পবিত্র ভালোবাসা

পবিত্র ভালোবাসা
ডাক্তার সাহেব জানান দিয়েছেন আমি আর কখনো বাবা হতে পারবোনা। আমার করানো টেস্টের রিপোর্টগুলে চিৎকার দিয়ে বলছে আমি বাবা হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। একটা পুরুষের জন্য এরচেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে। ডাক্তার সাহেব সরাসরি বলেছেন সমস্যা টা আমার মধ্যে। আমি জানি এই খবরটা যদি অর্পা জানতে পারে তাহলে পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। মেয়েটার খুব ইচ্ছে একটা ফুটফুটে মেয়ের মা হওয়ার। কিন্তু তার এই ইচ্ছে পূরণে আমি অক্ষম। একটা নারীর কাছে মা হওয়ার সুখ পৃথিবীর সব সুখের চেয়ে আলাদা। একজন নারীর জন্য মা হওয়ার অনুভূতিটা অনেক সুখের। কিন্তু এতোটা স্বপ্ন বুনার পর অর্পা যখন জানতে পারবে আমি তার স্বপ্ন পূরণে অক্ষম তখন তার অবস্থা টা কি হবে তা আমি কল্পনাও করতে পারছিনা।
অর্পা আর আমি শৈশবের বন্ধু। তারপর আমাদের মাঝে ভালোবাসা জন্ম নেয়। আমাদের ভালোবাসাকে আমাদের পরিবার হাসিমুখে স্বীকার করলো। বিয়ে করে নতুন জীবনের শুরু করলাম আমি আর অর্পা। কিন্তু বিয়ের দু’বছর পরও যখন আমাদের কোনো সন্তান হচ্ছে না তখন আমার মা আর অর্পার মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করলো। আমি দিনের অধিকাংশ সময় অফিসে থাকি।
রাত্রে যখন বাসায় ফিরি তখন দেখি অর্পা বিছানার উপর শুয়ে কান্না করে। আমি আসলেই করুণ কণ্ঠে আর্তনাদ করতে করতে বলে মা নাকি অনেক বকাবকি করে। কারণ হলো আমরা দুই বছরেও মায়ের কোলে সন্তান তুলে দিতে পারিনি। কিন্তু আমাদের পাশের বাসায় একবছর আগে বিয়ে করে আসা মেয়েটা যমজ সন্তান জন্ম দিয়েছে। মাকে নাকি পাশের বাসার আন্টি খোটা দেয়। বলে কেমন মেয়েকে ছেলের জন্য বেছে নিয়েছে যে আজ অবদি দুবছর হয়ে গেল কিন্তু একটা নাতি দিতে পারলো না। এসব খোটা মারা কথাবার্তার কারণে মা পাশের বাড়িতে যাওয়াই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এমনকি ঘরেই থাকেন সবসময়। বাইরে আসাযাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, কোন মুখে বাইরে যাবো…? বাইরে গেলেই লোকে জিজ্ঞেস করে “তোমার বউমা কবে মা হবে? দুবছর হয়ে গেলো তোমার কোলে তোমার নাতিকে দেখলামনা।” এইসব কথা শুনলে কি বাইরে যাওয়া সম্ভব!!!
ডাক্তার সাহেবের চেম্বার থেকে এসে একটা চায়ের স্টলে ঢুকে চা অর্ডার করলাম। কি করবো..? অর্পা সব সত্য বলে দেবো? নাকি গোপন করে রাখবো? খুব ভয় হচ্ছে। যদি অর্পা সত্যটা জানার পর আমাকে ছেড়ে চলে যায়…! আমি অর্পা কে হারাতে চাইনা। কিন্তু সত্যটা লুকিয়ে রাখাটা কি উচিৎ..? নাহ, আমি অর্পা কে সব খুলে বলবো। তারপর যদি আমাকে ছেড়ে যেতে চায় তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। চায়ের বিল দিয়ে সোজা বাসায় চলে আসলাম। বাসায় এসে দেখি মা বসার ঘরে বসে আছেন। মা এতোসময় কি যেন বলাবলি করছিলেন। কিন্তু আমাকে দেখে চুপটি করে বসলেন। আমি অফিস থেকে ফিরে আসলে মা ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেন কিন্তু আজ করেননি। নিশ্চয়ই তাহলে অর্পার সাথে ঝগড়া হয়েছে মায়ের। আমি অর্পার রুমে ঢুকলাম। অর্পা বিছানায় বসে কাঁদছে। আমি অফিসের ব্যাগটা রেখে শার্ট টা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে অর্পা? মা কিছু বলেছেন..? অর্পা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো,
-আজ আমি শপিং করতে গিয়েছিলাম। আমি আমাদের বেবির জন্য কিছু কাপড় কিনে এনেছি। আমার আসামাত্রই মা আমাকে বকতে শুরু করলেন। বললেন, আমি নাকি মা হতে পারবোনা। আমার মধ্যে সমস্যা আছে তাই এসব ঢং-তামাশা বাদ দিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু তুমি তো জানো আমার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। সেদিন ডাক্তার সাহেব নিজেই তো বলেছিলেন যে আমার সবকিছু ঠিক আছে। আমরা একটু চেষ্টা করলেই বেবি নিতে পারবো। রুপম তুমি ই বলো আমি কি করবো! মা হওয়ার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।
কয়েকদিন আগেই অর্পার টেস্ট করেছিলেন ডাক্তার সেলিনা। তিনি বলেছেন যে অর্পার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। আমরা যদি একটু চেষ্টা করি তাহলেই সন্তান নিতে পারবো। কিন্তু অর্পাকে কিভাবে বলি যে সমস্যা আমার মাঝে। আমিই অক্ষম বাবা হতে। এখন যদি অর্পা জানতে পারে যে আমি বাবা হতে পারবোনা তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে ছেড়ে দেবে। আমি কোনোভাবেই চাইনা অর্পা কে হারাতে। স্বার্থপরের মতো সত্য টা নিজের বুকের মাঝে চেপে রাখলাম। অর্পাকে বললাম,
-ঈশ্বর সব ঠিক করবে অর্পা। তুমি মায়ের কথাকে মনে লাগিয়ও না। একবার যখন তুমি মা হয়ে যাবে মা তোমাকে নিজের মাথায় করে বেড়াবে। মিথ্যে বলে অর্পা কে শান্ত করলাম। আজ বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেলাম। মেয়েটা জীবনে কখনো মা হওয়ার সুখটা অনুভব করতে পারবেনা একমাত্র আমার জন্য।
এভাবে কয়েকদিন কেটে গেলো। প্রতিদিন মা আর অর্পা একই বিষয়ে ঝগড়া করতো। মা যা মুখে আসতো অর্পা কে বলে দিতেন। অর্পা তার সীমাবদ্ধতায় থাকতো। কটুবাক্য বলতে পারতোনা মাকে তাই রুমে গিয়ে কান্না করতো আর আমি আসলে নিজের দুঃখ কষ্ট আমার সামনে ব্যক্ত করতো। কিন্তু আমি বলতে পারতাম না যে সবকিছুর দায়ী আমি। মায়ের কোলে নাতি বা নাতনী তুলে দিতে না পারায় দায়ী আমি। অর্পার মা হতে না পারায় দায়ী আমি। সব দুঃখ কষ্টের জন্য দায়ী আমি। কিন্তু আমি স্বার্থপরের মতো চুপ থাকমাত। কিন্তু আজ যখন বাসায় এসে যা দেখলাম তা দেখে আমিতো থ বনে গেলাম। মা আর অর্পা একসাথে বসে গল্প করছে, কাজ করছে, রান্না করছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে যেন তাদের মধ্যে শাশুড়ি আর বউয়ের সম্পর্ক নয়, মা ও মেয়ের সম্পর্ক। যে মা অর্পার সাথে ভালোভাবে কথা বলতো না সেই মা আজ অর্পার সাথে বসে গল্প করছেন, একসাথে রান্না করছেন।
কয়েকদিন এভাবেই চললো। মা নাতো কখনো সন্তানের কথা বলে অর্পাকে খোটা দেয়, নাইবা আমার কাছে অর্পার মা হওয়া নিয়ে নালিশ দেয়। ঘরে এখন সবকিছু স্বাভাবিক যেন এই ঘরে কখনো কোনো ঝগড়াঝাটি হয়ই নি। বেশ অনেক হলো আমার স্বার্থপরতা। আমার উচিৎ অর্পা কে সবকিছু বলে দেয়া। যদি অর্পা আমাকে আপন করে নেয় তাহলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবো। আর যদি ছেড়ে চলে যায় তাহলে ভাববো এই জন্মে অর্পা আমার ছিলোনা। অর্পা রুমে ডেকে আনলাম। অর্পা আমার সামনে দাঁড়ানো। আমার সাহস হচ্ছে না অর্পাকে বলার। হৃদস্পন্দন কয়েকশো গুন বেড়ে গেছে আমার। তবুও আজ আমাকে বুকে পাথর রেখে সত্য কথাগুলো বলতে হবে। আমি আর স্বার্থপর হতে পারবোনা। আমি ভাবছিলাম তখনি অর্পা বলে উঠলো,
-আমায় কেনো ডেকেছো রুপম? আমার ভাবান্তরের অবসান ঘটলো। আমি অর্পা কে অনুরোধের কণ্ঠে বললাম,
-অর্পা একটু আমার পাশে বসবে..
– না না রুপম আমার সময় নেই। মায়ের সাথে রান্নায় সাহায্য করতে হবে..
-প্লিজ অর্পা কিছু কথা আছে অর্পা আমার পাশে বসলো।
-জানো অর্পা..! কিছু কথা আমি তোমার থেকে লুকিয়েছি। তুমি মা হতে পারছোনা কারণ সমস্যা তোমার মধ্যে না আমার মধ্যে। ডাক্তার বলেছেন আমি কখনো বাবা হতে পারবোনা। আমি বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি অর্পা। সরি অর্পা আমাকে মাফ করে দিও.. আমি চেয়েছিলাম বিষয়টি তোমাকে প্রথমেই জানিয়ে দিতে। কিন্তু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও… প্লিজ অর্পা আমাকে ক্ষমা করে দাও!!
আমি কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম। অর্পা কোনো কথা বললোনা। চুপচাপ আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেলো। আমি জানতাম অর্পা সহ্য করতে পারবেনা। নিশ্চয়ই আমি আজকের পর থেকে অর্পাকে হারিয়ে ফেলবো। ঈশ্বরের লীলাখেলা বোঝা বড় দায়। জীবনে যাকে যত আপন করে পেতে চাই ঈশ্বর আমার কাছ থেকে তাকে ততই দূরে সরিয়ে নেন।
একটু পর অর্পা মাকে নিয়ে আমার রুমে ঢুকলো। মাকে নিয়ে আসার মানে কি..? অর্পা কি মাকে এটা দেখাতে এনেছে যে সমস্যা আমার মধ্যে…! এতোদিন যে মা অর্পাকে দোষারোপ করতেন তাই অর্পা মনে হয় মাকে দেখানোর জন্য এনেছে যে সমস্যা অর্পার মধ্যে ছিলোনা, সমস্যা ছিলো আমার মাঝে। এবার হয়তোবা অর্পা চিৎকার দিয়ে দিয়ে বলবে, এই দেখ বুড়ি সমস্যা তোর ছেলের মধ্যে। তোর ছেলের জীবন আমি ধ্বংস করিনি, তোর ছেলে আমার জীবন ধ্বংস করেছে। কিন্তু এসবের কিছুই ঘটলোনা। মা আমার পাশে এসে বসলেন। আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
– চিন্তা করার কিছু নেই বাবা। সব ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে হয়। ঈশ্বর যেভাবে চান সেভাবেই হয়। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কি হচ্ছে এসব…? মাকে তো অর্পা কিছুই বলেনি। তাহলে?? মা আমার সন্দেহ দূর করার জন্য বললেন,
-অর্পা আমাকে তোর রিপোর্ট টা আগেই দেখিয়ে বলেছিলো তুই কখনো বাবা হতে পারবিনা। প্রথম প্রথম আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু রিপোর্ট দেখে আমিও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। অর্পা আমাকে বারণ করেছিলো তকে বলতে।
আমি অর্পার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-তুমি এসব আগে থেকে কিভাবে জানলে?
– কাপড়ের আলমারি টা গুছানোর সময় তোমার রিপোর্ট টা আমার ছোখে পড়লো। রিপোর্ট টা দেখে আমি সব বুঝতে পারলাম।
-অর্প
-তাহলে তুমি মাকে না করলে কেন আমাকে বলতে? অর্পা আমার বাঁ পাশে বসে আমার হাতটা ধরে বললো,
-আমি জানতাম তুমি আমাকে হারানোর ভয়ে রিপোর্ট টা দেখাওনি। তোমাকে বাথরুমে একা একা কান্না করতে শুনেছি রুপম। জানতাম বাবা না হতে পারার কষ্টটা তুমি সহ্য করতে পারছোনা। তাই মাকে বলেছিলাম যে তোমাকে জানতে না দিতে যে আমরা বিষয়টা জেনে গেছি। আমি জানি তুমি বিষয়টা জানলে খুব কষ্ট পেতে। জীবনে তোমার মতো করে কেউ আমাকে ভালোবাসেনি রুপম। জীবনে অনেক বিপদের সময় এসেছে যখন তুমি আমার পাশে ছিলে। তোমার বিপদের সময় কি আমি পাশে থাকতে পারিনা….
-কিন্তু অর্পা, আমার সাথে থাকলে তুমি যে আর কখনো মা হতে পারবেনা।
-কে বললো মা হতে পারবোনা? আমরা বেবি এডপ্ট করে নেবো। মাও অর্পার কথায় সহমত প্রকাশ করলেন।
-কিন্তু অর্পা? ….
-কিন্তু কি? তুমি ভাবছো আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো?
এতো সহজে তোমাকে শান্তি দেবোনা বাবাজি। এতো তাড়াতাড়ি তোমাকে ছাড়ার পাত্রী আমি নই তারপর মা আর অর্পা একসাথে ভুবন মাতানো হাসি দিলেন। এমন হাসি দেখে তো বুকের সব দুঃখ-কষ্ট জুড়িয়ে যায়। সত্যিই ভালোবাসার মানুষ গুলো যেকোনো পরিস্থিতিতে ভালোবাসতে জানে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত