বাড়ির একশো খানা কাজ আর অসুস্থ শাশুড়িকে সামলে অফিসের জন্য বের হয় ফারিয়া। আজকেও লেট। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার।
বাসা-অফিস সব একা হাতে সামলাতে সামলাতে মাঝে মধ্যে ভয়ানক অস্থির লাগতে থাকে। একটু খানি ছুটি চায় শরীর আর মন।
কিন্তু সংসারের ডামাডোলে সেই ছুটি আর মেলে কই?
আরিফের নিজেরই কাজ শেষে ফিরতে বাজে রাত ১০-১১টা, বেচারা চাইলেও খুব একটা সাহায্য করতে পারে না ফারিয়াকে।
সংসার, বাচ্চা, অফিস মিলিয়ে মেয়েটার হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে খুব মায়া হয় ওর, কিন্তু নিজে যে হাতটা বাড়িয়ে দেবে সেই সময়টুকুও আরিফ পায় না।
এই শহরে টিকে থাকতে আর অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করতে যে অনেকগুলো টাকা লাগে, সেই রোজগারের পেছনেই ছুটতে হয় তাকে।
আজ রিকশা পেতেও দেরি হয় ফারিয়ার।
রিকশার ভাড়া যেমন হুহু করে বাড়ছে, ইদানিং রিকশাওয়ালাদের সাথে তর্ক করতে করতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়।
তার মধ্যে গন্তব্য পছন্দ না হলে তো কথাই নেই। তবু কষ্টে-সৃষ্টে অবশেষে একটা রিকশা জুটলো কপালে।
রিকশায় বসে নানা আবোল তাবোল চিন্তা করতে করতে সময়টা কাটিয়ে নেয় ফারিয়া। শুধু এই রাস্তার সময়টুকুই তো ওর নিজের জন্য।
আলাদা করে আর নিজেকে দেয়ার সময় তো নেই তার। জীবনের অনেক হিসেব-নিকেশ মাথায় গিজগিজ করতে থাকে।
আট বছরের সংসার, পাঁচ বছরের নিনি, আরিফ, আরিফের মা; গত আট বছরে জীবন তো এদের নিয়েই কেটে গেলো।
নিজের বাবা-মা কেও দেখতে যাওয়া হয় শুধু ছুটির দিনে।
আরিফের মা ফারিয়ার বিয়ের পর থেকেই ভীষণ অসুস্থ। এত অসাধারণ মানুষটা কেন এত কঠিনভাবে রোগে পড়লো, ভেবে পায় না ফারিয়া।
তিনিই পছন্দ করে ঘরে এনেছিলেন ফারিয়াকে। খুব আদর করতেন।
তাঁর জন্য ফারিয়ার এত পরিশ্রম দেখে তিনি যে খুব কষ্ট পান, ফারিয়া বুঝতে পারে।
কিন্তু একবেলাও তাঁর কোন অযত্ন হতে দেয়নি ফারিয়া এত বছরে। এই মানুষটাকে ভীষণ ভালোবাসে সে।
আরিফের সাথে এরেঞ্জড ম্যারেজ হলেও বিয়ের আগে প্রেমটা দারুণ জমেছিল।
সন্ধ্যাবেলা টুপ করে আইসক্রিম খেতে যাওয়া, মন ভালো নেই বলে সারারাত ফোনে কথা কিছুই বাদ ছিল না।
বিয়ের পরে আরিফের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ততা আর ফারিয়ার সংসার-অফিসের চাপে প্রেমটা কি ধীরে ধীরে ঢিলে হয়ে গেছে কিনা ঠিক জানে না ফারিয়া।
কিন্তু এটাই তো জীবন, না? ভালোবাসাটা প্রতিদিন গভীর হবে অন্তরে, কিন্তু প্রেমের পাগলামি আলগা হয়ে দায়িত্ববোধ জায়গা করে নেবে সেখানে।
রোদটা হঠাৎ মেঘের আড়ালে মিলিয়ে যেতেই হুড ফেলে দেয় ফারিয়া। উফফফ কি শান্তি!!! হুডের নিচে রিকশাটাকে জেলখানা লাগে একদম!!!
স্বাধীন, মুক্ত রিকশাতে মনটা বেশ চনমন করে ওঠে। যাক, আজ অফিসের কাজগুলো বেশ ফুরফুরে মেজাজে শুরু করা যাবে।
কিন্তু মুহূর্তেই যেন পৃথিবীটা থমকে যায় ফারিয়ার। ডান দিকে তাকাতেই উলটো দিক থেকে আসা রিকশাটায় চোখ আটকে যায় তার।
সেই চোখ, সেই চুল, সেই একই দৃষ্টি। সেই অর্ণব। এক ঝটকায় যেন দশ বছর পিছিয়ে যায় ফারিয়া। ফারিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু অর্ণব।
অনেকের অনেক কানাকানিতে নিজেরা তেমন কান না দিলেও কি করে যেন একটা সময় গিয়ে বন্ধুত্বের থেকেও বেশি একটা টান অনুভব করা শুরু করে দুজন।
তারপরে গতানুগতিক সেই তারুণ্যের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম। কিন্তু সুখ বেশিদিন ছিল না সেই সম্পর্কে।
আস্তে আস্তে ভালোবাসার থেকে মনমালিন্য গুলোই বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে।
দুজনেই বুঝতে পারে তারা খুব ভালো বন্ধু হলেও ভালো প্রেমিক কেউ হয়ে উঠতে পারবে না কারো। এবং যথারীতি ব্রেকআপ।
ব্রেকআপের পরবর্তী সময়টা খুব খুব ক্রাইসিস গেছে ফারিয়ার।
একই ডিপার্টমেন্ট, একই ক্লাসে সারাদিন অর্ণবকে দেখাটা মানসিক যন্ত্রণায় কুড়ে কুড়ে খেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনগুলো।
না, ফারিয়া পারেনি প্রেমিককে আবারো বন্ধু হিসেবে দেখতে,
অনেক কষ্টে গ্রুপ স্টাডি কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় চেষ্টা করতো অর্ণবের সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে,
কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আস্তে আস্তে সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় ফারিয়া।
না থাকুক মনের মিল, না মিলুক জীবনের গন্তব্য, কিন্তু অর্ণবকে কখনো কম ভালোবাসেনি সে।
বিচ্ছেদের পরেও যত্ন করে ভালোবেসে গেছে ছেলেটাকে। বন্ধুদের মুখে একটা শব্দ অনেক শুনেছে ফারিয়া, “মুভ-অন”।
শুনে সে হাসি মুখে বলেছেও, হ্যাঁ মুভ-অন করছি আস্তে আস্তে।
অর্ণবও এ কাজে দারুণ পারদর্শী, ফারিয়ার সাথে সহজ-স্বাভাবিক বন্ধুসুলভ ব্যবহারই করতো সে ব্রেকআপের পর।
কিন্তু অদ্ভুত এক জ্বালা-যন্ত্রণায় ফারিয়ার স্বাভাবিক জীবন অনেক দিনের জন্য হারিয়ে যায়। কেউ কেউ বুঝেছিল তা, কেউ কেউ বুঝেনি।
গুটিয়ে যাওয়া ফারিয়া অবসাদ আর একাকিত্বে হারিয়ে গিয়েছিল, কেউ খবরও রাখে নি।
বর্তমান এসে আবার ধাক্কা দেয় ফারিয়ার মস্তিষ্কে। নাহ, সৃষ্টিকর্তা খারাপ রাখেননি ওকে।
পড়াশুনার পাট চুকিয়ে ভালো একটা চাকরিতে ঢোকার পরে বাবা-মা যখন বিয়ের কথা বললেন, ফারিয়া আর অমত করেনি।
নিজের কষ্টগুলো তখন একটু একটু করে মলিন হতে শুরু করেছে, আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হয় তার।
আরিফের সাথে যখন পরিবার থেকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, আরিফের ব্যবহার, ফারিয়ার প্রতি ওর যত্ন, দায়িত্ববোধ দেখে মুগ্ধ হয় ফারিয়া।
এমন একটা মানুষের সাথে তো দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যায় পুরোটা জীবন! কি অমায়িক!!!
আরিফের মাকেও দারুণ ভালোবাসতে শুরু করলো ফারিয়া।
তারপর আট বছর কেটে গেলো এই অসাধারন মানুষগুলোর সাথে, নিজের ঘর আলো করে আসা মেয়ে নিনির সাথে।
কিন্তু আজ অর্ণবের এক ঝলক দর্শন যেন অবশ করে দিয়ে গেলো ফারিয়াকে।
বুকের ভেতর মলিন হয়ে ধুলো জমা প্রেম যেন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আবার জানিয়ে দিয়ে গেলো, এই তো আমি আছি তোমার সাথে।
অর্ণব হয়তো খেয়াল করেনি ফারিয়াকে, অবশ্য করলেও ওর কিছু আসতো-যেতো না। খুব ভালমতো আর খুব জলদিই মুভ-অন করেছিল অর্ণব।
বুকের ভেতরের এই আগুন, এই যন্ত্রণা আবার কিসে নেভাবে জানে না ফারিয়া। কেন এত বছরেও এতটুকুও কমে না এই তীব্রতা?
কেন এত খানি পথ পাড়ি দিয়ে এসেও আবার স্মৃতিগুলো এমনি করে পোড়ায়?
অফিসে গিয়েও কাজে মন বসেনা ফারিয়ার। সারাটা দিন নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায়।
আচ্ছা, অর্ণবের নাম্বারটা কি আছে এখনও কোথাও লেখা? খুঁজে দেখলে কি পাবো? ও যদি নাম্বার বদলায়? আচ্ছা ফেসবুকে সার্চ করে দেখবো?
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালে কি এক্সেপ্ট করবে? ও যদি আবার কিছু মনে করে? কিন্তু কি মনে করবে?
আমি তো এখন সংসারী, বাচ্চার মা, পুরনো বন্ধুর খোঁজ নেয়া বাদে আর তো কোন উদ্দেশ্য নেই আমার।
উফফফ নাহ, খুব হ্যাংলামি হয়ে যাবে!!! কি না কি ভেবে বসবে অর্ণব। দূর ছাই, কি সব এলেবেলে চিন্তা!!!
রাজ্যের অবসাদ আর বেহিসেবী মনের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করতে করতে বাড়ি ফিরে কলিং-বেল বাজায় ফারিয়া।
আজ আর কোন কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না, অর্ণবের ব্যাপারটার একটা সুরাহা করতে হবে আগে।
আবার কেন এতদিন পর তাকে এত যন্ত্রণা দেবে সেই ফেলে আসা স্মৃতিগুলো?
অর্ণবের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ কি সেই অস্থিরতাটা কমাবে ফারিয়ার? উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই টুক করে দরজা খোলার আওয়াজ হয়।
ফারিয়া অবাক হয়ে দেখে ছোট্ট নিনি আজ দরজা খুলে দিয়েছে তার জন্য। আরো বিস্মিত হয়ে যায় বসার ঘরে তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে দেখে।
ফারিয়ার ব্যস্ত-শ্রান্ত জীবনটাতে একটুখানি আনন্দ দিতে আরিফ আর আরিফের মা মিলে এই সারপ্রাইজটা প্ল্যান করেছে ফারিয়ার জন্য।
আরিফও আজ জলদি বাসায় ফিরেছে, দুপুর থেকে রান্না করেছে ফারিয়ার সব পছন্দের আইটেম, একদম বিয়ের প্রথম দিনগুলোর মতন।
ফারিয়া দুহাতে জড়িয়ে ধরে স্বামী আর কন্যাকে। সব প্রশ্নের উত্তর মিলে যায় তার।
যন্ত্রণার স্মৃতিকে ছাই চাপা না দিয়ে বরং ভালোবাসায় মুড়ে হৃদয়ের ছোট্ট একটা কোণে একটুখানি জায়গা দিলেই না মেলে শান্তি!
থাকুক না প্রথম প্রেম জীবনের একটা অমূল্য সম্পদ হয়ে, কাছের মানুষগুলোর জন্য ভালোবাসায় তাতে কমতি হবে না এতটুকুও।