দুপুরের খাবার মুখে তোলার মত অবসর পেতে পেতে জাহিদের বিকেল গড়ালো। লাঞ্চপ্যাকেট টা ফেলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার সাথে সাথে ফোন বেজে উঠল তারস্বর এ। মুখ খারাপ করে ফোন টা পকেট থেকে বের করল জাহিদ, দুইটা মিনিট বসার ফুরসত দেয় না শালারা! এই সমস্যা সেই সমস্যা! দশজনের একশ সমস্যা। নতুন প্রজেক্ট ম্যানেজার হওয়ার পর থেকে তার দম ফেলার সময় কই।
ফোনের স্ক্রিন চোখের সামনে আসতেই, ভ্রু কুঁচকে যায় তার! নাম্বার টা চেনা চেনা! কিন্তু! কে যেন! রুপা??? রুপা ফোন করেছে??? এক পলকে চোখে হাজার স্মৃতি ধাক্কা দিয়ে গেল জাহিদ কে! এই নাম্বার একসময় থাকত ঠোঁটের আগায়। এই নম্বরে একসময় রাতের পর রাত কথা হত। দিনের পর দিন এস এম এস চলত। তখনো সেভাবে আসেনাই ফেসবুক হোয়াটস এপ এর যুগ। মাত্র টিএনটির পালা সাংগ করে সবার হাতে হাতে ফোন এসেছে। তাও এন্ড্রয়েড না। নোকিয়ার সাপ আলা মোবাইল এ বাউন্সি বলের গেমটা পপুলার হয়েছে মাত্র। সেই সময়ের কথা। ফোন টা হাতে ভাইব্রেট করেই যাচ্ছে,
পাশের রুমের হামিদ সাহেব দুইবার উকি দিয়ে গেলেন। শেষবার তাড়া দিয়ে উঠলেন,
কি ভাই? ভাবীর ধ্যানে মগ্ন নাকি? কতক্ষণ ধরে অফিস মাথায় উঠে যাচ্ছে ফোনের আওয়াজে। ফোন টা ধরুন।
ধ্যান আসলেই ভাঙে তার। ফোনটা রিসিভ করে জাহিদ।
ওপ্রান্ত থেকে মৃদু ফোঁপানি টের পাওয়া যায়। সেই আগের মতন নাক টানতে টানতে কথা বলছে মেয়েটা।
– হ্যালো!
– এত দিন পর তুমি এই……
– প্লিজ আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাইনা। আমি আজকে শুধু আমার কিছু কথা বলতে ফোন দিয়েছি!
– কাঁদছ কেন রুপা?
এতটাই মায়া নিয়ে বলল জাহিদ, যা মুহুর্তে স্তব্ধ করে দিল রুপাকে। উষ্ণ পানির ধারায় গাল ভিজে গেল আবারো। গলা চেপে বলল, আমাকে একটা দিন দেবে তোমার জীবন থেকে ? প্লিজ? শুধু কালকের দিন টা? সারা টা দিন দেবে আমাকে? সেই আগের মত? খুব ইচ্ছা করছে!
– কিন্তু রুপা….
– থামো প্লিজ। জানি বাস্তবতার কথা বলবে। বিয়ে হয়ে গেছে, এসব এখন আর হয় না। আমি কি অস্বীকার করেছি জাহিদ কখনো? ফিরে চেয়েছি তোমাকে কোনদিন? আজ শুধু একটা দিন চেয়েছি। একটা মাত্র। দেবেনা?
বুক টা শূন্যতায় হু হু করে উঠল জাহিদের। একসময় এই মেয়েটার বলা একটা কথা মাটিতে পড়ত না তার। রাত তিনটে বাজে রুপা ন্যাকা ন্যাকা করে তাকে বলত,
চকবার খেতে মন চাচ্ছে? দিবেনা এনে? দিবেনা?
তার এই কাতর অনুরোধ শুনে কিছুতে নিজেকে সামলাতে পারতো না জাহিদ। শুধু রুপার জন্যই কার্টন ভরে ফ্রিজে চকবার আইস্ক্রিম জমাত জাহিদ আর মায়ের বকা খেত,
তুই পড়াশোনা বাদ দিয়ে আইস্ক্রিম এর ডিলারশীপ নিচ্ছিস নাকি?
আইস্ক্রিম দেয়ার কাহিনী ও অভিনব। ওদের ড্রইংরুম এর জানালা দিয়ে গেটের চাবি ফেলা হত দড়ি বাধা একটা মগের মধ্যে দিয়ে। সেই মগে করে চকবার পাঠানো হত চারতালায়। জানালায় দাঁড়িয়ে রুপা তৃপ্তিভরে বাচ্চাদের মতন আইস্ক্রিম খেত,সে নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমনভাবে দেখত যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম কোনকিছুর সামনে আছে সে।
আর আজ সেই মায়াবী গলায় কত কত কতদিন পর রুপা কিছু একটা চেয়েছে এমন আকুলভাবে। কিভাবে ফেরাবে জাহিদ?
– বেশ। কাল কখন?
– কাল সকাল দশটায়। ফার্মগেট মোড়? ঠিক যেমন কলেজ শেষে দেখা হত আনন্দ সিনেমা হলের সামনে?
– ফার্মগেট? মানে ওখানে তো!!
– জানি। তবু এক দিন। পুরানো জীবনের একটা দিন ফিরে আসুক আগের মতন! একটা দিন বেচে থাকি তোমার প্রেমিকা হয়ে?
– রুপা!
– গাড়ি টা এনো না। আমরা তো রিকশায়ই প্রেম করতাম! বৃষ্টি এলে পলিথিন নিয়ে যা মারামারি করতে তুমি। কাল বৃষ্টি হলে বেশ হয়।
– কিন্তু….
– আজ কোন আপত্তি কর না। একটা দিন আমার জীবন টাকে ফিরে পেতে দাও। আর চাইব না কিছু তোমার কাছে। এই এক দিনে আমি সহস্র পৃথিবী র সুখ খুঁজে নেব।
– বেশ। তাই হবে। যেমন তুমি চাও।
– কাল দশটায় ফার্মগেট। স্যুটেড ব্যুটেড হয়ে এসোনা। আগের মত টি শার্ট, অবশ্যই তোমার রঙের চাকা আলা টি শার্ট বাদ দিয়ে। আউলানো চুল। আর কোন দামী পারফিউম দিওনা। এক্স এর চকোলেট টা। আছে তো? না থাকলে বাড়ি ফেরার পথে আজ কিনে নিও।
– এভাবে কি পুরাতন দিন ফেরত আসবে রুপা?
– মানুষই তো হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। পুরাতন সময়কে কেমন করে ফিরিয়ে আনব বলো? পুরাতন সময় এ গিয়ে একটা দিন ঘুরে আসতে চাই শুধু ? শেষবারের মত তোমাকে পেতে চাই।
–
ফোনটা কেটে গেল। এখনো কেমন অবাস্তব অদ্ভূত লাগছে জাহিদের। এও কখনো হয়? কত প্রেমের কথা ছিল। কত ভালবাসার স্বপ্ন ছিল। জীবনের ব্যস্ততায় জীবিকার প্রয়োজন এসব কথা হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে।
অফিস শেষে আলমাস হয়ে একটা এক্স এর চকলেট ফ্লেভারড বডি স্প্রে নিয়েই নিল জাহিদ। বাসায় ঢুকতেই মনে পড়ল বউ বাড়ি নেই। ছেলেমেয়ের ফাইনাল শেষ হতেই দৌড় দিয়েছে মায়ের বাড়ি। বিরস মুখে টেবিলে বাড়া খাবার এক পলক দেখে বেডরুম এ ঢুকে গেল।
২.
ফার্মগেট এ দাঁড়িয়ে ঘেমে নেয়ে অস্থির হচ্ছে জাহিদ। সাড়ে দশটা বাজে। এখনো দেখা নেই। এতদিন পর রুপা নিশ্চয় তার সাথে রসিকতা করেনি। হয়ত বাচ্চার যন্ত্রণায় এখনো বের হতে পারছেনা। হয়ত…… ভাবনা আর এগুনোর আগেই ব্রিজের নিচে রাস্তা পার হতে দেখা গেল রুপা কে। হলুদ রঙের সালওয়ার কামিজ। চুল পরিপাটি করে এক বেনী। চোখের কোনে কাল কাজল। এক ধাক্কায় যেন বয়স দশ বছর কমে গেছে তার। আশেপাশে কলেজ ড্রেস পরা মেয়েদের দিকে আড়চোখ এ তাকাল জাহিদ এক বার। একসময় রুপা এই কলেজ ড্রেস এ বাড়ি ফিরত। বাড়ি ফেরার সময় টা রিকশায় পাশাপাশি হাত ধরে কেটে যেত মুহুর্তেই।
– কি দেখছ জাহিদ?
– অতীত। দশ বছর আগের সেই তোমাকে।
– খুব পচা লাগছে? মোটা হয় গেছি আগের চেয়ে?
– কিছুটা। চারপাশ দেখ। দশ বছর আগের আনন্দ সিনেমা হল। দশ বছর আগের ফুটওভার ব্রিজ।
– দেখো। খুব কি কিছু বদলিয়েছে? আগের মতই ট্রাফিক পুলিশ রিকশাগুলাতে বাড়ি দিচ্ছে!
– হলে এখনো থার্ড ক্লাস মার্কা সিনেমার পোস্টার!
– এখনো রিক্সাওয়ালাদের ভিড় হলের সামনে!
– হকার গুলা এখনো খালি একশ খালি একশ করছে!
– জি না আগে খালি পঞ্চাশ খালি পঞ্চাশ করত।
– বলেছে তোমাকে!
– তারপর দেখ ওই ছেলে দোকানের চিপায় দাঁড়িয়ে কলেজ গেটের সামনে ইতিউতি করে প্রেমিকাকে খুঁজছে। যেমন আমি খুঁজতাম গোবেচারার মতন!
– ও বেচারা যেন পায়! ও যেন প্রেম খুঁজে পায়, ও যেন ধরে রাখতে পারে। আমাদের মতন হারায় না যেন!
বিষণ্ণতা ছুঁয়ে গেল এক পলক রুপার গলায়। মুহুর্তে আবার চঞ্চল।
– এখান থেকে আমরা হটহাট যাব। নাস্তা করে আসিনি! আর গলাও কেমন খুসখুস করছে। হট চকলেট খাই না বহুদিন।
– চলো!
– এমন নির্বিকার কেন জাহিদ? কেমন যেন সুর নেই নেই গিয়েছে ভাব। জানি সুর কেটে গিয়েছে। তবু আজ কোন পুরানো কষ্ট, হারানোর গল্প, ভবিষ্যৎ এর চিন্তা নয়। আজ শুধুই ফেলে আসা প্রেমের সাথে একটা দিন। প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে একদিন প্রেমিক হতে পারছ না?
সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিল জাহিদ। দশ বছরের পুরানো চোখে দশ বছর আগের প্রেম মিশে গেল যেন!
– প্রেমিক হতে বলছ?
– তবে আর কি?
রিকশায় উঠেই রুপার কোমর পেঁচিয়ে ধরল জাহিদ। ঝটকা মেরে সরে গেল রুপা।
– কি করছ?
– বারে? প্রেমিক হচ্ছি!
– এ মা ছিহ! এসব করতে বলেছি! প্রেম করতে বলেছি।
কোন অসভ্যতা নয়।
– অসভ্যতা করলাম কখন? প্রেমই তো করছি!
আর কিছু বলার আগেই রুপার ডান হাত টা বাম হাতের মুঠোয় পুরে নিল জাহিদ।
– তোমার হাতটা এত্ত ঠান্ডা কেন রুপা?
অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছে রুপা নি:শব্দে। কিছুই বলে না।
রিকশা হটহাটের সামনে আসলে দুজন নেমে পড়ে।
মেনু বুক হাতে নিয়ে পেইজ উল্টাতে থাকে রুপা। জাহিদ ঠোঁটে বাকা হাসি হেসে তাকিয়ে থাকে।
– আজো বুঝি এ অভ্যাস গেল না? পুরা মেনু মুখস্ত করা লাগবে? আধা ঘন্টা মেনু দেখে অর্ডার তো দিতে তুমি সেই ফ্রেঞ্চফ্রাই, থাই স্যুপ অন্থন।
– তোমার মনে আছে?
– প্রথম প্রেম হে প্রেমিকা। এত সহজে কি ভোলা যায়?
মিষ্টি হাসে রুপা।
– মনে আছে যখন অর্ডার কর। আমার জন্য একটা হট চকলেট প্লিজ।
– এই অখাদ্য কেন নাও? ঢং দেখাতে নিতে, জীবনে সেকেন্ড চুমুক দাওনাই। পুরাটা আমার খাওয়া লাগত। আজ কিন্তু আমি খেতে পারব না।
– এখন আমি গরম খেতে পারি। চা কফি ধরেছি যে!
– তুমি চা কফি খাও? তুমি? আনবিলিভেবল!
– হাসব্যান্ড এর জন্য রাতজেগে অপেক্ষা করতে করতে এ বদভ্যাস হয়েছে। সে রোজ দেরি করে বাড়ি ফেরে। দশটা এগারটা। ভোরে উঠতে হয়, বাচ্চাদের স্কুল। তাই রাত জাগতে পারিনা। সেই থেকে কফির নেশা।
– তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে ভালবাসে রুপা?
– বাসবেনা কেন? অবশ্যই বাসে। দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়া থাকতাম আমরা। এখন চার বেডের ফ্ল্যাট আমাদের দুইটা। দুজনের আলাদা গাড়ি। প্রতি এনিভার্সারীতে একটা করে হীরের সেট পাই। কতটা ভাগ্য আমার ভাবো!
– এসব জানতে চাইনি তো। শুধু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে ভালবাসে? আমার চেয়েও বেশি?
– তোমার চেয়ে? তোমার চেয়ে তো অবশ্যই বেশি। তুমি আমাকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে। একবার ভাবো নি আমার কি হবে। আমি কিভাবে বাচব তোমাকে ছাড়া। চলে গেছ তুমি! ছাড়ো সেসব কথা। এসব আর ভাবিনা।
হাত বাড়িয়ে জাহিদের মুখ স্পর্শ করল রুপা। হাত বুলিয়ে দিল আগের মত করে। হাত ঠোঁটের উপর আসতেই আঙুল কামড়ে ধরলো জাহিদ!
– এইটা কি হল শুনি?
– বারে, তুমি প্রেমিকা হতে চাইলে কিছুনা। আমি প্রেমিক হলেই দোষ?
– তুমি সারা জীবনই অসভ্য থেকে গেলে!
হটহাট থেকে বের হয়ে বসুন্ধরা সিটিতে চলে গেল দুজন। কলেজের পর আগে যেমন ফাঁকফোকর পেলে বসুন্ধরা সিটিতে ঘুরতে যেত দুজন। ফোন দেখত, জামা দেখত, জুতা দেখত, টিভি দেখত, বিয়ের শাড়ি লেহেঙ্গা দেখত, পাঞ্জাবী শেরওয়ানী দেখত। কাচের দরজার বাইরে থেকে সোনার গয়নার দাম হিসাব করত মনে মনে। ভাবত বিয়ে করতে কত্ত খরচ! হোমটেক্সে গিয়ে বিছানার চাদর দেখত, পর্দা দেখত, শোপিস দেখত আর হিসাব করত তাদের সংসার চালাতে কত টাকা লাগবে।
আগের কথা ভেবে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল দুজনেই দুদিকে ফিরে। সংসার আজ দুজনেরই আছে। অথচ……
হাটতে হাটতে আটতলায় সিনেপ্লেক্স এর সামনে চলে এল দুজন । সেই যে রিকশায় একবার হাত ধরেছিল জাহিদ তারপর যেন দুজনের বাঁধন কেটে গিয়েছে! হাতের ভেতর হাত ভরে প্রেমিল প্রেমিকার মতন হাটছে দুজন।
– দেখ তো কি সিনেমা আছে? দুইটা টিকেট কাটো!
– আমি কিন্তু ওইসব ধ্যারধ্যারে বাংলা মুভি দেখতে পারব না।
– কোন কালে দেখতে? কাটো অবাস্তব সব ইংরেজি সিনেমার টিকিট ই কাটো!
– টাইটানিক চলছে। দেখবে?
– টাইটানিক? এই মান্ধাতা আমলের ছবি এখন কেন?
– আরে এগুলা কালজয়ী ছবি। সবসময়ই চলবে। দেখবে?
– আচ্ছা নাও। তোমার শখ পুরন করি।
– স্টার ভি আই পি নিচ্ছি দুইটা।
– না না। রেগুলার সিট নাও। আগের মতন।
– তাহলে টিকিট কাটার আগে এইটাও বলি আগের মতন, প্লিজ একটু পেছনের দিকে সিট দিবেন, প্লিজ একটু সাইডের দিকে সিট দিবেন!
হাসতে হাসতে গড়ায় পড়ল রুপা। কোনমতে বলল, আবার দুষ্টামি করছ!
কপট রাগের অভিনয় করে ভ্রু কুঁচকায় জাহিদ, ওরে আমার সতী সাবিত্রী রে! এই কথা কিন্তু তুমিই বেশি বলতে টিকিট কাটার লোকটাকে !
লজ্জায় মুখ ফেরায় রুপা।
আজ একদম সাইডে সিট না পেলেও মোটামুটি কর্নার। টাইটানিক চলছে। জাহিদের সবচাইতে প্রিয় সিনেমা টাইটানিক, তা সত্ত্বেও কখনো দেখেনি রুপা। সিডি কিনে দিয়েছিল একবার। ফেলে রেখেছিল। টিভিতে হচ্ছিল, ফোন করে দেখতে বলেছিল। দেখেনি রুপা। ইউনিভার্সিটি তে পড়তে একবার সিনেপ্লেক্সে এসেছিল, কত জোর করেছিল জাহিদ, তাও দেখেনি।
আজ দেখছে সে অবশেষে।
এখনো হাত দুইটা কোলের উপর। রুপার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে জাহিদ,
কাহিনী বুঝতে পারছ তো? না আগের মত ইংলিশ কে বাংলায় ট্রান্সলেট করে দিব?
ক্ষেপে উঠে রুপা।
– তুমি কি আমাকে আগের মত খ্যাত ভাব? যত্তসব। এখন আমার রোজ বৃহস্পতিবার রাতে মুভি নাইট করতে হয় ওর সাথে। সারা রাত ইংলিশ ছবি দেখি। না বুঝলে হবে?
জাহিদের হাত একটু সাহসী হবার চেষ্টা করতেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল রুপা।
– এমন করোনা প্লিজ। আমি সহ্য করতে পারবনা। আজ বাড়ি ফিরে গেলে প্রতি টা রাত আমার মরে যেতে ইচ্ছা করবে।
– কিন্তু…..
– আমি পারব না।। এই ভালবাসা টা আমি হারিয়েছি। কিছুক্ষণ এর জন্য পাওয়া যদি অসহনীয় হয়!
আপত্তি করেনা জাহিদ। চুপচাপ দুজন মুভি দেখে।
কিছুসময় পর মুহুর্তের আলতোভাবে জাহিদের ঠোট স্পর্শ করে রুপা। চিরচেনা সেই ঠোঁটের স্পর্শে সবকিছু অর্থহীন মনে হয় জাহিদের। মনে হয় সব ছেড়ে হারিয়ে যায় রুপাকে নিয়ে। এই চাকরী, এই স্ট্যাটাস, এই জীবন সব ফেলে কোথাও পালিয়ে যায়। এখন বুঝতে পারে জাহিদ রুপা কেন বারণ করছিল।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সময় নিয়ে। তারপর দুষ্টামি করে বলে উঠে,
-এইবার? এই অসভ্যতা কেন করলে শুনি? দিন শেষে আমাকে বউয়ের কাছে ফিরতে হবে। তখন যদি তোমাকে পেতে ইচ্ছা করে?
-চলে আসবে। আমার হাজব্যন্ড বাসায় ফিরে খেয়ে দেয়ে মরার মত ঘুমায়। সেই ফাঁকে দুই দেশ ঘুরে আসলেও টের পাবেনা!
– পাপ হবে! পাপ!
মৃদু মলিন হাসে দুজনই।
হাফ টাইম শেষে সিনেমা যত শেষের দিকে এগুতে থাকে রুপার বুক ভার হয়ে যায়। মনে হয় যদি এমনি শেষ হত জীবন এই সিনেপ্লেক্সের অন্ধকার ঠান্ডা ঘরে প্রিয় মানুষটাকে ছুঁয়ে!
বিকেল পড়ে গেছে। সন্ধ্যাও হই হই করছে। ফিরতে হবে জানে দুজনেই। তাই বোধহয় পা চলতে চাইছেনা।
বসুন্ধরা সিটি থেকে বের হতেই জাহিদের চোখে পড়ল আইস্ক্রিমআলার ভ্যান। ক্রিনক্রিন করছে। রুপার দিকে এক পলক তাকাল তারপর সোজা ফ্রিজের ঢাকনা খুলে দুইটা চকবার বের করল সে। রুপা অপলক তাকিয়ে রইল। সেই চকবার!
– তুমি ভুলে যাওনি জাহিদ! সবকিছু কিভাবে মনে রেখেছ তুমি?
– বলেছি তো, প্রথম প্রেম কখনো ভোলা যায়? ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে এই প্রেম প্রেম লুক দিওনা তো! আইস্ক্রিম খাও, গলে যাচ্ছে। পরে হাত আঠা আঠা হলে চেঁচাবে!
চোখে অদ্ভূত তৃপ্তি নিয়ে গলে যাওয়া আইস্ক্রিমে কামড় বসাল রুপা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাহিদের ইচ্ছা হচ্ছিল স্থান কাল পাত্র সময় পরিস্থিতি বাস্তবতা সব ভুলে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রুপাকে!
নীরবতা ভাংগল রুপা। তার আইস্ক্রিম খাওয়া শেষ!
– জাহিদ আমাকে মায়ের বাসায় নামিয়ে দেবে আজকে আগের মত?
– সেই চিপা গলিতে?
– তো কি? গাড়ি চড়ে বাবু সাহেব হয়েছে! আগে তো রিকশা করে বাড়ি অব্দিই নামাতে!
– নামাবো না কখন বললাম? চল।
– আচ্ছা শোন, হাত আঠা আঠা করছে!
বলতে বলতে আইস্ক্রিম এর আঠা মাখা দুহাত জাহিদের টি শার্টে মোছার জন্য রুপা হাত বাড়াতেই খপ করে ধরে ফেলল জাহিদ।
– নো। নো। আমার টি শার্ট এ না। পানি কিনে দিচ্ছি দাড়াও।
মিনারেল ওয়াটার এর বোতল কেনার আগেই ঝুপ করে বৃষ্টি নামল।
– এইরে বৃষ্টি নেমেছে।
– সর্বনাশ করেছে। এখন তো গাড়ি আনাও মুশকিল।ড্রাইভারকে ফোন দিলে কাল বিকেলে পৌঁছাবে বসুন্ধরা সিটিতে। উবার কল দেই দাড়াও!
– বাবুগিরি করতে না করেছি না আজকে! রিকশায়ই যাব আজকে!
– ভিজতে ভিজতে?
– জি হা। বৃষ্টি টা হয়ে আজ ষোলকলা পূর্ণ হল। চল এই খুশিতে এক দফা টি এস সি চরকি কেটে আসি!
– তুমি কি পাগল না মাথা খারাপ?
– দুইটাই। চলোতো!
এক ছুটে বৃষ্টি তে নেম গেল রুপা। তার পেছন পেছন গোবেচারার মতন দশ বছর আগের জাহিদ। আধাভেজা হয়ে রিকশায় উঠল দুজন। যথারীতি পলিথিন গায়ে দেয়া নিয়ে এক প্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেল!
যথারীতি পরাস্ত হয়ে বিরস মুখে পলিথিন সরিয়ে রাখল জাহিদ। টি এস সি এর মোড়ে এসেই রিকশা থামিয়ে দুইটা পানিপুরি অর্ডার দিয়ে বসে রুপা। জাহিদের গজগজ ধোপেও টেকেনা।
রাত নামছে ঢাকার বুকে।
দোয়েল চত্বর পেরিয়ে রিকশা খুঁজে নেয় ফেরার পথ। শহীদ মিনারের মোড়ে আসতেই, এক ছুটে নেমে যায় জাহিদ। অন্ধকারে রুপা খেয়াল করার আগেই এক ছুটে ফিরে আসে হাপাতে হাপাতে, হাতে এক আটি বৃষ্টি ভেজা হলুদ রঙের স্বর্নচাপা! দুইহাতে চেপে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুপা। কয়েক মুহুর্ত কেবল।
চোখভরা জল হারিয়ে যায় বৃষ্টির মাঝে।
ওর মাথায় হাত রাখে জাহিদ, ফিসফিস করে বলে, কাদে না বোকা! কাদে না!
জাহিদ একটানে কাছে নেয় রুপাকে। বাধা দেয়না আর রুপা। বৃষ্টিভেজা নির্জন ফুলার রোড যেন ওদের প্রেমের সাক্ষ্য রেখে যায়।
বাড়ির গেটের কাছে আসতে চৈতন্য ফিরল রুপার। জাহিদের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, শেষ হয়ে গেল দিনটা। কেন এমন দিনই শুধু শেষ হয়ে যায়?
নিশ্চুপ থাকে জাহিদ।
– আজকের দিনটা যদি অনন্তকাল হত! যদি আজকের রাত টা কখনো না আসত! জানো জাহিদ, এই একটা দিন আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে বাকিটা জীবন!
– কিভাবে পারো রুপা?
– কে বলেছে পারি? পারি না তো! শুধু বেচে থাকি। আসি?
– একবার বলবেনা? আগে যেমন বলতে?
– চাও তুমি? লাগবে তোমার?
– কতটা যে দরকার আমি নিজেই তো বুঝিনি রুপা। একবার বল প্লিজ!
– ভালবাসি তোমাকে। এখনো।
ক্লান্ত পায়ে হেটে যায় রুপা গেট খুলে। একবার ও পিছে ফিরে তাকায়না। ব্যর্থ মানুষের মত দাঁড়িয়ে থাকে জাহিদ।
7.
বারান্দা থেকে জাহিদকে দেখে ভ্রু কুঁচকায় রুপার মা। তার দুই হাত ধরে রাখা তার দুই নাতনী। জমজ বোন রঙ আর তুলি এক ঝটকায় নানুমনির হাত ছাড়িয়ে তারস্বর এ চেঁচাতে চেঁচাতে নিচে নামে। খোলা গেট দিয়ে দুজন বের হয়ে দুদিক থেকে বৃষ্টিতে ভেজা জাহিদকে জড়িয়ে ধরে।
আব্বু এসেছে, আব্বু এসেছে চিৎকার এ ঘর মাথায় তুলে দুই মেয়ে। দুই কোলে দুজনকে তুলে ঘরে ঢোকে জাহিদ । সেই চিরচেনা গৃহিণী রুপে রুপা ছুটছে ঘর জুড়ে। হারিয়ে গেছে একটু আগের রুপা।
মেয়েদের টিভির সামনে বসিয়ে রুপার হাত ধরে টেনে ছাদে নিয়ে যায় সে।
– এই সন্ধ্যায় ছাদে এলে যে। এমনিতেই ভিজে আছ, অসুখ করবে। জলদি চেঞ্জ কর।
– রুপা, আমাকে একটাবার ক্ষমা করা যায়না?
– তোমার কি জর এসেছে নাকি জাহিদ?
– এমন কেন করছ?
– আমি কি করলাম? খেয়ে বাসায় যেতে হবে। সকালে তোমার মিটিং সকাল নয়টায়। এত দেরী করলে কাল উঠতে পারবেনা। চিল্লাবা তো আমার সাথেই!
– প্লিজ রুপা!
– বাচ্চাদের ক্ষুধা লেগে গেছে জাহিদ। সারাদিন বাইরে ছিলাম। ওরা খাওয়া নিয়ে কি যন্ত্রণা করে তাকিয়ে দেখেছ কোনদিন?
– উফফ। মা মা ভাব টা বন্ধ কর তো!
– কি কি ভাব করব?
– রুপা প্লিজ। আচ্ছা এই পুরানো ওয়ারিদ (এয়ারটেল) সিম টা ছিল তোমার কাছে? এতগুলো বছর রেখে দিয়েছিলে?
– নাহহ। কাল পুরানা আলমারির ড্রয়ার এ পেয়েছি। আর ও অনেক কিছু খুঁজে পেয়েছি। তোমার দেয়া চিঠি,কার্ড,সিডি,পুতুল।
– রুপা! আমি বুঝতে পারিনি একটু একটু করে আমরা এত্ত দূরে চলে গেছি।
– আমি তো বারবার তোমার পথ আঁকড়ে ধরেছিলাম।দিনের পর দিন এক কথাই বলে গেছ, জাস্ট এ মিনিট। এক মিনিট পর আসছি। এক মিনিট পরে ফোন করছি। এক মিনিটে পৌঁছে যাব। এক মিনিট পর কথা বলব। সেই এক মিনিট আর এল না, এক মিনিট এক মিনিট করে এক দশক চলে গেল। এক মিনিটের ফাদে পড়ে আমাদের বয়সটাই চলে গেল।।
– ছুটতে ছুটতে আমি আর থামতে পারিনি। আমি সত্যি খেয়াল করিনাই। আসলে পাশে পেতে পেতে পাওয়াটাই যে এতটা অভ্যাস হয়ে যায় যে পাশে থাকাটাই গুরুত্ব হারায়। আমি সত্যি ভুলে গেছিলাম তোমার প্রিয় আইস্ক্রিম, আমাদের মুভি দেখা, তোমার পছন্দের ফুল, আমাদের নিজেদের একান্ত সময়! আজকের দিন টা থেকে তুমি কতটা পেয়েছ জানিনা রুপা আমি আমার লাইফ টা ফিরে পেয়েছি!
– লেকচার শেষ!?
– পাত্তা দিলেনা?
– দিলাম তো! পাত্তা পাত্তা পাত্তা!
– পাত্তা লাগবে না। আমি আমার প্রেমিকাকে ফিরে চাই, প্রথম প্রেমিকাকে। এবং একমাত্র প্রেমিকা কে।
– আর বউকে লাগবেনা?
– বউ তো সবাই হয়। আমি প্রেমিকা ফেরত চাই। দশ বছরের পুরানো প্রেমিকা! দিবেনা?
হাসল রুপা মুখ টিপে। তারপর পিছনে ইশারা করল!
– আজকের চাঁদ টা দেখেছ জাহিদ? সেদিনের মত না? বিয়ের পর পর একদিন রিকশায় বাড়ি ফিরছিলাম আমরা, তুমি আমার হাত চেপে ধরে মন্ত্রমুগ্ধ এর মত চাঁদের দিকে তাকিয়েছিলে! এক বিশাল থালার মত চাঁদ উঠেছিল সেদিন! একদম আজকের মতন! দেখ!
একটু পলক ও ফেলল না জাহিদ। চোখও স্থির আগের জায়গায়ই!
– দেখছি তো! সামনের টা…. কত বছর পর এই চাঁদ উঠেছে জানো তুমি?
একটু অবাক হয়ে জাহিদের দিকে তাকিয়ে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল রুপা। একটু পর জাহিদ ও হেসে ফেলে। রাতের নীরবতা খান খান করে দুজনের প্রাণখোলা হাসি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে!
ঠিক দশ বছর আগের মতন। কিংবা আজকে সারা দিনের মতন।
…………………………………………….(সমাপ্ত)…………………………………….