তোয়ালে দিয়া মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলেন লেখক । যে গল্পটায় হাত দিয়েছেন সেটা শেষ করা দরকার । অনেকদিন থেকে মাথায় ঘুরঘুর
করছিল । এর মধ্যে কয়েকবার লেখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ঠিকমতো সাজানো হচ্ছিল না । ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিতে দিতে বাস্কেট প্রায় পরিপূর্ন । গতরাতে আবার
কিছুটা লিখেছেন । স্টার্টিংটাও বেশ ভালো হয়েছে । গল্পটা চিরাচরিত প্রেমের গল্প । তোয়ালেটা চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে রেখে লিখতে বসলেন আবার । সাদা কাগজের
উপর বলপয়েন্ট একটানা খশখশ করে চলছে । তার গল্পের নায়ক জয় এবং নায়িকা জয়িতা । দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক তাদের । সেই ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই । জয়
জয়িতার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিল । কিভাবে কিভাবে যেন একে অপরকে ভালো লেগে যায় । তারপর বন্ধুদের সহযোগীতা , নিজেদের প্রবল ইচ্ছায় আজকে
দুজনে একত্রে । ছোট্ট এক ঝামেলায় তাদের চার বছরের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার উপক্রম । ছোট্ট বললে অবশ্য ভুল হয় ।সামান্য একটা ঘটনা বা ঝামেলা বলে উল্লেখ
করা যায় । সমস্যাটা হচ্ছে জয়িতা এবার ফাইনাল দেবে । বাসায় পাত্র দেখছে । ইতোমধ্যে দুজন এসে দেখে গেছে । আর ওদিকে জয় এখনো বেকার । পার্কে বসে এ
ব্যাপারে দুজনের কথোপকথনঃ জয়িতাঃ বাসায় কি চলছে তার সবই তো শুনলে । আমি যে কী কষ্টে আছি কীভাবে বুঝাবো তোমাকে ?? কিছু বলছো না কেন ? জয়ঃ কি
বলব ? জয়িতাঃ কি বলব মানে ? তোমার কী কিচ্ছু বলার নাই ? কিচ্ছু করার নাই ? জয়ঃ কি করতে বলো আমাকে ? এ মুহুর্তে কি করার থাকতে পারে আমার ? আমি
বেকার । এখনো মেসে থাকি । একটাকা কামাই করতে পারিনি এখনো । কীভাবে দাঁড়াব তোমার বাবা মার সামনে ? কতদিন অপেক্ষা করিয়ে রাখবো তোমাকে ?
জয়িতাঃ ও । তাহলে তুমি কিছু করবেনা । চুপচাপ দেখে যাবে আমি কীভাবে অন্যের হই ? নাকি তুমি তাই চাও ? পরিষ্কার করে বলো না ক্যানো ? জয়ঃ আপাতত আমার
কিচ্ছু করার নেই জয়িতা । তুমি ভালো করেই জানো সেটা । আমার জন্য বসে না থেকে কোন ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলো । অনেকক্ষন কিছু বলতে পারলো না
জয়িতা । কোন রকমে কান্নাটা গলার কাছে চেপে রেখে উঠে চলে গেল । অন্যদিন হলে জয় তাকিয়ে থাকতো জয়িতার গমনপথের দিকে । আজ আর পারছেনা ।
নিজেকে বড্ড ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে । অন্যদিকে তাকিয়ে কষ্ট চেপে রাখার চেষ্টা করতে থাকলো জয় । ২…… পাশের রুম থেকে প্রান্তর গলার স্বর ভেসে আসছে । লেখক
লেখা ছেড়ে উঠে পড়ল । প্রান্ত ঘুম থেকে জেগেছে ওকে একটু দেখে আসা দরকার । পাশের রুমের দিকে হাটা দিল লেখক । প্রান্ত লেখকের একমাত্র ছেলে । বয়স ৮
বছর ২মাস ২১ দিন । প্রান্ত মানসিক প্রতিবন্ধী । অন্যান্য আর দশটা ছেলেমেয়ের তুলনায় তার বুদ্ধির বিকাশ অনেক অনেক ধীর । গাত্রবর্ণ উজ্জল শ্যামলা । একদম
রাজপুত্রের মতো । এটা অবশ্য পেয়েছে নীলার কাছ থেকে । নীলা লেখকের স্ত্রী । ভালো গান গায় , ভালো আবৃতি করতে পারে । লেখক চলে আসে রুমে । চেয়ারে বসে
কলম হাতে লিখতে বসে যায় । মুখে বিজয়ীর হাসি । লেখক প্রান্তের কাছে পৌঁছানোর আগেই নীলা পৌঁছে গেছে । দরজার পাশ থেকে লেখক কিছু প্রান্ত আর নীলার
কথা শুনতে লাগলোঃ প্রান্তঃ “পান্ত আর ঘুমাবে না । পান্তর ঘুম নেই । পান্ত আর ঘুমাবে না” নীলাঃ “না বাবা ! প্রান্তকে যে ঘুমাতে হবে । না ঘুমালে যে তুমি সারারাত
জেগে থাকবে ! ঘুমাও বাবা । আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ।” নীলা প্রান্তের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে । কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে প্রান্ত । নীলা উঠে
আসে । দরজার চৌকাঠে দাড়িয়ে দেখছিল লেখক । নীলা কাছাকাছি এসে দাড়ায় । কিছুক্ষন লেখকের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ডায়নিং টেবিলের দিকে যায় নীলা
পেছন পেছন লেখকও হাটা দেয় । কিছুদিন যাবত নীলা একটু অভিমান করে আছে । তার অভিযোগ হচ্ছে লেখক সংসারে সময় দিচ্ছেন না !লেখক নিজেও বুঝতে
পারছেন সংসারে তার যেটুকু সময় দেয়া উচিত তিনি তা দিতে পারছেন না । কিন্তু কী করবেন ? লেখালেখিতে এত সময় চলে যায় যে অন্যদিকে মনোযোগ দেয়ার
সময়ই থাকেনা । যাই হোক এই মুহুর্তে নীলার অভিমান ভাঙানোটা জরুরী হয়ে পড়েছে । লেখকঃ “ইয়ে…. নীলা …মানে এক কাপ চা দিতে পারবে ? ” নীলাঃ “এখন
পারব না । অনেক কাজ পরে আছে । বানিয়ে নিয়ে খাও ।” ডায়নিং টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বললো নীলা । লেখকঃ “না মানে ….আসলে তোমার হাতের চা খেতে
ইচ্ছে করছে ! দাও না এককাপ !” নীলাঃ “বললাম তো পারবো না । ঢং করবা না খবরদার আমার সাথে ।” লেখকঃ “রাগ করে আছো আমার উপর ??” নীলা নিশ্চুপ !
পরিষ্কার হয়ে যাওয়া টেবিলটা অযথাই আবার পরিষ্কার করছে । গুছিয়ে রাখা প্লেট , গ্লাস আবার গুছাতে শুরু করলো । লেখকঃ “শেষবারের মতো ক্ষমা করা যায় না ?”
টেবিল ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ায় নীলা । কোমড়ে হাত । কপাল পেরিয়ে ডান চোখের দিকে নেমে আসা অবাধ্য চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয় । নীলাঃ “তোমার
শেষবার কবে শেষ হবে ?” মুচকি হাসে লেখক । মোম গলতে শুরু করেছে । চোখদুটো ছোট করে ভ্রু দুটো উপরে তুলে তাকায় লেখক । লেখকঃ “আর হবেনা , সত্যি !
এই যে কানে ধরছি । এবারেই শেষ । আই কসম ।” সত্যি সত্যি দুহাতে কান ধরে লেখক । নীলাঃ “ঠিকাছে । ঠিকাছে । তুমি রুমে যাও আমি চা আনছি ।” হাসি চেপে রেখে
বলে নীলা । লেখক চলে আসে রুমে । চেয়ারে বসে কলম হাতে লিখতে বসে যায় । মুখে বিজয়ীর হাসি । ৩… বাসরঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোক জয় । ফুল দিয়ে
ফুলময় শয্যার মাঝখানে ঘোমটা দিয়ে দু হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে জয়িতা । এগিয়ে যায় জয় । আস্তে করে জয়িতার পাশে গিয়ে বসে । খুব ধীরে ঘোমটা সরিয়ে দেয়
। থুতনি ধরে মাথাটা তুলতেই লাল চোখ মেলে তাকায় জয়িতা । তারপর ‘ খুব ঘুম পাচ্ছে ‘ বলে জয়ের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে জয়িতা । অবাক
হয়ে যায় জয় । কতকিছু ভেবে রেখেছিলো জয় । প্রাণভরে কথা বলবে আজ । আয়নার সামনে দাড়িয়ে কয়েকবার প্রাকটিসও করে এসেছে । কবিতাও লিখেছিল দু
একটা । পকেটে করে নিয়ে এসেছে শোনাবে বলে । কিন্তু কিসের কী ? যাকে শোনাবে বলে এত কিছু , যার সাথে গল্প করবে বলে এত কথা সেই তো ঘুমিয়ে ! শুয়ে পড়ল
জয় । মাথার নিচে দুহাত রেখে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল । ভাবতে লাগলো আজকের কথা । জয় ভাবতেও পারেনি যে জয়িতার সাথে তার বিয়ে হবে । সে
আশা সেদিন পার্কে বসে কাগজের টুকরোর মতো করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল । কিন্তু পরদিনই ডাকে একটা চিঠি পায় জয় । এপয়েন্টমেন্ট লেটার । লাস্ট যে মাল্টি
ন্যাশনাল কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিয়েছিল সেখান থেকে এসেছে । ঝাড়া তিনবার চোখ বুলালো লেটারটার উপর । বিশ্বাস করাটা খুব কষ্টকর । যখন বিশ্বাস হলো তখন
মনে পড়ল জয়িতার কথা । একমুহুর্তেই রেডী হয়ে জয়িতাদের বাসার দিকে রওনা হয়ে যায় । জয়িতাদের বাসার কলিংবেলে চাপ পড়ার পর থেকে কীভাবে কীভাবে যেন
কী হয়ে গেলো । আর এই মাঝরাতে জয় নিজেকে জয়িতার পাশে আবিষ্কার করছে তার বর হিসেবে । প্রশান্তির একটা হাসি ঠোঁটে নিয়ে ঘুমাতে যায় জয় । মাঝরাতে ঘুম
ভেঙে যায় জয়ের । পাশে হাত দিয়ে দেখে জয়িতা নেই । জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে ঘরে । উঠে দাঁড়ায় জয় । ব্যলকনিতে এসে দাড়ায় । জয়িতা রেলিংয়ে
হাত রেখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে । কাছে এগিয়ে যায় জয় । জয়িতার গালে মুক্তোর মতো চিকচিক করতে থাকা দু ফোঁটা অশ্রু দেখতে পায় । পেছন থেকে
জয়িতার কাঁধে হাত রাখে জয় । জয়িতা ফিরে তাকিয়ে জয়ের বুকে মুখ গুজে দেয় । চোখ দিয়ে অজস্র মুক্তো বর্ষিত হতে থাকে জয়িতার । মুছে দিতে গিয়েও দেয়না জয়
। সব অশ্রু মুছতে নেই । ৪…. গল্প শেষ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়ায় লেখক । একটানা লেখে যাওয়ায় হাত সামান্য ব্যাথা করছে । মাথাও হালকা ধরেছে । এককাপ চা
পেলে মন্দ হতো না ! চেয়ারের পিঠ থেকে তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুম চলে যায় লেখক । ফ্রেশ হওয়া দরকার । মিনিট পাঁচেক পর বের হয়ে এলেন লেখক । বেডরুমে
ঢুকলেন নীলাকে চায়ের কথা বলার জন্য । বিছানায় শুয়ে আছে নীলা । পাশে গিয়ে বসলেন লেখক । নীলার বাহুতে হাত রাখতেই লেখক চমকে উঠল । নীলা কাঁদছে ।
নিঃশব্দ কান্না । আস্তে করে নীলা বলে ডাকতেই নীলা পাশ ফিরে লেখকের বাহুতে মুখ ঢেকে সশব্দে কাঁদতে শুরু করল । “কি হয়েছে নীলা ?” বলতেই আরো কেঁপে
কেঁপে কাঁদতে শুরু করলো নীলা । লেখক নীলার মাথায় হাত বুলাতে লাগল । কিছুক্ষন সময় দিল লেখক । “কেন আমাদের সাথে এমন হলো বলো তো ? কেন ? প্রান্ত
কেন অন্যদের মতো স্বাভাবিক হলো না ? কেন ?” আবার সশব্দে কাঁদতে শুরু করলো নীলা ।লেখক চুপ করে থাকলেন । প্রতিরাতেই প্রান্তকে ঘুম পাড়িয়ে এসে নিঃশব্দে
কাঁদত নীলা । বুকের ভেতরে জমে থাকা কষ্টগুলো নিঃশব্দ কান্নায় ভাসিয়ে দিত নীলা । লেখকের গল্পে জয়িতা কাঁদছে । বাস্তবে কাঁদছে নীলা । গল্পের কান্নাটা সুখের কিন্তু
বাস্তবের কান্না সবসময় দুঃখের।