এক মুঠো ভালোবাসা চায়

এক মুঠো ভালোবাসা চায়
আপনি অনেক খারাপ একটা মানুষ। আমি আপনার মতন খারাপ মানুষ আমার জীবনে দেখিনি। আপনি খুব ভালো অভিনয় করতে পারেন।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই থামলো আসমা। শাহেদ সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলো। পা দিয়ে পিষে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল….
–ডান হাতে চুরি একটা কম কেন?
আসমার বুক কেঁপে উঠলো। তাহলে লোকটা খেয়াল করেছে তাকে! আসমার খুব রাগ হয় শাহেদের উপর। এতদূর থেকে আসে সে অথচ লোকটা একটিবারও তার দিকে ফিরে তাকায় না৷ অথচ চুড়ি পরেছে সেটা ঠিকই খেয়াল করেছে। বেহায়া একটা! আসমা রাগ সংবরণ করে বেঞ্চে বসে পরে৷ শাহেদও একটু দূরে সরে যায়। আসমা বলে….
-কিছু বলছেন না যে?
–শেষ প্রশ্নটা আমিই করেছি।
-কি প্রশ্ন?
–চুড়ি একটা কম কেন?
-তার আগে বলেন বুঝলেন কেমনে যে একটা চুড়ি কম? আমারতো মনে হয় আপনি তাকানই না আমার দিকে।
–আমার মনের চোখ দিয়ে সব দেখতে পাই আমি।
-কচু দেখতে পান আপনি। কখনো তো চোখের দিকে তাকাননা আমার। একটু তাকালে কি হয়? নাকি আমি কালো শ্যামলা বলে তাকাননা?
–যেটা ভাবো।
আসমার রাগ হয় অনেক রাগ। চোখে পানি আসে। এই মানুষটা এত বেরসিক কেন! তার মাঝে কি অনুভূতি বলতে কিছু নেই? শাহেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পকেট থেকে সিগারেট বের করতে মুখে দিতেই আসমা সিগারেট সহ লাইটার ছুড়ে ফেলে দেয়৷ পাশের শিমুলগাছটায় দু’টো কাক সেই কখন থেকে কা কা করেই যাচ্ছে। শাহেদ বলল….
–কাকের কণ্ঠ কোকিলের মতন হলে এখন কত ভালো হতো তাইনা?
-দুনিয়ার সব উদ্ভট প্রশ্ন আপনার মাথায়। কাকের কণ্ঠ কখনো কোকিলের মতন হয়!?
–যদি হতো এখন কা কা শব্দের বদলে কুউউ কুউউ মিষ্টি শব্দ হতো।
-ডেকে এনে কাক কোকিলের গল্প শোনাচ্ছেন?
–শুনতে নিশ্চয়ই খারাপ লাগছেনা তোমার?
আসমার শুধু রাগ না। সাথে বিরক্তও লাগছে ভীষণ। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা। কেন জানি এই মানুষটার উপর সে রাগ ঝাড়তে পারেনা। মাঝেমাঝে দু’একটা উচু গলায় কথা বললেও তার খারাপ লাগে ভীষন। আসমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে….
–প্রিয়ন্তিকে আজকেও দেখতে এসেছিলো।
-ছেলে কি করে?
–জানিনা, হয়তো বড় চাকরি বাকরি করে।
-কিভাবে বুঝলে?
–আব্বা আম্মার ছেলে পছন্দ হয়েছে।
-উনারা তোমার কথা ভাবলনা? তুমিতো বড় মেয়ে, বড়কে রেখে ছোটকে বিয়ে দিবে?
–কালো মেয়েকে কেউ পছন্দ করেনা। এরা গল্প, উপন্যাসেই পছন্দ। বাস্তবে নয়, বাস্তবে সবাই সুন্দরের পিছনেই ছুটে।
-হুম সেটা ঠিক। প্রিয়ন্তি কি রাজি?
–রাজি না থাকলেও কিছু করার নেই। বাবার মতের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস ওর নেই।
-এই আধুনিক যুগে এসেও বাবা মায়েরা তাদের মতামতকেই প্রাধান্য কেন যে বেশি দেয় বুঝিনা। ছেলে মেয়েদের কথা শুনতেই চায়না। এদের ওতো একটা মতামত আছে তাইনা? যাইহোক বাদ দাও, তোমায় কবে দেখতে আসবে?
–দেখতেই আসলেই বা লাভ কি। এসেতো প্রিয়ন্তিকেই পছন্দ করে।
-প্রিয়ন্তির জন্য তো ছেলে ঠিক হয়ে গেছে। ওকে আর পছন্দ করে লাভ কি। এখন শুধু তুমিই বাকি। আর কোন চিন্তা নেই।
–এসব বলবেননা। সব সহ্য হয়, আপনার মুখে এসব শুনলে আমার ভয়ংকর খারাপ লাগে।
-আচ্ছা বলবনা।
–গতকাল চাকরির ইন্টারভিউ কেমন হলো?
-ভালোনা।
–এই নিয়ে ক’টা হলো?
– সতেরো টা।
–আবার কবে আছে।
-আর দিবনা ইন্টারভিউ।
–কেন?
-টিউশনিই করাবো, এতেই দিব্যি চলে যাবে।
–টিউশনি দিয়ে জীবন চলবে?
-আমার চলবে! এতিম মানুষ, কোন টেনশন নেই। যা টাকা পাই ভালোই চলে।
–এই এতিম শব্দটা বলতে নিষেধ করেছি।
-সরি..!
–হু।
দু’জনেই চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। আসমার এখন আর আগের মতন রাগ নেই। শাহেদও একদম চুপচাপ। আসমা ভাবছে শাহেদের কথা। এই মানুষটাকে সে কখনো বুঝতে পারবে বলে মনে হয়না৷ অদ্ভুত এই মানুষ। শাহেদ বলল….
–শোনো, আমায় কিন্তু আগের বাসায় পাবেনা। ওখানে যেওনা।
-মানে?
–বাসা ওটা ছেড়ে দিয়েছি। বাড়িওয়ালা নতুন ভাড়াটিয়া পেয়েছে। ওরা ভাড়া বেশি দিবে।
-আর আপনি ছেড়ে দিলেন? কোন প্রতিবাদ করলেন না?
–আমার কাছে দিগুণ ভাড়া চেয়েছিলো, সেটাতো সম্ভব না। তাই ছেড়ে দিয়েছি।
-থাকেন কোথায়?
–বিজু মামার সাথে, সারাদিন তো টিউশনি করেই চলে। শুধু রাতটা ঘুমালেই হলো।
আসমা অন্য দিকে ফিরে তাকায়। শাহেদের এই সহজ সরল কথাগুলো সে সহ্য করতে পারেনা। তার ভীষণ কান্না পায়। কেন পায় সে জানেনা৷ অদ্ভুত ভাবেই পরিচয় হয়েছিলো দু’জনের। একটা বৃদ্ধাশ্রমে আসমার সাথে দেখা হয়েছিলো শাহেদের। আর তখন থেকেই পরিচয়৷ কেউ কাউকে কখনো মুখ ফুটে বলেনি, ভালোবাসি। তবে দু’জনের মনেই যে ভালোবাসার মহাপ্রলয় ঘটেছে সেটা বেশ ভালোই আন্দাজ করতে পারে দু’জন।
একদিন আসমা ওর বাবাকে শাহেদের কথা বলেছিল। ভদ্রলোক মুখের উপর বলে দিয়েছে..’কোন এতিম ছেলের হাতে মেয়ে দিবেনা। যার মা বাবা নেই, কোন আত্বীর স্বজন নেই, তার কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া প্রশ্নই আসেনা। প্রয়োজনে মেয়েকে সারাজীবন কুমারী রাখবে।’ আসমা শাহেদকে বহুবার বলতে চেয়েছে, আমায় বিয়ে করবেন? কিছু লাগবেনা। শুধু তিনবেলার জায়গায় দু’বেলা দুমুঠো ভাত দিবেন। আর এক বেলা এক মুঠো ভালোবাসা দিলেই হবে। আর কিছুই চাইনা আমি। কিন্তু আসমার সাহসে কুলোয়না। পাছে মানুষটা যদি বলে, আমার সুন্দর মানুষ চাই, আমি কুৎসিত কাউকে জীবনসঙ্গী করতে পারবনা। নীরবতা ভেঙে আসমা বলে….
–সন্ধ্যা হয়ে এলো যে।
-বাসায় যাবে? আচ্ছা যাও।
–তাড়িয়ে দিচ্ছেন?
-তুমিইতো বললে সন্ধ্যে হয়ে এলো..!
–আমিতো বেলার ছুতোয় নীরবতা ভাঙলাম।
-আচ্ছা তোমার বয়স কত পেরুলো?
–মেয়েদের বয়স জানতে নেই মহারাজ।
-আচ্ছা বাদ দাও। একটা বাসা দরকার, তোমার পরিচিত কেউ আছে যে বাসা ম্যানেজ করে দিতে পারবে?
–আচ্ছা আমি দারোয়ান কাকাকে বলবনি।
-একটা বাসার খুব দরকর।
–এত দরকার কেন? আপাতত বিজু মামার সাথেই থাকেন। পাশাপাশি বাসা খোঁজেন পেয়ে যাবেন।
শাহেদ উঠে দাঁড়ায়। মাটিতে পরে থাকা সিগারেট আর লাইটার তুলে নিয়ে পকেটে রাখে। আসমা বুঝতে পারে মানুষটা আর বেশিক্ষণ থাকবেনা। সেও উঠে দাঁড়ায়। দু’জনেই রাস্তার দিকে চলতে থাকে। দুজনেই নীরব। রাস্তায় এসে শাহেদ একটা রিকশা ডাকে। ইশারায় আসমাকে রিকশায় উঠতে বলে। আসমা রিকশায় ওঠে। রিকশাওয়ালার শার্ট ঘামে ভেজা। পেছনের দিকে শার্ট ফেসে গেছে অনেক খানি। শাহেদ রিকশাওয়ালাকে বলে….
–মামা আজকের কামাই কত?
-বেশি না, শেষ বেলায় একটা টিপ পাইছিলাম মামা। ২০০ শো টাকা দিছে। শাহেদ আসমার দিকে তাকিয়ে বলে….
–৩০০ টাকা দাওতো। আসমা ওর ব্যাগ থেকে ৩০০ টাকা বের করে শাহেদের হাতে দেয়। শাহেদ টাকা নিয়ে রিকশাওয়ালার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলে….
-এটা আপনার টিপস্ মামা। এক্কেবারে ৫০০ মিল করে দিলাম। রিকশাওয়ালা হতবাক। সাথে আসমাও। আসমা ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ১৫ টাকার ভাড়া শাহেদ ৩০০ টাকা দিয়ে দিলো। এটা আবার কিসের টিপস্! আসমার কাছে চলে যায় শাহেদ। ওর দু-হাত চেপে ধরে। আসমার বুক ধুক করে উঠে। প্রথম পুরুষের ছোয়া তার হাতে লেগেছে। লেগেছে নয়, মানুষ টা তার হাত দু’হাত চেপে ধরে আছে। আসমার বুক ধুকপুক করছে। শাহেদ বিনয় স্বুরে বলল….
–একটা চাকরি পেয়েছি। সেলারি ১২ হাজার টাকা। বস বলছে সামনে আরো বাড়বে। আমি একা মানুষ এত টাকা দিয়ে কি করব! আমার একটা মানুষের দরকার৷ তুমিই সেই মানুষ। আসমার ঠোঁট কাঁপছে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে চলছে প্রতিনিয়ত। সে কি বলবে বুঝতে পারছেনা। শাহেদ আসমার হাত আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলে….
-সেজন্যই একটা বাসা খুব দরকার আমার৷ খুব দরকার। বাসাটা পেলেই আমি মানুষটাকে ঘরে তুলব। সেই ঘরে যেতে আপত্তি আছে তোমার? আসমা বাকরুদ্ধ। সে একদম নিশ্চুম৷ শাহেদ আবারো বলল কথাটা৷ আসমা চোখ বুঁজে নিচের দিকে মাথা ঝাঁকালো। শাহেদ হাত ছেড়ে দিয়ে বলল…
–মামা যান, আপনার মামিকে ঠিক মতন বাসায় পৌঁছে দিয়েন।
রিকশাওয়ালা রিকশার প্যাডেলে পা রেখেই রিকশা নিয়ে ছুটে চলে। রিকশা থেকে পিছন ফেরে তাকিয়ে থাকে আসমা। শাহেদ হাত ইশারা করছে আসমাকে। আসমা তাকিয়ে আছে শাহেদের দিকে। আসমার চোখে পানি। যেই পানির প্রতিটি বিন্দু বলছে…’এই কুৎসিত কালো মেয়েটা অনেক ভালোবাসে আপনাকে শাহেদ। এই মানুষটা শুধু আপনাকে চায়৷ একটু ভালোবাসা চায়। এক মুঠো ভালোবাসা চায়।’
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত