ভাই-বোনের ভালবাসা

ভাই-বোনের ভালবাসা
রাস্তার ফুটপাত ধরে হাটছিলাম।মনটা ভালো নেই।বাসায় ঝগড়া করে এসেছি মা-বাবার সাথে।তার কারণ হচ্ছে আমার ৬বছর বয়সের বোন মীরাকে নিয়ে।আমি টিভিতে মুভি দেখছিলাম।হঠাৎ করে মীরা এসে আমার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে কার্টুন দেখতে লাগলো।মাথাটা পুরাই খারাপ হয়ে গেল।আমি ওকে বললাম,
_মুভিটা পাল্টিয়ে দিলি কেনো??
-আমি কার্টুন দেখবো তাই।
-তুই কার্টুন দেখবি মানে মুভিটা তাড়াতাড়ি দে।না হলে।
-না হলে কি??
-তুই দিবি।
-না দিব না।
এবার আর রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম।থাপ্পড়টা অনেক জোরে লেগেছে।আমার থাপ্পড়ের তাল সামলাতে না পেরে সে সোফা থেকে নিচে পড়ে গেল।সে থাপ্পড় খেয়ে কাদতে লাগলো।মা কিচেন থেকে দৌড়ে এসে মীরাকে কাদতে দেখে আমাকে বলল,
-কি হয়েছে??
-কিছু না। মা এবার মীরাকে জিজ্ঞেস করল।মীরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই থাপ্পড়ের দাগ দেখে আমার আব্বুকে ডেকে বলল,
-ওগো শুনো তোমার গুনধর ছেলে মেয়েকে থাপ্পড় দিয়ে দাগ করে ফেলছে। বাবা রুম থেকে এসে আমাকে থাপ্পড় দিয়ে বলল,
-হারামজাদা এত বড় হয়েছিস আর ছোটদের সাথে কি করে আচরণ করতে হয় জানিস না। আমি রেগে গিয়ে বললাম,
-জানিনা।
বাবা আরেকটা থাপ্পড় মারলো।আমি কিছু না বলে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম।এখনো পর্যন্ত বাইরে আছে।বোন জন্ম নেওয়ার পর থেকে মনে হল আমার জন্য মা-বাবার ভালবাসা অনেক কমে গেছে।তখন থেকেই বোনকে আমি সহ্য করতে পারিনা।বোন অনেক চেষ্টা করে আমার কাছে আসার।আমি সেই সুযোগ দিই না।সে মাঝে মাঝে আমাকে বলে তার জন্য এইটা ওটা আনতে কিন্তু আমি নিই না।ঐ একটাই কারণ সহ্য করতে পারিনা।আমাকে মাঝে মাঝে বলে ওকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য।আমি তখন বলি,
_ঢং শিখে গেছিস তাই না।নিজ হাতে খেয়ে নে।
ওর জন্য সারাক্ষণ মা-বাবার কথা শুনতে হয়।তাই ওকে ঘৃণা করি।কড়া রোদে বাইরে হাটতে কষ্ট হচ্ছে।তাই একটা চায়ের দোকানে বসলাম চা খেতে।আমি একটা চা আর দুইটা বিস্কুট অর্ডার দিলাম।একটা ১০-১২ বছরের বাচ্চা আমাকে বিস্কুট আর চা এনে দিল।ছেলেটি মনে হয় এই দোকানে কাজ করে।মোবাইলে তাকিয়ে দেখি দুপুর ১ঃ৩০ বাজে।ছেলেটি তার মালিক মানে দোকানদারকে বলল,
-মালিক কয়টা টেহা দেন না??
-টেহা দিয়া কি হরবি??
-মালিক আমার ছোট বইনডা বিরিয়ানি খাইবো কয়ছে।তার জন্য এক প্যকেট বিরিয়ানি নিইয়া যামু।
ছেলেটির কথা শুনে বুকের মধ্যে চিরিৎ করে উঠলো।ছেলেটির কথা শুনে হা করে তাকিয়ে আছি।দোকানদার বলল,
-তোরে কয়দিন বাদে বাদে টেহা দিতে থাকলেই আমার ব্যাবসা বন্ধ হইয়া যামু।যা এহন সামনে থাইকা সর।যত্তসব কুত্তার বাচ্চা কোথাকার। ছেলেটি মুখটা কালো করে ফেললো।সে দোকান থেকে হতাশ হয়ে বেরিয়ে পড়লো।আমি আমার খাবারের বিলটা দিয়ে তার পিছনে গেলাম।কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলেটিকে ডেকে বললাম,
-এই ছেলে শোন। সে পিছনে ফিরে বলল,
-কি ভাইয়া??
-এদিকে আয়।
-জ্বি বলেন।।
-তোর নাম কি??
-আসিফ ভাইয়া।
-তোর বোনের নাম কি??
-লিমা।
-বয়স কত তার??
-৫ বছর ভাইয়া।
-তোর বাবা কি করে??
-বাপ ছোট্ট থাইকতে মইরা গেছে।মা গেরস্ত বাড়িতে কাইজ করে আর আমি চায়ের দোকানে।বোন পড়ালেখা করে।এবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হইরাছি।
-মালিকের কাছে টাকা চাইলি কেনো??
-ছোট্ট বোনটা অনেকদিন ধইরা বিরিয়ানি খাইবর চাই।তাই টেহা চাইছিলাম।
ওর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।যেই জায়গায় আমি আমার বোনকে সামান্য খাবার খাইয়ে দিতে চাই না সে জায়গায় একটা ছেলে তার বোনের বিরিয়ানির জন্য এত কষ্ট এত গালি সহ্য করছে।যেই জায়গায় আমার বোন আমাকে এইটা ঐটা আনতে বললে আমি ওকে ঝাড়ি মারি।সেখানে এই বয়সেই একটা ছেলে তার বোনকে বিরিয়ানি খাওয়ার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য এতটা কষ্ট করছে।
আমি কেমন ভাই??বোনের সামান্য আবদার টুকু পূরণ করতে পারিনা।কি চেয়েছিল সে??শুধু তাকে একটু আদর করি।একটু ভালবাসি।তাকে আদর করে খাইয়ে দিই।এইটুকুই ব্যস।আর তো কিছু চাই নি মীরা।যেখানে একটা ১০-১২ বছরের বাচ্চা তার বোনের প্রতি এত ভালবাসা দেখাচ্ছে।সেখানে আমি ২০ বছরের হয়ে আমার বোনটাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিয়ে এসেছি।এই বয়সে ছেলেটির যেই ভালবাসা রয়েছে তার ঠুনকো পরিমাণ ভালবাসা আমার মাঝে নেই।ছিঃ নিজেকে ভাই বলে দাবি করতেই লজ্জা লাগছে।চোখ দিয়ে দুইফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।আমি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিয়ে বললাম,
-ভাই তুই আমার চোখ খুলে দিয়েছিস।তোকে অনেক ধন্যবাদ। ছেলেটি বুঝতে পারছেনা আমি কি বলছি।আমি তাকে মানিব্যাগ থেকে একটা পাচঁশ টাকার নোট দিয়ে বললাম,
-নে ধর এইটা দিয়ে তোর বোনের জন্য বিরিয়ানি নিয়ে যাবি। সে প্রথমে নিতে চাইনি।অনেক জোর করে দিলাম।তারপর আমি মীরার জন্য চকলেট নিয়ে বাসায় ফিরলাম।বাসায় আসতেই বাবা আমাকে আবার থাপ্পড় দিয়ে বলল,
-হারামজাদা সারাদিন কই ছিলি।আমার মেয়েটা যে তোকে ছাড়া খাবে না বলে জিদ করে শুয়ে আছি।সেউ খবর রাখিস তুই। বাবার থাপ্পড়ে এইবার খারাপ লাগে নি।খারাপ লেগেছে বোনটা না খেয়ে আছে বলে।যাকে এত অবহেলা এত ঘৃণা করি।সে কিনা আমার জন্য না খেয়ে আছে।এখন নিজের উপরই অনেক রাগ হচ্ছে।চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।আমি মাকে বললাম,
-মা আমাকে খাবারের প্লেটটা দাও।
মার থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে বোনের কাছে গেলাম।বোন রুমে শুয়ে আছে।ঘুমন্ত অবস্থায় আমার বোনটাকে পরীর মত লাগছে।কিন্তু তার ডানগালটা দেখে বুকটা মুচড় দিতে উঠলো।আমার হাতে আঙুলের দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।চোকটা ফোলা।মনে হয় অনেক কেদেছে।।আমি খাবারের প্লেটটা টেবিলে রেখে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
-তুই এত ভালো কেনো বোন??আমিতো তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।তারপরেও তুই কেনো আমার জন্য না খেয়ে আছিস।আমি খুব পচা তাই না।তোকে আজকের পর থেকে আর কষ্ট দিব না।অনেক অনেক আদর করবো।তুর জন্য প্রতিদিন চকলেট নিয়ে আসবো।আমি ওর ডানগালে একটা ভালবাসার স্পর্শ একে দিলাম।সাথে সাথে ছোট বোন আমার ঘুম থেকে উঠে বলল,
-সত্যি ভাইয়া আজকের পর থেকে তুই আমাকে অনেক আদর করবি। আমি ওর কথা শুনে বললাম,
-তুই এতক্ষণ জেগে ছিলি।
-হ্যা।তোর কথা শুনছিলাম।ভাইয়া জানিস।আমি যখন স্কুলে আমার বন্ধুদের দেখতাম তারা তাদের বড় ভাইদের সাথে বোনদেএ সাথে স্কুলে যাচ্ছে তখন আমারও ইচ্ছা হত তোর সাথে স্কুলে যাওয়ার জন্য।সবসময় তোর সাথে খেলতে চাইতাম।কিন্তু তুইতো আমাকে দেখতেই পারতি না।
-কে বলেছে আমি আমার বোনটাকে দেখতে পারিনা।
-তাহলে এতদিন কষ্ট দিয়েছিলে কেনো??
-আচ্ছা তার জন্য সরি।
-সরিতে কাজ হবে না।আজকের পর থেকে তুই সবসময় আমাকে খাইয়ে দিবে।আমাকে নিয়ে স্কুলে যাবি।আর আমার জন্য অনেকগুলো চকলেট নিয়ে আসবি।
-আচ্ছা আনবো।নে এবার হা কর। সে হা করলো।আমি তাকে এক লোকমা ভাত খাইয়ে দিলাম।এক লোকমা খাওয়ার পর সে আমাকে বলল,
-ভাইয়া তুই খেয়েছিস। আমি চুপ করে আছি।সে এক লোকমা ভাত আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-হা কর।
আমি হা করলাম।সে আমাকে খাইয়ে দিলাম।দুজন দুজনকে খাইয়ে দিচ্ছি।আমার চোখ দিয়ে অশ্রু পড়ছে অনবরত।আর বোন বলছে,
-ভাইয়া কাদছিস কেনো??
-না বোন এমনে।
দরজার পর্দার আড়াল থেকে মা-বাবা আমাদের দুজনকে দেখে হাসছে।তারা হয়তো বুঝে গেছে ভাই_বোনের এই ভালিবাসার ঝুটি আজীবন চলতে থাকবে। আসলেই পৃথিবীর সব বোনেরা তার ভাইয়ের কাছে রাজরাণীর মত।আর প্রত্যেক ভাই তার বোনের কাছে রাজার মত।ভাইবোনের এই ভালবাসা আজীবন চলতে থাকবে।পৃথিবীর কিছু পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে এই সম্পর্কটা সবার উপরে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত