পবিত্র সম্পর্ক

পবিত্র সম্পর্ক
– আপনারা সম্মতি দিলে একটা কথা বলতে চাই আমি।
– হ্যাঁ বলো মা।
– আমি চাই বিয়ের আগেই যেন আমার দেনমোহরের টাকা আপনারা পরিশোধ করেন।
এ কথা শুনে মোটামুটি ঘরে উপস্থিত সবাই একে অন্যের দিকে চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে।করবে বা ই কেন? হবু বউ লজ্জা-শরম ভুলে এভাবে এ কথা বলে বসতে পারলো?
আমি সম্পূর্ণা।আমার সামনে বসে আছে আমার হবু বরের পরিবার।আজ আনুষ্ঠানিক ভাবেই আমার আর নিহানের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলো।সেই সঙ্গে আংটি বদলও হয়ে গেলো।বিয়েটা একদমই এরেঞ্জ ম্যারেজ। কথাবার্তার এক পর্যায়ে বিয়ের আয়োজন ও দেনমোহর নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। দু পক্ষের সম্মতিতে দেনমোহর ধার্য করা হলো, পঁচিশ লাখ টাকা। আমার এমন প্রস্তাবে পাত্রের খালা বলে ই বসলেন, “আজকালের যুগের মেয়েরা কত নির্লজ্জ! কই আমাদের বিয়ের এতো বছর হলো, কিন্ত দেনমোহরের এক টাকায় চাইনি!” আমার দিকে আমার বাবা-মা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।মা বারবার ইশারায় মানা করছে যেন কিছু না বলি।তারপরও বলে ফেললাম,
– তার মানে এটা দাঁড়ায় আপনায় বিয়ে এখনো বৈধতা পায় নি আন্টি।
– মানে?বিয়ে আবার বৈধ কেন হবেনা?
– ইসলামে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে ই যেন তার দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা হয় অথবা কোনো প্রকার সমস্যা হলে স্ত্রীর নিকট অনুমতি চেয়ে সে টাকা যেন আস্তে আস্তে ই দেয়া হয়।নাহয় এ টাকা পরিশোধ না করা অব্ধি বিয়ে অবৈধ হিসেবে স্বীকৃত হবে। আমার কথা শুনে এবার পাত্রের মা মুখ খুললেন,
– সবই বুঝলাম মা।তবে এই মুহুর্তে এতো টাকা?
– আন্টি আমি বলছি না এতো বড় অংকের টাকা আপনাদের দিতে হবে।আপনাদের যা সামর্থ্য রয়েছে তা ই দিবেন।এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। দেনমোহর নিয়ে আমার পরিবার ও পাত্রের পরিবারে মোটামুটি ঝামেলা বেধে গেলো।দুই পক্ষ সময় চাইলো সিদ্ধান্ত নেয়ার।বাবা-মা সহ আমাকে সবাই কথা শোনাতে শুরু করলো।তবুও আমি ঠান্ডা মাথায় বাবা-মাকে আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালাম,
– আচ্ছা বাবা তোমার আর মায়ের দেনমোহর কত ছিল?
– সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী ত্রিশ হাজার টাকা।কেন?
– তুমি কি তা মাকে পরিশোধ করেছো?
– না।এইযে তোর মাকে টুকটাক টাকা দেই এসবেই তো ওই টাকার বেশি পরিশোধ করা হয়ে গেছে।
– উঁহু, ওই টাকার হিসেব তো আলাদা তাই না বাবা?
এবার মা আমাকে থামিয়ে বললেন,
– আচ্ছা মা মানলাম আমি। কিন্ত ওরা যদি কম দেনমোহরের টাকা দেয় লোকে কি বলবে বল?
– মা, লোক দেখানো নিয়মেই তো এতো বছর এ সমাজ চলেছে।
এইযে এতো লাখ লাখ টাকার দেনমোহর দিয়ে বিয়ে হয়, কয়জনের সামর্থ্য আছে বলো এতো টাকা দেয়ার?তবু শো-অফ তো করতেই হবে।আর এই শো-অফের কারণে কত বৈবাহিক সম্পর্ক এখনো অবৈধ তা জানো মা?
দু’দিন পর পাত্রের বাবা ফোন দিয়ে খুশি হয়ে বিয়ের আয়োজন করার কথা বললেন।সেই সাথে এ ও জানিয়ে দিলেন আমাদের পক্ষ থেকে যেন কোনো প্রকার জিনিসপত্র না দেয়া হয়।বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব তাদের।তারপরও বাবা-মা আপত্তি করলেন এতে।তখন আমার হবু শ্বশুর বলেন, “দেখুন বেয়াই, আমরা সত্যি ভাগ্যবান এমন মেয়েকে ঘরের বউ করতে পেরে।তারচেয়ে বড় কথা আমার ছেলে আপনার মেয়েকে পছন্দ করেছে তাই সে আমাদেরকে বুঝিয়ে বললো আপনার মেয়ে যদি দেনমোহরের বিষয়ে এমন সুন্দর প্রস্তাব রাখতে পারে তবে আমরা কেন নয়?
দেখুন আমাদের যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা নাহয় এসব করতে পারবো কিন্ত আমাদের এইসব অদ্ভুত নিয়মের জন্য সমাজে একপ্রকার বাধ্য নিয়ম তৈরি হয়েছে, যার ভুক্তভোগী হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ছেলে-মেয়ের বাবা-মায়েরা। আমরা নিজেরা পরিবর্তিত নাহলে কিভাবে বলুন সমাজের পরিবর্তন হবে?” দু পক্ষের মতামতের ভিত্তিতেই বিয়েটা সম্পূর্ণ হলো। আমার ও নিহানের ইচ্ছেতে বিয়ের প্রধান অতিথী ছিল – সুবিধাবঞ্চিত সকল মানুষেরা।কেননা লোক দেখানো বিয়ে আমরা চাইনি।তাছাড়া যারা তিনবেলা খেতে পায় তাদের জন্য এতো আয়োজন করে কি লাভ যদি যারা তিনবেলার একবেলাও খাবার না পায় তারা ই এর অংশীদার না হয়। বিয়ের প্রথম রাত। আমি নিহানের জন্য অপেক্ষা করছি।তাকে ধন্যবাদ দেয়া প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পর ই নিহান আসলো রুমে।পাশে বসলো। আমার দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এতে খুব বেশি না এক লাখের মত টাকা আছে।আমার নিজের রোজগারের টাকা।যদিও চাইলে ই বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে পারতাম, কিন্ত চাইনি। আমার বউকে নিজের টাকায় দেনমোহর দিতে চেয়েছি।
– আপনাকে ধন্যবাদ দেয়ার ছিল।
– কেন?
– এইযে এতো সুন্দর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।
– আসলে ধন্যবাদ আপনাকে দেয়া উচিত।আপনি সেদিন আমার চোখ খুলে না দিলে হয়তো আমিও এ সমাজের ট্রেন্ডটাকে ই মেনে নিতাম।দেখুন সত্যি বলতে কি এ সমাজের এমন উদ্ভট নিয়মের জন্য আমরা নিজেরা দায়ী।আমরা সবাই যদি নিজেদের পরিবর্তন না করি তবে দেখুন এই সমাজে বেশি ভুগবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর বাবা-মায়েরা।
– আমি সত্যি সৌভাগ্যবতী আপনাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে।
– আমিও জানেন খুব সৌভাগ্যবান। আচ্ছা যাইহোক একটু ফ্রেশ হয়ে ওজু করে আসুন তো।
নিহানের কথা অজু করে আসলাম।নিহান পাশাপাশি দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে বললো আমায়, ” একটা নতুন সম্পর্কের শুরু হবার আগে আসুন নামাজ আদায় করি আগে ” আজকের রাতের চাঁদটা খুব সুন্দর।আমি ও নিহান ছাদে দু’জনে পাশাপাশি বসে গল্প করছি।
– তুমি করি বলি সম্পূর্ণা?
– হ্যাঁ, অবশ্যই!
– আমি না শুধু, তোমাকেও আমায় তুমি করে বলতে হবে।
– আচ্ছা, চেষ্টা করবো।
– উঁহু চেষ্টা নয়।আরে লজ্জা পেয়ো না আমি কিন্ত আজ থেকে স্বামী কম বন্ধু বেশি।প্রতিটা সম্পর্ক বন্ধুর মত হওয়া উচিত, বুঝলে?
– হুম, জনাব।বুঝলাম।
– আচ্ছা চলো অনেক রাত হলো।সারাদিন কত ধকল গেলো।কাল ভোরে তো উঠতে হবে। তোমায় নিয়ে একটা জায়গায় যাবো।
– কোথায়?
– ওহ, তোমাকে তো বলা হয়নি।যেহেতু বিয়ের বাজেট ছিল অনেক টাকার কিন্ত এতো অনুষ্ঠান করিনি তাই অর্ধেক টাকা ই বেঁচে গেছে।তাই আমি চাইছিলাম এ টাকায় সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য এমন কিছু করতে এই যেমন যা দিয়ে ওরা সাবলম্বী হতে পারে।
– তা তো বেশ ভালো।
– হুম ম্যাডাম।চলুন ঘুমাতে হবে।
আর হ্যাঁ আজ থেকে কিন্ত প্রতিদিন ফজরের আজানের সময় ডেকে দিবেন।দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করবো। ভোরে আমি আর নিহান নামাজ আদায় শেষ করে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি আর প্রকৃতি দেখছি।দেখছি সূর্য উদয়ের সময়ের আকাশটাকে।আজকের দিনটা অন্যরকম। অনেক সুন্দর ও পবিত্র একটি দিন।সেই সাথে জীবনের নতুন একটি পবিত্র অধ্যায় শুরু হচ্ছে আজ থেকে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত