স্বামী স্ত্রী

স্বামী স্ত্রী
সাতদিন ছুটি পেয়েছে নিজের বিয়েতে তানিম হোসাইন, কিন্তু সেই সাতদিন পেরিয়ে দশদিন হতে চললো। নতুন বউ কে ছেড়ে কাজের জন্য ঢাকায় যেতে তাঁর শরীর,মন কোনটাই সায় দেয় না। ওদিকে তানিমের দোকানের মালিক বারবার মোবাইলে কল দিচ্ছেন যত দ্রুত সম্ভব সে যেন ঢাকায় চলে আসে একা তিনি দুটো দোকান সামলাতে পারছেন না। অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে রেহাই পায় তানিম মালিকের কাছে, কিন্তু এভাবে আর কতো দিন।
নতুন বউ কে ছেড়ে ঢাকা তাঁকে যেতেই হবে, পেটের দায়ে ভালো ভাবে সমাজে বাঁচার তাগিদে আজ থেকে দশ বছর আগে ঢাকা শহরে পাড়ি জমিয়েছিলো তানিম। এইচএসসি পরীক্ষার পর সকলেই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং করতে বড় বড় বিভাগীয় শহরে ছুটে যায়, তানিম তখন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলো। কষ্ট করে আজ সে অনেকটাই সফল ও সচ্ছল , কিন্তু তাঁকে আরো বড় হতে হবে আরো টাকা রোজগার করতে হবে। তাঁর সঙ্গে এখন আরও একটা জীবন জড়িয়ে আছে তাঁর ভালমন্দ সকল দায়িত্ব তানিমের। নবম দিনে টিকিট কেটে বাড়ি ফিরে তানিম, টিকিট টা ঘরে ঢুকে বউ এর হাতে দেয়। বউ শামীমা টিকিট টা খুলে দেখে এক পলক তারপর টেবিলের উপরে রেখে দেয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা এই কয়েকটুকরা কাগজের এত্তো ক্ষমতা।
আলাদা করে দিচ্ছে স্বামী- স্ত্রী কে এই কাগজের টিকিট টা, তানিম একাই যাবে আগেই কথা হয়েছে শামীমা বাড়িতে থাকবে। তবুও টিকিট টা অনেক আশা নিয়ে খুলে দেখে শামীমা যদি দুইটা সীটের নাম্বারের উপরে কালো কালির দাগ দেয়া থাকে সেই আশায়। পারিবারিক ভাবেই বিয়েটা হয় তাঁদের, দুই মাস আগে বিয়ের কথা পাকা হয়েছিলো তানিমের ছুটি মিলে না জন্য দেরিতে হলো বিয়ে। টিকিট দেখে শামীমা যেন চোখে সবকিছু অন্ধকার দেখতে লাগলো, রান্নাও ঠিকভাবে করতে পারলো না। খেতে বসে শ্বাশুড়ি মায়ের গাল-মন্দ, ছেলে তাঁর চলে যাবে কাল ভোরেই আর আজ এমন বাজে রান্না করেছে বউ, মন তার থাকে কোথায় নাকি বাপের বাড়িতে মায়ে রান্না শিখায় নাই।
শামীমা চুপ করে শ্বাশুড়ির কথা শুনে মাথা নিচু করে, তানিম আড়চোখে শামীমার পানে তাকায়। শ্বাশুড়ি তাঁর অনেক কঠিন মানুষ, কোনো কিছুতেই ছাড় নেই নতুন বউ হয়েছে তো কি। এক দেখাতেই সবকিছু শিখে নিতে হয় এমন পরিবারের বউদের। তানিমের মুখটা দেখলে শামীমা শ্বাশুড়ি মায়ের সব শাসন ভুলে যায়। বিষন্ন মুখ টা উজ্জ্বল হয়ে উঠে মুহূর্তেই অজানা একটা শান্তি বিরাজ করে বুকের ভিতর। কিন্তু আজ রাতে শামীমার মন অনেক খারাপ, থেমে থেমে সে চোখের পানি মুছছে শাড়ির আঁচল দিয়ে। তার একমাত্র কারণ কাল ফজরেই চলে যাবে তাঁকে একলা রেখে তানিম। বিয়ের আগে এই শর্ত শুনে কিছু মনে না হলেও এখন তানিম কে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে। এই কয়দিনে অনেক আপন করে কাছে পেয়েছে তাঁকে সে।
মায়ের বাধ্য ছেলে তানিম, তাঁর সাথে ঢাকা যেতে চাইলেও যেতে পারবে না শামীমা মায়ের নিষেধ আছে। তানিম সাহস করে একবার বলছিলো তাঁর মাকে যে নতুন বউ কয়েকদিন ঢাকা থেকে ঘুরে আসুক মা। ঘোর আপত্তি জানায় তাতে শ্বাশুড়ি মা, তানিমও চুপ হয়ে গেছে এ ব্যাপারে আর একটা কথাও বলে নাই। ঢাকা শহরে বউ নিয়ে থাকলে অনেক টাকা লাগবে খেতে তারপর ঘর ভাড়া দিতে হবে বেশি, সংসার দুইটা হবে তখন একটা বাড়িতে অন্যটা ঢাকায় । বাড়িতে টাকা দেয়া বন্ধ হয়ে যাবে কিছু দিন পর এতোকিছু ভেবে শ্বাশুড়ি যেতে দিবেন না বউকে ছেলের সাথে তাছাড়া এ নিয়ে বিয়ের শুরুতেই কথা হয়েছিল শামীমার অভিভাবক এর সাথে। স্বামীর সাথে ঢাকা যেতে চাওয়ার বায়না করলে সেটা ছেলেমানুষী হয়ে যাবে অনেক তাই শামীমা নিরবে চোখের পানি ফেলছে এছাড়া তার আর কিবা করার আছে।
মধ্য রাতে স্বামীর বুকে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে শামীমা, তানিমেরও চোখ ভিজে যায় তবুও সান্ত্বনা দেয় সে বউ’কে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে বলে, কিন্তু তাঁর বউ জানে ঢাকা থেকে বছরে দুই থেকে একবার বাড়িতে আসে সে। ঈদেও বাড়িতে আসে না, অতিরিক্ত সময় কাজ করলে বেশি টাকা পাওয়া যায় তাই। সারারাত কেউ ঘুমাতে পারলো না, রাত চারটার পর শামীমা উঠে গোসল করে তানিমের জন্য চা আর নাস্তা বানিয়ে ঘরে নিয়ে আসে। তানিমও তৈরি হয়ে খাবার খেয়ে নেয়, এবার তাঁর যাওয়ার পালা। রাতেই বলে দিয়েছে শামীমা যেন তাঁর বিদায়ের বেলা না কাঁদে। মোবাইলে কথা হবে সবসময় আর সে যেনো নিজের যত্ন নেয় ঠিকমতো খায়, মায়ের কথায় কিছু মনে না করে।
বাড়ির সবাই উঠে গেছে ফজরের নামাজ পড়ে বাইরে আসে বাবা, মা, ভাই -ভাবি তানিমের। ভাই তাঁর বন্ধুর বাইকে করে তানিমকে নিয়ে যায় বাসস্ট্যান্ডে। রাস্তার দিকে একভাবে চেয়ে থাকে শামীমা বুকটা তার ভরে যায় শূন্যতা আর রিক্ততায়। ভাবির ডাকে বাড়ির ভিতরে আসে সে, চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। মুখ দেখে শ্বাশুড়ি মা তাঁকে আর কিছুক্ষণ ঘরে ঘুমাতে বলে, ঘরে ঢুকেই তানিমের বালিশ কোলে আর শার্ট হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে নিরব কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। তানিম কে ছাড়া এক-একটা দিন যেন একমাসের সমান আর এক রাত তো হাজার রাতের সমান, দিন ফুরালেও তানিমকে ছাড়া রাত ফুরায় না তাঁর।
সবসময় মোবাইলে কথা হয় তাদের, এ কয়দিন স্বামীকে চোখে না দেখে মনে হয় কত যুগ ধরে চোখ দুটো তাঁর তৃষ্ণার্ত। তানিম সবসময় শামীমা কে সান্ত্বনা দেয়। পাশের বাড়ির ভাবির মোবাইল থেকে ভিডিও কলে কথা বলে দুইদিন শামীমা তানিমের সাথে, ভিডিও কলে কথা বলা যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। এবার বাড়িতে আসার সময় শামীমার জন্য একটা ভালো মোবাইল নিয়ে আসবে তানিম শামীমার আগের মোবাইল টা নষ্ট হয়ে গেছে। একা একটা ঘরে থাকতে মন চায় না আবার ভয়ও লাগে শামীমার, শ্বাশুড়ি মা দুই রাত থাকলেও শ্বশুর বাবা অসুস্থ জন্য আর থাকেন না। বিশাল বিছানা বারবার শামীমা কে স্মরণ করিয়ে দেয় সে একা বড়োই একা। এভাবেই দিন রাত কেটে যায়।
দুই মাস পর তানিম বাড়িতে আসে, শামীমার চোখে আজও আনন্দের অশ্রু স্বামী এসেছে তাঁর বাড়িতে তাই।
পাঁচ দিন থাকবে সে এবার, শামীমার জন্য মোবাইল কিনতে পারে নাই সে মা বারণ করছিলো শুনে। টাকা জমিয়ে তারা বাড়ি পাকা করেছে ঠিকই কিন্তু বাড়ির অনেক কাজ পরে আছে এখন তারজন্য টাকার দরকার অযথা বাড়তি খরচ যেন না করে তানিম। ভাইয়ের উপার্জন বলতে নিজের জমিতে ফসল ফলিয়ে বাড়ির চালের ভাত খাওয়া আর টুকটাক ফসল বাজারে বিক্রি করে যতসামান্য টাকা পাওয়া। বিশ হাজার এরও বেশি টাকা বেতন পায় এখন তানিম। যা দিয়ে বউ নিয়ে ভালোভাবেই থাকতে পারবে সে ঢাকায় ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করে।
কিন্তু পরিবারের উন্নতির জন্য তাঁর সেই স্বপ্ন আর ইচ্ছে কে বলি দেয় সে। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে শামীমার রেজাল্ট বেশ ভালো করেছে সে, আরো পড়তে চাইলে দরিদ্র বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন। তানিমের কাছে চায় সে ডিগ্রি তে ভর্তি হবে পড়াশোনা টা শেষ করবে। শামীমার পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বললে, মা তানিমকে যাতা বলে গালিগালাজ করে। এ নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা অশান্তি বিরাজ করে, বাড়ির বউ নাকি কলেজে যাবে পড়তে বাড়ির কাজ ফেলে এতোই যদি পড়ালেখার শখ তাহলে বিয়ে করলো কেন, যখন তখন এসব কথা বলে শ্বাশুড়ি মা। শামীমা ভীষণ মন খারাপ করে এসব শুনে, এবার তানিম ঢাকায় যাওয়ার সময় সে গোপনে কাঁদলেও সাথে যেতে চায়না একবারো।
দুই দিন হয় তানিমের মোবাইল নাম্বার বন্ধ, চিন্তায় সবাই অস্থির হয়ে গেছে। শামীমা নামাজে বসে কেঁদে মোনাজাত করে স্বামীর জন্য। শামীমার বড় ভাই ও ঢাকায় কাজ করে তবে সে অন্য কাজ করে তার কাছেও খোঁজ পাওয়া যায় না তানিমের আজ তিনদিন হতে চললো। শামীমা রোজা রেখেছে আজ স্বামীর জন্য, শুকিয়ে গেছে এই তিন দিনে অনেকটা চিন্তায় সে। রাতে খবর পায় তানিমের এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে পা ভেঙে গেছে ডাক্তার কোনো ভাবেই জার্নি করতে নিষেধ করছে তাঁকে। তিন মাস তাঁকে বিছানায় থাকতে হবে আর রিস্ক নিয়ে জার্নি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এসব কথা শুনে শামীমা ও তাঁর শ্বাশুড়ি মা দুইজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।
শামীমার বড় ভাই মোবাইল করে বলে তানিমের দেখাশোনা করার জন্য কে আসবে ঢাকায় কাল যেন তৈরি হয়ে থাকে। সে আসছে কাল সকালে এ বাড়িতে রাতে নিয়ে যাবে যে যাবে সাথে। প্রথমে ঠিক হয় বড় ভাই যাবেন কিন্তু এসময় মাঠে অনেক কাজ বাবা অসুস্থ এতো কিছু সামলাতে পারবেন না আর মা’তো এতদূরের পথ যেতে পারবেন না পা আর কোমড়ের ব্যাথার জন্য। শেষে ঠিক হলো শামীমাই যাবে ঢাকা, শ্বাশুড়ি ভালো ভাবে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে বলে শামীমা কে। শামীমাও তৈরি পুরোপুরি, তবে এভাবে তাঁকে ঢাকায় যেতে হবে স্বামীর কাছে সেটা ভাবে নাই সে। যাক তবুও তো কাছে পাবে চোখে দেখবে তানিমকে সে এতেই সে মহাখুশি এখন। রাতে বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ভাইসহ শামীমা।
হাজারো চিন্তা এখন তাঁর মাথায় কেমন আছে মানুষটা, পায়ের কোথায় ভেঙেছে কি খেয়েছে এ কদিন। কিভাবে সে সুস্থ করে তুলবে তানিমকে, সংসার চলবে কিভাবে তাকে কি কোনো কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে হবে তাছাড়া সে থাকবে বা কোথায় এখন তানিম তো চারজন বন্ধু মিলে একটা ঘর ভাড়া করে থাকতো। এসব ভাবে আর জানালা দিয়ে রাতের প্রকৃতি দেখে সে। গ্রামের অনেক মেয়ে ঢাকায় এসে কাজ করে সেও করবে, এইচএসসি পাশ করেছে একটা ছোটমোটো চাকরি সে পেয়েই যাবে। কথা বলতে পারে নাই সে তানিমের সাথে ডাক্তারের বারণ ছিলো বলে।
ভোর হয়ে গেছে আকাশ পরিস্কার পাখি দুই একটা কিচিরমিচির শব্দ করলেও কাক কা কা করছে অনেক। বাস থেমে গেছে কয় মিনিট হবে। বড় ভাই শামীমা কে বাস থেকে নামতে বলেন শামীমা ব্যাগ সহ নেমে পরে। বাস থেকে নেমে শামীমা পাশে একটু তাকায় ভাই নামলো কিনা কিন্তু তখনি বাস চলে যায় তার ভাই কে নিয়ে । ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় সে চারপাশে অনেক লোকের আনাগোনা রিক্সা আর অটোর যেন মেলা বসে সকালে ঢাকা শহরে। ভাই কই আমি এখন কিভাবে খুঁজে পাবো ওনার ঠিকানা এই কথা বিড়বিড় করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে শামীমা। হঠাৎ তাঁর হাত ধরে টান দেয় কে যেন, চোখ তুলে দেখে তানিম।
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে, তানিম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর তো পা ভাঙে নাই তাহলে কি অন্য ক্ষতি হয়েছে এই ভেবে তানিমকে ভালো ভাবে দেখতে থাকে সে। এই সময় সে বুঝতে পারে তানিমের সাজানো কাহিনি টা।
চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরে তাঁর এতো লোকের ভীড়েও সে মুখ লুকায় তানিমের বুকে আর বলে ভালোবাসি ভীষণ ভালোবাসি। তানিমও একহাত শামীমার পিঠে অন্য হাত দিয়ে বউ এর মুখ তুলে কপালে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দুই ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া দেয়।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত