গ্রুপে সবাই ব্যর্থতার গল্প শোনায়।আমি নাহয় বলি আমার সফলতার গল্প। ২০১৪ সাল।তখন পুরোপুরি ড্রাগ এডিক্ট হয়ে পড়েছিলাম।স্টাডি গ্যাপ,ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে মেন্টাল ডিস্ট্যান্স সব মিলে পুরোপুরি ফ্রাস্ট্রেটেড আর ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছিলাম।দুইবার সুইসাইড এটেম্পটও করেছিলাম কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই।এমন একটা দুঃসময়ে ওর সাথে ফেসবুকে পরিচয়।প্রথম এক-দুই মাস ফ্রেন্ড হিসেবে চ্যাটিং হত।সেও তখন সদ্য ব্রেকাপের শোকে কাতর। একসময় নাম্বার বিনিময়,ফোনে কথা বলা এবং অবধারিতভাবে প্রেম হয়ে গেল। আমরা দুজনেই কেউ কারো কাছে নিজেরদের অতীত লুকাইনি।ও আমার সবটা জানত আর আমি ওর সবটা।একদিন সে বলল, “তুমি কি আমাকে চাও না?চাও না আমাদের একটা হ্যাপি লাইফ হোক?তাহলে প্লিজ ড্রাগ ছেড়ে দাও।”
“তুমি আমার হাতদুটো শক্তভাবে ধরো,আমি পুরো দুনিয়া জয় করতে পারব তাহলে।” ড্রাগ ছেড়ে দিলাম,শার্ট-প্যান্ট কে তালাক দিয়ে সুন্নতি লেবাস নিলাম কারণ ওর পছন্দ ছিল।নামাজে নিয়মিত হতে লাগলাম। ও প্রতি ওয়াক্তে নামাজের সময় আমাকে কল করে নামাজের জন্য তাগাদা দিত। একদিন আমাকে কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল,
” তোমাকে একটা কথা বলার ছিল কিন্তু ভয় করে তুমি শোনার পর হয়ত রিলেশন রাখবা না।”
“কি বল?রিলেশন রাখবো না কেন?তুমি নিশ্চিন্তে বল।”
“আমার বাম পা অচল। ক্রাচে ভর দিয়ে হাটত হয়।ছোটবেলায় পোলিও হয়েছিল। “
“এই তুমি আমাকে চিনলা?এটা আমার কাছে কোন ব্যাপারই না।বরং আজ থেকে আমি তোমার পা।” পাগলীটা খুব কেদেছিল সেদিন।বাধা দেইনি।কাদুক।হাল্কা হোক।এই সামান্য খুত নিয়ে জীবনে অনেক কথা শুনেছে বেচারি। কিন্তু আর না।আর শুনতে হবে না,”এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে?এই মেয়েকে পার করতে অনেক ঝামেলা আছে।” আমি শুনতে দেব না। রিলেশনের ৩ মাস চলে তখন।একদিন বলল, “দেখ প্রেম মধুর হলেও এটা পাপ।হারাম।চল আমরা বিয়ে করে ফেলি।” এবার বিরাট সমস্যায় পড়ে গেলাম।একে আমি বেকার তার উপর ফ্যামিলির সাথে তখন আমার সম্পর্ক খুব বাজে।
ফ্যামিলি আমাকে কোনভাবেই সাপোর্ট করবেনা।আল্লাহর উপর ভরসা করে আব্বাকে বললাম ওর কথা।শুনেই আব্বা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, “হারামজাদা, এখনো খাস বাপের হোটেলে ওইদিকে আবার নাকি মেয়ের পায়েও সমস্যা। আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে তুমি যা ইচ্ছা করতে পার।” আর দেরি করলাম না।হাতের কাছে জামা কাপড় যা পেয়েছি তাই নিয়ে নেমে পড়লাম নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য।সম্বল বলতে তখন দুই টাকার দুইটা টেপ মারা নোট।মাসের অর্ধেক চলে তখন। টিউশনির বাসাগুলোতে গিয়ে অর্ধেক মাসের বেতন নিলাম।৪৫০০ টাকার মত হয়েছিল।কিন্তু এখন যাব কোথায়? ফোনবুক ঘাটতে লাগলাম পরিচিত কারো আশায় যে এই দুঃসময়ে আমাকে সাহায্য করতে পারবে।পেলাম এক দূর সম্পর্কের কাজিন কে। চট্টগ্রামে সিএনজি চালাত। কাজিন সব শুনে আমাকে অভয় দিল।টিকিট কেটে উঠে পড়লাম বাসে। ওদিকে ওকে জানিয়ে দিয়েছি আমি বাসা ছেড়েছি। খুব কান্না করেছিল শুনে।
চট্টগ্রামে পৌছে একটা গার্মেন্টস এ চাকরি জুটিয়ে নিলাম কাজিনের সহায়তায়। কারণ টাকা লাগবে। বাপের টাকায় মোবাইলে মিস্টি মিস্টি প্রেম করা যায়, গাছতলায় সংসার পাতার স্বপ্ন দেখা যায় কিন্তু বাস্তবতা খুব নির্মম রে ভাই। যদি আপনার পকেটে কড়ি না থাকে তাহলে ইউ আর নো ওয়ান ইন দিস ক্রুয়েল ওয়ার্ল্ড। আর ওকে বিয়ে করতে মিনিমাম হাজার ৩০ টাকা তো লাগবেই। অন্তত একটা আংটি আর একটা বেনারসি তো দিতেই হবে। আর এটা হবে
ওর কাছে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ। শুরু হল নতুন এক জীবন। যে আমি এক গ্লাস পানি নিজে কখনো ঢেলে খাইনি সেই আমি টানা ৪ মাস গার্মেন্টস এ দৈনিক ১৪/১৫ ঘন্টা গাধার খাটনি খেটেছি।রাতে প্রতিদিন পায়ে ব্যথায় কাতরাতাম আর ও কান্না করত।দোয়া পড়ে মোবাইলে ফু দিত যেন ব্যথা চলে যায়। গড়ে এক বেলা খেতাম দিনে।শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু মনে তৃপ্তি ছিলো কারণ আমি আমার ভালোবাসাকে জয় করার জন্য কস্ট করছি।
ও ততোদিনে ওর ফ্যামিলিকে রাজি করিয়ে ফেলেছে। আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড খারাপ না।আব্বা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার।রাজি না হওয়ার কোন কারণ ছিলো না।হাতে টাকা জমা হওয়ার পর ঠিক হলো নোয়াখালী ওর নানাবাড়িতে আমাদের বিয়ে হবে।ওর বলা ঠিকান অনুসারে চলে গেলাম নোয়াখালী। ১৮ ডিসেম্বর,২০১৪। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমাদের বিয়ে হয়।কিছু আত্মীয় স্বজন প্রথমে অসম্মতি জানিয়েছিল কারন আমার স্বাস্থ ভেঙে গিয়েছিল অমানুষিক পরিশ্রমে। কিন্তু যখন সবাই শুনল ওকে পাওয়ার জন্য আমার এই হাল, তখন তারাই জামাই আদর করার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। একটা মজার ব্যাপার বলিনি।আমি কিন্তু ওকে দেখিনি।বাসর রাতেই আমি ওকে প্রথম দেখি।
বাসর রাত।
লজ্জা পাবেন না। বাসর রাতের বর্ননা দিচ্ছি না।ওর পাশে গিয়ে যখন বসলাম ও হাউমাউ করে কেদে উঠলো আমাকে জড়িয়ে ধরে। সে কান্নায় ছিলো প্রাপ্তির আনন্দ। “কি হাল করছ শরীরের? এতটা ভালোবাসে কেউ?আর কিছুদিন গার্মেন্টস এ থাকলে তো তুমি মরেই যেতে। ” মনের অজান্তেই কয়েক ফোটা পানি আমার চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়ল। আমি পাইলাম,আমি ইহাকে পাইলাম। ভালো থাকুক সবার ভালোবাসা।।।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা