মন খাঁচার অবুঝ পাখি

মন খাঁচার অবুঝ পাখি

চারবছর পর নিজের শহরে ফিরেছে পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পুস্পক সেন| বহরমপুরের ছেলে হলেও কাজের সূত্রে দীর্ঘদিন মুম্বাইয়ে পোস্টিং| শহরের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো তার| বহু পুরাতন ঘটনার কথা আজ মনে পড়ে যাচ্ছে তার| সেই গঙ্গার পাড়, স্কুলঘর সবকিছু যেন তাকে অতীতের আঙ্গিনায় এনে দুমড়ে মুষড়ে ফালাফালা করে দিচ্ছে| একদিন যে রোদেলা বিকেল ছিল তার প্রিয় আজ সেই রোদ বিকেলকেই অসহ্য লাগে তার| সামনের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে টানতে টানতে গঙ্গার পাড়ে এসে একাকী বসেছে সে| ভরা নদীতে নৌকা ভেসে যাচ্ছে, কতো মানুষ পারাপার করছে সেই নৌকায়| এই প্রান্তের সঙ্গে ওই প্রান্তের যেন মিলন ঘটিয়েছে গঙ্গা| কিন্তু তবু কেন তার জীবনে এমন বিচ্ছেদ যন্ত্রনা দিলো গঙ্গা? চারবছর আগে দূর্বার কথাগুলো আজও তার কানে এসে ধাক্কা লাগছে খুব জোরে|

শোন দূর্বা সবকিছু কিন্তু হিসেব করে হয়না|

–কেন হয়না? আমারতো মনে হয় সবকিছুই খুব নিয়মে হিসেব করেই হয়|

কীকরে হয় ?

–এই যে ধর এখন আমি তোর সঙ্গে এই রেস্তোরাঁয় বসে আছি এটাও কিন্তু হিসেব করেই| (টেবিলে রাখা গ্লাসের জলটা ঢক ঢক করে খেয়ে নেয় দূর্বা)

মানে?

–মানেটা খুব সোজা পুস্পক| যদি তুই আমার বন্ধু না হতিস, যদি তুই আমায় এখানে না ডাকতিস তাহলে কী এখানে আমি আসতাম বল? ভালো বন্ধু আমরা সেজন্যই তো তোর একডাকে ছুটে এসেছি| যদি অপরিচিত হতিস তাহলে তুইবা ডাকতিস কেন আর আমিইবা আসতাম কেন| তাইনা?

হ্যাঁ! তা ঠিক| তবু…..

–আচ্ছা অনেক হয়েছে এবার চুপ কর| শোন না বলছি কাল যেটা ফোনে বলেছিলি….(তেষ্টায় গলাটা শুকিয়ে আসে দূর্বার)

নে জল খা (নিজের গ্লাসের জলটা দূর্বার দিকে বাড়িয়ে দেয় পুস্পক)| বল কী বলতে চাইছিলি|

–তুই কাল সন্ধ্যায় যেটা বলেছিলি….(দূর্বার ফোনে রিং বেজে ওঠে)|

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ ভিজে আসে পুস্পকের| চার বছর হয়েগেল তাদের সম্পর্কে ছেদ পড়েছে| আসলে ছেদ পড়েছে বললে ভুল হবে, নিজেরাই একে অপরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে সরে এসেছে| এখন যদিও কথা হয় খুব কম| তবু আজ হঠাৎ পুস্পকের মনটা কেমন যেন করছে| একটা জমাট বাঁধা যন্ত্রনা যেন তার বুকে সিঁটিয়ে রয়েছে|

ছোটর থেকে একই স্কুলে পড়লেও কেউ কাউকে সহ্য করতে পারতো না| স্কুলে বসার জায়গা নিয়ে প্রায় মারপিট হতো তাদের| ক্লাস ফাইভে পুস্পক বয়েজ স্কুলে আর দূর্বা গার্লস স্কুলে ভর্তি হয়| কিন্তু মারপিটের বিরাম নেই| অঙ্কের টিউশনি একই স্যারের কাছে দুজনেই পড়তো| টিউশনিতেও চলতো ধুমধুমার কান্ড| প্রকাশ্যে ঝামেলা করলে কী হবে লোকচক্ষুর আড়ালে পুস্পক আর দূর্বা দুজন দুজনাকে কখন যে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিল তা বুঝতেই পারেনি| বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একে অপরের প্রতি কেয়ার বেড়েছে, বেড়েছে বন্ধুত্ব| পুস্পকের কথা বলার স্টাইল আর বুদ্ধিমত্তার কাছে বারবার দূর্বার মন পরাজিত হয়েছে| একইভাবে দূর্বার সহজ সরল মনের কাছে পুস্পকও কখন হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে টেরও পায়নি| সেই ছোটবেলার ঝগড়া কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আজকাল| ধীরে ধীরে একে অপরের প্রতি অনেকটাই যত্নবান হয়ে উঠছে তারা| একদিন টিউশনি না এলে বারবার খোঁজ নেওয়া, কোন বইটা পড়লে সহজে রপ্ত করা যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি…..| এসব নিয়ে দূর্বার অবশ্য খুব একটা হেলদোল ছিলোনা| খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন বন্ধুর জন্য মন খারাপ করে এমনটাই তার ধারণা| এভাবেই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত গড়ায়| তখন সবে কলেজে ফার্স্ট ইয়ার| পুস্পক একটি কোয়েড কলেজে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে আর দূর্বার অনিচ্ছা সত্বেও বাড়ির লোক তাকে ভর্তি করেছে গার্লস কলেজে|কিছুদিন পর ফিজিক্স ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং চান্স পেয়ে পড়তে কোলকাতা চলে যায় পুস্পক| তারপর থেকে দেখাসাক্ষাৎ কমে যায়| কিন্তু প্রতিদিন ফোনে একবার হলেও কথা হতো তাদের|

ঘুম থেকে উঠে সবে বিছানার উপর হাত পা ছড়িয়ে বসেছে দূর্বা তৎক্ষণাৎ মায়ের বকুনি|

-সন্ধ্যা হয়ে এলো এখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস| পড়াশোনা নেই বুঝি| ওঠ|

–ওহ! এতো বিরক্ত করোনা তো মা| উঠছি দাঁড়াও|

ফোনটা হাতে নিয়ে দূর্বা দেখলো সাতটা মিসড্ কল| একি পুস্পক এতোবার ফোন করেছে কেন? ফোনটা ব্যাক করতেই কলারটোনে বেজে উঠলো দূর্বার পছন্দের গান -‘চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট/ আহা উত্তাপ কতো সুন্দর তুই থার্মোমিটারে মাপলে/ হিয়া টুপটাপ, জিয়া নস্টাল মিঠে কুয়াশায় ভেজা অাস্তিন/ আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম আর তুই কাকে ভালোবাসতিস…|’

হ্যালো|

–হ্যাঁ হ্যালো পুস্পক তুই ফোন করেছিলি? বল কী দরকার এতো? এতোগুলো মিসড্ কল|

তোকে ভীষণ মিস্ করছিলাম রে তাই|

–বলছি আজ কি মাল টাল সেঁটেছিস নাকি? কী বকছিস তুই|

সত্যি বলছি দূর্বা| তোকে ভীষণ মিস্ করছি|

–পাগলামী ছাড়| বল কি বলছিস|

আই লাভ ইউ দূর্বা| খুব ভালোবাসি তোকে| ভেবেছিলাম দেখা হলে বলব কিন্তু আর পারলাম না তাই বলেই ফেললাম|

–এই দাঁড়া দাঁড়া| কীসব বাজে বকছিস| তুই শুধুই আমার ভালো বন্ধু| তাছাড়া আমি এখনো এসব নিয়ে কিছুই ভাবিনি| পড়াশুনোর চাপ| সামনে পরীক্ষা|

প্লিজ দূর্বা খারাপ ভাবিস না| কিন্তু এটাই সত্যি আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি| আমাকে ফিরিয়ে দিসনা|

—-আচ্ছা থাম এখন| দেখ পুস্পক আমিতো তোকে সেরকম কিছু ভাবিনি তাই আমার একটু সময় লাগবে|

বেশ| আমি অপেক্ষা করব|

ফোনটা বিছানার উপর রেখে মায়ের বানানো গরম এককাপ চা খেয়ে পড়তে বসলো দূর্বা| আজ কেন কিছুতেই পড়ায় মন বসছেনা তার| কেমন যেন একটা লাগছে| বইয়ের দিকে তাকালেই শুধু পুস্পকের কথা মনে আসছে তার| তবে কী সেও পুস্পক কে ভালোবেসে ফেলেছে?

রাতের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছে| অন্যদিন শুয়ে পড়লেই ঘুম চলে আসে তবে আজ কেন ঘুম আসছেনা তার| পুরাতন দিনের ঝগড়ার কথাগুলো ভেবে মনে মনে হাসতে থাকে দূর্বা| রাত ঘনিয়ে আসে ক্রমশ| ইতিউতি ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই| সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে তার| আজকের সকালটা যেন অন্য দিনগুলোর থেকে আলাদা লাগছে| মনটাও বেশ ফুরফুরে| ব্রাশ করে চা বিস্কুট খেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে একটি ম্যাসেজ| পুস্পক পাঠিয়েছে|

তোকে খুব মনে পড়ছে রে| আজ কি একবার দেখা হতে পারে?

স্নান করে কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরী হয় দূর্বা| সামনেই পরীক্ষা| কলেজে তেমন খুব একটা ইমপর্টেন্ট ক্লাস হয়না| তবে আজ অ্যাডমিট নিতে যেতেই হবে| বাড়ি থেকে বেরিয়ে চৌরাস্তার মাথায় এসে পুস্পককে ফোন করে জানায় বিকেলে ‘ডায়মন্ড প্লাজা’ রেস্তোরাঁয় মিট করবে বিশেষ দরকার|

বিকেল চারটা বেজে পনেরো পূর্বপরিকল্পিত জায়গায় হাজির হয়েছে পুস্পক খুব সাধারণ ভাবেই| মিনিট দশেক পর দূর্বা উপস্থিত হয়| নীল চুড়িদার, ঠোটে হালকা লিপস্টিক, খোলা চুল….| আজ দূর্বাকে দেখে যেন চোখ ফেরাতে পারছেনা পুস্পক| আজ যেন দূর্বার চোখগুলো আরও বেশি মায়াবী লাগছে| এসে পৌছতেই টেবিলে রাখা গ্লাসের জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো সে| দু প্লেট বিরিয়ানি অর্ডার করলো পুস্পক|

—পুস্পক তুই যেটা কাল বলেছিলি…..(ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে দূর্বার)

বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে পুস্পকের| কোন ঝড় উঠতে চলছে এই ভেবে সে অস্থির হয়ে ওঠে|

—-সরি রে! মা ফোন করেছিল|

ওহ! কী বললো কাকিমা?

—কোথায় আছি, কখন ফিরবো এইসব| হ্যাঁ যেটা বলছিলাম শোন|

বল|

—-তুই যেটা কাল বলেছিলি অনেক ভেবে দেখলাম জানিস| মনে হল…

থাক| আমি বুঝেছি| ইটস্ ওকে ইয়ার| পছন্দ নাই হতে পারে| আমি কিছু মনে করিনি|

—-হোয়াট রাবিশ! একটা চড় মারবো বুঝতে পারবি| কী বলতে চাই না শুনেই বকবক করছিস কেন?

জানিতো কী বলবি|

—-বলতো কী বলবো?

তুই এটাই বলবি যে আমাকে পছন্দ নয়| তোর জীবনে অন্য কেউ আছে অথবা বাড়িতে সমস্যা| ছাড় এসব| নে বিরিয়ানি খা|

—-মেরে মুখটা ভেঙে দেবো জানোয়ার| কথাটা না শুনেই বকে যাচ্ছিস তখন থেকে| অসহ্য!

বল তবে|

—আই লাভ ইউ ইডিয়ট|

রেস্তোরাঁর টেবিলে পুস্পকের হাতে নিজের হাতটা চেপে ধরে কথাটা বলে দূর্বা| সারা রেস্তোরাঁ জুড়ে যেন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে| খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর গঙ্গার ধারে গিয়ে দুজনে বসেছে| সেই ছোট থেকেই গঙ্গার পাড় দূর্বার খুব প্রিয়| মন খারাপ হলেই সে গঙ্গার পাড়ে এসে বসতো| নিমেষে কোথায় যেন হারিয়ে যেত মন খারাপগুলো| আজও গঙ্গার পাড়ে এসে বসেছে তবে আজ মন খারাপগুলো তার সঙ্গী নয় আজ পুস্পক রয়েছে তার পাশে|

দীর্ঘ চারবছর পর আবার গঙ্গার পাড়ে এসে বসেছে পুস্পক, তবে এবার খুব একাকী পাশে নেই কেউ| গঙ্গার পাড়টাও আগের মতো আর নেই| সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে অনেককিছুই| পাকার বাঁধানো পাড় হয়েছে, সারিবদ্ধভাবে লাগানো নারকেল ও বট গাছ| সেই বটগাছগুলির নীচে বসে আছে অনেক প্রেমিক প্রেমিকা| সব থেকেও কিছুই নেই আজ তার| দূর্বা এখন কেমন আছে, কোথায় আছে জানেনা সে| হঠাৎ হালকা বাতাস বয়ে যায়| গা শিরশিরিয়ে ওঠে তার| একরাশ বিষন্নতা বুকে নিয়ে গঙ্গার কাছে জানতে চায় ‘কেমন আছো নদী তুমি? কেমন আছে সে?’

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত