শেষ থেকে শুরু

শেষ থেকে শুরু

“তোমার সাথে আমি আর এক মুহূর্ত সংসার করতে চাইনা নীলা।” আকাশের মুখে এরকম কথা শুনে নীলা একটুও অবাক হয়না। সেও সাথে সাথে বলে “আমিও চাইনা তোমার সাথে সংসার করতে আকাশ।” অনেকক্ষণ ধরে কথা কাটাকাটি করার পর দুজনেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে। কালকেই হয়তো চিরদিনের জন্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে আকাশ আর নীলার। “প্রেম করে বিয়ে করলে সুখী হওয়া যায় না” এই বাক্যটি তাদের দুজনেরই কেমন যেন বিশ্বাস হতে শুরু করেছে। ঢাকার একটা ছোটখাটো বাসাতে এই দুজনের একটা পরিবার। কাল থেকে হয়তো এই দুটো মানুষ চিরদিনের জন্য অন্য কোথাও চলে যাবে। দুজন দু-পথে। আর হয়তো তাদের কখনো দেখাই হবে না।

রাত ধীরে ধীরে বেড়েই যাচ্ছে। ঝগড়ার কারণে রাতের খাবার খাইনি দুজন মানুষই। ভিন্ন রুমে অবস্থান করছে তারা।
নীলা তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছে। আর মাঝে মধ্যে বিরতি নিয়ে নিজের চোখ দুটো মুছতে মুছতে ভাবছে, তার তো এরকম পরিণতি হওয়ার কথা নয়। সে একটা তীব্র সুখের আশায়, একটা সুন্দর জীবনের আশায় আকাশের হাতটি ধরে ছিল। কিন্তু আকাশের হাতটি এতটাই পিচ্ছিল যে কোনভাবেই সে আঁকড়ে ধরতে পারলো না। জীবনে অনেক কিছু অপূর্ণ ছিল নীলার, ভেবেছিল আকাশের মত একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলে আর কোন অপ্রাপ্তি থাকবে না কিন্তু বিয়ের পর কি রকম অদ্ভুতভাবে লোকটা পরিবর্তন হয়ে গেল। সারাদিন ঝগড়া। ছোট ছোট জিনিস গুলাকে এত বেশি বড় করে যে আর সহ্য হয়না।

নীলাও যা ইচ্ছা বলে বেড়ায় কিন্তু আকাশ, আকাশ কি পারতো না একটু নিজেকে সামলে, একটু কথা কম বলে, একটু গালিগালাজ কম করে সেক্রিফাইস করতে? যতবার ভাবছে ব্যপারগুলো, ততই যেন নীলার কষ্টটা বেড়ে যাচ্ছে। ভাববার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে নীলার ভেতরের কান্নাটুকু যেন আরো বেশি তীব্র হচ্ছে। এক পর্যায়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো।

অনেকক্ষণ কান্না করার পরে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে দেখে বলতে লাগলো, ” সত্যিই তুই অভাগী, তোর কখনোই সুখ হবে না। আজীবন সৎ মায়ের ধারা তীব্র আঘাত পেয়ে ভাবলি একজনকে আপন করে নিয়ে যে সুখ গুলো কখনো পাওয়া হয়নি সবগুলো পেয়ে যাবি। তাও হলোনা। ” একই সময় অন্যরুমে আকাশ সিগারেট ফুরাচ্ছে। যদিও সে সিগারেট খায় না তবে আজকে ইচ্ছা করেই কিনে আনলো। একের পর এক ধরাচ্ছে আর খাচ্ছে।

আকাশ ভাবছে, কিরকমভাবে পাল্টে গেল নীলা। বিয়ের আগে কত কিছু ম্যানেজ করে চলত আর এখন কিছু বললে রেগে যায়। আমাদের, আমাদের তো একটা সুন্দর ছোট্ট সংসার হবার কথা ছিল। কত রকম স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম বিয়ের আগে। একটা ছোট্ট সংসার দুজন মিলে মিশে থাকবো, দুজন দুজনার প্রতি শুধু ভালোবাসা দিব কখনো ঘৃণা নয়। অথচ সবকিছু যেন অদ্ভুত ভাবে মুছে গেলো। আকাশ ভাবে, কত সুন্দর ভাবে আমরা পরিকল্পনা করতাম, “নিরব কালো রাত যখন পৃথিবীর উপর আসবে সব কিছু যখন নীরব হয়ে যাবে তখন দুজন দুজনের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকব। এখানে কোন কথা বলা হবে না মুখ দিয়ে, তার পরেও যে সকল কথা মুখে বলা যায় না সেই সবকিছুই বলা হয়ে যাবে দু’জন দু’জনার চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। অনেক কাছাকাছি দুটো মানুষ নীরবতায় হারিয়ে যাব। গ্রামীণ সবুজ স্নিগ্ধ লতিকার দেহের মত নিরব প্রেম জাগবে দুটো প্রাণে।”

কিন্ত সেই সবকিছুই যেন হারিয়ে যেতে লাগলো। কেন এমন হলো? কেন নীলা এখন আর আকাশকে বুঝে না, সেটা আকাশ নিজেও জানেনা। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে চিন্তা করে “থাকুক, নীলা নীলার মত আর আমি আমার মত থাকি। তাহলে হয়তো বেঁচে থাকতে পারবো। এরকম জীবন নিয়ে আসলে চলা যাবে না। এত ঝগড়া, এত ভুল বুঝাবুঝি নিয়ে চলা যায় না।

কালকে এর একটা সমাধান হয়ে যাক এটাই ভালো।” নীলা বুকশেলফের বইগুলো দিকে তাকিয়ে আছে। পছন্দের সবগুলো বই আকাশ তার জন্য এনে রেখেছিলো। প্রথম প্রথম সবকিছুই কত সুন্দর মনে হতো আর এখন আকাশ কিরকমভাবে অসহ্যকর ব্যবহার করে। নীলা ভাবে, “থাক আকাশের হয়তো আমাকে আর ভাল লাগেনা, সে যদি সুখী হয় আমাকে ছেড়ে তাহলে সেটাই হোক। কাল এটার একটা সমাধান হয়ে যাক। দুজন দুজনের মতো আলাদা হয়ে যাব এটাই ভালো। আমি কতটুকু সুখে থাকবো জানিনা তবে আকাশ সুখে থাকুক এটাই তো সবসময় চেয়েছি। কালকেই এর একটা সমাধান হোক।”

রাত বেড়ে যায়। ভিন্ন পৃথিবীর সৌন্দর্য যেন ঝরতে থাকে। দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কোন অসহায়ের চিন্তাহীন ঘুম আরো গাঢ় হয়। গলি মাতিয়ে রাখা ক্লান্ত ছেলেটিও হয়তো ঘুমিয়ে আছে মাকে আঁকড়ে ধরে। রাতের সৌন্দর্য ক্রমশ বেড়ে যায়, শুধু বাড়ে না এই দুটো মানুষের মধ্যকার সুখের হিসেব। সাগরে পতিত হতে হতে দুজনের ভাবনা কেমন যেন পাল্টে যায়। নীলা ভাবে, “আকাশের কী আসলেই খুব দোষ? মনে তো হয় না। আমি, আমি যদি একটু সেক্রিফাইস করি, আমি যদি একটু কম কথা বলি আকাশ যখন রেগে যায়, তাহলে কি আমাদের সম্পর্কটা ভালো থাকতো না? হয়তো থাকতো। তাহলে কেন আমি এরকম করেছি। আকাশ তো আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, তাকে ছেড়ে কি আমি সত্যিই চলে যাবো চিরদিনের জন্য? ”

যে সকালটা আসার জন্য নীলা কিছুক্ষণ আগে অপেক্ষা করেছিল সেই সকালটা যেন না আসে সেই প্রার্থনা এখন সে করে নিচ্ছে মনে মনে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে আকাশকে ছাড়া সে সত্যিই চলতে পারবে না। এই মানুষটা ছোট ছোট জিনিস নিয়ে ঝগড়া করলেও দিনশেষে ঠিকই প্রচণ্ডরকম ভালবাসে। ভালবাসার জন্য কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ছোট ছোট ঝগড়া করার জন্য হলেও আকাশের সাথে নীলার প্রচন্ড রকম ভাবে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আকাশ যদি এখন আর মেনে না নেয়। সত্যিই কি আকাশ কালকে ছাড়াছাড়ি করে ফেলবে? ”

নীলা ভাবতে থাকে। তার খুব ইচ্ছা হয় আকাশ কে বলতে,” আকাশ এইসব বাদ দিয়ে দুজন আপন হয়ে আমরা কি পারিনা সংসারটাকে সুখী করতে? তোমার পরিবারে কেউ নেই, আমার পরিবারেও কেউ নেই আপন, যারা আছে ওরা সব দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় ওদের কৃত্রিমতার ভিড় জড়িয়ে নিজেদের ভালোবাসাটুকু হারাতে চাইনা। চলোনা এক হয়ে যাই আবার। কিন্তু নীলা সাহস পায় না বলতে। যদি আকাশ মুখের উপরে না করে দেয় হয়তো সেটা সহ্য করতে পারবে না। নীলা ভাবে ” আসলেই কি দেরি হয়ে গেছে?” এইসবের কোন উত্তর পায় না সে।

এদিকে আকাশের সিগারেটের প্যাকেট ফুরিয়ে এসেছে। সে ভাবছে “একটা কোমল, মায়াবতী, পরিবারহীন মেয়ে সে কোথায় যাবে এরপর? যে সকল আত্মীয় তার আছে তারা শুধু স্বার্থের জন্যই কয়েকদিন হয়তো তাকে আশ্রয় দেবে তারপর কি হবে? নীলা তো আমাকে সত্যি ভালোবাসে। তাহলে কেন নীলাকে এভাবে ছেড়ে দিচ্ছি? আমারই তো সব ভুল। নীলার মত মেয়েকে কেউ ছাড়তে পারে? কেন আমি রেগে যাই সবকিছুতে? কেন নীলা একটা কথা বললে সেটার রেশ টেনে ধরে নিয়ে লম্বা করতে থাকি? আমি কি পারতাম না নীলাকে একটু কম রাগিয়ে সুন্দরকরে সংসারটা চালনা করতে? এই কোমল, চিরদুখী মেয়েটাকে আরো বেশি সুখ দিতে?

তাহলে কেন এরকমটা করলাম? সত্যিই যদি নীলা কালকে আমার থেকে চিরদিনের জন্য দূরে সরে যায় আমিই বা কাকে নিয়ে বাঁচবো? আচ্ছা, আচ্ছা নীলা কি আমার বুঝ এখন মানবে? আমি যদি গিয়ে নীলাকে এখন বলি “নীলা চলনা এইসব সকল কিছু বাদ দিয়ে আবার দুজন আপন হয়ে সংসারটাকে বাঁচিয়ে রাখি। রাত দেখার আনন্দ, বিদ্যুৎ চলে যাবার দুঃখ, মেঘের আগমনের যে সৌন্দর্যতা, বৃষ্টি ঝরে পড়ার যে শব্দ সবকিছু ভাগ করে নিই। ” পরক্ষণেই আকাশ আবার ভাবে, “না নীলা হয়তো এখন আর কিছুই মানবে না। কিছুই বুঝবে না। হয়তো সে আসলেই হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। আর কখনো হয়তো নীলার হাত ধরার অধিকারটুকু পাবো না। ”

দুটো মানুষ দুটো রুম থেকে একই ভাবনায় এসে পৌঁছালেও কেউ কাউকে কিছু বলতে পারেনা। কিন্তু রাত রাতের মতো করে বেড়েই যায়। হয়তো আজকে কেউ একজন নিজ থেকে এগিয়ে এসে যদি কথাগুলো না বলে তাহলে চিরদিনের জন্যই তাদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবে। কে সাহস নিয়ে এসে বলবে দুজন একত্রে থাকার কথা? কাউকেই সাহসী হয়ে উঠতে দেখা গেল না। দুজন মানুষ শুধু ভেবেই চলেছে এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখা উচিত কিন্তু কেউই টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়ার সাহস পাচ্ছেনা।

এটাই হয়তো তাদের পরিণতি। হয়তো এই ক্ষুদ্র একটি সাহসিকতার অভাবে তাদের সম্পর্কটা ভেঙে যাবে চিরদিনের জন্য। রাত হয়তো আর খুব একটা বাকি নেই। নীলা ভাবছে “আচ্ছা নিজের সেই পছন্দের মানুষটাকে আপন করে রাখবার জন্য একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক।” নীলা পরিকল্পনা করে, সে ওয়াশরুমে গিয়ে খুব জোরে কাশতে শুরু করবে, খুব জোরে। যেন মনে হয় গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আর এসব শুনে আকাশ হয়তো দৌড়ে এসে তাকে ধরবে। শরীর ছুঁবে। আর এরপর হয়তো ভিন্নকিছুও হয়ে যেতে পারে।

নীলা নিস্তব্ধে তার রুম থেকে বের হয়ে আসে। ওয়াশরুমের দিকে এক পা এক পা করে এগুতে থাকে। কিন্তু ঠিক তখনই আশ্চর্য রকম ভাবে সে শুনতে পায় ওয়াশরুম থেকে আকাশ খুব জোরে কাশছে, খুব জোরে। যেন মনে হচ্ছে আকাশের গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এরপর আর কী হয়েছিল সেই রাতে আমার জানা নেই। তবে এটা জানি তারা পরস্পরের ভুল বুঝতে পেরে একটা সুখের নিদ্রাতে জড়িয়েছিল। এর পরের দিন সকাল এগারোটা বাজে। এই ছোট্ট পরিবারের দুজন সদস্যের কাউকেই জাগ্রত দেখতে পাওয়া গেল না। বালিশের উপরে নীলার চুলগুলো বিছিয়ে দিয়ে সেখানটায় মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে আকাশ। আর অন্যদিকে আকাশের হাতটা নিজের বুকের মধ্যে তীব্র ভাবে চাপ দিয়ে ধরে রেখে ঘুমোচ্ছে নীলা। কেউই জাগ্রত নয়।

দুজন দু-দিকে চিরদিনের জন্য চলে যাবার যে পরিকল্পনা মাথায় এসেছিল তাদের সেই পরিকল্পনাটুকু যেন লজ্জা পেয়ে অনেক দূরে কোথাও হারিয়ে গেল। আর উল্টোদিকে এই দুটো মানুষ চিরদিন একসাথে, ভুল বুঝাবুঝি থেকে দূরে থেকে, একে অপরের খুব কাছাকাছি থাকার একটা শুভ প্রতিজ্ঞার জন্ম হলো। অথচ এরকম একটা শুভ প্রতিজ্ঞা না আসার কারণে কতো সংসার যে কত রকম ভাবে ভেঙে যায় তার হিসেব কিংবা কাহিনী কেউ মনে রাখেনা বা জানেনা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত