জনম জনম তোর হবো

জনম জনম তোর হবো

ক্যামেলিয়া ব্লেড হাতে বসে আছে। অল্প অল্প কাঁপছে। ব্লেড দিয়ে হাতের শিরাটা কাটার চেষ্টা করছে, হচ্ছে না। দুবার পোচ মেরেছে। কিন্তু আলতো করে শুধু চামড়ার উপর দিয়ে চলে গেছে। সাহস করে কাটতে পারছে না। জীবন দেয়া এতো কঠিন কেন?

ও ভেবেছিল বিষ খাবে বা গলায় দড়ি দিবে। কিন্তু ওগুলো বাদ দিল শেষ পর্যন্ত। বিষ ও জোগাড় করতে পারেনি আর গলায় দড়ি দেয়াটা ওর কাছে মনে হলো ও পারবে না। এখন দেখছে ব্লেড দিয়েও কাটতে পারছে না। কিন্তু ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। অপারেশন করবে? কেন করবে? করে কি হবে? হাসনাত তো নেই সাথে! ও থাকলে, যদি হাতটা ধরে থাকতো অপারেশন থিয়েটারে, ও করতো। ওর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করতো। এখন হাসনাত নেই, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও নেই।

একটা লম্বা শ্বাস নিল ক্যামেলিয়া। ব্লেডটা জায়গামতো বসালো। চোখ বন্ধ করে দেবে ধরলো চামড়ায়। একটু গেথে গেল ব্লেডের কোনা। ঘ্যাচ! টান দিল সজোরে। চিৎকার বেরোলো একটা। চিৎকার পুরোটা শুনতে পারলো না। তার আগে জ্ঞান হারিয়ে গেল। জ্ঞান হারানোর আগে সে যেন দেখলো সামনে হাসনাত দাঁড়িয়ে। হাসছে। হাসলে ওকে এতো সুন্দর লাগে!

২.
সেদিন বিকেলের ঘটনা।
হাসনাত বসে আছে লেকের ধারে। অপেক্ষা করছে ক্যামেলিয়ার জন্য। ক্যামেলিয়ার দেয়া সময়ের প্রায় আধ ঘন্টা পার হয়ে গেল। মেয়েটা সাধারণত এতো দেরী করে না। কোনো সমস্যা হলো না তো? হাসনাত ফোন বের করে কল দিতে লাগলো। ফোন বাজছে, কেউ ধরছে না। হাসনাত আরও দুবার ফোন দিল কিন্তু কেউ ধরলো না। হাসনাত ফোনটা পকেটে রাখলো। তাকিয়ে থাকলো লেকের স্থির পানির দিকে।

আরও মিনিট পাঁচেক পর ক্যামেলিয়া এলো।
“কোথায় ছিলে এতোক্ষন?” জিজ্ঞাসা করলো হাসনাত।
“ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।” পাশে বসতে বসতে বললো ক্যামেলিয়া। ক্যামেলিয়ার মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত। চোখের নিচে একটু কালি আর ফোলাফোলা। কেঁদেছে নাকি? হাসনাত ধরতে পারলো না। জিজ্ঞাসা করলো, “শরীর খারাপ?”
“না।” বললো ক্যামেলিয়া। “একটা কথা বলি?” জিজ্ঞাসা করলো ও।
“হু বলো।” বললো হাসনাত।
“আমার এখানে বসতে ভালো লাগছে না। অন্য কোথাও বসি?”
“কোথায় বসবা?” জিজ্ঞাসা করলো হাসনাত।
“তাও ঠিক! বসার মতো তেমন জায়গা তো নেই!” বলে ক্যামেলিয়া চুপ হয়ে গেল। অনেকক্ষন দুজন চুপচাপ। হাসনাতের কেমন জানি লাগছে। ক্যামেলিয়ার কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? হঠাৎ হাসনাতের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ক্যামেলিয়ার মন ভালো করে দেয়া যাবে এক্ষুনি, ভাবলো হাসনাত। “ক্যামি।” ডাকলো হাসনাত।
“হু বলো।” বললো ক্যামেলিয়া।
“বাসায় আমাদের কথা বলেছি। সবাই রাজি। তোমার পরিবারের সাথে কথা বলতে চায় বাবা মা।” কথাটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠলো ক্যামেলিয়া। চোখ এড়ালো না হাসনাতের। ক্যামেলিয়ার চোখেমুখে কোনো আনন্দ দেখতে পেল না সে। ক্যামেলিয়া খুশি হয়নি? ক্যামেলিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে শুধু বললো, “ও।” আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ দুজনে। হাসনাতের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ভেবেছিল, ক্যামেলিয়া খুশি হবে। কিন্তু হয়নি। ক্যামেলিয়া এবার নীরবতা ভাঙলো, “হাসনাত, তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।”
“বলো।” বললো হাসনাত।
“আমি তোমাকে বিয়ে করবো না। মানে করতে পারবো না।” লেকের জলে তাকিয়ে বললো ক্যামেলিয়া। হাসনাতের মনে হলো কেউ ওর মাথার ভেতর বোমা ফাটালো। দু চোখ বড়বড় করে তাকালো ক্যামেলিয়ার দিকে। ক্যামেলিয়া নির্বিকার। ওর যেন কোনো যায় আসছে না। হাসনাত জিজ্ঞাসা করলো, “কি বললে?” “বললাম আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আর আজকেই আমাদের শেষ দেখা।” হাসনাত তাকিয়েই থাকলো। “তুমি কি মজা করছো?” বললো হাসনাত। “না।” হঠাৎ যেন হাসনাতের মাথায় রাগ উঠে গেল। ক্যামেলিয়ার হাত ধরে ঝাকি দিয়ে নিজের দিকে ঘোরালো ওকে। “তুমি মজা করছো?” জোরে জিজ্ঞাসা করলো হাসনাত। ক্যামেলিয়া একহাত দিয়ে হাসনাতের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো, “না আমি মজা করছি না। আর তুমি আমার সাথে এরকম করতে পারো না।” হাসনাত কি যেন ভেবে একেবারে চুপ হয়ে গেল। তাকালো লেকের দিকে। আনমনে জিজ্ঞাসা করলো, “আমাদের আর দেখা হবে না?”
“হতেও পারে। আমি তো আর শহর ছাড়ছি না, তুমিও ছাড়ছো না। এক শহরে যখন থাকছি, রাস্তায় দেখা হতেই পারে!” হাসনাত ভাবলো বলে, ও এরকম দেখার কথা বলছে না। কিন্তু বললো না শেষ পর্যন্ত। ক্যামেলিয়া তাকালো আড়চোখে হাসনাতের দিকে। হাসনাত লেকের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন পানি ভেদ করে তলা পর্যন্ত দেখতে পারছে! ক্যামেলিয়া ডাকলো, “হাসনাত।” “হু,” সাড়া দিল হাসনাত। “উঠলাম আমি।”
“আচ্ছা।” নির্বিকার ভাবে বললো হাসনাত। তাকালো না ক্যামেলিয়ার দিকে। ক্যামেলিয়া উঠে দাঁড়ালো, হাসনাত কিছু বললো না। ক্যামেলিয়ার কেমন জানি কান্না পাচ্ছে। ও কিছুক্ষণ হাসনাতের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। হাসনাত ফিরে তাকালো না ক্যামেলিয়ার দিকে। ওর মনে হতে লাগলো যার সাথে এতোক্ষন বসেছিল ও ক্যামেলিয়া না, অন্যকেউ। অচেনা কেউ। হাসনাত তাকিয়ে থাকলো একদৃষ্টে। চোখে একরাশ বিষন্নতা।

৩.
ক্যামেলিয়া নিজের রুমে লাইট বন্ধ করে শুয়ে ছিল। চোখ ভেজা। বুক কেমন ভারভার লাগছে। ছোটোবোন মিনু দুবার ডেকে গিয়েছে। ও ওঠেনি। ওর কিছু ভালো লাগছে না। ও শুধু ভাবছে ওর সিদ্ধান্ত কি ঠিক হলো? হাসনাত কে কোনো কিছু না জানানো, নিজেই সম্পর্কটা ভেঙে ফেলা- ঠিক হলো? বুঝতে পারছে না ও। অনেক কিছু বুঝতে পারছে না!

হাসনাত একবারও জিজ্ঞাসা করেনি কি হয়েছে কেন এসব বলছে। আচ্ছা, হাসনাত এমন কিছু বললে কি ক্যামেলিয়া জিজ্ঞাসা করতে পারতো? জিজ্ঞাসা করার মানসিকতা থাকতো? ক্যামেলিয়া বুঝতে পারছে, না থাকতো না। ধাক্কাটা কেমন লেগেছে হাসনাতের, একটু হলেও বুঝতে পারছে। বরং ভালোই হয়েছে হাসনাত কিছু জিজ্ঞাসা করেনি বা পেছন থেকে ডাকেনি। জিজ্ঞাসা করলে বা ডাকলে ও পারতো না নিজেকে সামলাতে।

মিনু আবার এসে টোকা দিল দরজায়, “আপু?” ক্যামেলিয়া চোখ মুছলো। বললো, “কি হয়েছে?”
“দরজা খোল।”
“কেন?” জিজ্ঞাসা করলো ক্যামেলিয়া।
“বাবা ডাকছে। অরু আপু এসেছে।” বললো মিনু। ক্যামেলিয়া অরুর নাম শুনে চমকে উঠলো।
“অরু! এসময় কেন?” ক্যামেলিয়া বিছানা থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বললো।
“জানি না। বাবার সাথে আপু কি যেন বললো তখন থেকে বাবা মায়ের মুখ ভার।” বললো মিনু। ক্যামেলিয়া থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনু আবার বললো, “জলদি আয় আপু।”

আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে আসছি।” বললো ক্যামেলিয়া। মিনু চলে গেল। ক্যামেলিয়া বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষন নিজেকে আয়নায় দেখলো। চোখে মুখে পানি ছিটালো। দুদিনে চোখের নিচে কতো কালি পড়েছে। ও ভাবছে, শুধু ভাবছে। হাসনাতের কতো স্বপ্ন ছিল ওর সাথে। একটা পরিবারের স্বপ্ন। হাসনাত, ও আর ওদের সন্তান। কিন্তু ক্যামেলিয়া হাসনাত কে বলতে পারেনি ওর কথা, বলতে পারেনি ভুল হয়ে গিয়েছে যে ভুল শোধরানো যায় না।

ক্যামেলিয়া গেল ড্রয়িংরুমে। অরু বসে আছে। অরুর সামনে ক্যামেলিয়ার বাবা মা। সবার মুখ থমথম করছে। ক্যামেলিয়ার বাবার হাতে কাগজ। ক্যামেলিয়া কাগজের দিকে তাকিয়ে আবার অরুর দিকে তাকালো। অরু মুখ নামিয়ে ফেললো। ক্যামেলিয়ার বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, “ক্যামি, অরু যা বলছে তা সত্যি?”
ক্যামেলিয়া স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো, “কি বলছে বাবা?”
“তুমি বুঝতে পারছো না কি বলছে?” বললেন উনি। ক্যামেলিয়ার মা মাথা নিচু করে আছেন, গাল ভিজে চকচক করছে।
ক্যামেলিয়া কিছু বললো না। “কি হলো? চুপ করে আছো কেন?” একটু জোরে বললেন ক্যামেলিয়ার বাবা।
“হ্যা বাবা সত্যি।” ক্যামেলিয়ার বাবা মা দুজনেই তাকালেন ক্যামেলিয়ার দিকে। সবাই চুপ করে আছে। গাঢ় নীরবতা। অরুর অস্বস্তি লাগছে, কিন্তু না বলে।উপায় ছিল না। ক্যামেলিয়ার বাবা কিছুক্ষন পর বললেন, “ডাক্তার কি বলেছে?”
“উপায় নেই। অপারেশন করতে হবে।” মাটির দিকে তাকিয়ে বললো ক্যামেলিয়া।
“হাসনাত জানে?”
“না।” বললো ক্যামেলিয়া। “ওকে জড়াতে চাইনি আমি।” বাবা মা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলেন। হাসনাত আর ক্যামেলিয়ার সম্পর্কের কথা জানেন ওনারা। “কেন বলোনি?” জিজ্ঞাসা করলেন ওর বাবা। “ভেবেছি যদি ও মেনে না নেয়।” বললো ক্যামেলিয়া। সবাই আবার চুপ করে থাকলো। ক্যামেলিয়ার মা একটা কথাও বলেননি। এবার ক্যামেলিয়াই প্রথমে বললো, “বাবা যখন জেনেই গেছো তখন আর লুকিয়ে লাভ কি? কিন্তু এখন আর আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। এখন আমি যাই, পরে সব বলবো।” বলেই ক্যামেলিয়া চলে গেল একছুটে নিজের রুমে। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে রইলো। তাকিয়ে থাকলো ক্যামেলিয়ার যাওয়ার রাস্তায়।

৪.
ক্যামেলিয়ার চিৎকার শুনে ছুটে এলেন ওর মা, বাবা আর বোন। “ক্যামি ক্যামি” বলে জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন ওর মা বাবা। কেউ দরজা খুলছে না দেখে ধাক্কা দিতে লাগলেন দরজায়। ছিটকিনিটা ভেঙে গেল। ঘরে ঢুকে হতভম্ব সবাই। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কিছুক্ষনের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন ক্যামেলিয়ার বাবা। এরপর ছুটে গিয়ে মেয়ের মাথা কোলে তুলে নিলেন। ওর মা ওর হাত বেধে দিল। রক্ত থামানো যাচ্ছে না। “মিনু তাড়াতাড়ি ফোন দে এম্বুলেন্সে।” মিনু ছুটে গেল শোনামাত্র। ঘরের ডায়েরি থেকে খুজে খুজে বের করলো কাছের হাসপাতালের নাম্বার। জলদি আসতে বললো। ওরা বললো পাঁচ মিনিট লাগবে। মিনু কি মনে করে ফোন দিল হাসনাতকে। নাম্বারটা লেখা ছিল ডায়েরিতে। দুবার বাজতেই ফোন ধরলো হাসনাত।
“হ্যালো।”
“হ্যালো, ভাইয়া? আমি মিনু।” কাঁপছে মিনুর গলা।
“হ্যা মিনু বলো। কি হয়েছে? এরকম শোনাচ্ছে কেন গলা?” হাসনাত উদ্বিগ্ন গলায় বললো।
“ভাইয়া আপু…” মিনু শেষ করতে পারলো না কথা, কেঁদে ফেললো।
“কি হয়েছে আপুর?” হাসনাত ভয় পেয়ে গেলো।
“আপু হাত কেটেছে, হাসপাতালে নিতে হবে। আপনি আসুন জলদি।”
“আমি আসছি এখনই…” বলে হাসনাত ফোন কেটে দিল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

এম্বুলেন্স আসার কিছুক্ষন পর হাসনাতও আসলো। এম্বুলেন্সে ততোক্ষনে ক্যামেলিয়াকে ওঠানো হয়ে গেছে। অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। হাসনাতকে দেখে ক্যামেলিয়ার বাবা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। হাসনাত কিছু বলতে গিয়েও বললো না। “তুমি মিনুকে নিয়ে আসো হাসপাতালে।” বলে ক্যামেলিয়ার বাবা আর মা ভেতরে বসলেন। এম্বুলেন্স ছুটে চললো। হাসনাত আরেকটা রিক্সা ডেকে মিনু কে নিয়ে চললো।

৫.
ক্যামেলিয়া অপারেশন থিয়েটারে। বাইরে অপেক্ষা করছে ওর বাবা, মা, বোন আর হাসনাত। ওর বাবার জামা রক্তে ভেজা। মেয়েকে কোলে করে এম্বুলেন্সে তুলেছেন তিনি। ক্যামেলিয়ার বাবা হাসনাতের দিকে তাকালেন, “তোমাদের কি হয়েছে?”
“ও আজই আমার সাথে ওর সম্পর্কটা ভেঙে ফেলেছে।” বললো হাসনাত। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ওর বাবা। “কেন?”
“আমি জানি না। আমাকে বলেনি। শুধু বলেছে ও আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না।” বললো হাসনাত।
“তাহলে তুমি কিছু জানো না?” বললেন ওর বাবা।
“না তো। কেন কি হয়েছে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো হাসনাত।
“ছোটোকালে ওর জরায়ুতে একটা সিস্ট হয়েছিল। ব্যাথা করতো খুব। অপারেশন করিয়ে ঠিক করা হয়। তখনই আমাদের বলা হয়েছিল বড় হয়ে যদি আবার কোনো সমস্যা হয় তবে আপনার মেয়ে মা হতে পারবে না কখনও। কিছুদিন আগে ওর আবার পেটে ব্যাথা হচ্ছিল। ও কাউকে বলেনি। ও নিজে ওর বান্ধবীর সাথে হাসপাতালে যায়। ডাক্তার দেখায়। টেস্ট করিয়ে জানে সিস্ট আর নেই। ছোটোখাটো একটা টিউমার হয়ে গেছে। এটা অপারেশন করা লাগবে। আর এবার সে তার মাতৃত্বের ক্ষমতা পুরোপুরি হারাবে। ও হয়তো ভেবেছিল, তুমি যদি জানতে পারো যে ও মা হতে পারবে না কখনও তাহলে তুমি ওকে ছেড়ে দেবে। তাই নিজেই ভেঙে ফেলেছে সম্পর্কটা।” হাসনাত শুধু শুনে গেলো ক্যামেলিয়ার মায়ের কথা। এতোক্ষন মহিলা চুপ করে ছিলেন, কিন্তু এবার সব বললেন তিনি। “তুমি কি ছেড়ে দিতে ওকে?” “না কখনও না। আর আমি তো ওকে ছাড়িনি! ও এখনও আমার।” বললো হাসনাত। অপেক্ষা করতে লাগলো সব ঠিক হওয়ার। ক্যামেলিয়ার সাথে কথা বলার।

অনেকক্ষন পেরিয়ে জ্ঞান ফিরলো ক্যামেলিয়ার। প্রথমে ওর পুরো পরিবার ঢুকলো ভেতরে। ডাক্তার দেবে না দেখা করতে কিন্তু জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত পারলো না। তবে ওর বাবা কথা দিলেন, দু মিনিটেই চলে আসবেন। ক্যামেলিয়া কে ডাকলো ওর বাবা, “মা।” ক্যামেলিয়া চোখ মেললো। আস্তে আস্তে বললো, “বাবা মাফ করে দাও আমাকে। মা মাফ করে দিও।” “এমন কেন করলি মা? কেন?” ডুকরে কেঁদে জিজ্ঞাসা করলেন ওর মা। “আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়নি মা।” “হাসনাতের জন্য?” জিজ্ঞাসা করলেন বাবা। ক্যামেলিয়া কিছু বললো না। চুপ করে থাকলো। “হাসনাত এর সাথে সম্পর্ক নেই তাই বেঁচে থাকা যাবে না? আমরা কেউ নই?” ক্যামেলিয়া চুপ করে থাকলো। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। “ঠিক আছে যদি হাসনাতকে ছাড়া বাঁচতে না পারিস তাহলে ওকে নিয়েই বাঁচ। কিন্তু আমাদের ছেড়ে যাস না মা।” বললেন ওর বাবা। ক্যামেলিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো। ওর বাবা বেরিয়ে গেলেন। ঢুকলেন হাসনাত কে নিয়ে। হাসনাত তাকিয়ে আছে ক্যামেলিয়ার দিকে। হাসনাতকে রেখে উনি সবাইকে।নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সবাই চলে গেলে হাসনাত এগিয়ে আসলো ক্যামেলিয়ার দিকে।
“আমাকে বলতে পারতি না একবার?” বললো হাসনাত। ক্যামেলিয়া কিছু বললো না। চুপ করে থাকলো।
“কি হলো? আমার উপর বিশ্বাস ছিল না? আমি তোকে ভালোবাসি না?”
“জানি ভালোবাসো। বিশ্বাসও ছিল। কিন্তু ভয়ও ছিল, যদি ছেড়ে যাও। আমি সহ্য করতে পারতাম না।” বললো ক্যামেলিয়া।
হাসনাত টুল টেনে এনে পাশে বসলো। হাত ধরলো ক্যামেলিয়ার। ক্যামেলিয়া কেঁপে উঠলো।
“কেমন বিশ্বাস যে বিশ্বাস রাখতে পারলি না?” ক্যামেলিয়া এবারও চুপ করে থাকলো। একটা হাত হাসনাত ক্যামেলিয়ার মাথায় রাখলো। চুলে বুলিয়ে দিতে লাগলো। “তোকে কখনও ছেড়ে যাবো না। ছড়ে গেলে তোর মতো আমিও কিছু করে বসবো।” ক্যামেলিয়া কেঁদে ফেললো। বললো, “না ওরকম কিছু হবে না। কখনও হবে না। আমিও কোথাও যাবো না।” হাসনাত মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “তুই মা হতে পারবি না কে বললো? কে বললো আমি বাবা হতে পারবো না? পৃথিবীতে কতোজন আছে যাদের বাবা মা নেই। তাদের বাবা মা আমরা হবো। ভেবে দেখ, আমরা সন্তান পাবো ও বাবা মা পাবে। দুটো অপূর্ণ অংশ মিলে পরিবার হবে। এটা ভালো না?”
“হু ভালো।” কাঁদতে লাগলো ক্যামেলিয়া। হাসনাতের হাতটা ধরে টেনে ঠোটের কাছে আনলো। চুমু দিলো আলতো করে। “তোকে কখনও ছেড়ে যাবো না। ভয় পাস না। এতো ঠুনকো না। কালই বাবা মা আঙ্কেল আন্টির সাথে কথা বলবে।” বললো হাসনাত।
“ক্যামেলিয়া নাক ঘষতে লাগলো হাতে। তার অস্ফুট স্বরে বললো, “ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি।”

অস্ফুট কথাটাই একটা তীব্র প্রশান্তি এনে দিলো হাসনাতের মনে। ও বিড়বিড় করে বললো, যে কথাগুলো শুনলে ক্যামেলিয়ার মন ভরে যায় শান্তিতে,
“ভালোবাসি।
ভালোবেসেছি আর ভালোবাসবো।
এ জনমে তোকে পেয়েছি, ভালোবেসেছি
আরও যতো জনম হবে-
সব জনমেই আমি তোর হবো।”

সাদা বিছানা। গায়ে সাদা চাদর। প্রেমিকার হাত ধরে রেখেছে প্রেমিক। দুজনের চোখেই পানি। চোখের পানির মতো স্বচ্ছ আর শুদ্ধ ভালোবাসা। পৃথিবীর।অন্যতম সেরা দৃশ্য। সাক্ষী হয়ে রইলো হাসপাতালের কেবিনটা

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত