শেষ থেকে শুরু

শেষ থেকে শুরু

আকাশটা আজ বড্ড অভিমানী। সে তার অভিমানের জানান দিচ্ছে দমকা হাওয়া আর অঝর ধারার বর্ষণে। ৭০ বছর বয়সী অমল বাবুর মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচ বারবার সিক্ত হচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটায়। কিন্ত, সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ঝাপসা কাঁচের আভাতে তার মনের কোণে জমা থাকা স্মৃতিগুলোতে যেন আরো একবার প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে৷

“কি গো শুনছো, সে কবে থেকে এমন বৃষ্টির মধ্যে বসে আছো। পরে যখন জ্বর বাঁধাবে তখন কার শরীরের ওপর ধকল যাবে শুনি। আমার হয়েছে যত জ্বালা। নাতী এতক্ষণ জ্বালিয়ে ছাড়লো তার বৃষ্টিতে ভেজার বায়না দিয়ে। তাকে তো বুঝিয়ে সুজিয়ে গল্প শোনাবো বলে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, নাতীর দাদু এই বুড়ো খোকা দেখছি কোন কথা কানেই নিতে চাইনা৷ একদিন সত্যি সব ছেড়ে বনবাসে চলে যাবো।”

পরমা দেবীর গলার স্বরে যেন অমলবাবু অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এসেছে। কিন্তু, আজ তার পরমা দেবীর চোখের দিকে তাকাতেও অপরাধবোধ হচ্ছে। যে মানুষটার সাথে ৫০ বছরের সংসার নামক গাড়ি চলছে শুধু সেই মানুষটাকে তিনি শুধু দায়িত্ব হিসেবেই ভেবেছেন, কখনো তার মন বোঝার চেষ্টা করেন নি। সকল মানুষের যে তার জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে কিছু চাওয়া থাকতে পারে এই সহজ কথাটি তার মনে একবারের জন্যেও আসেনি!

ডায়েরির প্রথম দুই পাতার উল্টোনোর পর তিনি দেখতে পান খুব নৈপুণ্যের সাথে তার আর পরমাদেবীর নাম বড় বড় অক্ষরে লেখা। অমলবাবু অবাক হয়ে বলেন “পরমা ডায়েরি লিখতো! আর আমি কিনা কখনো বুঝতেই পারিনি”! ডায়েরিতে পরমাদেবী তাদের প্রথম দেখা হওয়া, সাত পাকে বাঁধা, প্রথম সন্তানের মা হওয়ার অনুভূতি সব এক অব্যক্ত আবেগ মিশিয়ে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। অমলবাবুর পড়তে বেশ ভালোই লাগছিলো। পুরনো স্মৃতি গুলো তার সামনে আবার রঙ্গিন করে ধরা দিচ্ছে। কিন্ত, যতই ডায়েরির পাতা যতই ফুরিয়ে আসছে ততই এক টুকরো কালো মেঘ যেন অমলবাবুর মনকে গ্রাস করে নিচ্ছে।

“আজ তিনি কাজ শেষ করে একটু জলদি বাড়ি ফিরে এসেছেন। সাথে দেখছি একটি নীল রংয়ের শাড়ি। আমার প্রিয় রং যে নীল সেটা তিনি কি করে জানলেন। তার মানে আমাদের বিবাহবার্ষিকীর কথা তিনি ভুলেন নি। এমনটা ভাবনার সাথে পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন আমার ঘিরে ধরেছিলো। কিন্তু একটু পর যখন তিনি এসে বললো আজ তার বন্ধুর স্ত্রীর জন্মদিন, শাড়িটা তার জন্য। তখন বুঝলাম হঠাৎ পাওয়া সুখের চেয়ে হঠাৎ আসা কষ্টের বোঝা অনেক বেশি।”

অমলবাবুর চোখের নোনা জলে কয়েকটি শব্দ ঝাপসা হয়ে গেছে। তার ঠিক পরের পাতায় লেখা,

“নীল শাড়ি, নদীর তীরে হাত ধরে হাঁটা, তারা বিছানো আকাশের নিচে সারারাত ছাদে বসে গল্পের ইচ্ছেগুলো ডায়েরির শব্দের মতো মনের খাঁচায় বন্দী করে নিলাম”। অমলবাবু আজ বুঝলেন পাশে থেকেও দুটো মানুষ কতটা দূরে থাকতে পারে।”

“কি গো, দুপুরের খাবার যে ঠান্ডা হয়ে গেলো। এবারতো দরজাটা খুলো।” অমলবাবু দরজা খুলে অমলাদেবীর সামনে দাঁড়িয়ে তার হাত দুটো ঝাপটে নিজের বুকের মাঝে রাখকেন। “বউ ছেলের সামনে বুড়ো করছে কি।” নীল রংয়ের শাড়ি কিন্তু তোমাকে এখনো পড়লে বেশ লাগবে। নদীর পাড়ে ভীড় বেশি, বুড়োকে একটু সামলে রাখতে হবে। আর তারা গুলো কিন্তু দুজন একসাথে গুনবো। আমাদের না হয় শেষ থেকে শুরু হোক।” অমলাদেবী যেন তার চেনা মানুষটাকে আজ আবার নতুন করে চিনলো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত