে ”আমার বউমা না হয় পঙ্গু কিন্তু আপনার ছেলের বউয়ের মতো না।যৌতুক আমরা নিই নাই।যৌতুক নিয়েছেন আপনি।”
লোকটা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো।আসলেই তার কিছু বলার নেয় আজ।দিন শেষে পিছন থেকে বউকে জড়িয়ে ধরে সামান্য কিছু টাকার বেলি ফুলের মালা তার খোপায় বেঁধে দিই।মেয়েটা লজ্জায় বুকে মাথা গুজে দেয়।মনে হয় অনেক বেশি লজ্জা পেয়েছে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত