ঝাঁকুনী দিয়ে জাগিয়ে দিল নিধি৷ আমি চোখ কচলে ভালোভাবে তাকালাম৷ নিধি হাসে৷ মুচকি হাসি৷ আমি শোয়া থেকে উঠে বসতেই বলল, চাঁদের আলোটা গাঢ়ো হয়েছে আরো! চলো বসি একটু৷ আমি কিছু বলি না৷ এই রগচটা মেয়েটাকে আমি এখনো বুঝতে পারি না৷ আমি জানি, এই রাগগুলো ভিতরে এক আকাশ ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে মেয়েটা৷
সন্ধ্যা থেকেই পুরো উঠোন জুড়ে ধবধবে চাঁদের আলো ছিল৷ শোঁয়ার আগে নিধিকে বলেছিলাম, জোৎস্নাটা সুন্দর৷ চলো বাইরে গিয়ে বসি!” জবাবে নিধি কিছু বলেনি৷ আমিও আর জোর করতে পারিনি৷ হুটহাট রেগে যায় মেয়েটা৷ আমি চুপ করে শুয়ে পরেছিলাম৷ মেয়েটার সাথে প্রতিদিনই ঝগড়া হয় আমার৷ নিধি বলে যায়,আর আমি শুনি৷ এর বেশি কিছু আমার করা হয়ে উঠেনা৷ চাকরিটা হারিয়েছি ৬মাস হয়েছে৷ প্রত্যেকটা দিনে নিধির রাগগুলো বিন্দু বিন্দু বেড়েছে৷ সেদিন ভাতের প্লেটে ডাল আর আলুবর্তা দেখে ছোট ভাইটা আমাকে আবদার করে বলেছিল,
-ভাইয়া বিরিয়ানী খাবো!” আমি কিছু বলতে পারিনি৷ চুপচাপ গিলে যাচ্ছিলাম৷ ছোট ভাই আমার হাত ধরে আবার বলল, ভাইয়া বিরিয়ানী খাবো৷” আমি শান্তনা দিবো বলে গলা পরিষ্কার করি৷ তার আগেই নিধির রাগীকন্ঠের জবাব,
-একদিন বিরিয়ানী খেলে পরেরদিন উপোস থাকতে হবে৷ পারবি?”
ছোটভাইটা আর কিছু বলেনি৷ ভাইয়ের মুখটা আষাঢ়ের মেঘ এর মতো কালো হয়েছিল হুট করে৷ আমি কিছু বলতে গিয়েও বলিনি৷ সেই দিনের সারাটা বিকেল আমি বাইরে কাটিয়ে দিয়েছিলাম৷ আর ঘরমুখো হতে ইচ্ছে করেনি৷ যতবারই পা বাড়িয়েছি৷ ততবারই ভাইয়ের সেই কালো মুখটা আমার ভেতরে নাড়া দিয়েছিল৷ বাবার ফোনে ঘরে ফিরেছিলাম৷
ঘরে ফিরতেই আমার মন খারাপগুলো গায়েব হয়ে গিয়েছিল একদম৷ বিরিয়ানীর সুগন্ধ ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ আমি ছোট ভাইয়ের রুমের দিকে উখি মারি৷ নিধি মেয়েটা খুব যত্ন করে নিজের হাতে বিরিয়ানী খাওয়াচ্ছিলো ছোটভাইকে৷ আমার চোখটা ভিজে উঠে হুট করে৷ নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় আমার৷ ছোট বোনটা মাঝে মাঝে চুড়ির আবদার করে৷ নিধির সামনে করেনা কখনো৷ সবসময় লুকিয়ে কিংবা কানে ফিসফিস করে বলে, ভাইয়া আমার জন্য চুড়ি আনবা কেমন?” জবাবে আমি মাথা নাড়ায়৷ পকেটে টাকা থাকলে আনি মাঝে মাঝে৷ নয়তো ভুলে যাওয়ার ভান ধরি৷” একবার ছোটবোনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাবীর সামনে বলিস না কেন? ভয় লাগে?” ছোট বোন মুচকি হেসে বলেছিল, য়ুহু৷ ভাবীর সামনে বললে নিজে না খেয়ে চুড়ি কিনে বসে থাকবেন উনি৷”
আমি দু’একটা টিউশনের টাকা দিয়ে সংসার চলবে ভাবাটা বরাবরই বোকামী৷ আব্বা-আম্মার ঔষধগুলা ঠিকমতো কেনা হয়না অনেকদিন৷ সেদিন মাঝরাতে আব্বার কাঁশির শব্দে ঘুম ভাঙে আমাদের৷ নিধি গম্ভীর গলায় বলেছিল, আব্বা-আম্মার ঔষধগুলো কিনে দিও শুধু৷ বাকিটা আমি দেখবো৷” পাশের বাসার পিচ্চিগুলোকে নিধির সামনে এনে যখন বলি, আমাদেরও একটা বাচ্চা দরকার৷” জবাবে নিধি মুখ শক্ত করে বলে, খাওয়াতে পারবে বাচ্চাকে?” আমি প্রতুত্যর দিতে পারিনা৷ চুপষে যাই মুহূর্তেই৷”
সপ্তাহখানেক ধরে ঘুম ভাঙতেই নিধির চেহারাটা দেখা হয় না৷ আমি জিজ্ঞেস করি৷ জবাব পাইনা কখনো৷ ছোটবোনের কাছে জিজ্ঞেস করতেই বলল, বাচ্চা পড়ানো শুরু করেছে৷” আমার খুব ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে বারণ করি৷ পরক্ষণেই আমার পকেটের কথা মনে পরে৷ ছোট ভাইয়ের পছন্দের বিরিয়ানী কিংবা ছোটবোন কে চুড়ি কিনে দিতে না পারার বেদনাটা ছুঁয়ে যায় আমার ভেতরে৷ আমার আর বারণ করা হয়ে উঠে না৷ মনে মনে বলি, চলুক না৷ তারপর নীল আকাশটা দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে হেঁটে চলি নতুন গন্তব্যে৷”
আব্বা-আম্মাকে নিধি নিজ হাতে ঔষধ খাইয়ে দেয়৷ আমি পাশে বসে দেখি৷ অদ্ভূত ভালোলাগা কাজ করে আমার ভেতরে৷ সেদিন পত্রিকা পড়ার ফাঁকে চশমাটা নাকের ডগায় এনে আব্বা বলল, আমি ভুল ছিলাম৷ মেয়েটা অন্য ধাতুতে গড়া বুঝলি৷” আমার ভালোলাগে খুব৷ নিধির সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিল হুট করে৷ নিধির সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল দুই বছরের৷ আমার খুব ইচ্ছে হতো হাতটা ধরে বলি, তুই আমার হবি? একদম আমার?” আমার ইচ্ছেগুলো আর পূর্ণতা পায় না৷ বাস্তবতার জালে বরাবরের মতোই আটকা পরে থাকে৷ তারপরও নিধি আমারই ছিল৷
তারপর শীতের একটা সকাল৷ নিধির ফোনকলে আমার হুড়োহুড়ি করে ঘুম থেকে উঠা৷ বাবার শালটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পরা৷ সবকিছুই যেন ভোরের স্বপ্নের মতো ছিল সেদিন৷ নিধির গায়ে ছিল সবুজ একটা শাল৷ মাথায় শীতের টুপি৷ তারমাঝে ছোট্টমুখটার মায়ায় আমি টুপ করে নিজেকে হারিয়ে ফেলি৷ নিধি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে আমাকে বলেছিল, আমাকে বিয়ে করবি?” আমার ভেতরে হিমশীতল শীহরণ বয়ে যায় কথাটা শোনামাত্রই৷ আমি নির্বাক ছিলাম৷ শুধু ঠান্ডা দৃষ্টিতে নিধির দিকে তাকিয়েছিলাম৷ সময়ের হিসাবে কতক্ষণ তা আমার জানা নেই৷ বিয়েটা সেদিনই করে ফেলেছিলাম৷ ৪হাজার টাকা বেতনের চাকরী করি আমি তখন৷ লেখাপড়া শেষ হয়নি৷
নিধিকে নিয়ে যেদিন ঘরে ঢুকলাম৷ আব্বার আশেপাশে ঘেষিনি আমি৷ আম্মাকে দেখলাম নিধির সাথে মিশে গিয়েছে৷ ছোট ভাই-বোনগুলোর দিকে তাকাতে পারিনি৷ শেষরাতে আব্বার রুমে ডাক পরে আমার৷ আমি চুপচাপ সামনে গিয়ে বসি৷ আব্বার রাগী গলা শোনার অপেক্ষায় আমি৷ আমাকে অবাক করে দিয়ে কাঁধে হাত রাখে আব্বা৷ আব্বা ঠান্ডা গলায় বলেছিল, বড় ঘরের মেয়ে৷ রাখতে পারবি তো? মানাতে পারবে আমাদের সাথে?” জবাবে আমি কিছু বলিনা৷ জবাব না পেয়ে আব্বা আর কিছু বলেনি৷” সেই বড় ঘরের মেয়েটাই কি অদ্ভূতভাবে মিশে গেল পরিবারের প্রত্যেকটা প্রাণের সাথে৷ আমি ভাবি মাঝে মাঝে৷ বিন্দু বিন্দু রাগগুলোর ভেতরে ভালোবাসার একটা শীতল সমুদ্র নিয়ে বেঁচে আছে মেয়েটা৷ রাগের পর ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার মাঝে একটা অানন্দ আছে৷ একটা প্রশান্তি থাকে৷ আমি জানি নিধি সেটা খুব উপভোগ করে৷”
পরিশিষ্ট:রাতটা গভীর হয়েছে৷ চাঁদের আলোটা আরো ধবধবে৷ নিধি মেয়েটা আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে৷ মায়ামায়া মুখটায় তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ৷ কবি হলে নিশ্চিত কবিতা লিখে ফেলতাম৷ তারপর নিধিকে শোনানোর আবদার করতাম৷ মেয়েটা প্রথমে বলতো,ন্যাকামো সহ্য হয় না আমার!” তারপর মিনিট দশেক পর আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলতো, এই কবিতাটা শোনাও তো৷ না শুনলে আমার আবার ঘুম হবে না৷ তারপর একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমি কবিতা শোনাতাম৷” আমি গালগুলো আলতো করে টেনে দিতেই নিধির চোখ দু’টো টুপ করে মেলে যায়৷ নাকটা হালকা ফুলিয়ে বলল,
-পুরনো অভ্যাস গেল না?
-প্রতিদিনই নতুন লাগে আমার৷
-ন্যাকামো ভালো লাগে না আমার৷
আচ্ছা বলে মুখ ফেরাই আমি৷ পরক্ষণেই আমার হাত দু’টো গালে চেপে ধরে নিধি৷ আমার নাকটা টিপে দিয়ে বলল, নাও টানো৷
-কেন করছো এসব?” আমি জিজ্ঞেস করি৷
-কোন সব?
-এই যে, নিজের ত্যাগ করে ছোট বোন কিংবা ছোট ভাইয়ের আবদার মেটানো৷ আব্বার চশমা অথবা আম্মার নতুন শাড়ি৷ এসবতো আমার দায়িত্ব৷ নিজেকে খুব ছোট মনে হয় মাঝে মাঝে আমার৷”
-কে বলেছে আমি করেছি? সবতো তোমারই৷ মনে আছে আমায় দেয়া হাতখরচের টাকাগুলোর কথা?
-হু৷
-আমারতো আরেকটা স্বামী নেই,
ননদ নেই,দেবর নেই,শ্বশুর-শ্বাশুড়ী নেই যে তাদের পেছনে খরচ করবো৷ সব তোমার টাকা দিয়েই হচ্ছে বুঝলে৷ আর আমিতো শুধু “অর্ধাঙ্গিনী”শব্দটার স্বার্থকতা বজায় রেখে চলছি৷”
আমি নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখি৷ বাইরের জোৎস্নার মতো আমার মনের আকাশেও ধবধবে জোৎস্না বিরাজ করে৷ ভালো থাকুক “অর্ধাঙ্গিনীরা”৷ স্বার্থক করুক শব্দটাকে৷