কী ব্যাপার ফার্নিচার সব কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? শামীম, এই শামীম!!
-বলুন বাবা, আপনার ছেলে তো নতুন ফ্ল্যাট টা দেখতে গেছে!
-নতুন ফ্ল্যাট ?কী বলছ বৌ মা!!
-জ্বী বাবা।আমরা নতুন ফ্ল্যাট কিনেছি।সব কাজ শেষ হয়েছে।আজ তাই সব কিছু ওখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-ওহ্,আমাকে তো বললেই না!
-আপনার ছেলে বলতে নিষেধ করেছে বাবা।তাছাড়া…
-তাছাড়া কী বৌ মা?
-বাবা, আসলে আপনার ছেলে ঠিক করেছে আপনার পুরনো বন্ধু ঐ যে,আলমগীর চাচা যেখানে আছেন না,আপনাকে ওখানে রেখে আসবে।
আমিও নতুন চাকরী পেয়েছি।আপনি বাসায় একা থাকলে আমাদের চিন্তা হবে।আর ওখানে নাকি আরও অনেক লোক থাকে আপনারই বয়সের কাছাকাছি। ভালই থাকবেন। বিস্ফোরিত চোখে একমাত্র ছেলে শামীম এর বউ তাহমিনার দিকে তাকিয়ে আছে সরফুদ্দীন খাঁন। সদ্য বিয়ে করেছে ছেলে তারই পছন্দ অনুযায়ী।ছেলের পছন্দ আর ভাল থাকার জন্যই বিয়ে নিয়ে তিনি কোনরকম দ্বিমত করেন নি।শেষ সময়ে এসে একটু পরিবারের পাশে থাকতে চান। রক্তের বন্ধন এর চেয়ে শান্তি আর কোথায় থাকতে পারে? কিন্তু এ কী শুনছেন তিনি?নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না।
তাঁর চোখে ভেসে উঠল পুরনো স্মৃতি।আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে শামীম এর মা যখন তাঁর নিজের মা বাবা কে সেবা যত্ন করতে অস্বীকার করছিল,বার বার ঝগড়াঝাঁটি করছিল,সহ্যের সীমা যখন ছাড়িয়ে যাচ্ছিল তখন দুই বছরের শামীমকে নিজের কাছে রেখে বুকে পাথর চেপে শামীম এর মা রুবি কে বাবার বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
কিছুদিন পর বাবা মা যখন রুবিকে আনতে গিয়েছিলেন তখন রুবি খুব অপমান করে ওনাদের আর শর্ত দিয়েছিল, রুবি তার স্বামীকে নিয়ে একা থাকতে চায়। যদি ওনারা গ্রামের বাড়ী চলে যায় তাহলেই রুবি ফেরত আসবে।নয়ত না। এসব শুনে আর স্থির থাকতে পারেননি সরফুদ্দীন সাহেব।সোজা তালাক নামা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বউএর বাড়ী,সাথে একটা চিরকুট যাতে লিখা ছিলো “তুমি তোমার মত থাকো,হয়ত আর কারও ঘরণী হয়ে আবার নতুন জীবন শুরু করবে, তবে একটা অনুরোধ, এভাবে সন্তানকে বাবা মায়ের থেকে আলাদা করে ফেলার মত পাপ কাজ করার চেষ্টা আর করো না।
সব সন্তান হয়ত আমার মত করে বউ বাদ দিয়ে বাবা মায়ের হাত আগলে না ও রাখতে পারে, মনে রেখো এতে সাময়িক সুখ থাকলেও কোন রকম শান্তি নেই যে শান্তির তালাশ তুমি করছ।” এর পর বাবা মারা গেলো কিছুদিন পর মা ও ছেড়ে গেল। ওনারা অনেক চেয়েছেন তাকে আবারও বিয়ে করাতে কিন্তু তিনি প্রিয় সন্তানের জন্য কিছুতেই সৎ মা আনতে চান নি। তখন টগবগে যুবক ছিলেন। আজ তো চামড়া কুচকে গিয়েছে।দৃষ্টি ঘোলা!পা হয়ে পড়েছে নড়বড়ে! বড্ড অসহায় লাগছিল! চোখ ভিজে উঠল প্রচন্ড আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এই ষাটোর্ধ ব্যক্তিটির। চুপচাপ বসে রইলেন। ভাবছেন, তিনি এতই কী বিরক্তিকর? এতই কী অসহনীয় হয়ে পড়েছেন? কী করে তিনি বৃদ্ধাশ্রম এ বাকীটা সময় পার করবেন?
একটা সময় যখন খুব একা লাগত তখন সন্তানকে বুকে চেপে রাত পার করে দিতেন! এসময়ের একাকীত্বের সঙ্গী কে হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই পায়ে সেন্ডেল দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন অজানা উদ্দেশ্যে। ছেলে তাঁকে আড়াল করার জন্যে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার আগে তিনিই আড়াল হয়ে যেতে চান। বুকটা ছিঁড়ে যেতে চাইছে যেন।এমন করে চোখেরজল গড়িয়ে কেন পড়ছে? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।পুরুষ হয়ে জন্ম নিয়েছেন,কাঁদলেও বড সন্তপর্ণে কাঁদতে হয়।পাছে লোকে দেখে ফেলে!! পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছতে মুছতে সামনে চলতে লাগলেন। কিছুদূর যেতেই শুনতে পেলেন শামীম একটু দূর থেকে বাবা বাবা করে ডাকছে! ওফ্ তিনি ওদিকে তাকাতে পারছেন না।
বাবা ডাকটা বরাবরই ওনার কাছে স্বর্গীয় ছিল।তবে আজ খুব বিষাক্ত লাগছে। শামীম দৌড়ে এলো বাবার কাছে,বললো, কোথায় চলেছ বাবা? খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল সরফুদ্দীন সাহেবের, তোদের চলার পথ থেকে একেবারে সরতে চলেছিরে!আগে একাকিত্ব কে ভয় পাই নি।তবে এখন খুব ভয় হচ্ছেরে!পাছে তোদের চোখে পড়ে যায়,পাছে তোদের সামনে ঝর ঝর করে কেঁদে না ফেলি! সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি অজানার উদ্দেশ্যে পথ চলছিরে!!তোকে হয়ত মানুষ করতে পারিনি সেই লজ্জা ঢাকতে চলেছি! ইচ্ছে হলেও কিছুই বললেন না তিনি। আস্তে করে বললেন, একটু হাঁটতে বেরিয়েছি।বাসায় দম আটকে আসছিল।
-আচ্ছা চলো,বাসায় চলো,সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
-হ্যা চল! সব ঠিকঠাক।বাসায় যেন কিছুই ঘটেনি এমন করে রাতে খেয়ে সবাই যার যার রুমে চলে গেল। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল তাঁর,পাশের রুম থেকে শামীম এর আওয়াজ আসছে!
-তুমি বাবাকে কেন বলেছ এসব?
-তো কী হয়েছে?বাবা হিসেবে ওনার জানার অধিকার আছে, তুমি নতুন ফ্ল্যাট কিনেছ।ওনি তোমাকে অনেক ভালবাসেন।খুশীই তো হবেন।
-হ্যা, বাবা আমাকে অনেক ভালবাসেন।আমি জানি।
-আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো।আগামী কাল আমরা নতুন বাসায় উঠার পথে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে নামিয়ে দিয়ে যাব।
-আমার ঘুম আসছেনা।খাঁট ছাড়া ঘুম আসে না।সব পাঠিয়ে দিয়েছ!
-তুমি তো বাবার খাঁটটা পাঠাও নি ওখানে গিয়ে ঘুমাও যাও।
-হ্যা ঠিক বলেছ!
শামীম আজ অনেকদিন পর বাবার পাশে ঘুমাতে আসছে!ভাবতই সরফুদ্দীন সাহেব কেমন পাথর হয়ে গেলেন।খুশীতে! শামীম চুপচাপ বাবার পাশে শুয়ে পড়ল।আর সরফুদ্দীন সাহেব বুক ভরে সন্তানের শরীরের ঘ্রাণ নিতে লাগলেন।বড়ই মধুর ঘ্রান!ভাবছেন, যদি আজই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারতেন!এভাবেই সকালে গাড়ী আসল,রওনা হলো সকলে, যার যার নতুন গন্তব্যে।
সরফুদ্দীন সাহেব চোখ বন্ধ করে আছেন সিটে হেলান দিয়ে। যদি এমন হয়, তাঁকে ঘুম মনে করে শামীম না ডাকে,যদি ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়! তিনি ভাবছেন, যদি ওরা সাথে করে নিয়ে যায় তাহলে তিনি যতটুকু সম্ভব নিজের কাজ নিজে করবেন। তাহমিনাকে চা করে দিতে বলবেন না।সকাল সকাল পত্রিকা ও চাইবেন না। পারলে রান্নাও করে রাখবেন। না তা হচ্ছেনা হয়ত!গাড়ী থেমে গেলো। শামীম ডাকল,বাবা!বাবা! তাহমিনা বললো, কী এখানে কেন গাড়ী থামিয়েছ? শামীম কড়া, শীতল কন্ঠে বললো- তাহমিনা তুমি গাড়ী থেকে নামো,বাবা তুমি চাইলে ওকে শেষ বারের মত দেখে নিতে পারো।যে প্রতিটাদিন তোমার কাছ থেকে আমাকে আলাদা করতে চেয়েছে!
আমি ওকে ওর বাবার বাড়ীর সামনে রেখে আমার বাবাকে নিয়ে নতুন ঠিকানায় চলতে চাই আমাদের যেন কেউ খুঁজেও না পায়!বাবা হিসেবেই বাবার আমি নতুন ফ্ল্যাট কিনেছি সেটা যেমন জানার অধিকার আছে সাথে অধিকার আছে সন্তানের সাথে আমৃত্যু থাকার! সরফুদ্দীন সাহেব আজও কাঁদছেন! খুব কাঁদছেন! ছেলে তাঁর মানুষ হয়েছে, সেই পরম সুখে কাঁদছেন! যা কিনা পাঞ্জাবীর হাতায় আর সন্তপর্নে মুছে ফেলতে হবে না।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা