পাগল

পাগল

আজ সতেরো দিন ধরে শানুদের বাড়ির আশেপাশে পাগলের বেশে ঘুরাঘুরি করছি। কিন্তু সতেরো দিনের ভিতর শানু’কে আমি এক নজর দেখতে পাইনি। পাগলের বেশ আমি ইচ্ছে করে ধরিনি। আমার বড় বড় চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ দেখে ছোট্ট ছেলে মেয়ের দল পাগল বলে পিছু নিয়েছিল। তখন ভেবে দেখলাম পাগলের বেশে থাকা মন্দ নয়। এতে করে মানুষ সন্দেহ পোষণ করবে না। নয়তো একটি এলাকায় অপরিচিত যুবকের ঘুরাঘুরি কেউ সহজভাবে নিবে না। সারাদিন ঘুরে ফিরে রাত হলে প্রাইমারী স্কুলের বারান্দায় থাকি। এখানে এক কোণে খড়কুটা রেখে দিয়েছি। রাত হলে বারান্দায় খড়কুটা তুলে বড় টেলিভিশনের প্যাকেট বিছিয়ে শোয়ে পড়ি চাদর জড়িয়ে। শীতকাল হলে আমাকে বড্ড কষ্ট পেতে হতো।

এখনও কষ্ট হয়, তবুও শানুকে এক নজর দেখার জন্য এতটুকু কষ্ট আমাকে সইতে হবে। একটু কথা বলতে পারলে এই কষ্ট আর আমার কাছে কষ্ট মনে হবে না। কিন্তু এই সতেরো দিনের ভিতর শানু শ্বশুর বাড়ি থেকে একবারও আসেনি। যদি আসত তাহলে অবশ্যই আমার নজরে পড়ত। কারণ আমি দিনে একবার দুইবার ভূঁইয়া বাড়িতে ঠিকই যাতায়াত করি। কখনো তাদের বাড়ি থেকে পানি খাই। পানি চাইলে কখনো শানুর মা গ্লাস দিয়ে পানি দেয়। কখনো শানুর ছোট ভাইটা পুরো জগ এনে দিয়ে বলে, এই নেন। যত খুশি খান, খেয়ে বিদায় হোন। রাতে বাঁশি ফুঁকতে ফুঁকতে আসে গফুর মিয়া। তিনি এই এলাকার প্রবেশ পথ পাহাড়া দেন। আর চারিদিক একটু নীরব হলে আমার সাথে এসে বসেন। গল্প করার ছলে বলেন, এই গ্রামে চোর ডাকাত আসবে না। শুধু শুধু পাহাড়া দেয়া। আমার কী? আমার তো বেতন ঠিকই আসবে।

গফুর মিয়াও আমাকে পাগল বলেই জানে। তবে তার ধারণা আমি পুরো পাগল হইনি। আমি পাগলের বেশ ধরে আছি বড় ধরনের অপরাধ করার জন্য। মধ্য রাতে আমার পাশে বসে থেকে তিনি মনে করেন, এই রাস্তা পাহাড়া দেয়ার চেয়ে আমাকে পাহাড়া দেয়া ঢেঢ় ভালো। শেষ রাতে আমার চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করে। সকালে বাচ্চাদের কিচির মিচিরে ঘুম ভাঙ্গে। এই পাগল উঠ, এই পাগল উঠ শুনতে শুনতেও বহুবার খড় কুটার বিছানা গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়েছি। আর অপেক্ষার প্রহর, শানু কোনদিন আসবে?

শানু আমাকে দেখলে চিনবে না। আমিও শানুকে দেখলে চিনার কথা নয়। কারণ আজও কেউ কাউকে দেখিনি। ফোনেই কথা হয়েছে আড়াই বছর। চিনব না বলেই তো তাদের বাড়ি দিনে দুয়েকবার ঘুরে আসি। এই বাড়িতে তো আর মেয়ে নেই। শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি আসলে আমি দেখেই চিনতে পারব যে এটাই শানু। আর আমাকে যদি শানু আগে দেখত, তবুও এখন আর চিনার কথা নয়। পাগলের বেশে নিজেই নিজেকে চিনি না। সেদিন এক বাচ্চা ছেলে ভাঙ্গা আয়নার টুকরো দিয়ে রোদে খেলা করছিল। রোদ থেকে আয়না ধরলে ছায়ায় আয়না থেকে রোদের আলো যায়। সেই আয়নায় পাগল বেশ দেখার সুযোগ হয়েছিল। না, এটা কিছুতেই শাওন হতে পারে না। এ যে এক বড্ড পাগল।

বছর তিনেক আগের কথা। শুক্রবার জুমআর নামাজ থেকে এসে খেয়েই ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু ঘুম তো শোয়ার সাথে সাথেই চলে আসে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে চোখ দুটো মাত্র লেগেছিল। আঁধা ঘুম যাকে বলে। কাঁপুনি দিয়ে মোবাইলের রিংটোন বাজতে লাগল। চোখ বন্ধ রেখেই মোবাইল হাতড়ে রিসিভ করে কানে নিয়ে হ্যালো বললাম। ওপাশ থেকে মেয়ে কন্ঠে বলছে,

-সানজিদা, তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস? তাড়াতাড়ি আয়, ছবি শুরু হয়ে গেছে। সালমানশাহ’র স্বপ্নের ঠিকানা ছবি, তাড়াতাড়ি আয়।

ফোন নামিয়ে রেখে চোখ না খুলেই ভাবছি, মেনে নিলাম রং নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। তাই বলে হ্যালো বলার পরও আমাকে সানজিদা মনে হবে? আমার কন্ঠ কি মেয়েদের মতো হয়ে গেল নাকি? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি। আবার ফোনের রিংটোনে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন খুব খারাপ লাগছিল। ঘুমের অপূর্ণতায় মাথার একপাশে ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। রিসিভ করে কানে দিতেই আগের মেয়েটি আবারো বলছে, ঐ তুই এখনো উঠিসনি? পরে আবার বলবি তোকে জানাইনি। তাড়াতাড়ি আয়, ছবি শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে ধমক দিয়ে আমি বললাম, এই ছেরি, মানুষের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে মজা নেও? আর একবার যদি ফোন আসে, খবর আছে বলে দিলাম।

এবার ফোন রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করেও বিফল। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর সহজে আসতে চায় না। একবার কোচিংয়ের স্যারকে ফোন দিয়েছিলাম সকাল বেলা। তিনি ঘুমে ছিলেন। আমার ফোন পেয়ে যে মোটেও খুশি হয়নি তা উনার গলার স্বরে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। পড়তে গিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে বললাম, স্যার আপনার কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আমি দুঃখিত। তিনি সেদিন সহজ ভঙ্গিতে বললেন, ঘুম কখনো কাঁচা বা পাকা হয় না। যতি হতো, তাহলে তুমি যে ঘুম ভেঙ্গে দিয়েছো সে ঘুমটি বড্ড পাকা ছিল। আমি হাসতেও পারছিলাম না, হাসি থামাতেও পারছিলাম না। সেই কথাটি মনে পড়াতে আমার কাঁচা ঘুম নষ্ট হওয়ার যে রাগ ছিল, সেটা একটু কমে গেল।

সন্ধার পর সেই নাম্বার থেকে আবারো ফোন এল। বন্ধু বান্ধব যারা প্রেমের চুরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে তাদের ধারণা সব মেয়েরাই মিসকল দেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে মোবাইল ব্যবহার করে। কিন্তু এই মেয়েটি এখন নিয়ে তিনবারই মিসকল না দিয়ে কল করেছে। আমি রিসিভ করে হ্যালো বলার পরও ওপাশ নীরব। মনে হচ্ছে নীরবতা কোনো ভাষা। কিন্তু সে ভাষা আমি বুঝতে পারছি না। হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠল,”ভুল মানুষেরই হয়, গরু ছাগলের হয় না। আমি না হয় ভুল করে আপনাকে ফোন দিয়েছি।

আর দুনিয়া জুড়েই ভুলে একে অন্যকে ফোন দিয়ে ফেলে। তাই বলে আপনি আমাকে ছেরি বলে গালি দিবেন?” আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। তখন রাগের মাথায় কী বলেছিলাম মনে পড়ছে না। তবুও মেয়েটিকে নরম কন্ঠে বললাম, আসলে ছেরি শব্দটা গালি নয়। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় মেয়েদের ছেরি বলে। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠায় রাগের বশে আঞ্চলিকতা চলে এসেছে, আপনি কিছু মনে করবেন না।

-বাহ, আপনি কথা বলছেন এভাবে? কিন্তু আপনার আগের রাগী গলা আরো বেশি ভালো ছিল।

আমি ঠিক বুঝলাম না, আমার প্রশংসা করল নাকি সুযোগে প্রতিশোধ নিল। আমি আরেকটু সহজ হবার জন্য বললাম, আমার কন্ঠ কি আপনার বান্ধবী সানজিদার মতো? এই কথা শুনে মেয়েটি আপন মনে হেসে যাচ্ছে। প্রাণখোলা হাসি যাকে বলে। যেন কোনোদিন দুঃখ স্পর্শ করেনি তাকে। ভুবন ভোলানো হাসি। কার কাছে যেন হাসি নিয়ে ছোট্ট একটি বাক্য শুনেছিলাম। ‘মেয়েটি যেন হেসে কুটিকুটি’। এই হাসির ক্ষেত্রে বাক্যটি একদম মানানসই। মনে এক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিল, আমি যদি এই হাসি সারাজীবন শুনতে পেতাম।

আমি বললাম, আমি আপনাকে হাসির রাণী ডাকতে পারি? হঠাৎ হাসি বন্ধ হয়ে গেল। বড্ড ভুল হলো মনে হচ্ছে। হাসি শুনছিলাম সেই ভালো ছিল। মেয়েটি জবাব দিল, আমার নাম শাহনাজ। শানু বলে ডাকে সবাই। হাসির রাণী ডাকতে হবে না। আর ডাকার অজুহাতে বারবার ফোন যেন না আসে। সে যে আমাকে ফোন দিতে বারণ করছে তার কন্ঠে তা বুঝা যায়নি। মনে হচ্ছে দরজা খুলে দিয়ে কেউ বলছে, ঘরে আসার দরকার কী?

সেই যে কথা বলার শুরু। মাস পেরিয়ে বছর যায়। কথার ফুলঝুরিতে কাটে দিন পেরিয়ে একেকটা বড় বড় রাত। বালিশের নিচে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলা। আমি জানতাম আমি শানুর হাসির প্রেমে পড়েছি। ভাবলাম, বলার দরকার কী? একভাবে তো কেটে যাচ্ছে দিনগুলো আনন্দে। সে না হয় বুঝে নিবে আমার মনের অব্যক্ত ভাষা। আমি ওকে এক সময় খুব করে দেখতে চাইতাম। সে বলল, যদি দেখতে হয় এসে দেখে নিও। তাকে আর দেখা হয় না। মনের ক্যানভাসে কল্পনার তুলিতে তার একেকটা ছবি এঁকেছি দীর্ঘ সময় নিয়ে। আমি দুইটা কৌতূকের বই কিনেছিলাম। তাকে কৌতূক শোনানোর জন্য। শানু শুনত আর হেসে কুটি কুটি হতো। মনে হতো অনন্ত কাল যদি শানু এভাবে হাসতেই থাকত, আর আমি কান দুটোকে খাড়া করে রাখতাম ভুবন ভোলানো হাসি শোনার জন্য।

বছর দুই কেটে যাবার পর শানুর একদিন খুব মন খারাপ হলো। আমি কিছুতেই তার মন খারাপের কারণ বের করতে পারছিলাম না। তখন সে বললো, “তোমার সাথে হয়তো আমার আর কথা বলা হবে না। আমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। যদি বিয়ে হয়ে যায়, স্বামীর সংসারে গিয়ে আর কথা বলা হবে না। আমার অনেকগুলো দিন ভালো কেটেছে তোমার জন্য। আমি ভুলতে পারব না স্মৃতিগুলো।”

আমার বড্ড রাগ হলো। যাকে না দেখেই মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছি। যার হাসি শোনার জন্য আকুল হয়ে থাকি। তার বিয়ে হয়ে যাবে অন্য জায়গায়? এ হতে পারে না। দরকার হয় বাবা মায়ের পায়ে ধরব, তবুও শানুর অন্য কোথাও বিয়ে হতে দেব না। রেগেমেগে বললাম, তোমাকে কবে দেখতে আসবে? সে বলল সামনের মাসের চার তারিখ। আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, সে তো অনেক দেরি। তার আগেই আমি আমার বাবা মা’কে তোমাদের বাড়ি পাঠাব। ঠিকানা বলো আমি লিখছি এখনই। শানু মনে হয় আমার এই কথাটি শোনার অপেক্ষায় ছিল।

বাবা মা’কে রাজী করতে হয়েছে দুলাভাইকে দিয়ে। দুলাভাই কিছু বললে বাবা মা ফেলতে পারে না। যেদিন শানুকে দেখতে যাব তার আগেরদিন শানু বলল, আমার একটি কথা রাখবে? জানতে চাইলাম কী কথা? সে বলল, এতদিন আমরা দু’জন দু’জনকে না দেখে থেকেছি। আমরা বিয়ের আগে কেউ কাউকে দেখব না। তোমার আসার দরকার নেই। তোমার পরিবারের যদি পছন্দ হয় আমাকে, তখন তারা গিয়েই বলবে তোমার কাছে। এটা আমার ইচ্ছে। তুমি যদি মনে করো আমাকে না দেখে বিয়ে করবে না। দেখার পর পছন্দ হলে বিয়ে করবে তবে তুমি আসো। আমি বললাম, পাগলি আমি না দেখে তোমাকে ভালোবেসেছি। না দেখেই বিয়ে করতে রাজী আছি। শানু জানতে চাইলো, যদি তোমার বাবা মা আমাকে পছন্দ না করেন। যদি আমার আর তোমার বিয়ে না হয়?

আমি বলেছি, তবে আমি পাগল হবো। তোমার বাড়ির রাস্তার ধূলায় মাখাব নিজেকে। তখন অট্টহাসি দিয়ে জানতে চেয়েছে, তুমি পাগল হলেই আমি দেখব? আমি বলেছিলাম, আমি তোমার জন্য পাগল হলে তোমাকে দেখতেই হবে। যে পর্যন্ত না দেখবে সে পর্যন্ত পথে পথে ঘুরব। তোমাকে দেখতেই হবে আমি তোমার জন্য পাগল হয়েছি। শানুদের বাড়ি পাশের জেলায়, ঘন্টা তিনেকের পথ। বাবা মা আর দুলাভাই সকাল সকাল গেলেন শানুকে দেখতে। বিকাল হবার আগেই শানু আমাকে ফোন দিয়ে সে কি কান্না। কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে কান্নার জন্য। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। শানু বলল, তুমি আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবে না।

আমি তার কথার কারণ বুঝে উঠার আগেই কেউ শানুর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল। আমি বারবার ফোন দিয়েও বন্ধ পেলাম। কিছুক্ষন পর বাবা মা ফিরে এলেন। আমাকে শুধু বললেন, মেয়ে পছন্দ হয়নি। এই বিয়ে হবে না। আমি বারবার জানতে চেয়েছি কেন পছন্দ হয়নি? তারা আমাকে বলেননি। পরদিন দুলাভাই আমাকে ফোন করে বললেন, আমি আর তোমাদের বাড়ি আসব না। কারণ জানতে চাইলে বললেন, পরীর মতো একটি সুন্দর মেয়ে। মেয়ে দেখতে গিয়ে কেউ যৌতুকের কথা বলে? তোমার বাবা চার লাখ টাকা দাবি করেছে। তারা এমন প্রস্তাব শুনেই বিয়ে দিতে অস্বীকার করলেন। ওখানে নিজেকের ছোটলোক প্রমান করার কী দরকার ছিল?

পনেরো দিন আমি শানুর ফোন খোলা পাইনি। বাবা মা’কেও এই বিষয়ে কিছু বলার রুচি হয়নি। কেঁদে কেঁদে কত রাত পার করেছি। একদিন হুট করে শানু ফোন দিল। সেই পরিচিত সেভ করা নাম্বার। আবারো হৃদয় ভাঙ্গা কান্না। সে বলল তার বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের শুক্রবার। আমিও কান্না ধরে রাখতে পারিনি। কেঁদে কেঁদে বলেছি, শানু চলো আমরা পালিয়ে যাই। জবাবে শানু বলল, “শাওন তুমি জানো আমার বাবা নেই। মামা, নানা-নানী যদি আমাদের সহযোগীতা না করতেন আমরা ভালো থাকতাম না।

সেখানে আমি পালিয়ে যাই কিভাবে? তাদের সম্মান নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই। আমাকে ক্ষমা করো। ফোন রেখে দেবার পর চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করতে পারিনি। বাবা মা’কে শুধু বলেছি, শানুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বাবা অপরাধীর ভঙ্গিতে শুধু বলেছিলেন, আমি তো শুধু বলেছিলাম। তারা দিবেনা বললেই পারত। আমি তো যৌতুক ছাড়া বিয়ে করাব না বলিনি। আমি আর কথা বাড়াইনি। রাত হলে কেঁদে বালিশ ভিজানো আর দিন হলে নিজেকে পাথর করে রেখে মুখে মিথ্যে হাসি নিয়ে চলা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না।

শানুর বিয়ের সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় আমাকে যখন অন্য মেয়ে দেখতে বাবা মা জোর করছিলেন, তখন চুল কাটার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি। টিউশনির জমানো সব টাকা নিয়ে নিলাম। কোথায় যাব কোথায় যাব ভাবতে ভাবতেই মনে হলো, শানুকে আমার এই জীবনে একটিবার দেখার খুব ইচ্ছে। সামনে থেকে একটিবার বলার ইচ্ছে, আমি বড্ড ভালোবাসি তোমাকে।

বাচ্চারা ভীর করে ছিল। আমি এক এক করে তাদের নারকেল পাতা দিয়ে ঘড়ি, চশমা বানিয়ে দিচ্ছি। পথের পানে চেয়ে দেখি শানুর ভাইয়ের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। পিছনে একটি মেয়ে তার স্বামীর সাথে আসছে। বিয়ের এতদিন পরও তাহলে শ্বশুর বাড়ি গেলে ছেলেদের মিষ্টি নিয়ে যেতে হয়। আমার বুঝতে বাকি নেই এটাই আমার শানু। নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা নেই তার। বাবার বাড়িতে আসলে মনে হয় বড় করে ঘোমটা দিতে হয় না। বাচ্চারা ধাক্কা দিয়ে বলছে, আমাকে একটা বানিয়ে দেন না। আমি কী আর বানাব? নিজের ঘর বানাতে পারিনি শানুকে নিয়ে বসত করার জন্য। আমার চোখের সামনে দিয়ে স্বামী নিয়ে যাচ্ছে। পাগলেরও যে আজ বুক ফেটে কান্না আসছে। তাকে দেখার ইচ্ছে পূরণ হলো। এবার একটু কথা বলতে পারলেই বিদায় নেব চিরদিনের জন্য।

শানুর সাথে কথা বলেছি এরও চারদিন পর। তার স্বামী চলে যাওয়াতে আমি সেই ভূঁইয়া বাড়িতে যাই পানি খাবার অজুহাতে। শানু খুব সংসারী হয়েছে। বাবার বাড়ি এসেও কেমন উঠান ঝাড়ু দেয়াতে মগ্ন। আমাকে ঢুকতে দেখেই শানু বলে উঠল, এই মা। বাড়িতে পাগল ঢুকে গেছে। শানুর মা এসে আমাকে দেখে শানুকে বললেন, আরে এটা শাওন পাগলা। কারো ক্ষতি করে না। বলেই রান্না ঘরের দিকে গেলেন। শানু তার মায়ের মুখে শাওন নামটি শুনে হাত থেকে ঝাড়ু ফেলে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, শানু আমি তোমাকে দেখাতে এসেছি, আমি তোমার জন্য পাগল হয়েছি। তোমার এলাকার পথের ধূলা গায়ে মেখেছি। শানু মুখ ফিরিয়ে ঘুরে দাড়াল। বললো, শাওন তুমি চলে যাও, আমার বিয়ে হয়েছে। আমার সংসার ভেঙ্গে দিওনা।

শানুর সংসার ভেঙ্গে দেয়ার কোনো অধিকার নেই আমার। শানুদের এলাকার অনেকেই জড়ো হয়েছে। তারা অবাক হয়ে দেখছে পাগলটা সবার কাছ থেকে কত সুন্দর করে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিচ্ছে। তারা কেউ জানেনা এই পাগলটা কেন এসেছিল, কেনই চলে যাচ্ছে। গফুর মিয়া বাজার করে আসার পথে আমাকে চলে যেতে দেখে বললো, আমি এই এলাকা পাহাড়া দেই। তোকেও পাহাড়া দিয়েছি, তাই চুরি ডাকাতি করতে পারিসনি। মুচকি হাসি দিয়ে পথ চলতে আরম্ভ করলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত