দু’মুঠো সুখ

দু’মুঠো সুখ
-বাসায় কীভাবে যাবে? তয়ার কোন কথার জবাব না দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে নিঝুম।
-কি হলো জবাব দাও।
-কীভাবে যাবো আবার কি? ঢাকার শহরে কি রিকশা-বাসের স্ট্রাইক চলছে নাকি?
-রিকশা-বাসের স্ট্রাইক চলছে না তবে তোমার পকেটের স্ট্রাইক ঠিকই চলছে। তয়ার এমন কথায় সামান্য লজ্জা বোধ করে নিঝুম। কণ্ঠস্বর নিচু করে শান্ত ভঙ্গিতে নিঝুম বলে,
-তাতেও সমস্যা নেই। আমার পায়ের তো আর স্ট্রাইক চলছে না। সুস্থ-সবল দু’টো পা যেহেতু আছে তাদেরকে কাজে লাগানো যাবে। কি বলো?
-এতোটা পথ তুমি হেঁটে যাবে?
-হুম। হেঁটে আসতে পারলে যেতে পারবো না কেন?
-কিহ! তুমি এই ১০ মিনিট দেখা করার জন্য ২ ঘণ্টা হেঁটে এসেছো।
-হুম।
-সত্যি!
-হুম।
-হুম হুম করছো কেন?
-তোমার চেহারায় কি আছে তা তুমি নিজেও জানো না। তাই তোমাকে দেখার জন্য এমন শত সহস্র ঘন্টা আমি হাঁটতে পারি তা তুমি বুঝবে না।
-তোমার এসব ফালতু আবেগের টাইম নাই। একদম আবেগ দেখাবে না আমাকে। নিঝুম চুপ করে তাকিয়ে থাকে তয়ার দিকে।
-এভাবে তাকাতে না করেছি না তোমাকে কতবার।
-আচ্ছা আর তাকাবো না।
-আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-যাও।
-না আগে তুমি যাও।
-আমি চলে যাবো তুমি যাও।
-না। তুমি আগে যাবে। আমি জানি, আমি আগে গেলে তুমি সেই সন্ধ্যা অবধি এখানেই বসে থাকবে।
-থাকলাম না হয়। আমার তো আর কোন কাজ নেই। তাই কোন তাড়াও নেই।
-জানি তোমার তাড়া নেই কিন্তু তুমি এখানে বসে থাকলে আমি ক্লাসে মন দিতে পারবো না। তাই তুমি যাও।
-আচ্ছা যাচ্ছি। নিঝুম বসা থেকে উঠে চলে যেতে নিলেই তয়া পিছন থেকে ডাকে।
-সকালে কিছু খেয়েছিলে?
-হুম।
-খাওনি কেন?
নিঝুম চুপ করে থাকে। কীভাবে কীভাবে যেন মেয়েটা নিঝুমের সত্য মিথ্যাগুলো সব ধরে ফেলে। কোনোভাবেই নিঝুম তয়ার থেকে কোন কথা লুকিয়ে রাখতে পারে না। আগে একবার এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তয়া নিঝুমকে বলেছিল সে তার চেহারা দেখলেই নাকি সবটা জেনে যায়, টের পেয়ে যায়।
-বলো খাওনি কেন?
-বললাম তো খেয়েছি।
-না তুমি খাওনি।
নিঝুম চুপ হয়ে যায় আর কিছু বলে না। নিজের অসহায়ত্বের কথা প্রেমিকাকে বলতে এই মুহুর্তে ভালো লাগছে না তার। কিন্তু যে প্রেমিকা না বলার আগেই সব বুঝে যায় তার কাছে নিঝুম চাইলেও কিছু লুকাতে পারে না। আর পারবেও না।
-তোমাকে না বলেছি সাদিকের হোটেল থেকে তুমি তিনবেলা খেয়ে নিবে। কখনো না খেয়ে থাকবে না।
-মাস শেষে সাদিককে টাকাও দিতে হবে।
-সেটা আমি বুঝবো। তোমাকে খেতে বলছি তুমি খাবে। তোমার কাজ শুধু খাওয়া।
-এই সময় এসে প্রেমিকরা প্রেমিকার খরচ চালায়। প্রেমিকা প্রেমিকের নয়।
-আমি এই যুগের না। আদি যুগের, ব্যাক ডেটেড। কোন সমস্যা? তোমাকে যা বলছি তা করবে কোন প্রশ্ন করবে না।
-প্রশ্ন করি নাই তো।
-তাহলে খাও নাই কেন?
-এমনি।
-বলতে বলছি বলো।
-আজ মাসের এক তারিখ।
-তো?
-গেলে ওরা টাকা চাইবে।
-না গিয়ে কীভাবে বুঝলে গেলে ওরা টাকা চাইবে?
-আমি জানি।
-না তুমি কিছুই জানো না। ওরা তোমার কাছে টাকা চাইবে না।
-কেন?
-এত কেন তোমার জানা লাগবে না।
ওরা কখনোই তোমার কাছে টাকা চাইবে না। আর তুমি তিনবেলার জায়গায় ৫ বেলা খেলেও কেউ কিছু বলবে না বা জানতেও চাইবে না। নিঝুম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তয়ার দিকে। কিন্তু নিঝুম এটাও জানে এই সংক্রান্ত কোন কিছু তয়া তাকে বলবে না। গত তিনমাসেও সে কিছু বলেনি, আজও বলবে না।
-আচ্ছা এখন তুমি যাও।
-যাচ্ছি। নিঝুম কিছু দূর যেতেই তয়া আবার পিছন থেকে ডেকে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-সিএনজিতে উঠো।
-পাগল তুমি এতটুকু রাস্তা সিএনজিতে যাবো নাকি?
তয়া জানে নিঝুম নিজ থেকে কখনই সিএনজি করে যাবে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পল্লবী পর্যন্ত প্রায় ৩০০ টাকার ভাড়া। ফাঁকা পকেট নিয়ে কোন সাহসেই বা সে সিএনজিতে উঠবে।
-যা বলছি তাই করো। আজ যথেষ্ট হেঁটেছো আর হাঁটা লাগবে না। সিএনজি করে গিয়ে সাদিকের হোটেলের সামনে নামবে সেখান থেকে খেয়ে গলির মোড়ের টং দোকানে যাবে।
-সেখানে কেন?
-দরকার আছে তাই।
-কি দরকার?
-সেখান থেকে একটা মালব্রো লাইট সিগারেট নিবা। সেটা টানতে টানতে বাসায় যাবা।
সিগারেটের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকায় নিঝুম তয়ার দিকে। কি বলবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। যার পকেটে ১ টাকার একটা কয়েন নেই সে কিনা ১২ টাকা দামের একটা সিগারেট খাবে। যেখানে ১০ টাকায় ২ টা সিঙ্গারা পাওয়া যায় আর তা খেয়ে পুরো একটি দিন কাটানো সম্ভব নিঝুমের পক্ষে।
-তুমি আমাকে সিগারেট খাওয়ার পারমিশন দিচ্ছো?
-জ্বি না। পারমিশন দিচ্ছি না। গত ২৫ দিনে তুমি একটা সিগারেটও ছুঁয়ে দেখোনি তাই একটা সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দিলাম কেবল।
নিঝুমের বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হতে চাইছে কিন্তু সে তা নিজের বুকেই আটকে রাখলো। তয়াকে সে তার দীর্ঘশ্বাসটা দেখাতে চায় না এই মুহুর্তে। মেয়েটা তার সাধ্যের বাইরে গিয়ে তার জন্য করছে তাই তাকে সে নিজের অসহায়েত্বের দীর্ঘশ্বাসটা দেখাতে চায় না। নিঝুম নিজ থেকে কখনই সিএনজি করে বাসায় যাবে না তা তয়া জানে। তাই তয়া নিজে থেকেই একটা সিএনজি ডেকে ঠিক করে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে স্মিত হেসে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,
-সাবধানে যেও। নিঝুম সিএনজিতে উঠতে নিলে তয়া হুট করে তার হাতটা ধরে ফেলে।
-কি হলো? কিছু বলবে?
-বলছিলাম কি এভাবে আর কত দিন। তুমি আরেকটু চেষ্টা করো দেখবে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এভাবে তো বাবার সামনে দাঁড়াতে পারবো না আমরা। আর আমি কিছুতেই তোমাকে হারাতে চাই না।
-হুম।
নিঝুম তয়ার মাথায় হাত রেখে চুল গুলো নেড়ে দিয়ে সিএনজিতে উঠে যায়। হোটেলের লোকগুলো কখনোই নিঝুমের কাছে টাকা চাইবে না কারণ প্রতিমাসের শেষ দিন তয়া নিঝুমের আগের মাসের খাবারের বিল চুকিয়ে দিয়ে আসে। যেমন গতকাল বিকেলেই তয়া নিঝুমের গতমাসের খাবারের সব বিল চুকিয়ে দিয়ে এসেছে। তাদেরকে তয়ার বলাই আছে নিঝুম যখন যেটা ইচ্ছা খাবে মাস শেষে তয়া একসাথে সব টাকা দিয়ে দিবে।
এমনকি নিঝুমের এলাকার সেই টং দোকানের মামাকেও সে অগ্রিম টাকা দিয়ে এসেছে নিঝুম প্রতিদিন ২ টি করে সিগারেট তার কাছে থেকে নিবে। কিন্তু ২টা সিগারেটের কথাটা তয়া ইচ্ছা করে বলেনি তাকে। নিঝুমের সিগারেট খাওয়াটা তয়া একদম পছন্দ করে না। শুধু ভালোবাসলেই হয় না, ভালোবাসার মানুষের সবটাসহ তাকে ভালোবাসতে হয়। গতরাতে হিসাব কষতে বসেই বিষয়টা তয়া লক্ষ করেছে গত ২৫ দিনে নিঝুম একটা সিগারেটও মুখে তুলেনি। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে সেজন্য নয়। তার পকেটে ১ টা টাকাও নেই সেজন্য। কথাটা বুঝতে পারার পর থেকেই তয়ার বুকের ভেতরটা কেমন কেমন করছে। যতক্ষণ না নিঝুম মনের সুখে একটা সিগারেট টানবে ততক্ষণ তয়ার বুকের ভিতরের অস্থিরতাটা কমবে না। তয়া কিছুক্ষণ নিঝুমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ক্লাসের দিকে ফিরতে লাগে। ক্লাস শেষ করে তার দুটো টিউশনিও আছে। তাই নিঝুমকে থাকতে দিলো না সে। নিঝুম থাকলে তয়ার টিউশনি মিস যাবে।
তয়া আর নিঝুমের সম্পর্কের ভিত্তিটা এখন একদম নড়বড়ে তা জানা সত্ত্বেও তারা একে অপরকে খুব মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। তাদের সম্পর্কের আপাতত কোন ভবিষ্যৎ তারা দেখতে পাচ্ছে না। আদৌও তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে না জেনেও তারা একে অপরের সঙ্গ ছাড়তে নারাজ। ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা ছাড়া প্রতিদিন এমন হাজারটা তয়া নিঝুম একে অপরের হাত আঁকড়ে ধরেছে। তয়া নিজেও জানে না সে কতদিন পারবে এভাবে নিঝুমের জীবনের ছায়া হয়ে থাকতে। তবু জীবনের যতটা সময় পর্যন্ত সে পারবে এভাবেই ছায়া হয়ে নিঝুমের মাথার উপর থাকবে। মানুষটার হাত ধরে পথ পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখে যাবে প্রতি মুহুর্ত। ভবিষ্যতের কথা কে জানে হলেও হতে পারে একটি সুন্দর ইতি। নাহলেও আফসোস নেই। যা পাচ্ছে তাতে না হয় জীবন ভরের দু’মুঠো সুখ কুঁড়িয়ে নিবে তারা।
সমাপ্তি
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত