চাকরি ছেড়েছি ছয় মাস হয়ে গেল। সংসার এখন আমার স্ত্রী নীলিমা চালাচ্ছে। এ নিয়ে পাড়া-পড়শির ঘুম নেই। কেউ কেউ বাসায় এসে মা-বাবাকে পর্যন্ত বলে গেছে, “ছেলেকে কিছু একটা করতে বলেন। স্বামী থাকতে বউ চাকরি করবে- এ কেমন কথা?” কালাম সাহেব একদিন হাসতে হাসতে বাবার সামনে আমার মুখের উপর বলে গেলেন, “বাচ্চা পালতে কেমন লাগছে? বাচ্চা পালাও কিন্তু একপ্রকার চাকরির মধ্যেই পড়ে, হা হা।”
বর্তমানে পড়শিদের কাছে পৃথিবীর সবথেকে অসমাঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়টি যেন—আমার চাকরি না থাকা এবং আমার স্ত্রীর চাকরি করা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মাঝে-মধ্যে পেছন থেকে পড়শিদের কানাঘুসা শুনতে পাই। আলোচনা-সমালোচনা যে আমাকে নিয়েই হয় সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। মাঝে মধ্যে পড়শিদের দু-একটা কথা সুচের মতো বুকে বিধে, সংসারে কর্মঠ সুস্থ-সবল পুরুষ মানুষ থাকতে স্ত্রী চাকরি করবে কেন? ছেলের বউয়ের টাকায় সংসার চলে? ছি ছি! অথচ বাবা এখনো প্রতিমাসে অবসর ভাতা পান। নিচতলায় দুটি ইউনিটে ভাড়াটে আছে, সংসারের খরচ ওসব দিয়ে ভালো-ভাবেই চলে যায়। নীলিমা যা কিছু খরচ করে নিজে থেকেই করে।
পড়শিদের পাশাপাশি কিছু আত্নীয়-স্বজনও এসব নিয়ে কথা বলতে ছাড়ছে না। তাদের ধারণা বেতনের পুরো টাকাটা নীলিমা বুঝি এই সংসারেই ঢেলে দিচ্ছে। সরাসারি না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর একটা চেষ্টা তারা করছে।
আমাদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। বিয়ের আগে আমাদের সম্পর্কটা ছিল ‘বন্ধুত্বের।’ দুজন দুজনকে বুঝবার খুব চেষ্টা আমাদের মধ্যে ছিল। বিয়ের পর সেই চেষ্টাটা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। বিয়ের রাতেই আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সংসার জীবনে যত সমস্যাই আসুক না কেন কেউ কাউকে কোনদিন ছেড়ে যাব না। আমার চাকরি নেই, বউ চাকরি করছে দেখে মানুষ কত কথা বলে! অথচ নীলিমা বিয়ের আগে থেকেই চাকরী করছে। সত্যি বলতে কি চাকরি আমি খুঁজছি কিন্তু তেমন ভাল কোন চাকরি পাচ্ছিনা। ইদানীং মানুষের কথা শুনে মনে হয় চাকরি টা না ছেড়ে বসের কথা মতন বান্দরবান বদলি হয়ে চলে গেলেই ভাল করতাম।
আগের চাকরিটা আমি নিজের ইচ্ছায় ছেড়েছি কিন্ত বিনা কারণে ছাড়িনি। অফিসে বস একদিন ডেকে বললেন,
“বান্দরবানে আমাদের অফিসের নতুন ব্রাঞ্চে লোকের প্রয়োজন তাই অফিস থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আপনাকে সেখানে পাঠানো হবে।” আমি বললাম, “স্যার আমার পক্ষে তো বান্দরবান যাওয়া সম্ভব না। পুরো পরিবার আমার শহরে তাছাড়া মাস-খানেক আগে বাচ্চাটা হল, এমন অবস্থায় পরিবার রেখে বান্দরবান কি করে যাবো?” বস সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলেন—“যদি না যেতে চান তাহলে চাকরি ছেড়ে দিন।” কিছুই করার ছিল না পরেরদিনই রিজাইন লেটার জমা দিয়ে বেকারের খাতায় নাম লেখালাম।
আমাদের প্রথম ছেলে সন্তান জন্ম নিলো আট মাস আগে—তার অভিমানের সুরে ঠোঁট বাঁকিয়ে কান্না করা, ফিক করে স্বর্গীয় হাসি হাসা, মিষ্টি গলায় দুর্বোধ্য শব্দের উচ্চারণ, নিষ্পাপ মায়া ভরা মুখ আমাকে অদৃশ্য এক মায়াজালে বন্দী করে ফেলেছে। বউ-বাচ্চা, মা-বাবাকে ছেড়ে বান্দরবান আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না সেজন্যই বাধ্য হয়ে চাকরিটা ছাড়তে হয়েছে।
চাকরী ছাড়ার পর অনেকেই অনেক রকম কথা বলত, সেসব গোনায় ধরতাম না। নীলিমার মাতৃকালীণ ছুটি শেষ হবার পর অফিসে জয়েন করার পর থেকে তাদের কথা আর সহ্য হচ্ছে না। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদেরকে নিয়ে কতজন কতরকম গবেষণা করে, কতরকম কথা যে বলে! দোতলার বারান্দা থেকে তাদের কথা স্পষ্ঠ শোনা যায়, “ছি ছি সোহান বউয়ের কামাই খায়। বউ চাকরি করে আর সে ঘরে বসে বাচ্চাকে ফিডার খাওয়ায়। মেয়ে মানুষ চাকরি করবে কেন? মেয়ে মানুষ থাকবে ঘরে। মেয়েটাকে খাটিয়ে মারল।” এরকম অসংখ্য কথা আমাকে শুনতে হয়। কেউ কেউ পথে দেখলে পেছন থেকে হাসা-হাসি করে। আজ বিকেল থেকে মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। নিশানকে কোলে নিয়ে বিকেলে বারান্দায় হাঁটছিলাম। নিচ থেকে কে যেন বলে উঠল “সোহানের তো মেয়ে হয়েই জন্মানো দরকার ছিল, কেন যে ছেলে হয়ে জন্মালো?” নীলিমা বাড়ি ফিরল রাত আটটায়। রাতে খাবার টেবিলে বসেই সে বুঝতে পারল আমার মন বিশেষ ভাল নেই। খাওয়া শেষে ঘরে যাবার পর নীলিমা বলল- “কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?” আমি কোন কথা বললাম না। নীলিমা আবারও বলল,
–কেউ কিছু বলেছে তাই না?
–আর কত সহ্য করা যায় বলো তো?
–মানুষ কি বলল না বলল তা নিয়ে এতো মাথা ঘামাও কেন? দু-বেলা না খেয়ে থাকলে কি ওরা এসে খাইয়ে দিয়ে যাবে নাকি? আর এমন তো না তুমি ইচ্ছে করে চাকরিটা ছেড়েছো। এসব নিয়ে একদম মন খারাপ করবে না বলে দিলাম।
–মানুষের কথা আর কতদিন সহ্য করা যায় বলো? তাছাড়া আমার কিছু একটা করা প্রয়োজন, তোমার একা একা খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
–ওমা তাই নাকি? আমি তাই বলেছি নাকি? কষ্ট তো করছো তুমি। এই যে সারাদিন বাবুকে রাখছো, খাওয়াচ্ছ, ঘুম পারাচ্ছ, জামা-কাপড় বদলে দিচ্ছ, আবার কাপড়-চোপড় ধুচ্ছ—এগুলো করা কি চারটি খানি কথা? এতো চিন্তা করোনা দেখবে কিছুদিনের মধ্যে ভাল একটা চাকরি তোমার হয়ে যাবে।
বিয়ের পর থেকে আমাদের মধ্যে তেমন বড় ধরনের কোন ঝগড়া-ঝাটি হয়নি। এই নিয়ে নীলিমা আমাকে প্রায়ই খোটা দিয়ে বসে। আমার সাথে ওর ঝগড়া করার খুব ইচ্ছা কিন্তু আমার সাথে নাকি ঝগড়া করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। সে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার আফসোসের কথা বলে, “কেমন একটা মানুষ বিয়ে করলাম? ঝগড়া করতে পারে না।” আমিও তখন উল্টো খোটা দেই, “তুমি খুব পারো বুঝি?” বারান্দায় কিছু কাপড় ছিল। ঘর থেকে বের হয়ে কাপড় নিয়ে এসে কাঠের আলমিরাতে তুলে রাখছিলাম। নীলিমা ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে ঢং করে বলল, “সারাদিন সংসারে সময় দিতে দিতে আপনার যে একটা বউ আছে সেই কথা মনে হয় একদম ভুলেই গেছেন। বউয়ের জন্যে একদম সময় নেই তাইনা?”
–আরে নাহ তাই হয় নাকি?
–এইতো সব ভুলে গেছ।
–কই নাতো! কি ভুললাম?
–কাল শুক্রবার, অফিস নেই, এই কথা তুমি ভুলে গেছ।
–ও আচ্ছা এই কথা।
বেশ কিছুদিন আগে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে সিনিয়র আইটি অফিসার পদে চাকরির জন্য ভাইবা দিয়ে এসেছিলাম। চাকরিটা আমার হয়ে গেছে। নীলিমা অফিস থেকে ফিরতেই নীলিমাকে নিয়ে চলে গেলাম ছাদে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “নীলিমা ব্যাংকের চাকরীটা আমার হয়ে গেছে।”
তখন রাত সাড়ে এগারোটা, আশে-পাশের বারান্দাগুলোতে তখনও আলো জ্বলছে। নীলিমা বাচ্চাদের মতন আনন্দে লাফাতে শুরু করল। সে যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেছে। আমি তাকে বাঁধা দেই না কিংবা তাকে বাঁধা দেয়ার কিইবা সাধ্য আমার আছে? চুপচাপ বসে থেকে তার সরল নিষ্পাপ মনের আনন্দ দেখতে থাকি, হঠাৎই আমার গাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে, আমি রুখবার চেষ্টা করি না। যার আনন্দ আমি দেখছি এ যে সেই নারী যে আমার সকল অপরাগতাকে মেনে নিতে বিন্দুমাত্র সংকোচ-বোধ করেনি, আমাকে সুখ নামের অমূল্য রত্নটি যে নিজের মন দিয়ে কিনে এনে দিয়েছে। আকাশে বৈশাখের মেঘেরা ডাকছে, নীলিমা আমার কাঁধে মাথা রেখে হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুল গেঁথে চুপচাপ বসে রইলো। ঝিরঝির বৃষ্টির জল গায়ে এসে পড়ছে। আমরা দুজন বসে আছি বৃষ্টির নিচে। আমি নীলিমার চোখের দিকে তাকাইনি অথচ আমি জানি—তার চোখে বৃষ্টির জল ছাড়াও কিছু জল জমে জমে পরিপূর্ণ হয়ে বৃষ্টির জলে মিশে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন পর আবারও নিয়মিত শার্ট-প্যান্ট ইন করে সকাল সকাল বাসা থেকে বের হচ্ছি। চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে নীলিমা-আমি একসাথেই অফিসে যাওয়া আসা করি। মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফিরতে আমার বেশ রাত হয়, সেদিন নীলিমাকে একা একাই বাড়ি ফিরতে হয়। নিশান এখন দাদা-দাদীর কাছে থাকে। নিশানের সাথে বাবা-মা’র সময় বেশ ভালোই কাটে। এখন সে কিছু কিছু শব্দ বলতে পারে। চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে পাড়া-পড়শি, আত্নীয়-স্বজনদের কানাঘুসা বন্ধ হয়েছে। সমাজের একদল মানুষের পরিবর্তন আজো এলো না। নারী-পুরুষকে ভিন্ন চোখে বিভক্ত করে তারা নিয়ম বেঁধে দিয়েছে, “নারীরা ঘরে থাকবে, সংসারের কাজ-কর্ম করবে। পুরুষ মানুষ রুজি-রোজগার করবে। সাংসারিক জীবনে উভয়ের অংশগ্রহণ তাদের কাম্য নয়।”
আমাদের বিয়ের বয়স পাঁচ বছর হতে চলল। নিশানের পর পরিবারের নতুন সদস্য যোগ হয়েছে সিমিন। সিমিনের জন্মের পর পরই নীলিমা চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। সংসার বাচ্চাদের দেখা শোনা নিয়ে সে এখন ভীষণ ব্যস্ত। মাঝে মাঝেই দরজা দিয়ে ডিম লাইট জ্বেলে নীলিমাকে মনে করিয়ে দিতে হয়, “মিসেস নীলিমা সারাদিন সংসারে সময় দিতে দিতে আপনার যে একটা জামাই আছে সে কথা বোধহয় একদম ভুলেই গেছেন। জামায়ের জন্যে একদম সময় নেই বুঝি?” নীলিমা লাজুক হাসি হেসে বালিশে মুখ লুকোয়। সিমিনটা এমন সময় ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ওঠে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা