– তোমার মতো পাগল বর লইয়া আমার বাকি দিনটা যে কেমনে যাইবে, আল্লাহ্ জানেন।
আমি নোজাইফার দিকে তাকালাম। সে বেশ রেগে আছে আমার প্রতি। রাগের কারণটা ও বেশ শক্ত। আমার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
– রিক্সা ভাড়াটা কিভাবে দিলে?
আমি আমতাআমতা করতে লাগলাম। এই রিক্সা ভাড়ার জন্য যা করেছি সেটা শুনলে এই মেয়ে আমাকে আস্ত চিবিয়ে খেলে ফেলবে। নোজাইফা আমার কথা বলা না দেখে রেগে বলল, “রিক্সা ভাড়াটা দিলে কিভাবে?
আমি আফ চেপে রাখতে পারলাম না। বলেই দিলাম।
– আসলে, তোমাদের বাসার সামনে আসার পর দেখি তোমার আপু বের হয়েছেন। আমি রিক্সাওয়ালা মামাকে বলে এসেছি ভাড়াটা সে দিবে।
নোজাইফার এবারের দৃষ্টিটা তার চেয়েও বেশি পাওয়াফুল। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আগুনের ফুল্কি বের হচ্ছে। সে
আমার দিকে একবার তাকালো আর একবার আমার পাশে থাকা বস্তার দিকে।
– ওই পাগল, এই এক বস্তা বই দিয়া কি করবি তুই?
– নোজাইফা এমন করছো কেন, সামান্য বই তো।
– এই গুলা তর কাছে সামান্য বই হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এইগুলা আমার সতীনের মতো। যেটা বারবার আমার ভালোবাসায় ভাগ বসায়।
নোজাইফা হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ঘটনা হইছে কি! নতুন কোনো শহরে আমি এসেই আগে যেটা দেখে আসি সেটা হল এই শহরের আনাচেকানাচে কোনো পুরাতন লাইব্রেরীর দোকানের অস্তিত্ব আছে কি না। বউয়ের বাপের বাড়ি আসার আগেও আমাকে বেশ কিছু ইনফরমেশন নিতে হয়েছে। জানলাম এখানেও দু’একটা পুরাতন বইয়ের দোকান আছে। তাই শ্বশুরবাড়ি আসার পরপরই বের হয়ে গিয়েছি তার উদ্দেশ্যে। বইয়ের দোকান গেঁটেগেঁটে প্রায় তিন ঘন্টায় এই বইয়ের লিস্ট করেছি। সবগুলা বই বস্তায় ভরে টাকা দিলাম। ব্যস ওমনি পকেট ফাকা হয়ে গেল। রিক্সা ভাড়াটা পর্যন্ত নেই। ভাগ্যিস পকেটে এটিএম কার্ডটা ছিল। ডাচ বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথে ঢুকেই পড়লাম আরেক বিপদে। কার্ডের পিন ভুলে গেছি। এখন কি হবে? কার্ডের পিন তো নোজাইফা জানে।
দিলাম নোজাইফাকে কল। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যায় হয়, নোজাইফা কল ধরল না। বুথে বেশি সময় থাকতে দিল না। বলল এসির বাতাসের জন্য নাকি আমি এখানে ভান ধরে বসে আছি। শেষমেশ একটা পিন মনে করতে পারলাম। আর গিয়ে পিনটা দিতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কারণের পিনের লাস্ট নাম্বারটা ১ কিন্তু আমি দুই দিয়ে দিছি। ব্যস ওমনি আমার এটিএম কার্ড আটকিয়ে রেখে দিল বুথটা। তখন ইচ্ছে করছিল শালার বুথটা কে এক লাথি দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলি। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ডের জন্য সেটা সম্ভব হল না। আর এখন ব্যাংক অফিসে না গিয়ে আর কিছু করাও সম্ভব না। আর এখন শ্বশুরবাড়িতে আমি টাকা বিহীন। আর বাড়ি ফিরবই বা কিভাবে? এখন তো নতুন জামাই। শ্বশুরের কাছে তো আর টাকা চাইতে পারিনা। এটা করলে তো জামাইদের ইজ্জতে আঘাত করা হবে।
আমি বইয়ের বস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। বস্তাটা দেখলেই সব কষ্ট ভুলে যাই। পকেটে যে টাকা নাই সেটাও ভুলে যাই। মনের সুখ শান্তি যেন ফিরে পাই। এই বস্তাটায় বই আছে শুনে, শ্বশুর শাশুড়ির মুখটা হয়েছে দেখার মতো। দুজনেই ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। শাশুড়ি তো শেষমেশ বলেই ফেললেন, “আমি মনে করলাম জামাই আমাদের জন্য বস্তা ভরে সুপারি পান নিয়ে এসেছে।
আমার শাশুড়ির আবার সুপারির প্রতি একটা আলাদা মায়া আছে। উনি অন্য সব খাবার থেকে একেই একটু বেশি স্নেহ করেন, মানে বেশি খান আরকি। অতিরিক্ত, দাত সবগুলা দেখে মনে হয় আলতা বেয়ে পড়ছে। শ্বশুর বলে উঠলেন, আমিতো মনে করলাম রাস্তার কোনো বোতল খোঁজে নেয়া। শ্বশুর মশাই বাক্যটা শেষ করতে পারেন নাই। আমি হনহন করে চলে গেলাম। বেচারা শ্বশুর এখন শাশুড়ির জিম্মায়। কারণ শাশুড়ি অগ্নিদৃষ্টি প্রদান করেছেন উনার উপর। যদিও দেখতে শুনতে শ্বশুরের থেকে শাশুড়িকে একটু বেশিই বয়স্ক মনে হয়।
সন্ধ্যা হতেই আমি বস্তা থেকে বের করে নুরুল ইসলামের সমীকরণ বইটা পড়তে লাগলাম। এই বই গুলা এখন আর খোঁজে পাওয়া যায় না। আর না এই লেখকদের। সেদিন আরেকটা লাইব্রেরী থেকে সূর্যাস্ত নামে একটা বই খুঁজে পেয়েছিলাম। যার সংস্করণ বয়সটা আমার বয়সের থেকে ও বেশি।সমীকরণ বইটা দুটো ফ্যামিলিচিত্র বলা যায়। প্রায় অর্ধেক পড়ে ফেলছি এমন সময় নোজাইফা রুমে ঢুকল। আমার দিকে তাকিয়েই অগ্নিদৃষ্টি স্থাপন করল।
– তোমার খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নাই না?
– না। শ্বশুরবাড়িতে আবার কিসের কাজ।
– কিসের কাজ মানে? আসো আমার সাথে, তোমার কাজ দেখিয়ে দিচ্ছি?
নোজাইফা আমাকে টেনে টেনে ছাদে নিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় দেখলাম শ্বশুরের রুমের বাতি জ্বলতেছে। আর শ্বশুর আব্বা এক পায়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটো দুই কানে ধরে আছেন। নোজাইফার দিকে তাকালাম। সে বলল “এটা ওদের সমস্যা, মান অভিমান। এখানে আমাদের কিছু করার নাই।”
কিন্তু শ্বশুরের জন্য বেশ কষ্ট লাগল আমার। অথচ তার চেয়েও বড় কষ্ট এই ছাদ ঝাড়ু দেয়া। নোজাইফা আমাকে ছাদ পরিষ্কার করতে দিয়ে গেছে। রাত হওয়ায় কেউ দেখছে না অবশ্য। কিন্তু ততক্ষণে আমি ঝাপসা দেখতে শুরু করেছি। মানে আমার চশমাটা নিয়ে আসি নাই। বইয়ের উপরে চশমাটা রেখে আসছি। এখন যামু কেমনে? পুরোপুরি ঝাপসা দেখার আগেই দৌড় দিলাম দরজার দিকে। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যায় হয়, তার আগেই আমার হাতে থাকা ঝাড়ুটার সাথে কিছু একটার ধাক্কা লেগে গেল। ব্যস ওমনি একটা মেয়ের আত্ম চিৎকার শুনা গেল। নীচ থেকে সবাই বলতে শুনলাম “এই হাতি পড়ে গেছে, হাতি পড়ে গেছে। ” এই ঘটনার পর বুঝতে পারলাম উনি আমার শালী হন। আর এটা উনার ডাক নাম।
রাতে শুয়ে শুয়ে যে একটা চিন্তা করতেছি সেটা আমাদের সিলেট আসা নিয়ে। কম করে হলেও তো হাজার দুএক টাকা দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে পকেট চিরুনি তল্লাশি দিয়ে ও একটা টাকা পাওয়া যাবে না। নোজাইফার দিকে তাকালাম। সে এখনো ঘুমায়নি। কিন্তু আমার সাথে কথা বলছে না। মেসেঞ্জারে যেভাবে মেসেজ সিন হয়, কিন্তু রিপ্লাই আসে না এই মুহূর্তে সেও এইরকম করছে। কথা শুনছে কিন্তু রিপ্লাই দিচ্ছে না। আমি বললাম,
– ওই, কাল যে চলে যামু কিন্তু ভাড়ার টাকা পাবো কোথায়?
– রিপ্লাই নাই।
– আমার মাথায় না একটা বুদ্ধি আসছে। ধরো, যাওয়ার সময় তো তোমার আম্মু আব্বু আমাদের সালামির টাকা দিবেন সেইটা দিয়ে না হয়……
– কি বললি হারামজাদা? তর এইসব উদ্ভট কাজকর্মে আমি কিছু বলছি না ভেবে শান্তি পেয়েছিস? তর শান্তি পাওয়া বের করছি। আর এখন সালামির টাকা দিয়ে বাড়ি যামু? যদি তরে সালামির টাকা দেয় না তখন কি করবি, শালা পাগল।
আমি চুপসে গেলাম। এর সাথে আর কিছু বলতে গেলে আরো তুইতোকারি করবে। যদিও তুইতোকারিটা আমার ভালোলাগে। আমি ভাবছি একদিন এর সাথে তুইতোকারি খেলা খেলবো। সে তুইতোকারি করবে আমিও করব। যে বেশি সময় কথা বলতে পারবে তাকে বই পুরষ্কার দিবো। সকালে নাস্তা করে রেডি হয়ে আছি। আমার কপালে চিন্তার রেখাটা এখনো যায় নাই। বারবার মনে হচ্ছে যদি সালামি না দেয় তাইলে কেমনে যামু? ইজ্জত তো আর থাকবে না। আর সালামি না দিলে এইবার সালামি আদায় করে নিবে বলেকয়ে। কিন্তু নোজাইফা সেটা হতে দিবে না সেটা আমি জানি।
দুপুরের দিকে আমরা রওনা হলাম। নোজাইফা বেরিয়ে আসতেই দেখলাম শ্বশুর শাশুড়িকে ও আসতে। আমার মনে হচ্ছে এই শাশুড়ি আম্মা এসে হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন “কিছু দিতে পারলাম না। এটা দিয়ে কিছু কিনে নিয়ো।” কিন্তু সেটা না হয়ে যা হল সেটা দেখেয় আমার মাথা ঘুরতে লাগল। শাশুড়ি আম্মা একটা প্যাকেট নিয়ে এসে আমাকে বললেন “এখানে বেশ কিছু বই আছে বাবা। তুমি তো আবার বই ছাড়া কিছুই বুঝো না, তাই সালামি হিসেবে বই দিলাম।
শ্বশুরও একি কথা বললেন। এমনকি নোজাইফার বড়বোনও। আমি পুরাই বোবা হয়ে গেলাম তাদের এই কর্মকাণ্ডে। নোজাইফার দিকে তাকিয়ে দেখি মিটমিট করে হাসছে আমার এই পরিস্থিতি দেখে। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করতেছে শ্বশুরের পায়ে ধরে বলি “শ্বশুর আব্বা আমারে বাঁচান।” কিন্তু সেটা করতে পারলাম না। তার আগেই নোজাইফা আমাকে টেনে নিয়ে রিক্সায় উঠালো। আমার এক হাতে ওদের দেয়া বইয়ের প্যাকেট, অন্যহাতে আমার বইয়ের বস্তা। তার মধ্যে ঘামে পুরো পাঞ্জাবীটা ভিজে গেছে। আর কপালে ভাড়া কোথা থেকে আসবে সেই চিন্তা। এই যে রিক্সায় উঠে বসে আছি সেই ভাড়াটাই বা কে দিবে।
বাস স্টেশনে এসে রিক্সা থেকে নেমেই আমি রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বললাম “ভাই একটা থাপ্পড় আমার গালে দিয়ে যান, ভাড়া টাড়া দিতে পারুম না।” নোজাইফা কথা শুনেই হাসতে লাগলো। আর বলতে লাগলো ” তর উচিৎ শিক্ষা হওয়া দরকার।” কথাটা বলেই নিজের পার্স থেকে রিক্সা ভাড়াটা দিয়ে দিল। আমি এবার ক্যাবলার মতো হাসতে লাগলাম। এই মেয়েটার ব্যাগে যে টাকা থাকে এইটা ভুলে গেছিলাম একদম।
– আয় হারামজাদা, তরে পাবনা দিয়ে আসতেছি। তুই পাবনা মেন্টাল হসপিটালেই ভালো থাকবি।
– যদি সাথে এইরকম বস্তার বস্তা বই দাও, তাইলে পাবনা কি বুড়িগঙ্গাও থাকতে রাজি আছি।
– সেই সুযোগ দিলে তো।
আমি হাঁটতে লাগলাম। একহাতে বইয়ের বস্তা। অন্য হাতে নোজাইফার একটি হাত ধরে। তারপর মনে হল আমার গন্তব্য জানা নেই। তার হাত ধরে এভাবে অনন্তকাল যদি হাঁটতে পারতাম। চোখে চোখ রেখে সারাটা জীবন যদি কাটিয়ে দিতে পারি, তাহলেই যেন জীবনটা আমার সার্থক হবে। আসলে, মানুষ একটু ভালোবাসার জন্য কাঙাল হয়। নিঃশেষ করে দেয় সবকিছু। তবুও তার একটু ভালোবাসা দরকার। বেঁচে থাকার জন্য কাউকে দরকার।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা