শাহেদ!!! আমার মুখটা লিটারেলি হা হয়ে গেছে,এইটা কি দেখলাম!! ইরিন আপু শাহেদ ভাইয়াকে চড় মেরেছে!!! ইরিন আপু?? আমি তৃতীয়বারের মত চোখ কচলালাম। এইমাত্র যা দেখলাম তা সত্যি তো !
ইরিন আপু আর শাহেদ ভাইয়ার রিলেশনটা হচ্ছে দ্য মোস্ট সুইট কিউট কাপল অন আর্থ টাইপ।আজ পর্যন্ত ওদের মধ্যে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়েছে, এমনটা কেউ দেখেছে বা শুনেছে বলে জোড় গলায় দাবি করতে পারবে না! বলতে গেলে পুরো পাড়ায় সবচেয়ে আদর্শ কাপল বলে রীতিমত ঈর্ষণীয় জায়গা দখল করে রেখেছেন ইনারা। শুধুমাত্র “তুমি শাহেদ বা ইরিনের ধারে কাছেও নেই” এই এক লাইন যে কত ব্রেকাপ ঘটিয়েছে আজ পর্যন্ত তার হিসাব নেই। সেই ইরিন আপু আজ চড় মেরেছে শাহেদ ভাইয়াকে!!!
আমি উল্টো ঘুরে দৌড় লাগালাম। এই ঘটনা পাঁচকান হওয়ার আগেই ফয়সাল ভাইয়ার কাছে পৌঁছাতে হবে! খুঁজতে খুঁজতে যখন প্রায় অজ্ঞান হওয়ার যোগাড় ঠিক তখনই আমি ফয়সাল ভাইয়াকে দেখতে পেলাম।রিকশা থেকে হেলতে দুলতে নামছেন।হাতে একগাদা শপিং ব্যাগ। এগুলো নিশ্চয়ই পুঁচকিটার জন্য। আমি নিশ্চিত ভাইয়া আজ পুরো বাজার উঠিয়ে এনেছেন। সবসময় বেহিসাবি খরচ। আজকে নেহা আপুর ঝাড়ুর একটা বারিও মাটিতে পড়বে না।বেচারা ফয়সাল ভাই ! আমি মাথাটা একটা ঝাঁকি দিলাম।আপাতত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ইরিন আপু আর শাহেদ ভাইয়া।
-ফয়সাল ভাইয়া, ইরিন আপু শাহেদ ভাইয়াকে চড় মেরেছে!
হাফাতে হাফাতে কথাগুলো বলতেই ফয়সাল ভাইয়া বাই করে ঘুরলেন আমার দিকে। আমার চোখ গেল নিচের দিকে। শপিং ব্যাগগুলো সব রাস্তায় পড়ে আছে। আর ফয়সাল ভাইয়া আমাকে এমনভাবে দেখছেন যেন আমি মারা গেছি, আর আমার ভুত উনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লা হাওলা কুওয়াতা। রেডি থাক টগর ,নইলে শপিং ব্যাগগুলার জায়গায় তুই মাটিতে গড়াগড়ি খাবি! কয়েক সেকেন্ড পরে যখন চোখ খুললাম,দেখি আমার সামনে কেউ নাই! ফয়সাল ভাইয়া গেলো কই!! অল্পের উপ্রে বেচে গেছিসরে টগর বাবাজী !
বাসায় এসে দেখি তুলকালাম অবস্থা। মা অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তাকে সোফায় শুইয়ে বাতাস করছেন আমাদের বাসার বুয়া আসমা খালা। সেই সাথে চলছে তার বুক চাপড়ে আহাজারি করা (এই ব্যাপারে ইনি রীতিমত সিদ্ধহস্ত)। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না কি বলছেন। একটু মনোযোগ দিতেই শুনতে পেলাম খালা বলছেন, ‘ও আল্লা গো,এইডা কি অইলো গো। আফামনি এইডা কি করলো গো। অহন শাহেদ বাইয়ের কি অইবো গো। হেতে না জানি কুনু আছে গো। হেতের না জানি কয়ডা আড্ডি বাংসে গো। সিরিয়াসলি ম্যান !!! আমি ফয়সাল ভাইয়াকে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও না পেয়ে শেষমেশ ছাদে গিয়ে দেখি ভাইয়া একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে আর ছাদের এমাথা থেকে ওমাথা চষে বেড়াচ্ছে। আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে ফয়সাল ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম।
-এখন কি হবে ভাইয়া? ফয়সাল ভাইয়া রক্তচক্ষু করে বললেন,
– আমি কি জানি না কি রে হারামজাদা? লাই দিয়া দিয়া সবাই দুইটারে মাথায় তুলছে। এখন ঠেলা সামলাও…..
বকবক করতে করতে ফয়সাল ভাইয়া নিচে নেমে গেলেন। এখন নির্ঘাৎ মিটিং বসবে। যাই, দেখে আসি কি অবস্থা হয়। নিচে নেমে দেখি শাহেদ ভাইয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। আর ইরিন আপু তার পাশে বসে ফোঁপাচ্ছে। ঘটনা তাহলে অনেক সিরিয়াস ! আমি গিয়ে চুপচাপ মায়ের পাশে বসলাম। ইতিমধ্যে তার জ্ঞান ফিরেছে এবং বর্তমানে তিনি গম্ভীর মুখে লেবুর শরবত খাচ্ছেন। আর আসমা বুয়া যথারীতি তাকে বাতাস করছে। সে যে চুপচাপ বসে আছে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।ফয়সাল ভাইয়াই সবার প্রথমে মুখ খুললেন,
– টগর যা দেখেছে তা সত্যি? দেখলাম, কথাটা শুনেই শাহেদ ভাইয়ার মুখ আরো নিচু হয়ে গেল। এবার বাবা হুংকার দিয়ে উঠলেন,
-ফয়সাল কি বলল কানে যায় নি?ঘটনা সত্যি কি না? শাহেদ ভাইয়া মিনমিন করে বলল,
-জ্বী, বাবা।আসলে ফয়সাল ভাইয়া হঠাৎ করেই শান্ত অথচ কঠিন সুরে বললেন,
-যা হয়েছে ঠিক করে বলো। আমরা চাই না কোন অকারণ ঝামেলা বাধুক। তোমাদের দুইদিন পরে বিয়ে হতে যাচ্ছে। তাই, যা বলার স্পষ্ট করে বলো। এবার ইরিন আপু মুখ খুলল,
– আংকেল, শাহেদ আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না।
ঘরের ভেতরে যেন বজ্রপাত হল। মা আবার সেন্সলেস হয়ে গেলেন। তাকে ধরাধরি করে ভেতরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। এমনিতেই হার্টের রুগী তিনি। এত চাপ নিতে পারেন নি। ডাক্তার ডাকা হল। তিনি এসে ইঞ্জেকশন আর ওষুধ দিয়ে গেলেন। সাথে এটাও বলে গেলেন, মাকে যাতে কোন প্রকার টেনশন না দেয়া হয়। নইলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমি খুঁজছি শাহেদ ভাইয়াকে। জানা দরকার যে আসলে হচ্ছেটা কি। সারা বাড়ি খুঁজে শেষে তাকে ফয়সাল ভাইয়ার রুমে পেলাম। বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার আওয়াজ পেয়ে ফিরে তাকালো। উঠে বসে বলল,
-বোস টগর। আমি বসলাম।
-আমি জানি,সবাই খুব রেগে আছে। স্বাভাবিক। এটাও জানি যে কথাটা হজম করতে সময় লাগবে সবারই। আমার সময় দিতেও সমস্যা নেই।কিন্তু টগর, আমি ইরিনকে বিয়ে করব না। আমি বললাম,
-কেন ভাইয়া? তোমরা তো কত সুইট কাপল।হঠাৎ করে কি এমন হল যে তুমি এত বড় ডিসিশন নিলে?
– আমি প্রেমে পড়েছি রে টগর।
-হোয়াট!!! আমি আকাশ থেকে থপ করে মাটিতে পড়লাম। এইগুলা কি শুনছি আমি ! শাহেদ ভাইয়া বলল,
-যা শুনলি একদম সত্যি। আমি অন্য আরেকটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি। সে আমার সাথেই পড়ে,খুবই ব্রিলিয়ান্ট আর ইনোসেন্ট। জানিস, তার চোখের দিকে তাকালে আমি হারিয়ে যাই, এত সুন্দর ঘন নীল চোখ তার ! আমি চিৎকার করে বললাম,
-এসব কি বলছ তুমি? ইরিন আপুর কি হবে? এটা তুমি কিভাবে করলে ভাইয়া? শাহেদ ভাইয়া উদাস স্বরে বলল,
-জানি না রে টগর, সত্যিই জানি না। তুই প্লিজ সবাইকে বলে দিস। আমার সাহসে কুলাবে না। আমি এক দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। তারপরের ঘটনাগুলি ঘটলো খুব দ্রুত।
ইরিন আপুকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেয়া হল তার খালার কাছে। শুনেছি আপু সেখানকার একটা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনো শেষ করে এখন দাপটের সাথে শিক্ষকতা করছে। বিয়েশাদি আর করে নি। তাকে কেউ বিয়ের কথা বললেই খেপে যায়। তাই আপাতত তাকে কেউ কিছু বলছে না।তবে চেষ্টা জারি রয়েছে। তবে শুনেছি, তারই এক সিনিয়র কলিগ না কি তাকে পটানোর চেষ্টা করছে। বাঙালি,নাম কবির । আপু সাড়া দিচ্ছে না অবশ্য। কিন্তু সেই লোক হাল ছাড়ে নি। ভদ্রলোক না কি আপুর খালাকেও হাত করে ফেলেছে। আমরা অপেক্ষা করছি, দেখা যাক।
শাহেদ ভাইয়া সেই মেয়েটাকে পটাতে পারে নি। মেয়েটার আগে থেকেই রিলেশন ছিল। সে তাকেই বিয়ে করেছে। শাহেদ ভাইয়া পরে ইরিন আপুর কাছে মাফ চেয়ে তার জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছিলো । তবে ইরিন আপু মানা করে দিয়েছে। ভাইয়া এখন একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করছে। সেও বিয়ে করবে না বলে ডিসিশন নিয়েছে। নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত সে ।প্রায়ই আমাকে বলে,
-টগর রে, আমার মত ভুল করিস না । যে ভালবাসে তাকে যেতে দিস না। পস্তাবি।সারাজীবন ধরেই পস্তাতে হবে। লাইফ পুরাই হেল হয়ে যাবে। আমি কিছু বলি না। চুপচাপ শুনি আর মনে মনেই হাসি।