আমরা বিয়ে করেছি কিন্তু বাসায় জানে না। বাসায় জানলে তিনটে সমস্যা হবে। প্রথম সমস্যা,আব্বু-আম্মু মারবে ।
দ্বিতীয় সমস্যা,বাসা থেকে বের করে দেবে। তখন মাত্র ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট সেমিস্টারে। বাসা থেকে বের করে দিলে কোথায় থাকবো,কি খাবো! তৃতীয় সমস্যাটা ছিলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর,পুলিশ! আমি যখন বিয়ে করি,তখন সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার বয়স ১৯। বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেরা দারুণ বৈষম্যের শিকার। ছেলের বয়স ২১ বছর না হলে বিয়ে বেআইনি হয়ে যায়। কাজেই বাসায় যদি জানে যে আমরা বিয়ে করেছি এবং ছেলে নাবালক,তাইলে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। এইজন্য আমি আর মিতু বিয়ে করলাম। কিন্তু বাসায় জানালাম না।
যে যার বাসায় থাকি। ইউনিভার্সিটিতে আসি। মিতুকে আমি বলি,”বউ।” মিতু বলে,”ওগো আমার স্বামী।” আমরা ক্লাসে পাশাপাশি বসি। ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাওয়ার সময় মিতু ওড়না দিয়ে চায়ের কাপ মুছে দিয়ে স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। পরীক্ষার হলে মিতুকে খাতা দেখিয়ে আমি স্বামীর দায়িত্ব পালন করি। অতি সুখের সংসার! ক্লাস শেষ হলে আমরা দুজন গাছতলায় বসি। মিতুকে আমি কথা দিয়েছিলাম,”বিয়ের পর দুচোখ যেদিকে যায়,চলে যাবো। গাছের তলায় ঘর বাঁধবো।”
কাজেই গাছের তলায় বসতে পেরে মিতু খুবই খুশি। স্বামী প্রতিশ্রুতি রেখেছে। বিয়ের পর গাছতলায় সংসার বেঁধেছে!
হঠাৎ মিতুর বাসায় কি যেন একটা ঝামেলা হলো। মিতুর বাবা মিতুকে বললো,”আমার খাও,আমার পরো আর আমার সাথে বেয়াদবি!” বিয়ের পর মেয়েরা আসলেই পর হয়ে যায়। এই সামান্য কথায় মিতু দারুণভাবে আহত হলো। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলো। সে আর পিতার অন্ন মুখে তুলবে না। ক্লাসে এসে আমাকে বললো,”বাজার করে দাও।” আমি আকাশ থেকে পড়লাম! বাজার মানে? টাকা পাবো কোথায়?
তখন প্রথম আলো পত্রিকায় লিখে কয়েকশত টাকা পেতাম। সেই টাকা তোলা হলো। কারওয়ান বাজার থেকে দুই কেজি চাল,আধা কেজি আলু এবং ডাল কেনা হলো। মিতু ব্যাগভর্তি করে বাজার নিয়ে বাসায় চলে গেলো। নিজে রান্না শুরু করলো। ভাত,আলু ভর্তা, ডাল। নিজেই রান্না করে,নিজেই খায়। সে এক কঠিন ব্রত! আমি ভেবেছিলাম,এইভাবে মিতু একদিন মারা যাবে। কিন্তু না,মিতু মারা যায়নি। বরং অতি সাধাসিধে খাওয়াদাওয়ায় মিতু অল্প দিনেই শুকিয়ে গেলো। রাতারাতি তাকে অপ্সরীর মতো লাগতে লাগলো!
মিতুকে কখনো বলিনি, মিতু যতদিন ডালভাত কর্মসূচী চালিয়েছে ততদিন আমিও বাসায় মাছ-মাংস ঠেলে সরিয়ে শুধু ডাল-ভাতই খেতাম। আমার মা বলতেন,”তোর কি হইছে?” আমি চোরের মতো মাথা নিচু করে বলতাম, “কিছুই না,কিছুই না।” মাকে আমার বলতে ইচ্ছে করতো মিতুর কথা। কে বলে মেয়েরা লাজুক হয়? রুমের লাইট নিভিয়ে যখন প্রথম আম্মুকে মিতুর কথা বলছিলাম,”আম্মু,আমার সাথে একটা মেয়ে পড়ে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তুমি আর আব্বু একটু যাবা ওদের বাসায়?”
আমার কথা শুনে আম্মু লাফ দিয়ে উঠলো। চট করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বললো,”একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে,তাতে তোর কি?এসব তুই কি কইতাছস?তোর কি মাথা খারাপ হইয়া গেছে?” আমি বাসা থেকে পালালাম। একটা ফার্মেসি থেকে মিতুদের বাসার ল্যান্ডফোনে কল দিলাম। মিতুকে বললাম,”মিতু তুমি চলে এসো। আমি বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি।” মিতু ছোট্ট করে বলল,”আচ্ছা।” সব মিলিয়ে ১৫ সেকেন্ড।
টিএসসিতে এসে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তখন মোবাইল ফোনের যুগ না। অস্থির হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছি। মিতু আসবে তো?এত দেরি করছে কেন! কখন আসবে! আমার চোখ জ্বালা করছে। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। পকেটে একটা টাকাও নেই। মাঝেমাঝে মায়ের কথা মনে পড়ছে। মাথার রগ টনটন করছে। চোখ অকারণে আর্দ্র হচ্ছে! এমন সময় হুডতোলা রিকশায় করে মিতু আসলো। রিকশা থেকে নেমে আমাকে দেখে হাসলো।
আমার মাত্র ১৫ সেকেন্ডের একটা অনুরোধে এই মেয়ে নিজের সব ফেলে চলে এসেছে। তার ১৮ বছরের বাবা-মা,ভাই-বোন এবং সবকিছু। কোথায় যাবে জানে না,কি খাবে সেটাও জানে না। কিন্তু রিকশা থেকে নেমেই এমন উজ্জলভাবে হাসলো যেন সে জীবনের সব সুখ পেয়ে গেছে! আমি ভ্যালেন্টাইন ব্যাপারটা ঠিক বুঝিনা। ভালবাসা,প্রেম এগুলোও ঠিক মাথায় ঢোকে না। আমার কাছে প্রেম মানে,এই মেয়েটার মুখে সুখী একটা হাসি। কি পরম নির্ভরতাই না ছিলো সেই হাসিতে। কি গাঢ় বিশ্বাসে মাখা ছিলো সেই হাসি! এটাই আমার ভালবাসা। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারবো,সেই একমুহুর্তের হাসিটাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।
পুনশ্চ: আমি আর মিতু একসাথে ১৫ অথবা ১৬ বছর ধরে সংসার করছি। আগে গুনে গুণে বছর মনে রাখতাম। এখন গোণাগুনির ঝামেলায় আর যাই না। হবে কিছু একটা! আজকাল আমরা প্রতিদিন ঝগড়া করি,সপ্তাহে একদিন কথা বন্ধ থাকে,প্রতি মাসে একবার ডিভোর্সের চিন্তা করি। কিন্তু কিছু করতে গেলেই,মেয়েটার ওই হাসিটাই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়!
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা