মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিল নবীন বরণ অনুষ্ঠানে। সব্বাই হই-হুল্লোড় করলেও, মেয়েটা চুপচাপ করে বসে ছিল। চোখদুটো আর দুজনার মত ছিল না, কালো অংশটা কালো ছিল না। বিড়ালচোখী ছিল মেয়েটা। চোখদুটো যেন রূপকথার কোন গল্প ছিল, যা যে কারো হুশ কারার জন্য যথেষ্ট ছিল।
সাকিলের কাছে জানতে পারি মেয়েটার নাম ইজা। খোদ সাকিলের কাছে নামটা উদ্ভট লাগলেও, আমার কাছে মধুর কোনো বাণী ছিল। যা শুনলে মনে শীতল হাওয়া বয়ে যেতো।
.
ফার্স্ট ইয়ারে হাতে গুনে কয়েকদিন ক্লাস করতে দেখেছিলাম ইজাকে। এই কয়েকদিন আমার কাছে হাজার বছরের সমান ছিল। ওর সাথে মুখোমুখি কথা বলার সাহস হয় নি। তবে হ্যাঁ কল্পনায় ইজাকে ঘিরে আমার এক জগত ছিল। যেখানে ইজার সাথে মনের অনুভূতি লেনদেন চলতো।
.
ইজাকে আমি ভালবেসে ফেলেছিলাম; তাতে সন্দেহ ছিল না বিন্দুমাত্র। প্রথম জিনিসটা সবার কাছে পবিত্র হয়। আমার কাছে তা পবিত্রের থেকে একটু বেশি ছিল, বলা যায় পবিত্রতম।
সেকেন্ড ইয়ারে ইজা নিয়মিত কলেজ আসা শুরু করলো। মেয়েটার চোখে দরদ ছিল অনেক, আমি দেখতে পেতাম। ভালবাসলে মানুষ অলৌকিকত্ব লাভ না করলেও, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে যাদুকর চেয়ে কম হয়ে উঠে না। কাছের মানুষটার তখন মুখে সব বলতে হয় না। তবু মন জেনে যায়, কেমনে জেনে যায়?? এটাই হলো ভালবাসা আর আবেগের মাঝে পার্থক্য।
.
ইজা খারাপ ছাত্রী না হলেও, ফিজিক্সে নড়বড়ে ছিল। আর তাই প্রিটেস্টে ফেইল করে বসে। রেজাল্টের দিন অগোচরে কেঁদে ফেলি। আমার রেজাল্ট ভালো হলেও ইজার অকৃতকার্য হওয়া মেনে নিতে পারছিলাম না।
জনি ভাইয়াও প্রেম করতো; খেয়াল করতাম ভাবির জন্য পারলে ভাইয়া কলিজা হাতে তুলে দেয়। আমি বড়ভাই এর দেখানো পথে চলার পথযাত্রী ছিলাম।
.
সাকিল খোজ করে বলে, রনি ভাবি হাবিব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে।
.
হাবিব স্যারের কথায় খানিক ঘাবড়ে যাই। লোকটা টাকার পাগল। যেমনতেমন করে প্রাইভেট পড়া তার রক্তে আছে, সবি নোটবুকের কামাল।
ছাত্র কিছু বুঝতে পারছে, কি না; তাতে হাবিব স্যারের মাথাব্যথা থাকে না।
.
মনে হচ্ছিল সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বড্ড দ্রুত ছুটে চলেছে। সামনে টেস্ট পরীক্ষা, তখনো কিছু ভাবিনি কি করবো।
কলেজের ফিজিক্স টিচার শফিয়ার স্যার আমার অনেক ক্লোজড ছিল। উনার কাছে কোর্স করেছিলাম কিছুদিন, পরে ফিজিক্স নিয়ে আর ভাবতে হয় নি। বাড়িতে রোজ প্রাকটিস করলে হয়ে যেতো। ভাবছিলাম ইজাকে যদি শফিয়ার স্যার পড়ায়, কেমন হয়?? মন্দ হবে না। এর জন্য ইজাকে রাজি করানোটা ছিল চ্যালেঞ্জের।
.
একদিন ইজাকে ক্লাসে বসে টিফিন খেতে দেখলাম। তখন আমি আর সাকিল সবে ক্যান্টিন হতে ফিরেছি। পাশ থেকে সাকিল বলল, আরে রনি কোনোকিছু করতে এতো ভাবে নাকি!! দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে যা বলার বলে আয়, আমি আছি।
.
সাকিল সাহস দেওয়া তে এক দু পা করে ইজার কাছে যাচ্ছি। দ্বিধায় না থেকে ইজার সামনে বসে পড়লাম। মুচকি হেসে বললাম, হায়।
ইজার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
কিছু টা ব্যথিত হলাম। বললাম, হাবিব স্যারের কাছে ফিজিক্স না পড়লে হয় না? শফিয়ার স্যারের কাছে পড়লে, তোমার ফিজিক্সে আর দুর্বলতা থাকবে না; আমায় বিশ্বাস করতে পারো।
.
ইজার মুখ দেখে বুঝবার কোনো অবকাশ নেই, কি ভাবছে। খানিক পরে মনে হলো মেয়েটা হয়তো আমার উপর বিরক্ত। ইজার এমন ব্যাবহার একদম ই যে খারাপ লাগে নি বলবো না। মনের মানুষ ই তো মন নিয়ে খেলে, অনুভূতির পরওয়া করে না। এই ভেবে নিজেকে বুঝালাম।
.
কয়েকদিন যেতে না যেতে আমি কবি হয়ে উঠেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ না হতে পারলেও দুচার লাইন ইনিয়েবিনিয়ে লিখে পোস্ট করতাম ফেসবুকে।
হুট করে অপরিচিতা নামে এক মেয়ের রিকুয়েস্ট আসে। ইনফো তে আমাদের কলেজ থাকাতে এক্সসেপ্ট করি। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা ইজা হবে, কিন্তু না ইজা নাকি ফোন ইউজড করে না। কিছুদিন পর নিয়ম করে অপরিচিতা টেক্সট করতে থাকে। মেয়েটা আমার খবর নিয়ে কথা বলা শুরু করবে, আর শেষ করবে ইজার নামে ভুলভাল বকে। অপরিচিতা মেয়েটা সব জানতো, এ নিয়ে মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে যেতাম।
.
পরের সপ্তাহে পরীক্ষা শুরু হবে, কিন্তু কি করবো এখনো কিছু ভাবিনি। কলেজ বন্ধ হওয়ার শেষদিন গুলোতে ইজার আগুপিছু ঘুরেছি, কাজে আসেনি। কোথা থেকে যেন অপরিচিতা সব দেখতো। আর রাতের বেলা আচ্ছা মতো আমায় বকা দিতো। অপরিচিতা বহুত চেষ্টা করেছে আমি যেন ইজার পিছু ছাড়ি, কিন্তু কমবখত এ মন শুনে নি কারো কথা। অপরিচিতা আমার সবকিছুর খবর রাখতো। আমি নিজের বিহেভিয়ারে তাজ্জব না হয়ে পারি না, অজানা কারো কথা কেন শুনি আমি। হয়তো আমরা এতদিনে বন্ধু হয়ে গেছিলাম। সোয়ার আগে ইজা কে নিয়ে জিজ্ঞেস করা অপরিচিতা ভুলতো না। আমি কিছু জবাব দিতে পারতাম না, কি করবো। কিন্তু এটা ঠিক করে রেখেছিলাম মেয়েটাকে শায়েস্তা করে ছাড়বো।
.
কয়েকটা পরীক্ষা হয়ে আজ ফিজিক্স পরীক্ষা। সকালবেলা বই টুকটাক ঘেটে, আগেভাগে হলে এসে হাজির হয়েছি। কালরাত্রি অপরিচিতা বেশিক্ষণ জাগতে দেয়নি, তাই ঘুম ভালোই হয়েছে। এজন্য ফ্রেশ লাগছে বড্ড।
আর পরীক্ষা শুরু হওয়ার মিনিট দশেক আছে। ইজা তখনো গায়েব। স্যার ক্লাসে পৌঁছে সব্বাইকে খাতা দিলো, তখন আমি লাইন টানছি। ঠিক তখন ইজা এসে হাজির। মুখে দুনিয়ার চিন্তা, চোখে চেনাজানা ভয়; সবমিলিয়ে ইজা কে অনেকটা অসহায় লাগছিল।
.
ইজা খাতা ভাজ করে কাঁদছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কোনো এক উত্তর হয়তো মেলাতে পারিনি। দুঘণ্টা ইজাকে শুধু পরীক্ষার খাতা কলম দিয়ে কাটতে দেখেছি, হাতে আর মাত্র এক ঘণ্টা।
কি করা যায় সেটাই ভাবছিলাম, তখনি কোনোএক ফেরেশতার মত শফিয়ার স্যার আসলো। আমার চোখের দিক তাকিয়ে, ইজার দিক তাকালো শফিয়ার স্যার। পরে আমাকে দুর হতে ইশারা করলেন। যেন বলছেন, যা করার কর আমি আছি।
.
হলে আরেকজন শিক্ষক যিনি গার্ড ছিলেন তাকে নিয়ে শফিয়ার স্যার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি দু-তিনটা লুজ নিয়ে, আমার খাতা হতে লুজপাতায় কপি করতে শুরু করলাম ঝটপট। দশ-পনেরো মিনিট পর লেখা শেষ হলে, ইজাকে উঠে গিয়ে টোকা দিলাম। ইজা মাথা তুলে ভুত দেখবার মতো তাকালো। আমি লুজ এগিয়ে বললাম, তিনটা সৃজনশীল করা আছে, পাস হয়ে যাবে।
ইজা কোনো জবাব দিলো না। কিন্তু লুজও নিচ্ছিল না। টেবিলে লুজ গুলো রাখতে গিয়ে পড়ে গেলো। ইজা আর আমি দুজনে ভয় পেয়ে গেলাম।
.
এইই!
ওখানে তোমরা দুজন কি করছো?? দাঁড়াও বলছি।
.
যিনি হলের গার্ড ছিলেন একথা বলে এগিয়ে আসলেন। তখন আমি ভয়ে কাঁপছি। স্যার আবার বললেন, তুমি সিট ছেড়ে এদিক কি করো??
– কিছুনা স্যার। ইজার লুজ পড়ে গেছিলো, ব্যস তাই উঠে দিচ্ছিলাম।
.
তিনি কিছু বলতে যাবেন তার আগে শফিয়ার স্যার সামলে নিলেন। ইজাকেও বাধ্য হয়ে লুজ নিজের খাতার সাথে পিনআপ করতে হলো। তখন যেন জান ফিরে পেলাম। ইজাকে লুজ যখন দিতে পেরেছি, বাকিটা শফিয়ার স্যার দেখে নিবেন!
.
পরীক্ষা শেষ করে বেড়িয়েছি সবে, সব্বাই আমাকে ঘিরে উত্তর মেলাতে শুরু করলো। আমি তখন নীরব দর্শক। মনে তখন অসীম শান্তি, আমি যে পেরেছি। এতদিনের যে ভয় ইজাকে নিয়ে ছিল দূর হওয়ার শান্তি। একটুপর সাকিলের সাথে বের হলাম,বাসা যাবো সিধা। আজ ভালোই ঘুম হবে।
.
এই রনি!!
দাঁড়াও বলছি।
.
সবে কলেজের সদর গেট পেরিয়েছি, তখনি ইজার কণ্ঠস্বর শুনলাম। খানিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না; ইজা আমাকে কেন ডাকতে যাবে। ফিরে দেখি সত্যি ইজা আমায় ডাকছে।
.
ইজা কাছে এসে বলল, তোমার সাহস তো কম না দেখছি। এমন পাগলামি কে করতে বলেছে তোমাকে হু??
– নাহহ মানে কেউ বলেনি।
– তাহলে এমন করতে গেলে কেনো??
– তোমাকে নিয়ে ভয় করছিল। যদি তুমি ফেইল করতে, তাহলে কি হতো!
– যা হওয়ার হতো। তোমাকে যেন আমার বিষয়ে নাক না গলাতে দেখি বলে রাখছি।
.
আমি কিছু বলার আগে ইজা সামনে দিয়ে চলে গেলো। পাশে সাকিলকে দেখলাম খানিক ক্ষেপে গেছে। আমি বললাম, তোর আবার কি হলো রে??
– ভাবি তোকে এমন করে বলল কেন?? তুই তো উনার জন্য এসব করছিস।
– হবে কোনোএক কারণ, যা ইজাকে ভালো লাগে নি। কিন্তু আমি যা চেয়েছি তাতো হয়েছে, তাহলে এতো ভাববার কি আছে। চল বাসা যাই।
.
সাকিল কে কোনোমতে মানিয়ে বাসার পথে হাটা শুরু করলাম। বাসায় ফিরে রাতে অপরিচিতাকে সব বললাম, সে তো রেগে আগুন। ইজাকে যাচ্ছেতাই বলে রাগ ঝাড়লো। যদিও অপরিচিতার মুখে ইজাকে নিয়ে এসব কথা কিছুটা খারাপ লাগছিল, কিন্তু অপরিচিতা কিংবা সাকিল দুজনে তার দিক থেকে ঠিক ছিল। ইজা তখন এমন করে না বললেও পারতো।
.
দেখতে দেখতে টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো। কিছুদিনের মাথায় সাকিলের কাছে শুনতে পেলাম ; ইজা শফিয়ার স্যারের কাছে পড়া শুরু করেছে। বোর্ড পরীক্ষা হতে হাতে সময় আছে অনেক বলা যায়, ভালো করে পড়লে ঠিকি ইজার ফিজিক্সে ভালো প্রস্তুতি হবে।
.
আজ টেস্টের রেজাল্ট আর আমাদের বিদায় একসাথে দিলো। আর কিছুদিন পর পরীক্ষা শুরু হবে। শফিয়ার স্যারের কাছে এর আগে রোজ জামিল ভাইয়ের দোকানে দেখা করতাম। চায়ের ফাকে ইজার খবর নিতাম। শফিয়ার স্যার মুচকি হেসে বলতো, এতো চিন্তা নিজের জন্য করলে পারিস, তোরো তো পরীক্ষা।
স্যারের কথায় কেমন জানি লাগতো, হয়তো লজ্জা পেতাম। ভাবনার দিনগুলো এমনে এগুবে, কে জানতো?
.
রাত পেরুলে পরীক্ষা, কিন্তু আমার কোনো টেনশন ই হচ্ছে না। হচ্ছে না বললে ভুল হবে, কিন্তু সেটা অপরিচিতার টেনশনের কাছে কম। মেয়েটার বিহেভিয়ার একেবারে বিস্ময়কর। মিনিট কয়েক পরপর মেসেঞ্জারে অপরিচিতা ফটো পাঠাচ্ছে। ওহ যা পড়ে ইম্পরট্যান্ট মনে করছে, ব্যস ফটো তুলে পাঠাচ্ছে। এই তো গুনে কয়েকদিন হবে, অপরিচিতার সাথে পরিচয়। তাও আবার ভার্চুয়াল জগতে, তবু এতো বুঝাপড়া হবে আমাদের মাঝে ভাবা যায়। আর যার পিছনে দুবছর ঘুরেছি, কলেজে শেষদিন বায়’ পর্যন্ত বলল না।
.
এক এক করে পরীক্ষা শেষ হচ্ছিল। ফিজিক্স পরীক্ষার দিন বহুত চিন্তায় ছিলাম। পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, ইজার জন্য নয়। ইজার পাশে যে মেয়েটা পরীক্ষা দিচ্ছে তার জন্য। মেয়েটার সাথে কথা বলে জানতে পারি ইজার পরীক্ষা খারাপ হয় নি। কথাটি শোনামাত্র হাফ ছেড়ে বাচলাম।
.
আমাদের প্রাক্টিকাল পরীক্ষা চলছে। কিছুদিন পর হয়তো ইজার সাথে হবে না আর দেখা, এ নিয়ে মনে অনেক ঝড়। অপরিচিতা আমার আবেগপূর্ণ কথা শুনে রেগে যেতো। তার এক কথা, যে মেয়ে আমার অনুভূতির কোনো পরওয়া করেনা তারজন্য কিসের এতো কষ্ট পাওয়া। আমি কিছু বলতাম না জবাবে। হাসির ইমোজি দিয়ে নিজের খারাপ লাগাকে দেবে রাখতাম। তবু কেমন করে জানি অপরিচিতা আমার মন খারাপি ধরে ফেলতো। আমায় সান্ত্বনা দিতো। একবার তো নিজের কাছে হেরে বলেই ফেললো, রনি ইজা কে মনের কথা বলে দাও।
ঠিক হলো শেষ প্রাক্টিকাল পরীক্ষার দিন চিরকুটে করে নিজের মনের কথা জানাবো।
.
এসে গেলো অপেক্ষার সেইদিন। ইজাকে মুখে কিছু বলার সাহস হয়নি, শুধু চিরকুট গুজে দিয়েছিলাম ওর হাতে। কবিতার দুচার চরণের সাথে ভালবাসি কথা লেখা ছিল চিরকুটে, সাথে ছিল আমার ফোন নাম্বার। আমার চাওয়া এতটুকু ছিল যেন ইজা ওর জবাব জানায়। জবাব না’ হলেও কষ্ট হবে না, তবু যেন চুপ করে না থাকে।
.
কিন্তু না ইজা তার জবাব দেয়নি। কিছুদিন পর শুনতে পেলাম, ওরা পুরো পরিবার ভিনদেশ পাড়ি দিয়েছে। মানে শহর ছেড়ে চলে গেছে। এতে মন এতোটা বিধ্বস্ত্ব হয়েছিল যে, নিজেকে নিয়ে ভাবা ভুলে যাই। ভেবেছিলাম বাইরে কোচিং করতে যাবো, কিন্তু মন পড়ে সায় দেয়নি। অপরিচিতা এ নিয়ে বড্ড রেগে যায়, দুদিন অনলাইন হয়নি। তবু আমি নিজের কথায় অনড় ছিলাম।
.
এরপর অনেকটা সময় চলে গেছে, এরমাঝে ইজা আর কল করেনি। পাই নি ইজার জবাব। এসময়ে সব্বাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। জনি ভাইয়া মালয়েশিয়া চলে যায়, ভিসা নিয়ে। সাকিল আর্মি তে ঢুকেছে। খাগড়াছড়ি তে শালার পোস্টিং। রোজ ফোন করে নিজের অভিজ্ঞতার গল্প শোনাবে। এদিকে বাবামা কে বাড়িতে রেখে, ঢাকা চলে এসেছি। ছোট্ট একটা চাকরি পেয়েছি। এতকিছুর মাঝে তবু অপরিচিতা আমার পিছু ছাড়েনি। ভালোমন্দ সময়ে ঠিকি আমার পাশে থেকেছে, আমার একাকীত্বের সঙ্গী হয়েছে।
.
অফিসে কিছুদিন ধরে আমাদের নতুন অফিসার জয়েন করার কথা গুঞ্জন চলছে। সব্বাই বলাবলি করছে তিনি একজন মেয়েমানুষ হতে পারেন। সিহাব ভাই তো বলছে মেয়েটি হয়তো এমডি স্যারের কাছের কেউ, হয়তো প্রেমিকা। কিন্তু সবার উপর বিশ্বাস করা গেলে, সিহাব ভাই ভিন্ন। মুখে কিচ্ছু আটকায় না। উনার কথায় কান না দিলে নিজের ই ভালো।
.
প্রথম দেখায় অফিসে ইজাকে চিনতে পেরেছি। ভুলবার তো কথা নয়, আবার মনে পড়ার কথাও নয়। মনে তো তাকে পড়ে যাকে কোনদিন ভুলা যায়, কিন্তু আমি তো ইজা কে কভু ভুলিনি।
সিহাব ভাইয়ের কথা আবার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইজা এমডি স্যারের কাছের মানুষ ঠিকি। তবে প্রেমিকা নয়, বউয়ের বোন অর্থাৎ শালিকা।
.
অতীতের কোনো প্রভাব কাজে পড়তে দেই নি। নিজের মতো করে অফিসে কাজ চুটিয়ে বাসা ফিরে আসতাম। কিন্তু এর ফাকে সিহাব ভাইয়ের সাথে ইজার ভালোই সখ্যতা গড়ে উঠে, যা আমার মনে তীর হয়ে আঘাত হানা করছিল। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলিনি। নিজের খারাপ লাগাকে মনের ভিতর চেপে রেখেছি। আজো মনে আছে ইজা বলেছিল, ওর বিষয়ে নাক না গলাতে। আজ নাহয় আবার ওর কথা মেনে চললাম।
.
আজ ইজার জন্মদিন, অফিস তাই ছুটি। এমডি স্যারের বাসায় বার্থডে পার্টি হবে, সব্বাই কে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি না গিয়ে বাড়িতে শুয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছি। গতরাত হতে কেন জানি অপরিচিতা কে অনলাইনে দেখছি না। ডাটা কানেকশন অন করে অপেক্ষা করছি অপরিচিতার। এমন সময় দরজায় কে জানি নক করলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে চোখ আমার চড়কগাছ। ইজা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
.
কি হলো দাড়িয়ে রাখবে? ভিতরে আসতে দিবে না??
.
ইজার কথায় সরে দাঁড়ালাম। ইজা তার চৌকস নজরে বাসা ঘুরেফিরে দেখছে। খানিক পরে বলল, এক গ্লাস শরবত খাওয়াবে??
অন্যসময় হলে হয়তো মানা করতাম। কিন্তু ইজা এমন করে বলল যে কথা ফেলতে পারলাম না। রান্নাঘরে গিয়ে শরবত বানাচ্ছি, ঠিক তখনি পকেটে রাখা ফোন বেজে উঠলো। মেসেঞ্জারের শব্দ এটা, অপরিচিতা ম্যাসেজ দিয়েছে।
.
কি হলো?? শরবত বানাতে এতক্ষণ লাগে বুঝি, আমার গলা শুকিয়ে গেলো যে!
.
অপরিচিতার ম্যাসেজ পড়ে তাজ্জব হলাম। অপরিচিতা কেমনে জানলো আমি শরবত বানাচ্ছি, অপরিচিতা বাসায় আসে নি তো??
ঝটপট শরবত বানিয়ে ড্রয়িংরুম এসে দেখি, ইজা বসে আছে। তারমানে অপরিচিতা আসেনি, তাহলে এসব ম্যাসেজের মানে কি??
.
ইজা ফোনে কি জানি টাইপ করছিল। ঠিক এ সময় আমার ফোন বেজে উঠলো। ম্যাসেজ এসেছে মেসেঞ্জারে।
” দাঁড়িয়ে থাকবে?? শরবত দাও”।
এবার সবকিছু পরিষ্কার হলো আমার কাছে। তাহলে ইজা কি অপরিচিতা??
.
অপরিচিতা মানে ইজা সবে শরবত খেয়ে গ্লাস রেখে আসলো রান্নাঘরে। আমার সামনে বসে বলল, আজ পুরোদিন ব্যস্ত ছিলাম। তাই আর অপরিচিতা অনলাইন হতে পারেনি। তবে আগেই ঠিক করে রেখেছি পার্টি তে আসলে তোমায় সব বুঝিয়ে বলবো। কিন্তু বদ তুমি আসলে না। বাধ্য হয়ে আমায় এভাবে আসতে হলো।
.
আমি তখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। সবকিছু যে স্বপ্নের মতো ঘটছিল। ইজা আবার বলল, জানো তো তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার আগপর্যন্ত কোনো ছেলের সাথে এভাবে ইনভলব হইনি। কেমন জানি লাগতো। তাই তোমার কাছ হতে দুরে থাকতাম। কিন্তু তোমার পাগলামি বাড়তে থাকলো। কেউ আমার জন্য এতোটা ভাবতে পারে অকল্পনীয় ছিল। আমি জানতাম একদিন তোমার থেকে আমাকে দুরে যেতে হবে, তাই কদিনের জন্য মোহ বাড়িয়ে লাভ কি ছিল বলতে পারো? পরে ভাবলাম তোমাকে ইগনোর করলে হয়তো, আমার পিছু ছাড়বে।
.
ইজা এতটুকু বলে থেমে গেলো। মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। আমি বললাম, অবহেলা করলে নাহয় তবে অপরিচিতা হওয়ার মানে কি??
– তোমাকে ইগনোর করলেও তো বাকে আনা যাচ্ছিল না। তাই ভাবলাম আমার সম্পর্কে কেউ যদি ভালোমন্দ বলে, তুমি নিশ্চয় একসময় ঘৃণা করবে। কিন্তু না; ঘৃণার পাত্র হতে গিয়ে আমি নিজে তোমার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে পড়ি। ভালোই চলছিল সবকিছু, ফিজিক্স পরীক্ষা হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত। তুমি লুজ দেওয়ার মতো এমনকিছু করবে ভাবতেও পারিনি। বড্ড রাগ করছিল আমার তখন। যদি তুমি ধরা পড়তে তাহলে কি হতো??
– হতো যা হওয়ার। তুমি তো আমার কথা শুনছিলে না। তাই অমন করতে বাধ্য হয়েছি।
.
আমার কথায় ইজার মুখের আভা বদলে গেলো। হয়তো রেগে গেছে। মুখ বাকিয়ে বলল, নিজের প্রতি এমন কেয়ারলেস হওয়ার কারণে তোমার সামনেও আসিনি। এরপর যেইদিন তুমি চিরকুট দিলে, আমি কি যে খুশি হয়েছিলাম; যদিও আমার জানা ছিল। কিন্তু পরেক্ষণে বড্ড কান্না পায়। আমার বিদায়কাল চলে এসেছিল, তাই তোমায় জবাব দেইনি। কিন্তু অপরিচিতা হয়ে পাশে থেকেছি। তোমার অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। এরপর যখন তুমি দুলাভাই এর অফিসে জয়েন করলে, আমি সপ্তমআসমানে উড়ছিলাম। ব্যস এতদিন পর তোমার মুখ দেখার জন্য জুটে আসি অফিসে। কিন্তু তুমি আমায় পাত্তায় দিলে না।
.
আমি ইজার কথায় খানিক হাসলাম। অট্টহাসি তে বললাম, আমার পাত্তা না দিলে তোমার কি?? আপনার তো সিহাব ভাইয়া আছে।
– আরে পাগল! আমি তোমাকে জ্বালানোর জন্য এসব করি।
.
আমি ইজার কথায় চুপ হয়ে গেলাম। ইজার আমার জন্য এসব করছিল, আর আমি কি না কি ভেবেছি।
ইজা আবার বলল, আমি কিন্তু এখনো বার্থডে কেক কাটিনি হু!
.
দোকানে এসেছি কেক কিনতে। তখনি ফোন বেজে উঠলো। অজানা নাম্বার থেকে টেক্সট এসেছে।
.
ভালবাসি তোমায়!
আমাকে বার্থডে গিফট কি দিবে??হু
.
বহু অপেক্ষিত ম্যাসেজ এতদিন পর পেলাম। দেরি তে হলেও আমি আমার জবাব পেয়েছি। আমি রিপ্লাই দিলাম, কি চাই তোমার??
কিছুক্ষণ পর জবাব আসলো, তোমাকে চাই; তুমিময় এক পৃথিবী গড়তে চাই।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা