বৃষ্টিভেজা সুখ

বৃষ্টিভেজা সুখ
অয়নের অফিসের কাজ শেষ,তবুও কেন জানি বাসায় যেতে মন চাইছে না।ওর বোন রিমির বিয়ের কথা চলছে, অথচ রিমি রাশেদকে পছন্দ করে। রাশেদ আর কেউ নয়,অয়নেরই বন্ধু। কিন্তু অয়নদের পরিবারের সাথে ওদের যায়না, অয়ন বুঝতে পারছে না রিমি এমন একটা ছেলেকে কেন পছন্দ করল! আসলে দোষটা অয়নেরই, ওইতো বাসায় বন্ধুদের নিয়ে আসত সব সময়! ওর বোনের কথাটা একবারও তখন মাথায় আসেনি, আর কেউ ওভাবে বলেওনি ব্যাপারটা, এখন বুঝতে পারছে বাসায় বোন থাকলে বন্ধুদের সাথে তার পরিচয় না করিয়ে দেওয়াই ভালো, আর বাসায় নিয়ে আসাতো আরো বিপদজনক!
অয়ন ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল রাত ১০ টা প্রায় বাজতে চলেছে। ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে ও অফিস থেকে বের হয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালো, এমন সময় বেখাপ্পাভাবে পকেটে থাকা ফোনটা টুংটাং করে বেজে উঠল। একরাশ ক্লান্তি আর বিরক্তি নিয়েই ফোনটা পকেট থেকে বের করল। ওর ধারণাই ঠিক নিশি ফোন করেছে।ইচ্ছে করেই কল কেটে দিল। নিশি ওর বউ, কয়মাস আগে দুজনে ভালবেসে বিয়ে করেছে। দুজনে ক্লাসমেট ছিল, আর ওদের পুরো ৩ বছরের বেশি সম্পর্ক ছিল।ওদের বিয়েতে ওর বন্ধুদের অবদান কম ছিলনা,বিশেষ করে রাশেদের, কিন্তু রাশেদ যে উপকারের পাশাপাশি এতো বড় ক্ষতি করার পরিকল্পনা করে রেখেছে তা কে জানত!
বাসায় পৌঁছে কারো সাথেই তেমন কোনো কথা বলল না অয়ন, শুধু সবাইকে এটা জানিয়ে রাখল যে কাল রিমিকে দেখতে আসবে,ছেলে খুব ভালো একটা চাকরি করে। রিমি শুয়ে শুয়ে কান্না করছে। কান্না করা ছাড়া আর ওর কিই বা করার আছে! রাশেদকে ভালবাসাটা যে ওর জীবনে এতো বড় ভুল হবে ও আগে বুঝতে পারেনি। ও দোটানায় ভুগছে খুব, রাশেদ চাইছে পালিয়ে বিয়ে করতে, কিন্তু রিমি সেটা করতে রাজি নয়, ও যে শুধু রাশেদকেই নয় ওর পরিবারকেও চায়। কিন্তু এটা ওর আগে ভাবা উচিৎ ছিল! রাশেদ বারবার কল করছে, ভাবল শেষ একবার কথা বলে দেখবে, ভালবাসে যে খুব! কল রিসিভ করতেই রিমি রাশেদের উতলা কন্ঠস্বর শুনতে পেল…
_প্লিজ রিমি তুমি আমার কথা শোনো! আর কত! আমি আর পারছি না, অয়ন কখনই রাজি হবেনা, আর তোমাকে ছাড়া আমি থাকতেও পারব না।
_কিন্তু আমি আমার পরিবারের সবাইকে কষ্ট দিয়ে তোমার সাথে সুখী থাকতে পারব না রাশেদ। তোমাকেতো আর পরিবার ছাড়তে হবেনা, তুমি কি বুঝবে!
_অবুঝের মতো কথা বলোনা রিমি, কেন নিশি আছে না! ওকে দেখো, কত খুশি ভালবাসার মানুষকে পাশে পেয়েছে।
_হ্যা দেখতে পাচ্ছি! খুব দেখতে পাচ্ছি! জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে এতো বড় করে গড়ে তোলা বাবা-মায়ের সাথে কয়েকমাস কথা না বলে একটা মেয়ে কতটা ভালো থাকতে পারে! না পারে সে কথা কারো সাথে শেয়ার করতে, আর না পারে কষ্টগুলো সহ্য করতে!
_কি বলতে চাইছো কি তুমি! নিশি আর অয়ন সুখী নয়?
_হ্যা সুখী! খুব সুখী! কিন্তু আমার ভাই,ভাবি নয়। আর আমি এমন সুখী হতে চাইনা। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমিও আর পারছি না, কাল আবার দেখতে আসবে, আমি আর কোনো অজুহাত দেখাতে পারব না, ভালো থেকো তুমি।
_কিন্তু এখানে ক্ষমা চাওয়ার কথা আসছে না রি….
রাশেদের পুরো কথা না শুনেই কলটা কেটে দিয়ে কান্না করতে লাগল রিমি। রিমি কল কেটে দিতেই রাগে-অভিমানে, কষ্টে ফেটে যাচ্ছে রাশেদ। ফোনটা আছাড় দিতে গিয়েও থেমে গেলো ও, ওকে যে এসব মানায় না! আসলেই কি রিমি পারবে অন্যকারো হতে! অন্যকারো সাথে সারাজীবন কাটাতে! ওর বন্ধুরা ঠিকই বলত, মেয়েরা খুব স্বার্থপর হয়! খুব সহজেই সব মানিয়ে নেয়, তাহলে ও কেন মানতে পারছে না!ও আর কিছু ভাবতে পারছে না, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। আজ রিমির বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করতে এসেছে ছেলের বাসা থেকে। রিমি মুখে এক চিলতে মিথ্যে হাসি নিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে।বিয়ে নিয়ে ওর কত স্বপ্ন ছিল,সব পুরণ হবে, শুধু মানুষটাই আলাদা! ভাবতেই কেমন লাগছে ওর!
অয়ন আজ খুব খুশি। দেরিতে হলেও ওর বোনের ভাবোদয় হয়েছে! সবকিছু ঠিকটাক মতই হচ্ছে, এখন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেলেই ও চিন্তামুক্ত। ওর বাবা অসুস্থ, আর একমাত্র বোনের একমাত্র ভাই হওয়ায় সব ঝামেলা ওকেই সামলাতে হবে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে অয়ন দেখে নিশি বিছানায় নেই। এতরাতে মেয়েটা আবার কোথায় গেল! নিশ্চয়ই বারান্দায় আছে! এসব ভাবতে ভাবতে ঘুম জড়ানো চোখে বারান্দায় যেতেই ও নিশিকে দেখতে পেলো গ্রিল ধরে আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। ও পেছন থেকে নিশিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরতেই চমকে উঠল মেয়েটা। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে, নিজেকে ছাড়িয়ে বলল…
_তুমি!!!
_আরে এতো রাতে তুমি ঘুমানো বাদ দিয়ে এখানে কি করছ নিশি?
_ভাবছি।
_কি এতো ভাবছ শুনি!
_বড্ড ভুল করে ফেলেছি তোমায় বিয়ে করে! না পেলাম কোনো বিলাসিতা, আর না পেলাম…
ওর কথা শেষ না হতেই অয়ন বলে উঠল…
_আরে এসব তুমি কি বলছ নিশি! আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি, আর তোমার বিলাসিতা চাই?? আমাকে পেয়ে তুমি সুখী নও?
_যদি বলি যে, না সুখী নই! আজ বুঝতে পারছি যে সব বাবা-মাই চায় যে তাদের মেয়ে সুখে থাকুক। আমিই ভুল করেছি বাবা-মাকে ছেড়ে এসে তোমায় বিয়ে করে! অনেক বড় ভুল করেছি তাদের কষ্ট দিয়ে।
_নিশি তোমার কি হয়েছে? তুমি আজ এমন কথা বলছ কেন? দেখো তোমার বাবা-মা আমাকে পছন্দ করেনা,এতে আমার কি দোষ! আমি তোমায় ভালবাসি।
_কেন অয়ন, আমার বাবা-মা আমায় কম ভালবাসে?
_কই তারাতো একবার এলোনা তোমার খোজ নিতে! তুমি না তাদের একমাত্র সন্তান!
_আমি গিয়েছি তাদের খোজ নিতে? বলো? অয়ন আমি উনাদের একমাত্র সন্তান,আর আমিই উনাদের ছেড়ে চলে এসেছি,উনারাতো আমাকে আসতে বলেনি!
_তুমি কি বলতে চাইছোটা কি! হেয়ালি না করে সোজাসুজি বলো!
_কিছুনা
বলেই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল নিশি। অয়নও একা একা বারান্দায় না থেকে রুমে চলে গেল। আজ রিমির বিয়ে। সবাই খুব খুশি। বিশেষ করে অয়ন। ওর চোখেমুখে একটা আত্মতৃপ্তির ছাপ! নিশি সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ ওর মনে হলো ও ওর মাকে দেখতে পেলো,কিন্তু চোখের ভুল ভেবে সেটা উড়িয়ে দিল,সাথে মনটাও একটু খারাপ হয়ে গেল নিশির মায়ের কথা মনে পড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ও দেখল যে সত্যি ওর মা-বাবা এসেছে বিয়েতে। আবেগে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে সবার সামনেই কান্না করে দিল নিশি। ওর মা নিশিকে সামলে নিয়ে বলল…
_শেষ পর্যন্ত তাহলে এই অচেনা মানুষ দু’টোর কথা মনে পড়ল!
_মা তুমি এমনভাবে বলছ কেন! তুমি জানো আমি তোমাদের কত মিস করেছি!
_থাক আর বলতে হবেনা। আমাদেরই হয়ত ভুল! তোর সুখটাকে না খুজে আমরা তোর সমৃদ্ধিটাকে খুজেছিলাম। অয়ন নিজে গিয়ে আমাদের বলবে আর আমরা আসব না তা কি হয়! হাজারহোক আমি মেয়ের মা!
_অয়ন গিয়েছিল?
_হ্যা কেন তুই জানিস না? আসলেই নিশি ব্যাপারটা জানেনা তারপরেও এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল..
_আচ্ছা মা চলো আমার রুমে,একটু রেস্ট নাও। পরে কথা হবে। নিজের মাকে নিয়ে রুমে গেল নিশি। তবে ও নিজেকে আজ সত্যিই খুব ভাগ্যবতী মনে করছে ওর বাবা-মাকে কাছে পেয়ে। তারমানে এখন সব ঠিক হয়ে যাবে মনে হয়! বরযাত্রী চলে এসেছে শুনে সব মেয়েরা রিমির পাশ থেকে উঠে বর দেখতে চলে গেলো। রিমিও লাজুক চোখে বরকে দেখার জন্য আকুল হয়ে বসা থেকে উঠে দাড়ালো, এমন সময় ওর বান্ধবী রুপা এসে বলতে লাগলো…
_রাশেদ ভাইয়াকে খুব সুন্দর লাগছে রে রিমি! একেবারে রাজপুত্রের মতো কথাটা শুনে রিমির লাজুক মুখটা লাল হয়ে উঠল।আজ ওর স্বপ্ন পুরণ হতে চলেছে।ওতো রাশদের আশা ছেড়েই দিয়েছিল! অয়ন যে এতো তাড়াতাড়ি বদলে যাবে ও ভাবতেই পারেনি। এখনো সবকিছু ওর কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।এসব ভাবতে ভাবতে কখন থেকে নিশি ওর সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছে বুঝতেই পারেনি! নিশি ওকে আনমনা দেখে বলল…
_কি ব্যাপার ননদিনী, এখন থেকেই হারিয়ে যাচ্ছ কোথায়! সবেতো শুরু এ কথা শুনে রিমি আমতা আমতা করে বলতে লাগল,
_না ভাবি,আমি ভাইয়ার কথা ভাবছিলাম, কি করে রাজি হয়ে গেল!
_আচ্ছা বাদ দাও। সেসব নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবেনা।
_না ভাবি বলোনা প্লিজ! তুমি কীভাবে রাজি করালে ভাইয়াকে?
_কেন! সে-ই শুধু ভালবেসে বিয়ে করতে পারে! অন্যকেউ নয়?
_মানে?
_মানে এটাই, আমিওতো তোমার ভাইকে আমার পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলাম, তখনতো সে বলেনি, সে আমার অযোগ্য! তাহলে আজ কেন রাশেদকে তোমার অযোগ্য বানিয়ে দিলো!
_তাতেই রাজি হয়ে গেল?
_জানিনা! তবে আমার মনে হয়, তোমাকে না পেলে রাশেদ যে কষ্টটা পেত সেটা সে অনুধাবন করতে পেরেছিল। যতই হোক বন্ধুতো ওর!
_সে যাই ভাবুক, রাজি হয়েছে এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। ওদের এতক্ষণ কথা বলতে দেখে পাশ থেকে সবাই ডাকাডাকি শুরু করল। বিয়ে বাড়ি বলে কথা, কণের সাথে এতো কথা কিসের এখন! বর চলে এসেছে, কণেকে সাজাতে হবে কত কাজ!!!
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত