আমি তখন সদ্য ছ্যাকাপ্রাপ্ত ছিলাম,মেডিকেলে চান্স পায়নি বলে শিশির আমার সাথে ব্রেকাপ করেছিল। জীবনের নতুন অধ্যায় শুরুর সময়েই প্রিয় মানুষটা হাত ছেড়ে দিয়েছিল। “তেলে আর জলে যেমন মিশ খায়না তেমনি মেডিকেল স্টুডেন্ট এর সাথে নাকি একজন ভার্সিটির স্টুডেন্ট এর যায়না। ” তার কাছে ভালোবাসার থেকে যোগ্যতা টাই যেনো বড় হয়ে দাড়িয়েছিল। আমার বাসা থেকে অবশ্য সেকেন্ড টাইম মেডিকেল এর প্রিপারেশন নিতে বলেছিল কিন্তু আমি না করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি খারাপ নাকি? প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। একটা বছর নষ্ট করার কোনো মানেই নেই। সেখানে আছি সেখান থেকে বড় কিছু করে দেখাবো।
ভার্সিটি যেতাম ক্লাস করতাম তারপর চলে আসতাম। চুপচাপ থাকতাম, ফ্রেন্ডদের সাথে তেমন আড্ডা কোলাহলে মাততাম না। ভার্সিটি তে নতুন ছিলাম বিধায় সিনিয়র দের র্যাগ খেতে হত,চুপচাপ সইতাম কারণ সে কষ্ট আমায় পোড়াত না। শিশিরের দেয়া কষ্টে তো এমনিতেই ভেঙে ছিলাম। কত রাত যে কেঁদেকেটে বালিশ ভিজিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। প্রথম প্রথম শিশিরকে ফোন দিয়ে অনেক রিকুয়েস্ট করতাম সম্পর্ক রাখার জন্য কিন্তু সে আমায় শুধু অপমানই করতো। সে তার কোনো এক জুনিয়র এর সাথে নাকি সম্পর্কে জড়িয়েছে, আমি যেনো আমার টাইপের কাউকে খুঁজে নেই। চাইতাম স্বাভাবিক হতে কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। সেসময়ই কোথা থেকে যেনো ইশতিয়াক ভাইয়ার উদয় হয়।
আমার স্কুলের সিনিয়র ছিল সে,মুখচেনা ছিল কেবল,তার নামটা পর্যন্ত জানতাম না আমি কিন্তু সে চিনতো আমাকে। ভার্সিটি তে এসে কথা হয়, পরিচয় হয়। অন্য ডিপার্টমেন্ট এ পড়তো সে, ভার্সিটি তে সে পাবলিক ফিগার ছিল। আমাকে বলেছিল কোনো সমস্যা হলে বা দরকার হলে যাতে তাকে জানাই। নোটস মেনেজ করে দেয়া থেকে যাবতীয় কোনো হেল্প লাগলে সে করতো। আমাদের এলাকার লোক বিধায় ভরসা ও করতাম তাকে। কিন্তু সে যখন মেসেজের পর মেসেজ আর ফোনের পর ফোন দিত বড্ড বেশী বিরক্ত লাগতো। আমি বেশী রেসপন্স করতাম না আর সে অভিযোগ ও করতোনা।
আমার একজন ফ্রেন্ড এর থেকে জানতে পারি ইশতিয়াক ভাইয়া নাকি আমাকে স্কুললাইফ থেকে পছন্দ করতো ইভেন এখনো করে। আমাকে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করার, এতো এতো মেসেজ ফোন দেয়ার কারণ কি তাহলে এটাই? পছন্দই যেহেতু করতো তাহলে জানায়নি কেনো আগে? জানালে হয়তো শিশির আমার জীবনে আসতোনা। শিশিরের সাথে সম্পর্কই তো হয়েছিল কলেজ থেকে। এখন তো আমার কিছুই করার নেই। উনি আমাকে পছন্দ করে এটা শিওর হয়েছিলাম সেদিন, যেদিন থেকে ওনার ফ্রেন্ড সার্কেল থেকে শুরু করে আমার সিনিয়র আর ফ্রেন্ড রা আমাকে ভাবী বলে ডাকা শুরু করেছিল। প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলাম আমি। তাকে ফোন দিয়ে ঝেড়েছিলাম ও অনেক,
__ আমার রিলেশন নেই দেখে কি এডভান্টেজ নিচ্ছেন আপনি?
__ নাতো, কেনো বলছো এ কথা??
__ কেনো সবাই আমাকে ভাবী বলছে? আই এ্যাম নাইদার ইউর গার্লফ্রেন্ড নর ওয়াইফ। হোয়াই ডু দে কল মি ভাবী, হোয়াই?
__ সবাই আমাকে সমীহ করে চলে। তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড শুনলে কেউ তোমাকে র্যাগ দেয়া বা কিছু বলার সাহস পাবেনা।
__ বোন তো বলা যেতো নাকি?
__ বোন বললে তো তোমাকে প্রোপোজ করার সাহস দেখাতো হয়তো অনেকে কিন্তু এখন অন্তত এমন করবেনা কেউ।
__ কেউ না করলেও আপনি তো করবেন।
__ করলে তো অনেক আগেই করতাম, প্রোপোজ করবো করবো ভেবে করার সাহস পেতাম না। যখন একটু সাহস হলো বলতে চাইলাম, তুমি অন্য কারো হয়ে গেছিলে ততদিনে। বলা হলোনা আর। যায় হোক ভালো থেকো। সেদিন হলে গিয়ে কান্নাকাটি করেছিলাম খুব। শিশির বলেছিল ভালো থেকো আবার ইশতিয়াক ভাইয়ারও একই কথা। ভালো থাকা কি এতোই সহজ? পারছিলাম না আমি ভালো থাকতে। এরপর থেকে ইশতিয়াক ভাইয়ার সাথে কখনো দেখা হলে সে খুব মেপে মেপে কথা বলতো আমার সাথে।
আমি সরি বলেছিলাম তাকে। কথা হতো মেসেঞ্জার, ফোনে। কখনো আমি নিজে নক করতাম কখনো সে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার সাথে। একটু একটু করে মোহিত হচ্ছিলাম তার প্রতি। শত মন খারাপ থাকলেও তার একটা মেসেজ মন ভালো করার টনিক হিসেবে কাজ করতো। তার মেসেজ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতাম মাঝেমাঝে। নিজের মনকে যখন আর মানাতে পারতাম না তখন নিজেই মেসেজ দিতাম। শিশিরের জন্য আর কান্নাও পেতোনা। হঠাৎ নিজেরই মনে হতে লাগলো, কি করছি আমি? স্বার্থপরতা করছি নাকি?ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে আর একজনকে ব্যবহার করছি,তাও আবার সেই মানুষকে যে আমাকে ভালোবাসে। তাকে কন্টাক্ট করা কমিয়ে দিলাম। সে বুঝতে পেরেছিল।
__ ফড়িং তুমি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছ কেনো? তার কথার জবাব দিতে পারিনি,মুচকি হেসেছিলাম শুধু। স্কুল কলেজে
থাকতে একটু চঞ্চল ছিলাম, এজন্য সে আমার নাম ফারহিন থেকে ফড়িং দিয়েছিল। ব্রেকাপের পর সেই চঞ্চলতা হারিয়ে গিয়েছিল আমার,চুপচাপ শান্ত মেয়ে হয়ে গিয়েছি আমি এখন। আমি এখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ি, ব্যাচ এর টপ স্টুডেন্ট। শুনেছি শিশিরের নাকি ব্রেকাপ হয়ে গেছে। আর ইশতিয়াক ভাইয়া? সে জব করে। তার সাথে যোগাযোগ নেই অনেকদিন। তাকে মেইল করেছি দেখা করার জন্য,অপেক্ষা করছি তার আসার। ওই যে, তাকে আসতে দেখা যাচ্ছে। ফরমাল লুক, অফিস থেকে আসছে বোধহয়।
__ দেখা করতে বললে কেনো?
__ কেমন আছেন?
__ ভালো আছি।
__ আমি কেমন আছি জিজ্ঞাসা করবেন না?
__ ভালো থাকো তো সবসময় তাই জিজ্ঞাসা করলাম না। বলো কি বলবে?
__ আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
__ তাই নাকি? কংগ্রাচুলেশনস!!
__ ঘামছেন কেনো আপনি এতো? লোকজন যে এতো ঢঙ করতে পারে, জানা ছিল না আমার।
__ ঢঙ করলাম কোথায়? অনেক গরম লাগছে তাই ঘামছি হয়তো।
__আপনার বন্ধুরা এখনো আমাকে ভাবী বলে ডাকে। আপনি কি চান না তারা সারাজীবন আমাকে ভাবী বলে ডাকুক??
__আমি তো চাই কিন্তু তুমি…
__কি আমি? পাত্রের মা বাবা এসে আমাকে পরিয়ে গেছেন। পাত্র আসেনি, তার কোনো ছবি দেখিনি। কিন্তু বায়ো শুনে কি আমি বুঝবোনা যে ব্যক্তিটি আপনি?
__না মানে,একবার তোমাকে হারিয়েছি তো আর চাইনা। ভয় লাগছিল তাই তোমাকে না জানিয়েই তোমার বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়েছি। তুমি রাজী না থাকলে বিয়েটা হবেনা। ভালো থেকো, আসছি আমি।
__ইশতিয়াক!! আমার ডাকে সে অবাক হয়ে পেছনে তাকালো।
__প্রথম ও শেষবারের মত নাম ধরে ডাকলাম। হবু বরকে তো আর ভাইয়া বলে ডাকা যায়না। যায় কি? নিজেকে খুব চালাক ভাবেন আর আমাকে বোকা তাইনা? বায়ো শুনে তারপরেই কিন্তু আংটি পরেছি আমি। শোনেন,আমি কিন্তু আপনাকে অনেক বেশী ভালোবাসতে পারবোনা। একটুখানি ভালোবাসা তে কি আপনার চলবে?
__চলবে মানে! দৌড়াবে। আমি চাই তুমি আমার ফড়িং হয়ে থাকো, উড়ে বেরাও আমার মনের আকাশে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা