শেষ থেকে শুরু

শেষ থেকে শুরু
আলমারি থেকে হলুদ রঙের শাড়িটা বের করে বিছানায় রেখে আমার স্ত্রী শ্রাবণীকে বললাম,
— তাড়াতাড়ি এই শাড়িটা পরে তৈরি হয়ে নাও।আর আলমারিতে একটা সবুজ রঙের শাড়ি আছে। এটা ভুলেও কখনো পরবে না। আমার মাথায় আসে না মানুষ সবুজ রঙের শাড়ি কিভাবে পরে। আর হ্যাঁ, চুলগুলো খোপা করবে। মুখে কোনো মেক-আপের দরকার নেই, ঠোঁটে কোনো লিপস্টিক লাগাবে না। আর চোখে মাসকারা কিংবা কাজল এই সব হাবিজাবি জিনিস একদম কিছুই দিবা না। তুমি সাজলে আর চোখে কাজল দিলে তোমাকে আলিফ লায়লার ডাইনীর মত দেখা যায়! আমার কথা শুনে শ্রাবণী শুধু আমার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো। আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ অন্য রুমে চলে গেলাম। ঘন্টাখানেক পর শ্রাবণী আসলো। শ্রাবণী সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। মুখে হালকা মেক-আপ, ঠোঁটে গোলাপী রঙের লিপস্টিক, চোখে গাঢ় করে কাজল দেওয়া আর খোলা চুলে শ্রাবণীকে খুব ভয়ংকর রকম সুন্দর লাগছে। আমি মুচকি হেসে শ্রাবণীকে বললাম,
— আমি যদি বলতাম কাল আমার কিনে আনা সবুজ রঙের শাড়িটা পরো, একটু সাজগোজ করো, চোখে কাজল দাও.. তুমি সেটা কখনোই করতে না কারণ আমি যা বলি তুমি ঠিক তার উল্টোটাই করো। তাই আজ উল্টো করে বললাম আর তুমি ঠিক করে করলে!! শ্রাবণী রাগে দাঁতের সাথে দাঁত চেপে বললো,
– আমি যাবো না বাহিরে ঘুরতে। আমি আবারও হেসে বললাম,
— তোমার কি মাথা খারাপ নাকি! আমি এই গরমে বাহিরে ঘুরতে যাবো! আসলে তোমায় কখনো সাজতে দেখি নি এমন কি বিয়ের দিনও না। তাই আজ দেখে নিলাম। আমার দেখা শেষ। এখন চাইলে তুমি মুখ থেকে আটা ময়দা তুলে স্বাভাবিক হতে পারো। আমার কথা শুনে শ্রাবণী পাশে থাকা টিভির রিমোটটা ভেঙে অন্য রুমে চলে গেলো। শ্রাবণীকে কোথাও দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারলাম শ্রাবণী ছাদে গেছে। আমি দু’কাপ কফি বানিয়ে ছাদে গেলাম। ছাদের কার্ণিশে হাত রেখে শ্রাবণী দূরে তাকিয়ে আছে। আমার গলার শব্দ শুনে শ্রাবণী আমার দিকে তাকাতেই আমি ওর দিকে কফির মগটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
— নাও, কফি খাও। শ্রাবণী বিরক্ত হয়ে আমায় বললো,
– আমি পৃথিবীতে অল্প কয়েকজন অমানুষ দেখেছি তার মধ্যে আপনিও একজন। আপনাকে সাকিব বলেছিলো আমরা দুইজন দুইজনকে ভালোবাসি তবুও আপনি আমায় বিয়ে করতে রাজি হলেন। ছিঃ! দেখলেন মেয়ে সুন্দর আর অমনি লোভ সামলাতে পারলেন না! আমি এই বিষয়ে কিছু না বলে শ্রাবণীকে বললাম,
— কফিটা খেয়ে দেখো খুব ভালো হয়েছে। আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। শ্রাবণী কফিটা আমার মুখে ছুঁড়ে মেরে চলে গেলো। আমি দূরে তাকিয়ে রইলাম। অফিসের বস ফাইলটা আমার হাতে দিয়ে মুখটা মলিন করে বললেন,
– পিয়াস সাহেব; শেষমেশ আমাদের ছেড়ে চলেই যাবেন? আমি মৃদু হেসে বললাম,
— আপনাদের ছেড়ে তো যাচ্ছি না। শুধু বদলি হচ্ছি। বস কৌতূহল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনার বাসা এইখানে। সকল আত্মীয় স্বজন এইখানে থাকে। তবুও আপনি এইখান থেকে বদলি হচ্ছেন কেন?
আমি চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বসকে বললাম,
— তেমন কিছু না স্যার। এই শহরটায় খুব একঘেয়েমি লাগছে। তাই বদলি নিচ্ছি অফিস থেকে বাসায় এসে কলিংবেল বাজাতেই আমার খালাতো ভাই লিমন দরজা খুললো। আমি লিমনকে দেখে হেসে বললাম,
– কি রে, তুই আসলি কখন? ড্রয়িংরুমে তাকিয়ে দেখি মা, খালা, মামা ওরা সবাই এসেছে। আমি সবাইকে সালাম দিলাম। তারপর মাকে বললাম,
— মা, আমি ফ্রেশ হয়ে তারপর আসছি। গোসল শেষ করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কাজের মেয়েটাকে বললাম টেবিলে খাবার দিতে। ভাত যখন মুখে তুলবো তখনি মা আর আমার দুই খালা আমার কাছে এসে বসলো । আমি মুচকি হেসে মাকে বললাম,
— দুপুরে খাই নি তো তাই খুব ক্ষুধা পেয়েছিলো। তা, তোমরা খেয়েছো মা? মা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– গলা দিয়ে ভাত নামলে তো খাবো। আমি বুঝি না তোর গলা দিয়ে কিভাবে ভাত নামছে? এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো। যেখানে আমাদের সব মান ইজ্জত শেষ হয়ে গেলো সেখানে তুই বসে বসে ভাত গিলছিস। শেষে কি না একটা বেশ্যাকে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসলাম? আমি মার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— শ্রাবণীকে নিয়ে বাজে কথা বলো না মা। খালা রেগে গিয়ে বললো,
– বেশ্যাকে বেশ্যা বলবে না তো কি বলবে?কেন, তুই জানিস না তোর বউয়ের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে? ছিঃ ছিঃ না জানি আরো কত ছেলের সাথে এমন করেছে! এমন সময় মামা ভিতর থেকে এসে বললো,
– এই মেয়ের জন্মের ঠিক নেই তাই এমন করেছে। তুই তোর বউকে কিছু বলবি না? না, আর সহ্য করা যায় না। আমি মামার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— কি বলবো আমি আমার বউকে? যেখানে আমার চরিত্রের ঠিক নেই সেখানে আমি আমার বউয়ের চরিত্র নিয়ে কিভাবে প্রশ্ন তুলবো? যখন আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ড কণা পালিয়ে গিয়েছিলাম তখন তোমরা ৫ দিন পর আমাদের ময়মনসিংহ থেকে ধরে নিয়ে এসেছিলে। আমি তোমাদের সবার কাছে অনুরোধ করেছিলাম আমার সাথে কণাকে বিয়ে দিতে। কিন্তু তোমরা কেউ রাজি হও নি। আমি তোমাদের পা ধরে বলেছিলাম আমি মেয়েটার সাথে উল্টো পাল্টা অনেক কিছু করে ফেলেছি এখন বিয়ে না করলে মেয়েটাকে ঠকানো হবে কিন্তু তোমরা আমার কোনো কথা মানো নি। বরং হাসতে হাসতে বলেছিলে ছেলে মানুষ টুকটাক এমন করেই। তোমাদের জন্য শেষে কণা আর ওর পরিবার কোথায় হারিয়ে যায় জানিনা। আমি আর ওদের খুঁজে পেলাম না। আর মা আমায় ইমোশনালি ব্লেক-মেইল করে শ্রাবণীর সাথে বিয়ে ঠিক করে। শ্রাবণী একজনকে বিশ্বাস করে ঠকেছে আর আমি একজনের বিশ্বাসকে ঠকিয়েছি। হিসাব করে দেখো আমি শ্রাবণীর চেয়েও বেশি অপরাধী নিজের রুমে এসে দেখি শ্রাবণী অনবরত কান্না করছে। আমি ওর পাশে বসে বললাম,
— সাকিব যদি আমায় সরাসরি এসে বলতো তোমাদের রিলেশন আছে আমি কখনোই তোমায় বিয়ে করতাম না। কিন্তু ও আমার ইনবক্সে তোমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওটা পাঠিয়েছিলো। যে ছেলে তার ভালোবাসার মানুষের অন্তরঙ্গ ভিডিও অন্য একজন অচেনা মানুষকে দিতে পারে; সে আর যাই হোক ভালোবাসতে পারে না। শ্রাবণী মাথা নিচু করে চুপ হয়ে আছে। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,
— তোমার পিছনে ফেলে আসা ২২ বছর জীবনে কখন কী হয়েছে না হয়েছে, এই বিষয়ে কোনোদিন আমি তোমায় কিছু বলবো না। শুধু খেয়াল রেখো সামনে যেন কোনো ভুল না হয়। শ্রাবণী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি খারাপ মেয়ে জেনেও আমায় আপনি বিয়ে করলেন? আমি মৃদ্যু হেসে বললাম,
— খারাপ ছেলে তো তাই খারাপ মেয়েকে বিয়ে করেছি। এখন তাড়াতাড়ি সব কিছু গুছিয়ে নাও। হুট করেই আমার নেত্রকোনা বদলি হয়ে গেছে । তাই আমরা এখন নেত্রকোনা চলে যাবো। আর হ্যাঁ, আলমারিতে গোলাপী রঙের একটা শাড়ি আছে। এই শাড়ি ভুলেও পরবে না। আমার মাথায় আসে না মেয়েরা কিভাবে গোলাপী রঙের শাড়ি পরে?
শ্রাবণী আলমারি থেকে গোলাপী রঙের শাড়িটা বের করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোমার হুট করে বদলি হয় নি। তুমি এই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছো যেন তোমার বউকে কেউ কিছু বলতে না পারে!
বাসের জানালা দিয়ে শ্রাবণী বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে আর পিয়াস ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। শ্রাবণী ভেবেছিলো পিয়াসকে বিয়ে করে ওর জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। আর এখন সে ভাবছে, ” শেষ থেকে আবার সব কিছু শুরু হয়েছে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত