রূপালী আলো

রূপালী আলো

অফিস থেকে বের হতেই মাথাটা ধরে গেল। সারাদিন দম ফেলার সময় পাইনি। এই জুন মাসে রাজ্যের কাজ থাকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় চাকরি ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। এদিকে বাস পাচ্ছি না একটাও। যা আসছে সব মুড়ির টিনের মতো ঠাসাঠাসি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মাথা ব্যথাটা বেড়ে চতুর্গুণ হয়েছে। বাড়ি না ফিরলেই নয়। এক বাসেই উঠে পড়লাম শেষ পর্যন্ত। ধাক্কায় ধাক্কায় চলে গেলাম বাসের মাঝখানে।

গাড়ি চলে তো চলে না। মাথা ব্যথার সাথে আশেপাশের লোকের ঘামের গন্ধে বমি পাচ্ছে ভীষণ। গরমের মধ্যে অনির্দিষ্টকাল দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা যখন প্রায় অসহ্যের পর্যায়ে চলে গেছে, তখনই আওয়াজটা শুনলাম- “এক্সকিউজ মি!” ভালো করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সামনের সিটে বসা মেয়েটি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই ডাকছিল। আমাকে বলল, “আপনি কি অসুস্থ?” আমি মাথা ঝাঁকালাম। মেয়েটি উঠে গিয়ে বলল, “বসুন।”

আমি মোটামুটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটা মেয়ে উঠে একটা ছেলেকে বসতে দিচ্ছে ব্যাপারটা সবার কাছেই বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি তৎক্ষনাৎ বসতে পারলাম না। মেয়েটি ভালো করে সরে জায়গা করে দিল। আমি আর বাক্য ব্যয় না করে বসে পড়লাম। মাথাটা সামনের সিটে ঠেকিয়ে একটু শান্তি পেলাম।

কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। যখন ঘুম ভাঙলো, মাথাটা একটু হালকা। ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছি। চারদিকে তাকিয়ে খুঁজে দেখি মেয়েটা নেই। নেমে গেছে তবে? আমি যে ধন্যবাদও জানাইনি। মুখটাও ভালো করে দেখা হয়নি। আবছা মনে আছে। নিজেকে বেশ অকৃতজ্ঞ মনে হতে লাগলো। ইশ্ একটিবার যদি দেখে নিতাম!

রাতের আঁধারে ছুটন্ত বাসে বসে বাইরের নির্নিমেষ অন্ধকারের দিকে চেয়ে মনে হলো পৃথিবীতে ভালো লোক এখনো অনেক আছে। এই মেয়েটির যেন খুব ভালো হয়। আমার কলিগ নাঈম। ছেলেটা ভারি ভালো মনের মানুষ। আমার পাশেই তার ডেস্ক। দুজনের অল্পদিনেই খুব খাতির হয়ে গেছে। আমার সমবয়সী হবে। একদিন এসে আমাকে একটা বিয়ের কার্ড দিয়ে বলল, “বোনের বিয়ে দিচ্ছি। আসবেন কিন্তু।”

“অবশ্যই যাব।” “আর কাউকে বলছি না অফিসের। ছোট করে বিয়ে। নিজের টাকায় বোনের বিয়ে দিচ্ছি। বোঝেন তো! কত আর ইনকাম করি। তবুও চেষ্টা করেছি-” আমি তার হাতদুটো ধরে বললাম, “বুঝেছি। আমি যাব।”

নির্দিষ্ট দিনে বিয়েবাড়িতে পৌঁছে গেলাম। আয়োজন অল্প হলেও সবখানে যত্নের ছাপ। বাড়ির লোকগুলোও চমৎকার। আমাকে খুব খাতির যত্ন করে বসালো। বুঝলাম আমার গল্প ভালোই করে বাড়িতে। বউটাকে বাড়িতেই সাজানো হয়েছে। একবার বসার ঘর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা হলো। মিষ্টি মুখটি। নাঈম পরিচয় করিয়ে দিল, “আমার বোন, নিঝুম।”

মেয়েটি সালাম দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভালো আছেন?” নাঈম বলল, “আরে আপনার চেয়ে অনেক ছোট, তুমি করে বলেন ভাই।” আমি হেসে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ভালো আছ?” সে বলল, “জি। আপনি কেমন আছেন?” “ভালো।” বিয়েবাড়ির সবকিছু সুন্দরভাবক শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হলো না। বরযাত্রী আসার সময় অতিবাহিত হতে লাগলো, কিন্তু তারা এলো না। তারপর পাত্রপক্ষ ফোন করে জানিয়ে দিল বিয়ে হবে না। ছেলে নাকি বেঁকে বসেছে, সে বিয়েটা করবে না। তার প্রেমিকা আছে। খবরটা শোনার পরপরই বাড়িতে শোকের ছায়া পড়ে গেল। বাড়ির সবার মুখ থমথম করছে। অপমান আর দুঃখে সবাই একেবারে পাথর হয়ে গেছে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম বাড়ি সাজানো মরিচ বাতিগুলো এখনো জ্বলছে। ডালাগুলো ছড়িয়ে আছে তাদের সদ্ব্যবহারের আশায়। জড়বস্তুগুলো জানে না, আনন্দ উৎসব মাটি হয়ে গেছে। ভেতর থেকে কার যেন কান্নার শব্দ আসছে। নিঝুমের নাকি? আমার মেয়েটার চেয়ে বেশি কষ্ট হলো ভাইটার জন্য। নাঈমের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আমার থেকে একটু দূরেই জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি শূন্য। এইযে এতসব আয়োজন, এত ভালোবাসা মাখা সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে।

হয়তো কিছুদিন পর বোনের বিয়ে হবে, কিন্তু এমন করে কি হবে? ভাইয়ের একটু একটু করে জমানো স্বপ্নগুলো যে একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সেটা আর জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। আমার ভীষণ মায়া হলো ওর জন্য। আমি ওর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলাম। নাঈম পেছন ফিরল। চোখদুটো ব্যথাতুর হয়ে আছে। আমি কী ভেবে বলে ফেললাম, “আমার সাথে বোনের বিয়ে দেবেন?” নাঈম প্রথমটায় কথাটা বুঝলো না। যখন মাথায় ঢুকলো, তখন ওর চোখদুটোতে অবিশ্বাস, আনন্দ, বিষ্ময় মিলে অদ্ভূত এক আলো তৈরি হলো। নাঈম কিছু বলতে পারলো না। ঠোঁটদুটো চেপে কান্না আটকে জড়িয়ে ধরলো আমায়।

আমি নিজেকে এই করুণ কাহিনীর নায়ক বলব না। মহৎপ্রাণ ব্যক্তি বলেও দাবি করব না। তবে নিজের সামনে যেন নিজেকে ছোট হতে না হয় সে ব্যবস্থা করে রাখলাম। সৃষ্টিকর্তা যখন প্রশ্ন করবেন, জীবনে কোন ভালো কাজটা করেছি? আমি নির্দ্বিধায় বলব, এইযে দেখো, একটা শোকে মূহ্যমান পরিবারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। বাইরে নিকষ কালো আঁধার। রাতজাগা প্রাণীদের ডাক শোনা যাচ্ছে। শীত ভালোই পড়েছে। আমি শুয়ে আছি বিছানায়। নিঝুম টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে কী যেন লিখে যাচ্ছে। আমি ঘড়ি দেখলাম। রাত এগারোটা পনেরো। সেই দশটা থেকে বসে আছি। মেয়ের ওঠার নাম নেই। আমি ডাক দিলাম- “নিঝুম! আর কতক্ষণ?” “এইতো আসছি..”

ওর এই আসছি মানে অন্তত আরো দশ মিনিট। আমি চোখ বুজলাম। আমার কেন যেন মনে হয় আমার বউ আমাকে ভালোবাসে না। আবার কখনো মনে হয় খুব ভালোবাসে। আমি বুঝতে পারি না ঠিক। এমনও হতে পারে, আমাকে ওর পছন্দ হয় না। যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, তাকেই এখনো মনে ধরে রেখেছে! তবে আমি নিঝুমকে বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই ভয়ানক ভালোবেসে ফেলেছি। ওর স্নিগ্ধ মুখ, গভীর চোখের দীপ্তির প্রেমে পড়েছি শুরুতেই। বিয়ের পরপর ও একটু মুটিয়ে গেছে। তাতে আরো আদুরে লাগে। যখন প্রাণখুলে হাসে, ওর হারমোনিয়াম রিডের মতো সাজানো দাঁতগুলো ঝিকমিক করে। আমার ইচ্ছে হয় অনন্তকাল তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। নিঝুম সাড়ে এগারোটায় বিছানায় এসে বসলো। আমি চোখ বুজেই হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি আমাকে ভালোবাসো নিঝুম?”

নিঝুম এমন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না। ওর উত্তর না পেয়ে চোখ বুজেও আমি বুঝতে পারলাম ওর মুখটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে। হারিয়ে গেছে চিন্তার রাজ্যে। চোখ খুলে দেখি তেমন কিছু না। উল্টে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “হাসো কেন?” নিঝুম আরও একটু হেসে বলল, “এমনি। হিহি।” হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। আমি মুখটা জিজ্ঞাসু করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ও আমার হাতদুটো ধরে বলল, “কী মনে হয়? ভালোবাসি না?”

“বুঝতে পারি না।” ও আমার কাছ ঘেঁষে এলো। হাসি থামিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে ভালোবাসো?”

“বাসি।”

“কবে থেকে?”

“বিয়ের পর থেকেই।”

ও মৃদু হেসে বলল, “আমি তোমাকে কবে থেকে ভালোবাসি জানো? যেদিন থেকে তোমাকে দেখেছি, সেদিন থেকে। বাসে দাঁড়িয়ে কী কষ্টটাই না পাচ্ছিলে! ইচ্ছে করছিলো তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। সেদিন প্রথমবার বুঝেছিলাম কারো জন্য এত মায়াও হতে পারে!” আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। বলে কী! ওই মেয়েটা নিঝুম! ও বলতে থাকলো, “দ্বিতীয় বার তোমাকে দেখেছি ভাইয়ার ফোনে, ছবিতে। চমকে গেছিলাম। অনেক দোয়া করতাম জানো, আমার যেন তোমার সাথেই বিয়ে হয়। মুখে বলতে পারিনি কখনো।”

বলেই ও মুখটা নিচু করে ফেলল লজ্জায়। তারপর আবার চেয়ে বলল, “বিয়ের দিনও তোমায় দেখে মনে মনে ভাবছিলাম, কিছু কী হতে পারে না, যাতে বিয়েটা তোমার সাথে হয়? আমার ইচ্ছে এমন করে পূরণ হলো কী করে বলোতো? তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসি না? আর আমি তোমার দিকে তাকাতে পারি না ভয়ে। মনে হয় নিজের নজর লেগে যাবে। মনে হয় বেশি কাছে গেলে হারিয়ে ফেলব তোমায়!” একটু থেমে মাথা নিচু করে বলল, “তোমার হয়তো অনেক হাস্যকর মনে হচ্ছে কথাগুলো তাই না?” আমি দুই হাতে ওর মুখটা তুলে বললাম, “আমি কী আর এতসব জানতাম?” তারপর ওর চোখের কোণ থেকে একটু কাজল নিয়ে আমার হাতের তালুতে লাগিয়ে বললাম, “নাও নজর লাগবে না আমার।”

নিঝুম খিলখিল করে হেসে ফেলল। নিস্তব্ধ রাতে ওর হাসি কানে বাজলো বহুক্ষণ। হাসি থামিয়ে গভীর চোখে আমার দিকে তাকালো। হঠাৎ খুব কাছে এসে আমার চোখদুটো হাত দিয়ে ঢেকে গালে চুমু খেলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “কোনো এক ভর সন্ধ্যায় তোমায় দেখেছিলাম প্রথম বার অচীন দেশের রূপালী আলোর মতো এলে মোর জীবনে ভাসি! রাতের আভাসে ভীষণ চাওয়ায় তোমায় আপন করে পেয়েছি হাজার বার বলো, তারপরেও কি বলে দিতে হয় কতোটা ভালোবাসি?”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত