অর্ধাঙ্গী

অর্ধাঙ্গী
— বাবা?
— হ্যাঁ মা বল।
— ও বসার ঘরে বসে আছে।
— আচ্ছা চল।
ইরা ওর বাবা সাদমান রহমানকে সাথে করে বসার ঘরের দিকে রওনা হলো। খুব বেশিই ভয় করছে ওর। না জানি বাবা বিষয়টা কিভাবে নেবে! তারপরও শেষ ভরসা হিসেবে ভয় হলেও করতেই হচ্ছে। ইরার বাবাকে দেখেই রাদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে বিনয়ী ভাবে সালাম দিলো। সাদমান রহমান সালামের উত্তর দিয়ে রাদকে বসতে বলে নিজেও বসে গেলেন। বাবার পেছনেই সোফা ধরে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইরা আর ওর পাশেই ওর মা৷ রাদের ভয় হচ্ছে খুব। তারপরও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য নিজেকে গুছিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
— তা বাবা কী নাম তোমার?
— জ্বি, রাবিয়াত রহমান রাদ।
— পড়াশোনা?
— সরকারি কলেজ থেকে পদার্থ নিয়ে পড়াশোনা করছি এবার চতুর্থ বর্ষে।
— পাশাপাশি কিছু করো?
— জ্বি, তিনটা টিউশনি করাই।
— বাবা কি করেন?
— দিনমজুর।
— পরিবারে কে কে আছেন?
— আমি আব্বু আর আম্মু।
— তোমার কি মনে হয় যে তুমি আমার মেয়েকে সুখী রাখতে পারবে?
— দেখুন, আসলে সুখ টা মনের। আপনার মেয়ে যদি অল্পতেই তুষ্ট হয় তো সে সুখী হবে তাছাড়া আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো ওকে সুখী রাখার।
— তোমাদের ইচ্ছে কী?
— বাবা, আমাদের ইচ্ছে হলো রাদ একটা চাকরি পেলেই তারপর বিয়ে করবো ততোদিন শুধু আমার যেন কিছু না হয় তাই তোমাকে বলা। কথার মাঝে হুট করেই ভয়কে উপেক্ষা করে ইরাই কথাটি বলল।
— আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা জব করার। কারণ আমার বাবা মা অনেক কষ্ট করে বড় করছেন আমাকে। আমি খুব তাড়াতাড়ি তাদের এত কষ্ট থেকে রেহাই দিতে চাই।
— সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু বিয়ের কথা কি ভেবেছো?
— জব পেলে তারপর!
— দেখো বাবা,
তুমি যখন জব পেয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলবে তখন তোমার বিয়ে করা মানে তুমি শুধুই তোমার প্রয়োজন মেটাতে বিয়ে করলে কিন্তু প্রকৃত অর্থে সহধর্মিণীর মানেটা কিন্তু বিস্তর। যে তোমার বিপদে আপদে সহ সর্বাবস্থায় পাশে থাকবে সেই তোমার অর্ধাঙ্গী। বুঝলে?
— জ্বি।
— ইরা তোমার কি মনে হয় তুমি কি ওর বাসায় থেকে কষ্ট সহ্য করে এমন সময়ে ওর পাশে থাকতে পারবে?
— পারবো বাবা।
— রাদ?
— জ্বি….
— তোমার বাবা-মাকে বলিও আমার সাথে কথা বলে যেতে। আর খুব দ্রুতই তোমাদের বিয়েটা দিয়ে দিতে চাই কেমন?
— জ্বি আচ্ছা।
— তাহলে তোমার বাবা-মাকে পাঠিয়ে দিও জলদি কেমন?
— জ্বি।
সাদমান রহমান বসা থেকে উঠে ঘরে চলে গেলেন। এদিকে অবাক হয়ে বসে আছে রাদ। এটা শুধুই কি মজা না কি বাস্তব সেটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে ওর। এদিকে বাবার এমন সিদ্ধান্তে ইরা নিজেও খুব অবাক হয়েছে। এত সহজে ওর বাবা মেনে নিলেন সবকিছু! ইরা আর রাদের সম্পর্কটা প্রায় তিন বছরের। দুজনেই খুব ভালোবাসে একে অপরকে। ইরার ফ্যামিলির অবস্থা ভাল হলেও রাদের অবস্থা একদম খারাপ। বাবা কোন রকমে সংসারটা চালায় আর ও টিউশনি করে নিজের পড়াশোনাটা চালিয়ে নিচ্ছে ও।
তবে ছাত্র হিসেবে যথেষ্ট ভাল রাদ শুধু কোচিং করা আর ভাগ্যে না থাকায়ই হয়তো কোনো পাবলিকে চান্স আসেনি।
দিন যতই যাচ্ছিল ওদের ভয়টাও বাড়ছিলো। কবে না কবে ইরার বিয়ে হয়ে যায় সেই ভয়। এদিকে ছাত্র অথবা বেকার, পরিবারের অবস্থাও ভাল না এমন ছেলের সাথে একটা সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ের বিয়ে হওয়াটা অনেকটাই আকাশ কুসুম ভাবনা। অনেক ভেবে চিন্তেও যখন ওরা কোনো উপায়ই পাচ্ছিল না তখন ইরা রাদকে বলেছিল যেন ও ওর বাবার সাথে একটা বার হলেও দেখা করে। রাদ রাজি হয়নি প্রথমে। এমন কিছুই নেই ওর যেটা নিয়ে ইরার বাবার সামনে দাঁড়াবে। তবুও ইরা জোর করেই ওকে ডেকে এনেছিল । রাদ ভেবেছিলো ইরার বাবা হয়তো ভাল ভাবেই অপমান করে তাড়িয়ে দেবেন। তবে এমন কথা শুনে খুব বেশিই অবাক হয়েছে ও। একটা গরীব, বেকার ছেলের হাতে হয়তো একটা পাগল বাবাও এত সহজে মেয়ে তুলে দেবেন না। শুধুমাত্র দুই পরিবারের উপস্থিতিতে সাদামাটা ভাবেই ওদের বিয়েটা হয়ে গেল৷ সাদমান রহমান রাদের হাতটা ধরে ইরাকে উদ্দেশ করে বললেন,
— তোমরা যেমনটা করবে ঠিক তেমনটাই ভোগ করবে বাকি জীবন। এখন বিষয়টা তোমাদের যে, তোমরা কী করবে। কারণ তোমাদের কর্মের উপরই তোমাদের বাকি জীবন নির্ভর করবে। ঘোরের মাঝেই এভাবে হুট করে বিয়ে হয়ে গেল ওদের। ইরার মা ওর বাবাকে বললেন,
— এটা কি তুমি ঠিক করলে?
— কোনটা?
— এইযে! একটা গরিব পরিবারের বেকার প্রায় ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিলে। ইরার কি আমরা ভাল ঘরে বিয়ে দিতে পারতাম না?
— তা অবশ্যই পারতাম। আমরা চাইলেই ওর বিয়েটা কোনো এক বিশাল ব্যবসায়ীর ছেলে বা ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার ছেলের সাথেও দিতে পারতাম। তবে এখানে কথাটা আসে সুখ আর ভালোবাসার বুঝলে তো?
— তোমার কি মনে হয় ওরা এমন কষ্টের জীবনে সুখী হবে?
— সেটা ওরাই ঠিক করবে।
— তাহলে ওদের পরীক্ষার মাঝে কেন ফেললে?
— তুমি কি ভুলে যাচ্ছ রেহানা যে, তোমার বাবা কিন্তু আমার হাতে তোমাকে এরচেয়েও খারাপ অবস্থায় তুলে দিয়েছিল?
আমাদের ছয়জনের সংসার ছিল তখন। বাবা পরের জমিতে কামলা খেটে সংসার চালাতেন। আমার বড় ছিল তিনটা বোন। আমরা এক ঘরে বড় হয়েছিলাম সবাই। অথচ তোমার বাবা এমন অবস্থা শর্তেও আমার সাথে তোমার বিয়ে দিয়েছিলেন। তোমার কি মনে হয়? তোমার বাবা পাগল ছিলেন?
— না, তা না।
— তাহলে? রেহানা, আমার ছেলেটাকে খুব পছন্দ হয়েছে। খুব স্পষ্টভাষী ছেলেটা। পরিবারের অবস্থা, বাবার ছোট কাজ করাকেও ছেলেটা নির্দিধায় বলে দিলো অথচ আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাবার কাজ ছোট হলে নিজেরাই হেয় করে। আর আমি আগেই খোঁজ নিয়েও দেখেছি ছেলেটা যথেষ্ট ভাল। খুব মেধাবী, বাবাকেও কাজে সাহায্য করে৷ কষ্ট করে টিউশনি করেই পড়ার খরচ চালায়। আমি নিশ্চিত ছেলেটা ভবিষ্যতে ভাল কিছু করবে দেখিও। .সাদমান রহমানের কথা ঠিকই ফলে গেল। শত কষ্টের অবসান ঘটিয়ে রাদ বিসিএসে টিকে গেল। সামনের জীবনটা রঙিন এখন! .রাদ আর ইরা দু’জনই ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলো। সাদমান সাহেব বললেন,
— আমিও আমার শ্বশুরকে জড়িয়ে ধরে এভাবেই কেঁদেছিলাম। আমারও কিছুই ছিল না। তারপরও উনি আমার হাতে তার মেয়েকে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ছেলেটা শিক্ষিত মানেই সে একদিন কিছু না কিছু অবশ্যই করবে। আমি তো শুধু আমার মেয়েকে তুলে দিয়ে তোমার চলার পথের সঙ্গী করে দিলাম৷ আমিও তোমাদের মতোই খুব কষ্ট করেছিলাম৷ ওনার আস্থা রাখতে খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। তার ফলই আমি একজন ডাক্তার। আমি ওনার কথাকে শ্রদ্ধা করি আর বিশ্বাসও করি, যে ভালোবাসা সত্যি হলে সব পরিস্থিতিই সামলে নেয়া যায়। তোমাদের উপর আমার এতটুকু আস্থা ছিল আর তোমরা সেটা রেখেছো। আর আমার এমন সময়ে একমাত্র ভরসা ছিল রেহানা। আমাকে সব সময় মেটালি সাপোর্ট দিতো। আমি ভেঙে পড়লে ও খুব সুন্দর করে আমাকে মোটিভেট করতো যার ফলে সকল বাঁধাই আমি পেরিয়ে গেছি। অর্ধাঙ্গী হলো এটাই। যে তোমার এমন সময়েও পাশে ধৈর্যের সাথে থাকে। এবার বুঝলে?
— জ্বি। সাদমান রহমান মুচকি হেসে আবার বললেন,
–প্রতিটা ছেলের জীবনেই সবচে সেরা উপহার হলো একজন যোগ্য অর্ধাঙ্গী পাওয়া আর আমি শুধু সেটাই উপহার দিয়েছি।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত