বাসটা খালি প্রায়। যাত্রী ওঠাবে বলে থেমে আছে। বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি। বাসে বসে আনমনে নিজের লেখা একটা বই পড়ছিলাম। নাম “মনের কথা”। হঠাৎ ভেজা জামা কাপড় পরে এক ছেলে ধুপ করে পাশে এসে বসলো। আমি রীতিমত মতো বিরক্ত। কিছু না বলে আর একটু চেপে বসলাম। হঠাৎ ছেলেটা কথা বলে উঠলো।
ছেলেঃ এক্সকিউজমি ম্যাডাম আমি পাশে ফিরে তাকালাম।
আমিঃ আমাকে বলছেন?
ছেলেঃ জ্বি, আপনাকেই বলছি, এটা অনামিকা রায়হানের লেখা বই না? আমি কিছুটা অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। কিছু বলার আগেই সে আবার বলতে শুরু করলো।
ছেলেঃ আমি রীতিমতো ফ্যান তার। অনেক ইউনিক চিন্তা ভাবনা করে মেয়েটা। আই জাস্ট লাভ হার।
আমি অবাক চোখে চেয়ে আছি ছেলেটার দিকে। বলে কি ছেলে? একবার ভাবলাম বলে দেই আমিই অনামিকা রায়হান। কিন্তু হঠাৎ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো।
আমিঃ আপনি চেনেন অনামিকা রায়হানকে?
ছেলেঃ নাহ, এই একটাই আফসোস। ওকে কখনো দেখিনি। আমাকে একজন তার লেখা বই গিফট করেছিলো। সেটা
পড়েই তার ফ্যান আমি।
আমিঃ ওহ! তা অনামিকা রায়হানের কোন বইটা গিফট করেছিলো ?
ছেলেঃ মুলাকাত!
আমিঃ মুলাকাত? এরকম কোনো বই তো উনি লেখেননি!
ছেলেঃ হুহ! এমন ভাবে বলছেন যেনো ওনার সব বই পড়েছেন আপনি!
আমিঃ আমার বান্ধবী অনামিকা। আর আমি জানবো না? মাত্র ৩ টি বই লিখেছে ও। আর অতো পপুলার রাইটার ও না। ওর বেশীরর ভাগ বইই বিক্রি হয় নি। ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেলো! একমুহুর্ত আমার দিকে চেয়ে থেকে আবার বলতে শুরু করলো।
ছেলেঃ ওহ, তাহলে হয়তো অন্য কোনো রাইটারের লেখা ছিলো। বাই দ্যা ওয়ে আমি শ্রাবণ। শ্রাবণ আরফান। আর আপনার নামটা?
আমিঃ আ-ঈশানা আমার কথা শেষ হবার আগেই আমাকে পাত্তা না দিয়ে আবার বলতে শুরু করল।
শ্রাবণঃ ওহ হোয়াটএভার, ঈশু, টিস্যু। আচ্ছা অনামিকা রায়হানের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন?
আমিঃ না।
শ্রাবণঃ কেনো?
আমিঃ আমার ইচ্ছে।
শ্রাবণঃ ওকে, তাহলে তার এড্রেসটা যদি বলেন….।
আমিঃ না।
শ্রাবণঃ আচ্ছা তবে ফোন নাম্বার?
আমিঃ না।
শ্রাবণঃ কিন্তু কেনো।
আমিঃ আমার ইচ্ছে!
শ্রাবণঃ আজব তো। সমস্যা কি? একবার দেখাই তো করতে চেয়েছি।
আমিঃ উফফ বড্ড আজব লোক তো আপনি। চিনি না জানি না, নাম্বার চেয়ে বসছেন!
শ্রাবণঃ এমন ভাবে বলছেন যেন আপনার নাম্বার চাইছি! আচ্ছা আপনি কি ওকে হিংসে করেন?
আমিঃ অদ্ভুত! আমি কেনো তা করবো?
শ্রাবণঃ কারন আপনি সুন্দরী হওয়া সত্বেয় আমার মতো একটা হ্যান্ডসাম ছেলে আপনার নাম্বার না চেয়ে অদেখা অচেনা আপনার বান্ধবীর নাম্বার চাচ্ছে তাই! আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে চেয়ে আছি?
ছেলেঃ কি ম্যাডাম? ঠিক বলেছি তো?
আমিঃ আপনি ঠিক কার প্রশংসা করছেন বলুন তো? আমার? আমার বান্ধবীর? নাকি আপনার নিজের?
ছেলেঃ আরে আরে? আপনি তো সিরিয়াস হয়ে গেছেন দেখছি! আপনাকে মজার ছলে সুন্দরী বললাম বলে আপনি সেটাই বিশ্বাস করে নিলেন? ছেলেটার কথা শুনে আমার ভীষণ রাগ হলো এবার। কি বলতে চায় ও? আমি সুন্দরি না? আমার কি নাক বোঁচা? নাকি চোখ ট্যারা? এদিকে হঠাৎ খেয়াল হল কথা বলতে বলতে অনেকটা পথ বেশী চলে গেছি। ছেলেটাকে জবাব না দিয়েই বাস থেকে তারাহুরো করে নেমে পরলাম। পেছন থেকে শুধু ছেলেটার কথা ভেসে আসছিলো….
শ্রাবণঃ আরে কোথায় যাচ্ছেন? রাগ করলেন নাকি? আচ্ছা অনামিকা রায়হানের নাম্বারটা পেছনের কথা গুলো আর শোনা যাচ্ছে না। পেছন ফিরে একবার দেখে নিলাম। বাস ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে ছাতা থাকতেও বোকার মতো বৃষ্টিতে কখন থেকে ভিজে যাচ্ছি আমি। সেটা অব্দি খেয়াল করি নি। লোকে নিশ্চই পাগল ভাবছে আমাকে। কিন্তু পুরোপুরি ভিজে যাওয়ার পর এখন ছাতা মাথায় দিলে লোকে আরো বড় পাগল ভাববে। সব ওই ছেলেটার জন্য হয়েছে। আমি এভাবেই ভিজতে ভিজতে বাড়িতে গেলাম। কলিং বেল চাপতেই ইন্টারে এ পড়ুয়া ছোটবোন অন্তরা দরজা খুলে দিলো।
অন্তরাঃ কিরে আপু ছাতা আছে তাও ভিজে গেলি কিভাবে?
আমিঃ কথা কম বল, আর আর ছাতাটা ধর। আর টাওয়েল রেডি কর, আমি ওয়াশরুমে যাবো।
অন্তরাঃ ইশশ আমি যেনো তোর চাকর!
আমিঃ না রে সোনা, তুই আমার চাকরানী। যা এবার, যেটা বললাম সেটা কর।
অন্তরাঃ মা-আ-আ-আ! দেখো আপু আমাকে চাকরানী বলছে!
আমিঃ ইশশ আবার মার কাছে বিচার দেওয়া হচ্ছে। তোকে চাকরানী বলবো না তো কি মহারানী বলবো?
রান্নাঘর থেকে মায়ের কন্ঠ ভেসে এলো।
মাঃ কিরে আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেলো তোদের? এই অন্তি যা তো অনু যা বলছে তাই কর। আর অনু তারাতারি ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। অন্তরা আমার হাত থেকে ছাতাটা নিয়ে আমাকে ভেংচি কেটে চলে গেলো।। পরের দিন আবারো সেই একি যায়গা থেকে ছেলেটি উঠলো। কিন্তু আজ সিট খালি নেই, সে আমার পাশেই দাড়ানো। এবং আমার দিকেই চেয়ে আছে। আমি তাকে না দেখার ভান করে অন্য দিকে চেয়ে আছি। এমন সময় সে কথা শুরু করলো।
শ্রাবণঃ এই যে ম্যাডাম।
আমিঃ…..
শ্রাবণঃ এইযে মিস ঈশু টিস্যু।
আমিঃ আপনার সমস্যা কি বলুনতো?
শ্রাবণঃ অনামিকা রায়হানের নাম্বারটা দিন না প্লিজ!
আমিঃ কি করবেন নাম্বার দিয়ে?
শ্রাবণঃ সেটা আপনাকে কেনো বলবো?
আমিঃ তবে আমি কেনো আপনাকে নাম্বার দিবো?
শ্রাবণঃ তাও ঠিক। ওকে, বাস থেকে নেমেই আমি আপনাকে ফুচকা খাওয়াবো। এবার তো বলুন।
আমিঃ আগে খাওয়ান তারপর দেখছি।
শ্রাবণঃ হায়রে। আচ্ছা ঠিক আছে!
আজ বাস থেকে নামলাম ঠিক মতো। আমার সাথে নামলো শ্রাবণও। শ্রাবণ আসে পাশে দেখছে ফুচকাওয়ালা আছে নাকি। কিন্তু আমি জানি, এ সময়ে ফুচকাওয়ালা এদিকে বসে না। বেচারা শ্রাবণ হতাশ হলো।
আমিঃ কি হলো মিস্টার? খাওয়াবেন না?
শ্রাবণঃ ফুচকাওয়ালা তো দেখছি না। অন্য কিছু খাওয়ালে হবে না?
আমিঃ উহু। মোটেই না।
শ্রাবণঃ আচ্ছা চলুন তাহলে এখান থেকে ১০ মিনিট হাটলেই একটা চটপটি ফুচকার দোকান আছে। আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই।
আমিঃ ইশশ! শখ কতো? চিনি না জানি না, আপনি বললেই আপনার সাথে যাবো নাকি?
শ্রাবণঃ আরে! আমাকে দেখে কি আপনার খারাপ ছেলে মনে হয়?
আমিঃ অবশ্যই!
শ্রাবণঃ হোয়াট দ্যা ….! আচ্ছা আমাকে কোন দিক থেকে আপনার খারাপ মনে হলো?আমি কি আপনার সাথে খারাপ কিছু করেছি?
আমিঃ করেন নি কিন্তু করবেন না তার কি গ্যারান্টি?
শ্রাবণঃ অদ্ভুত! আজব মেয়ে মানুষ! কিছু করিনি তাও দোষ ধরে!
আমিঃ এতো কিছু আমি বুঝি না। আপনি ফুচকা খাওয়াতে পারেননি। তাই আমি আপনাকে আমার বান্ধবীর নাম্বার দিচ্ছি না। ওকে? আমি চললাম!
শ্রাবণঃ আরে শুনুন। একটু কম্প্রোমাইজ করুন না প্লিজ!
আমিঃ আমি আসছি। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। ওকে? বাইই!
ছেলেটাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি দ্রুত গতিতে হাটা শুরু করলাম। ছেলেটাকে জব্দ করতে পেরে মনের ভেতর খুশি লাগছে। ছেলেটা তখন ও দাড়িয়ে আছে কিনা আমি জানি না। আমি দ্রুত পা ফেলে বাড়ি গেলাম। পরেরদিন বাসে উঠে বসে আছি। কিন্তু আজ শ্রাবণ এলো না। ভাবলাম নিশ্চই অনামিকা রায়হানের ভুত মাথা থেকে নেমেছে। কিন্তু বাস থেকে নামতেই দেখা পেলাম উনার। পাশে একজন ফুচকাওয়ালা!
শ্রাবণঃ উফফ কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি আপনার!
আমিঃ আপনি এখানে কি করছেন!
শ্রাবণঃ ফুচকা বেচি। খাবেন?
আমিঃ ফাজলামো বাদ দিন। কি করছেন এখানে?
শ্রাবণঃ আরে কালকে আপনি ফুচকা খেতে চেয়েছেন না! তাই…..
আমিঃ আচ্ছা? শ্রাবণ আমার দিকে এক প্লেট ফুচকা এগিয়ে দিলো!
শ্রাবণঃ যতো ইচ্ছা খান! বিল আমার!
আমিঃ নাহ। খাবো না আমি।
শ্রাবণঃ কেনো?
আমিঃ কে জানে কিছু মিশিয়েছেন কিনা!
শ্রাবণঃ অদ্ভুত! এতো অবিশ্বাস? আচ্ছা আমি খেয়ে দেখাচ্ছি। এই দেখুন! শ্রাবণ গপ করে একটা ফুচকা মুখে ঢুকিয়ে খেয়ে নিলো।
শ্রাবণঃ কি ম্যাডাম? এখন বিশ্বাস হয়েছে? আরে আমি অপরিচিত বলেই যে খারাপ এমন কেনো ভাবছেন? নিন না প্লিজ! আমি আর কথা বাড়ালাম না। ফুচকা দেখে এমনিতেই জিভে জল চলে এসেছে আমার। আর তার উপর ফ্রিতে আনলিমিটেড ফুচকা খাওয়ার অফার তো সচরাচর পাওয়া যায় না। আমি শ্রাবণের হাত থেকে প্লেট নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। গপাগপ ১২ প্লেট ফুচকা খেয়ে মন আর পেট দুটোই মোটামুটি শান্ত হলো। এদিকে শ্রাবণের সাথে হঠাৎ চোখাচোখি হতেই দেখলাম ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!
আমিঃ কি হলো?
শ্রাবণঃ আমি ভাবিনি যে আপনার মতো রোগা মেয়ে ১২ প্লেট ফুচকা খেতে পারবে! যাই হোক এবার বলুন নাম্বারটা!
আমিঃ কিসের নাম্বার?
শ্রাবণঃ আরে! অনামিকা রায়হানের নাম্বার!
আমিঃ ওটা তো আজকে পাবেন না।
শ্রাবণঃ কিহ! কেনো?
আমিঃ আমি আপনাকে গতকালকে ফুচকা খাওয়াতে বলে ছিলাম। কিন্ত আপনি আমাকে লেটে খাইয়েছেন। তাই নাম্বারও লেটেই পাবেন!
শ্রাবণঃ চিটিং? ওকে তবে বিলটাও লেটেই হবে। মামা আমি চললাম। পরে এসে বিল দিচ্ছি। ততক্ষণ এই মেয়েকে আটকে রাখুন!!
আমিঃ আরে আরে। এটা কেমন কথা? আপনি আমাকে এভাবে কিভাবে ফেলে যেতে পারেন!
শ্রাবণঃ আচ্ছা তাহলে আপনি বিল মিটিয়ে বাড়ি চলে যান। মামা কতো হয়েছে?
মামাঃ ৩৬০ টাকা!
আমিঃ আরে। এতো টাকা নেই এখন আমার কাছে! খুচরো মিলিয়ে সর্বচ্চো ২৪০ টাকা হবে। মামা বাকি টাকা কালকে দেই?
মামাঃ বাকি দেই না! ওহনি দেন।
আমিঃ এভাবে ইনসাল্ট করছেন আমাকে!
শ্রাবণঃ আমি কি করেছি? আপনি চিটিং করেছেন!
আমিঃ উফফ। সামান্য ফুচকার খাওনোর জন্য বান্ধবীর নাম্বার চাইছেন। এটা কি বেশী বেশী হচ্ছে না?
শ্রাবণঃ এতো কিছু বুঝি না। নাম্বার দিন। আমি এবার বড্ড বিপদেপরে গেলাম। ছেলেটা যে উল্টো আমাকেই জব্দ করবে ভাবিনি। কি করবো ভাবছিলাম এমন সময় মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।
আমিঃ দেখুন। নাম্বার দেওয়াটা তো মুশকিল। আমি বরং আপনাকে ওর ফেসবুক আইডি দিচ্ছি।
শ্রাবণঃ ফেসবুক! না না এসব ফেসবুক টেসবুক দিয়ে লাভ নেই। আপনি নাম্বার দিন।
আমিঃ আরে, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! ফেসবুকে অলওয়েজ থাকে ও। চাইলেই কথা বলতে পারেন যখন তখন।
শ্রাবণ এক মুহুর্ত কি যেনো ভাবলো। তারপর বলল, বুঝবো কিভাবে আপনি অরিজিনাল আইডি দিচ্ছেন কিনা!
আমিঃ এবাউট পড়লেই জানা যায়।
শ্রাবণঃ ওকে দিন।
আমিঃ অনামিকা রায়হান হিয়া। ” এটা ওর আইডি। সার্চ দিলেই পেয়ে জাবেন।
শ্রাবণঃ ওকে! থ্যাংক ইউ।
আমিঃ বিল দিন এবার।
শ্রাবণঃ বিল? সেটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আপনি বাড়ি যান। আর হ্যা, আপনার বান্ধবীকে বলবেন যেনো ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করে। আমি কিছু না বলে বাড়ি গেলাম। ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার। এভাবে অপমান করল! বই হাতে নিয়ে বসে আছি কিন্তু এগুলোই ভেবে যাচ্ছি। কে না কে একটা ছেলে আমার ফেসবুক আইডি জেনে নিলো! ধুর কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
এমন সময় ছোট বোনের আগমন।
অন্তরাঃ কিরে, কি হয়েছে তোর? এই আপু….
আমিঃ উফফ কি আবার হবে?
অন্তরাঃ কি ভাবছিস বলতো? আজ ভার্সিটি থেকে আসার পর থেকে তুই এমন চুপচাপ….?
আমিঃ উহু, চুপচাপ থাকবো না তো কি তোর মতো সারাদিন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করবো? দেখছিস তো পরছি। সামনে এক্সাম। এখন কি আমাকে বিরক্ত না করলে চলছে না?
অন্তরাঃ এই শোন, এতো বয়ান মারিস না। বই উল্টো ধরে কতো যে পড়ছিস তা তো দেখতেই পারছি। হুহ। যাই হোক, মা খেতে ডাকছে। নিচে আয়। আমি গেলাম। অন্তরা হনহন করে বেরিয়ে গেলো। আর আমি মনে মনে বই উল্টো ধরার জন্য আফসোস করতে লাগলাম। সব হয়েছে ওই ছেলেটার জন্য। এই ছেলেটাকে শায়েস্তা না করে শান্তি নেই! আমি ফেসবুকে ঢুকলাম। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট চেক করতেই শুরুতেই পেলাম তার আইডি। সাদা শার্ট পরা একটা ছবি প্রোফাইলে দেওয়া তার। খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
ঘাড় পর্যন্ত সিল্কি চুল! ফর্সা মুখে মিষ্টি হাসি। দারূন লাগছে। এমন চেহারা দেখে রাগের কথা ভুলেই গেলাম কিছুক্ষনের জন্য।পরক্ষণেই নিজের মাথায় নিজেই চাটি মারলাম। দুর্বল হওয়া চলবে না।আমার প্রোফাইলে আমার ছবি নেই। তাই চাইলেও বেচারা আমাকে চিনতে পারবে না। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ঝুলিয়ে রেখে নিচে খেতে চলে গেলাম। পরদিন বাসে উঠেই দেখলাম শ্রাবণ আগে থেকেই বাসে বসে আছে। পাশে সিট খালি। আসে পাশে কোনো সিট খালি না থাকায় ওর পাশেই বসতে হলো। আজকে ও কোনো কথা বলছে না। মেজাজ টা খারাপ হলো আমার। অনামিকা রায়হানের ফেসবুক আইডি পেয়ে গেছে বলে নিজেকে হিরো ভাবছে নাকি? কিছু বলতে যাবো এমন সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করলো।
শ্রাবণঃ সরি!
আমিঃ কিহ?
শ্রাবণঃ আই এম ভেরি সরি। আমার গতকাল আপনার সাথে এমন করা উচিত হয় নি! আমি মনে মনে খুশি হচ্ছি। যাক এতক্ষণ এ লাইনে এসেছে তাহলে! কিন্তু তার পরে কথাটা শুনে আমার সব খুশি নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।
শ্রাবণঃ জানেন অনামিকা রায়হান আমার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করে নি! তাকে একটু বলুন না রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করতে!
আমিঃ ওহ তাহলে এই জন্য সরি বলা হচ্ছিলো?
শ্রাবণঃ না না সত্যি বলেছি। একদম মন থেকে। আই এম সরি!
আমিঃ আচ্ছা? তাহলে এখনি জোরে জোরে “অপরাধী রে” গানটা গেয়ে শোনান।
শ্রাবণঃ হোয়াট দ্যা ফা…!
আমিঃ কি ভয় পেলেন?
শ্রাবণঃ…..
আমিঃ ভয় পেলে বাদ দিন….আর অনামিকাকেও ভুলে যান।
শ্রাবণঃ আরে বোঝার চেষ্টা করুন। পাবলিক প্লেসে গান গাবো? তাও আবার “অপরাধী গান!”
আমিঃ আমি অতো কিছু বুঝি না।
শ্রাবণঃ আচ্ছা ঠিক আছে, অন্তত গানটা চেঞ্জ করে দিন।
আমিঃ এটাই গান।
শ্রাবণঃ আরে ভাই, এই গান পারি না আমি।
আমিঃতাতে আমার কি?
শ্রাবণঃ প্লিজ প্লিজ প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন?
আমিঃ সেদিন আপনি বুঝেছিলেন? ব্লাকমেইল করে ফেসবুক আইডি নিয়ে নিয়েছেন!
শ্রাবণঃ আর হবে না প্লিজ!
আমিঃ ওকে তাহলে নিজে নিজে একটা গান বানান এবং জোরে জোরে গেয়ে শোনান।
শ্রাবণঃ না গাইলে হয় না?
আমিঃ না!
শ্রাবণঃ হুম ঠিক আছে।
আমি মনে মনে খুশি হলাম এবং মানুষের সামনে ওকে কতোটা অপদস্থ হতে হবে সেটা ভেবে মনে মনে শয়তানি একটা আনন্দ ফিল করছি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে গাইতে শুরু করলো “আমায় আপন করে নিও তোমার আকাশ জুরে তুমি রোজ এসো স্বপ্ন হয়ে কুয়াশা জড়ানো ভোরে আমি তোমার অপেক্ষায় শত বছর বসে থাকবো। তোমার অলখে হৃদয় মাঝে তোমারই ছবি একে রাখবো।”
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছি। আসে পাশের লোকের করোতালিতে আমার হুস হলো। বিভিন্ন জনে প্রশংসা করছে। এক অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ে এসে পরলো সেলফি তুলতে! শ্রাবণও সুন্দর হাসি হাসি মুখে সেল্ফি তুলতে দিলো। আমাকে অবাক করে দিয়েই মেয়েটা শ্রাবণের নাম্বার চেয়ে বসলো। কিন্তু তারচেয়েও অবাক হলাম যখন শ্রাবণ মিথ্যে বানিয়ে বলল, সে সেলফোন ব্যবহার করে না। অতঃপর মেয়েটা একটা কাগজে নিজের নাম্বার লিখে শ্রাবণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে “কল মি” বলে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো। মেয়েদের এতো অবনতি হয়ছে ভেবে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এমন সময় কথা বলে উঠলো শ্রাবণ।
শ্রাবণঃ কি ম্যাডাম? অবাক হয়ে কি দেখছেন?
আমিঃ ওই মেয়েটা……
শ্রাবণঃ ওহ। এখনকার স্কুলের মেয়েরা ম্যাচিউর ছেলেদের বেশীই পছন্দ করে। তাই বললাম সেলফোন ব্যাবহার করি না। বলতে বলতেই হাতে থাকা কাগজটা মুচড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো।
আমিঃ তাই নাকি? জানতাম না তো!
শ্রাবণঃ হুহ, আপনি জানবেন কি করে! বেরসিক মানুষ! যাই হোক আমার গান কেমন লাগলো সেটা বলুন!
আমিঃ এটা আপনার বানানো গান?
শ্রাবণঃ এনি ডাউট ম্যাডাম?
আমিঃ অফকোর্স!
শ্রাবণঃ হোয়াট দ্যা হেল! এতো কষ্ট করে বানিয়ে গাইলাম, আর এখন বলছেন বিশ্বাস হচ্ছে না!
আমিঃ ওকে গানটা ভালো হয়েছে! হ্যাপি?
আমিঃ হুহ। আমার হ্যাপি হওয়া না হওয়ায় কি এসে যায়? আপনি হ্যাপি হয়েছেন কিনা সেটাই মুখ্য বিষয়!
আমিঃ হুম, সেটাই বলেই বাস থেকে নেমে পরলাম আমি। পেছন পেছন সেও।
শ্রাবনঃ আচ্ছা এবারের মতো কি ক্ষমা করা যায় না?
আমিঃ কানে ধরুন!
শ্রাবণঃ হোয়াট!!
আমিঃ কি ধরবেন না?
শ্রাবণঃ না মানে….
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে…
শ্রাবনঃ না না। এই যে ধরছি। শ্রাবন ২ হাতে কান ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। এবার কেনো জানি মায়া হলো আমার।
আমিঃ হুম হয়েছে। কান ছাড়ুন। শ্রাবণ কান ছেড়ে আমার পাশে হাটতে শুরু করলো।
আমিঃ আচ্ছা কি এমন দেখেছেন অনামিকার মধ্যে? যে ওর জন্য আমার পিছে ঘুরছেন। খাওয়াচ্ছেন, ভরা বাসে গান গাইছেন। রাস্তায় সকলের সামনে কানে পর্যন্ত ধরছেন। ঘটনা কি? কেও কারো লেখা পড়ে তার প্রতি এতো আকৃষ্ট হতে পারে বলে তো মনে হয় না!
শ্রাবণঃ আপনি বুঝবেন না!
আমিঃ আমি বুঝবো না?
শ্রাবণঃ না মানে… বুঝবেন। কিন্তু এটা টপ সিক্রেট এখন বলা যাবে না।
আমিঃ আচ্ছা? হুম। ইন্টারেস্টিং! ওকে বাই।
শ্রাবণঃ সাবধানে যাবেন। আর অনামিকাকে বলবেন, যেনো রিকুয়েস্ট টা এক্সেপ্ট করে।
আমিঃ ভেবে দেখবো বাড়িতে গিয়ে, শ্রাবণের রিকুয়েস্ট টা এক্সেপ্ট করলাম। সাথে সাথেই নক করলো।
শ্রাবণঃ হাই ম্যাম। আই এম ইউর বিগ ফ্যান। ইউ আর সো ট্যালেন্টেড। এন্ড ইউর স্টোরিজ আর সো ইউনিক।
আমি মনে মনে ভাবছি, লাস্ট টাইম আমার লেখা পরে মা আমার দিকে বেলন ছুড়ে মেরেছিলো। সেখানে এই ছেলে এতো প্রশংসা করছে! মনে মনে খুশি হলাম। কিন্তু ভাব নিয়ে সংক্ষেপে শুধু থ্যাংক্স লিখে অনলাইন থেকে বেরিয়ে এলাম। পরের দিন আবার শ্রাবণের সাথে দেখা।
আমিঃ কি ব্যাপার মিস্টার আজ আবার এসেছেন? অনামিকা রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করেনি নাকি? শ্রাবণ ধুপ করে পাশে এসে বসলো।
শ্রাবণঃ করেছে, কিন্তু আপনাকে থ্যাংক্স বলার ছিলো।
আমিঃ তাহলে বলুন। শ্রাবণ সুন্দর একটা হাসি দিলো।
শ্রাবণঃ থ্যাংক ইউ ভেরি ভেরি মাচ।
আমিঃ ইউ মোস্ট ওয়েলকাম।
শ্রাবণঃ তারপর?
আমিঃ তারপর কি?
শ্রাবণঃ বন্ধু হতে পারি?
আমিঃ এতো তারা কেনো?
শ্রাবণঃ এমনি, আপনাকে ভালোলাগে তাই। আমি শ্রাবণকে কিছু বলার আগেই ও সিট ছেড়ে উঠে বাস থেকে নেমে গেলো। জানালা দিয়ে তাকাতেই চিৎকার করে বলল
শ্রাবণঃ ভেবে দেখবেন। সবাই বলে আমি খুব ভালো বন্ধু হতে পারি। ডোন্ট মিস মি…..
বাসটা ছেড়ে দিয়েছে। এমন সময় ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে শেষবারের মতো শ্রাবণকে দেখে নিলাম। ছেলেটা পাগল। হুট হাট এমন কথা বলে আমাকে থমকে দেয়। জানি না কেনো, আমারো ওকে ভালোলাগে। বাড়িতে এসে দেখলাম আগেই টেক্সট করে রেখেছে শ্রাবণ।
শ্রাবণঃ আপনার বান্ধবী খুব রুড জানেন! কিছুতেই আপনার আইডি দিচ্ছিলো না। কতো কষ্ট করতে হয়েছে জানেন?
আমিঃ হুম জানি, ও বলেছে।
শ্রাবণঃ কি বলেছে?
আমিঃ আপনাকে কেনো বলবো?
শ্রাবণঃ ওহ। একজোট হয়েছেন। কারো কথা কেও বলেন না!
আমিঃ না।
শ্রাবণঃ বলুন না প্লিজ।
আমিঃ ওকে তাহলে একটা গান শোনান।
শ্রাবণঃ ওরে বাবা গান! না না, আমি গাইতে পারি না।
আমিঃ মিথ্যে বলছেন? ঈশানা বলেছে আমাকে। আপনি নাকি ভালো গান পারেন আর সবার সামনে গেয়ে শুনিয়েছেন। আর এখন আমাকে শোনাতে পারছেন না। আবার নাকি আপনি আমার ফ্যান।
শ্রাবণঃ আপনারা ২ বান্ধবী খুব ভালো ইমোশোনাল ব্লাকমেইল করতে পারেন।
আমিঃ হুম, তা পারি। এখন গান গেয়ে শোনান।
শ্রাবণঃ আচ্ছা দেখা করুন তাহলে সামনাসামনি গেয়ে শোনাচ্ছি। আপনার জন্য তো পুরো দুনিয়ার সামনে গেয়ে শোনাতে পারি।
আমিঃ হোয়াট আ ফিল্মি ডাইলগ!
শ্রাবণঃ আপনি হয়তো জানেন না, ফিল্মি ডাইলগে মেয়েরা বেশী ইম্প্রেস হয়।
আমিঃ আচ্ছা? তো আপনি আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছেন?
শ্রাবণঃ অবশ্যই, এনি ডাউট?
আমিঃ কেনো?
শ্রাবণঃ এমনি আপনাকে ভালোলাগে।
আমিঃ সব মেয়েকেই ভালো লাগে আপনার? শুনলাম এই কথা নাকি আমার বান্ধবীকেও বলেছেন!
শ্রাবণঃ সব খবরই রাখেন দেখছি!
আমিঃ যেটা জিগেস করছি সেটা বলুন।
শ্রাবণঃ সবাইকে বলি না। যাকে ভালো লাগে শুধু তাকে বলি।
আমিঃ ওহ! গুড
শ্রাবনঃ আচ্ছা কি করছেন?
আমিঃ তা জেনে আপনার কি?
শ্রাবণঃ অনেক কিছু। আপনাকে ইম্প্রেস করতে হলে আপনার বিষয়ে জানতে হবে তো!
আমিঃ ওভার স্মার্ট!
শ্রাবণঃ তা তো একটু বটেই…..
আমিঃ আমি ঘুমাবো। আপনার সাথে পরে কথা হবে।
আমি অফ লাইন হয়ে গেলাম। পরের দিন বাসে শ্রাবণের সাথে দেখা হলো আবার আর এভাবে প্রতিদিন।
জানিনা কেনো শ্রাবণকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম। বন্ধুত্বটা অনেকদুর এগিয়েছে আমাদের। ও ফেসবুকে থাকলে ঈশানার কথা বলে সারাক্ষণ আর ঈশানার সাথে থাকলে অনামিকার কথা বলে। জানি না কাকে বেশী পছন্দ করে। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পরছিলাম ওর প্রতি, সেই দুর্বলতা যে ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে সেটা বুঝেছিলাম সেদিন, যেদিন বাসে ও আমার সাথে দেখা করতে এলো না। আমি বাস থেকে নেমে বাস স্ট্যান্ডে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টির ভেতর দাঁড়িয়ে ছিলাম শুধু ওর অপেক্ষায়। আমি ওকে ফোন করতে পারিনি, কারন এতো দিনের পরিচয়ের পরেও নাম্বার ছিলো না। শ্রাবণ চেয়েছে বহুবার। ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে দেওয়া হয়নি। কোন অজানা দুশ্চিন্তায় দাড়িয়েছিলাম জানি না। বাড়ি ফিরে ফেসবুক চেক করতেই দেখলাম শ্রাবণ ফেসবুকে লিখেছে সে সিলেট যাচ্ছে। খুব দুঃখ হলো এটা ভেবে যে সে আমায় বলে যায় নি। সেবার জ্বরে পরলাম। ৭ দিন বিছানায়।
এই সাত দিনে কলেজে যাইনি। আর ফেসবুকেও ঢুকি নি। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম হয়তো শ্রাবণ বুঝে গেছে। ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম প্রায় শ খানেক ম্যাসেজ জমে আছে। আমরা ২ জন একসাথে কোথায় গায়েব হয়ে গেলাম, ঈশানা কেনো কলেজে যায় না, আমি কেনো ফেসবুকে আসি না এসব লিখেছে। আমার মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করতে লাগলো। ও কাকে বেশী পছন্দ করে? ঈশানা নাকি অনামিকা? যেভাবেই হোক জানতে হবে। যদি ঈশানাকে পছন্দ করে তবে বলে দেবো ঈশানা আর অনামিকা ২ জন একজনই। আর যদি অনামিকাকে পছন্দ করে যদি বলে আমি ওকে ধোকা দিয়েছি! আমি আর ভাবতে পারছি না। যেভাবেই হোক, আজ এই খেলা শেষ করতে হবে। আমি শ্রাবণকে ম্যাসেজ দিলাম।
আমিঃ ঈশানা আজ তোমার সাথে দেখা করবে। সময় মতো যেও। আর সবটা ওর থেকেই জেনে নিও। অনলাইন থেকে বের হয়ে সোজা কলেজে চলে গেলাম। ফেরার পথে দেখি কলেজের বাহিরে শ্রাবণ আগে থেকেই দাড়ানো। আমাকে দেখেই এগিয়ে এলো। জ্বরে আক্রান্ত আমার শুখনো মুখ দেখে প্রশ্ন করল।
শ্রাবণঃ হেই, কি হয়েছে তোমার?
আমিঃ কিছু না। চলো বসি। আমি পাশের একটা বেঞ্চের উপর ধুপ করে বসে পরলাম।
শ্রাবণঃ কি হয়েছে, এই ২ দিন কোথায় ছিলে? এতো অসুস্থ কেনো মনে হচ্ছে তোমাকে?
আমিঃ কিছু না, সামান্য জ্বর হয়েছিলো। আর ২ দিন না ৭ দিন।
শ্রাবণঃ কতোবার তোমার নাম্বার চেয়েছি বলতো? এতটুকু বিশ্বাস করতে পারো না? কতো দুশ্চিন্তায় ছিলাম জানো?
আমিঃ তোমার জন্যই হয়েছে।
শ্রাবণঃ আমি? আমি কি করলাম?
আমিঃ কিছুনা। তুমি সিলেট কেনো গিয়েছিলে?
শ্রাবণঃ আমার দাদু মারা গেছেন। সে জন্য। আর এজন্যই বলে যেতে পারিনি। পরশুই এলাম আর দেখি তুমি কলেজ আসছো না।
আমিঃ একটা কথা বলার ছিলো তোমাকে।
শ্রাবণঃ কি?
আমিঃ জানি না তুমি কিভাবে রিয়েক্ট করবে। কিন্তু….
শ্রাবণঃ….
আমিঃ আচ্ছা আগে বল তুমি কাকে বেশী পছন্দ করো? আমাকে নাকি অনামিকাকে?
শ্রাবণঃ ২জনকেই।
আমিঃ ঠিক করে বল। যে কোনো এজনকে বেছে নাও।
শ্রাবণঃ আচ্ছা এসব কথা কেনো বলছো!
আমিঃ দরকার আছে। তুমি বল….
শ্রাবণঃ এখানে এসব বলার পরিবেশ নেই।
আমিঃ তাহলে চল আমার সাথে.
শ্রাবণঃ কোথায়?
আমিঃ চুপচাপ চল। শ্রাবণের বাইকের পিছে উঠে পরলাম।
শ্রাবণঃ কি করছো তুমি?
আমিঃ কথা কম বলো আর উঠে বসো। আর চলো। শ্রাবণ উঠে বসলো।
শ্রাবণঃ কোথায়?
আমিঃ আমি বলছি, উঠো তুমি। আর যেটা জিগেস করছি সেটা বল। শ্রাবন ফাকা রাস্তায় ফুল স্পিডে বাইক চালাচ্ছে।
শ্রাবণঃ এখন এগুলো বলা কি জরুরি?
আমিঃএতো কিছু জানি না। আগে উত্তর দাও। কথাটা শুনে শ্রাবণ এক মুহুর্তের জন্য চুপ হয় গেলো। তারপর যা বলল তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
শ্রাবণঃ আমি তোমাদের ২ জনকেই চাই।
আমিঃ তার মানে?
শ্রাবণঃ তুমি জানো তোমাকে আমি প্রথম কোথায় দেখেছি?… আমাদের কলেজের ক্যাম্পাসে। যেখানে তোমার বোন অন্তরা পরে। কলেজের ফাংশনে এসেছিলে তুমি। সবুজ শাড়ি, কাচের চুরি, খোলা চুল। প্রথম দর্শনেই আমার হৃদয়ের ফিউজ উড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলে। এক পলকে তোমার প্রেমে পরে গিয়েছিলাম। খোজ নিয়ে জানলাম তোমার বোন এখানে পড়ে। জানিনা তোমার বিশ্বাস হবে কিনা, তোমার বিষয়ে জানতে রোজ বাহানা খুঁজে তোমার বোনের সাথে কথা বলতাম। এট লাস্ট কাকতালীয় ভাবে তোমার দেখা মিললো বাসে। আমি শুরু থেকেই জানতাম তুমি অনামিকা। আমার সাথে তুমি যেই মজাটা করতে চেয়েছিলে আমি চাইনি সেটা নষ্ট হোক। আমি চাইনি তুমি দুঃখ পাও। বিশ্বাস করো।
একটানা কথা গুলো বলে শ্রাবণ থামলো। এমন কিছু শুনবো আমি ভাবি নি। এক মুহুর্ত যেন থমকে ছিলাম। হয়তো শ্রাবণও। হঠাৎ সামনে তাকাতেই একটা বাসের সাথে ধাক্কা লাগলো। শ্রাবণ রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পরে আছে। আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে, “ওর কিছু হলে আমি মরে যাবো।” আসে পাশে ভীর। হইচই। শ্রাবণের তখনো জ্ঞান আছে। আমার হাত ধরা। নিচু স্বরে একটা কথাই বলল,”তোমাকে খুব ভালোবাসি।” জ্ঞান হারানো শ্রাবণ কে নিয়ে আমি হাসপাতালে পাগলের মতো ছুটছি। তারপর আর কিছু মনে নেই। হাসপাতালের মেঝেতেই পরে জ্ঞান হারালাম।
৪ মাস পর…
আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সেদিনের এক্সিডেন্ট এর পর সব কিছু জানাজানি হয়েছে ২ পরিবারের ভেতর। শ্রাবণের বড় পরিবার, ওর বাবা অন্তিদের কলেজের প্রিন্সিপাল। শ্রাবণেরও পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে। কারোই এই বিয়েতে অমত ছিলো না। স্বপ্নের মতো বিয়ের দিন এগিয়ে এলো। সবার খুশি, আনন্দ মাখা চেহারা… সবটা যেনো স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন সবসময় সত্যি হয় কি? অনন্যা ডায়রীর বাকি পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো। না আর কিছু লেখা নেই। শুধু তার বাবার একটা প্রানবন্ত ছবি আছে। বাবাকে কখনো এতোটা প্রানবন্ত দেখে নি ও। খালামনির ডায়রীটা বন্ধ করে যায়গা মতো রেখে দিলো। ওর মনে এখন অনেক প্রশ্ন। ওর বাবা ওর খালামনিকে এতো ভালোবেসেও বিয়েটা ওর মা অন্তরাকে কেনো করলো? অনামিকা খালামনি কোথায়? আর বাড়ির সবাই ওকে অপছন্দ করে কেনো? এর উত্তর এক মাত্র ওর মাই দিতে পারবে। পরদিন সকালেই মাকে প্রশ্ন করে বসে অনন্যা।
অনন্যাঃ মা খালামনি এখন কোথায়? অন্তরা চমকে ওঠে মেয়ের প্রশ্ন শুনে।
অন্তরাঃ হঠাৎ এই প্রশ্ন?
অনন্যাঃ ছোট থেকেই শুনছি খালামনি আর বাবার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। কিন্তু….
অন্তরাঃ কিন্তু তুমি কি জানো না তোমার খালামনি বিয়ের দিন অন্য এক ছেলের সাথে পালিয়ে যায়?
অনন্যাঃ কিন্তু খালামনি তো বাবাকে ভালোবাসতো।
অন্তরাঃ আমরাও তাই ভাবতাম কিন্তু ও তোমার বাবাকে ধোকা দিয়েছিলো। জানি না কেনো এমন করেছিলো ও। সেই দিনটার কথা ভাবতে পারি না। আমরা কতো ভালোবাসতাম ওকে, কিন্তু ও…. বিয়ের দিন ওর ঘর থেকে চিঠি পেলাম, আদিত্য নামের এক হিন্দু ছেলেকে ও ২ বছর ধরে ভালোবাসতো। তোর বাবার সাথে যেটা ছিলো সেটা অভিনয়। ও নাকি এ কথা বলতে চেয়েছে বহুবার কিন্তু পারেনি, তাই পালিয়ে গিয়েছে। অন্তরার চোখে পানি। অনন্যার কষ্ট হয়। মনের ভেতরে একটা কথাই চলতে থাকে খালামনি একজন প্রতারক।
অনন্যাঃ সরি মা। আর কখনো খালামনির কথা বলবো না। প্লিজ তুমি কেঁদো না। আচ্ছা আমি যাচ্ছি কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অনন্যা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বাহিরে দমকা হাওয়া বইছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। অন্তরা দেওয়ালে টানানো নিজের বিয়ের ছবির দিকে তাকায়। হঠাৎ ওর চোখ চকচক করে উঠে। ঠোটের কোনে ক্রমশ এক চিলতি হাসি ফুটে উঠে। নিষ্ঠুর বিজয়ের হাসি। আর তারপর?থাক আর কাজ নেই।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা