জেনিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয় ফেইসবুকে। ও আমার সিনিয়র। কিন্তু কি ভাবে ওর সাথে সম্পর্কে ঝরিয়ে গেলাম এটা এখন অব্দি বুঝে উঠতে পারিনি। ওর সাথে আমার কোনোদিক দিয়েই মিলেনা। যেখানে ও বেড়ে ওঠেছে শহরের আলো বাতাসের ছোঁয়া নিয়ে, সেখানে আমার বেড়ে ওঠা গ্রামীণ পরিবেশে। ও দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি স্মার্ট। এর থেকে বড় কথা ও অনেক ভদ্র একটা মেয়ে। কিশোরগন্জ মূলত ভাটির এলাকা বলে পরিচিত। আর এই ভাটির এলাকাতেই আমার জন্য। মোটকথা,সব দিকে থেকে বিবেচনা করলে আমি ওর কাছে অতি নগন্য হবার কথা।
কিন্তু কোনোদিন সে আমাকে ঐই রকম ভাবে দেখেনি। যাইহোক,সম্পর্কের সূত্র ধরেই ওকে বিয়ে করেছি আমি। বিয়েটা যে স্বাভাবিক ভাবে হয়েছে তা না! আমাদের দুজনকেই অনেক কষ্ট আর কথা সহ্য করতে হয়েছে বিয়ের জন্য। সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয়েছে প্রতিবেশিদের কথা। তাদের মধ্যে প্রধান ছিল এটা যে”বয়সে বড় মেয়েদের বিয়ে করা যায়না!মেয়ে নাকি ছেলেদের থেকে ছোট হতে হয়!” এসব কথায় পাত্তা না দিয়েই ওকে বিয়ে করি আমি। প্রথমত পরিবারের লোকেরা ওকে দেখতে না পারলেও আস্তে আস্তে সবার মন জয় করতে পেরেছে ও। বিয়ের আগে ওকে বলেছিলাম সবকিছু ওর সাথে শেয়ার করবো। যতটুকু সম্ভব ওকে কাজে সহায়তা করবো।
জেনিয়া সেদিন আমার কথাশুনে প্রচন্ড খুশি হয়েছিল। মেয়েটা হয়তো এই রকম কাউকেই জীবনে আশা করেছিল। বিয়ের পরেও আমি আমার কথা রেখেছি। সবকিছুতেই জেনিয়াকে সাহায্য করি আমি। মাঝে মাঝে রান্নাটাও আমি করি। যেদিন আমি রান্না করি ঐই দিন মেয়েটা আমাকে ঝরিয়ে ধরে রাখে খুব শক্ত করে। মনে হয় কোনদিন হারাতে দিবেনা আমাকে। আজকে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় জেনিয়া ফোন দিয়ে বাসায় যেতে বললো। পাশে বসে থাকা প্রতিবেশি কয়েকজন আমাকে শুনিয়ে একজন আরেকজনকে নানা ধরনের উপহাস মূলক কথা বলছে। এদের মধ্যে একজন আমার পাশে এসে বসলো। তারপর চায়ে চূমুক দিতে দিতে বললো
-শুনেছি তুমি নাকি খুব বউ ভক্ত? বউকে আদর করে রান্নাটা পর্যন্ত করে খাওয়াও?
—জ্বী।ঠিক শুনেছেন। শুধু রান্না না কাপড়ও পরিষ্কার করে দিই আমি। যতটুকু পারি সবটুকু কাজেই আমি করি।
-তুমি তো পুরুষ জাতির মান-সম্মান সব ঢুবিয়ে দিচ্ছো!
—আপনার মধ্যে পুরুষত্ব আছে?
পুরুষত্ব কি নারীদের শোষন করার মাঝেই বিদ্যমান? আপনার বাবা যদি আপনার মাকে শোষন করে,জুলুম করে তাহলে কি পুরুষত্ব প্রকাশ পাবে বলে আপনার মনে হয়? আমার কথার জবাব দিতে না পেরে হাসিমাখা মুখটা কালো করে বসে রইলো লোকটি।। চায়ের বিল মিটিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বাসায় এসে দেখি জেনিয়া মুখ কালো করে বসে আছে।! কারণ জানতে চাইলেও বেশি কিছু একটা বললো না। শুধু বললো:
—কাল থেকে আর কোনদিন রান্না করবেনা। এমনকি কাপড়ও পরিষ্কার করতে হবেনা। কষ্ট হলেও আমি-ই করবো সবকিছু।
-হঠাৎ করে এই কথা বলার কারণটা কি জানতে পারিনা? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?
—না কেউ কিছু বলেনি। আমি বলছি করতে হবেনা আর কিছু তোমাকে।
-দেখো তুমি যদি না বলো তো আমি জোর করবোনা।
তবে একটা কথা মনে রেখো”স্বামী-স্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতে বা একে অন্যকে তার সমস্যার কথাগুলো প্রকাশ করার মাধ্যমে যে সমাধান বেরিয়ে আসবে এটাই হলো উওম আদর্শ।” আজকে তুমি যদি কিছু একটা নিজের ভেতরে গোপন করে রেখে দাও,স্বামীর কাছে না বলো তাহলে কি এর সমাধান পাবে কোনোদিন?? জেনিয়া কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আমিও আর বেশি কিছু বললাম না। রুম থেকে বের হয়ে আম্মুর রুমে গেলাম।
—আম্মু একটা কথা বলার ছিল।
-হু বাবা বল।
—জেনিয়াকে কি কিছু বলেছো তুমি?
-না বাবা। এমন লক্ষী বউমাকে আমি আবার কি বলতে পারি।
আম্মুর কথা শুনে বুঝতে পারলাম ওকে অন্যকেউ কিছু বলেছে। তাই রুমে চলে আসলাম। এসে দেখি ও ঘুমোচ্ছে। পাশ থেকে কাথাটা শরীরে টেনে দিতেই আমার হাতটা শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগলো।
—পাভেল আমাকে মাফ করে দাও।
-এই ভাবে কাঁদছো কেন? আগে তো বলো কি হয়েছে? না বুঝে না জেনে কোনো কিছু কেউ করতে পারে?
–পাশের বাসার ভাবি আমাকে অনেক কিছু বলেছে। তুমি আমার কাজগুলো করে দাও, রান্না করো এসব নিয়ে আমাকে অনেক কথা বলেছে।
–আমার ভাবির প্রতি একটুও রাগ হচ্ছেনা।
রাগ হচ্ছে তোমাকে নিয়ে। একটা মানুষ অহেতুক কিছু কথা শুনিয়ে গেল আর তুমি প্রতিবাদ না করে উল্টো হেরে গেলে!! ভাবি আবার আসবে। কারণ সে তোমার দুর্বলতার সুযোগ পেয়েছে। আর যখন আসবে তখন আমাকে ডেকে দিও।
—আচ্ছা।এবার চলো ঘুমোয়।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে যখন দাত ব্রাশ করছিলাম ঠিক তখন ভাবির উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। ব্রাশ হাতে নিয়েই ভাবির দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি কিছু বলার আগে ভাবিই বলতে শুরু করলো:
—এলাকার মানুষ তোমাদের নিয়ে কত কিছু বলছে।
–আপনার কি মতামত ভাবি?
—আমি আর কি বলবো।
এখনো সময় আছে নিজেকে পাল্টাও। বউ থাকতে তোমাকে ওর কাজ কেন করে দিতে হবে!! আমি জেনিয়ার দিকে তাকালাম। দেখলাম ওর চোঁখদুটোতে পানি ভর করেছে। তারপর ভাবির দিকে তাকিয়ে মুছকি হেসে বললাম:
–আমি যদি একবেলা না খেয়ে থাকি এলাকার লোকেরা আমাকে খাওয়াবে?
-না।তারা কেন তোমাকে খাওয়াতে যাবে।
—আমি যদি অসুস্থ হয়ে বিচানায় পড়ে থাকি আপনি কি সারারাত জাগ্রত থেকে আমার সেবা-যত্ন করবেন? এবার ভাবি কিছু বলতে পারছেনা। মুখটা এদিক-ওদিক করছে শুধু।
—আপনি যদি আমার পাশে সারারাত না থেকে আমার সেবা করতে না পারেন,এলাকার লোকেরা যদি এক বেলা খাবার দিতে না পারে। তাহলে আমি কেন এলাকার লোক এবং আপনাদের কথা শুনবো? আমার বিপদে-আমার সুখে আমার স্ত্রী জেনিয়া আমার পাশে থাকবে। আপনারা না। স্বামী স্ত্রীর কাজে সহায়তা করবে এর থেকে সুন্দর আর কি হতে পারে বলুন? ভাবির মুখে কোনো কথাই ফুটলনা আর। চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে গেল। জেনিয়া দৌড়ে এসে আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।
—হয়েছে হয়েছে আর কাঁদতে হবেনা।যাও কাপড়গুলো পরিষ্কার করো গিয়ে।
—ইমমম।তুমি আছো কি জন্য। বলেই জেনিয়া আরো শক্ত করে ঝরিয়ে ধরলো আমাকে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা