ঝিঁঝিদের রাত্রি

ঝিঁঝিদের রাত্রি

“তুমি আমার দাদারবাড়ি যাবে? পাগল হয়েছো?”
“হুমম যাবো। তোমাদের সাথে সাথেই। তোমাদের বাপবেটির সাথে একই বাসে উঠবো। একই সিএনজিতে উঠবো, শুধু অপরিচিতের অভিনয় করে থাকব”
“কেন যাবে শুনি?”
“চিনে আসবো আরকি”

পাগলের প্রলাপ যেমন পথচারীরা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দেয় ঠিক সেভাবে হালকা হাসিসমেত উড়িয়ে দিয়েছিল রুপু। তবে যাত্রার দিন বাস কাউন্টারে বাবার সাথে বসে অপেক্ষমান রুপু হাসনাতকে কাউন্টারে উদয় হতে দেখে বুঝলো, হাসনাত ফাঁপা কথা বলে নি।

বাস থেকে নেমে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল হাসনাত। বহু বছর আগে রুপু পিছু পিছু এই নোয়াখালিতে এলেও রাস্তাঘাট একদম মুখস্ত আছে এখনো তার। সোনাইমুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজিতে সাতারপায়া বাজার ১৫ মিনিটের পথ। সেখানে নেমে আবার নতুন সিএনজিতে কাশিপুর বাজার যাবার পথে মনামিয়ার হাসপাতালের সামনের পুলের গোড়ায় নামতে হয়। নেমে ১৫ মিনিট হাঁটলে রুপুর দাদাবাড়ি। সিএনজিঅলা বসিয়ে রেখেছে। যাত্রী না ভরিয়ে ছাড়বে না। পেছনে সোনাইমুড়ি চৌরাস্তা। কিছুক্ষণ পরপরই হাইওয়েতে চলাচলকারী বাসের আনাগোনা।
বাস থামলেই সিএনজিঅলাদের মাঝে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সবার একটা সাধারণ কথা হচ্ছে,

“কিও? সাতারপায়া যাইবেন্নিও?” যথারীতি হাসনাত বলল,
“হুমম যাবো। কাশিপুর যাওয়ার জন্য আগে সাতারপায়া যেতে হয় না চাচা?”
“হুম, উডেন” সিএনজি ছাড়ার মূহুর্তে আজান পড়লো মাগরিবের। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘের আনাগোনা। লালচে রং বৃষ্টির সামান্য আভাস দিচ্ছে। সিএনজির বেগ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামছে সন্ধ্যা।

যাত্রাপথে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ্য করলো হাসনাত। রাস্তার পাশের গাছগুলোয় একের ওর এক “সুবহাল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ”, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” লেখা ছোট ছোট টিনপ্লেট পেরেক দিয়ে আটকানো। যেন যাত্রীরা চোখ বুলালে তাদের চোখে পড়ে এবং মনে মনে তাদের জিকির করা হয়। চমৎকার বুদ্ধি; নিশ্চয়ই কোন মাদ্রাসার ছাত্রদের কাজ, তবে যে মাদ্রাসারই হোক, ছাত্ররা চৌকস – একথা মানতেই হবে। মাদ্রাসা হাসনাতকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রুপুর কথা মনে করিয়ে দিল। মাদ্রাসার ছাত্রী ছিল সে। রুপুর সঙ্গে পরিচয়ের পর্বটা একবার আওড়ে গেল মনে মনে। সন্ধ্যের আঁধার নেমেছে অনেকখানি। সিএনজির ইঞ্জিনের শব্দ আর বাতাস, অতীত জীবনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোর জন্য এমন একটা সময় কি উপযুক্ত নয়?

“আপনি প্রতিদিন আমাকে ফলো করেন?”
“ন-ন্ন-না তো!”
“আপনার কি ধারণা আমি কচি খুকি? আমি কিছু বুঝি না? মাদ্রাসার মেয়ে হলেও আপনার কলেজের ক্লাসমেট মেয়েগুলোর চেয়ে আমি কোন অংশে কম স্মার্ট নই, বুঝলেন?”

“হুমম, বু-বুঝলাম”
“তোতলামো কি জন্মগত নাকি আমায় দেখে?”
“শিওর না”
“আপনার কলেজ নেই? পড়ালেখা করেন না? নাকি কলেজ ফাঁকি দেন আমাকে দেখার জন্য?”
“ইয়ে…”
“কিয়ে? আচ্ছা বাদ দিন। প্রতিদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করতে গিয়ে তো অনেক চা খান, আমাকে এখন এক কাপ খাওয়ান”

হাসনাত ভ্যাবাচেকা ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। প্রথম আলাপে এমন একটা আচরণ আশা করে নি। “কী হল? টাকা নেই? আচ্ছা আমিই কিনে খাচ্ছি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন” চা খাওয়ার সময়টা কেউ কিছু বললো না। রুপু খুব মনোযোগ দিয়ে চা খেল, যেন কোন রান্নার অনুষ্ঠানের বিচারক মামুলি চা টাও বিচার করে দেখছে। খাওয়া শেষ করে ব্যাগের থেকে পার্স বের করে টাকা দিয়ে দিল। পার্স বন্ধ করে আবার খুলল এমন ভঙ্গিতে যেন কিছু বের করতে ভুলে গেছে। তারপর একটা চিরকুট বের করে হাসনাতকে দিয়ে বললো,

“এটা নিন, অনলি শুক্রবার, রাত দেড়টার পর। আর আজ সাড়ে আটটায়, আন্ডারস্টুড?”
“জ্বি বুঝলাম” মিনমিন করে বললো হাসনাত।

চিরকুটে একটা ফোন নম্বর লেখা গুটি গুটি অথচ মুক্তোর মত হস্তাক্ষরে। সন্ধ্যা ছয়টা বাজতেই হাসনাতে বুকের ধুকুরপুকুর বেড়ে গেল। কখন বাজবে সাড়ে আটটা? ফোনে ১০০ টাকা ভরে রেখেছে সে। রাত নটায় তার টিউশনি আছে। টিউশনি শেষে হাসপাতালে যাবে বাবাকে দেখে আসতে। রাত আটটায় হাসনাতেরই ফোন বেজে উঠল। আর ফোন এল হাসপাতাল থেকে।

“হ্যালো? মিসেস রহমান? হ্যালো?”
“না না, আমি ওনার ছেলে, হাসনাত রহমান। বলুন?”

“আমি হাসপাতালের শর্মিলাদি। চিনেছো? তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো তোমার মাকে নিয়ে। এক্ষুণি” ফোন কেটে গেল। হাসনাতের রাত নয়টায় একটা টিউশনি আছে, তাদের ফোন দিয়ে জানিয়ে দিল আজ পড়াবে না। হাসনাতের বাবা ছিলেন চূড়ান্ত পর্যায়ের সিগারেটখোর। তার রুমের প্রতিটা বস্তু থেকে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যেত। যেমন কর্ম তেমন ফল। ফুসফুস ক্যান্সার হয়ে কোমায় ছিলেন প্রায় এক হপ্তা। তিনি পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। খবরটা ফোনে দিতে চাননি শর্মিলাদি।

সেরাতে ফোন করা হয় নি রুপুকে। মনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাওয়া মাকে সামলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা হাসনাতের মত এই জগতসংসারে অনভিজ্ঞ একটি ছেলের জন্য কষ্টসাধ্যই ছিল বটে। প্রায় পাঁচদিন পর পুনরায় হাসনাত গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মাদ্রাসার গেটের সামনে। রুপুকে দেখে ইশারায় ডেকেছিল। রুপু কোন কথা না বলে সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। ভাঙা কাঁচের মত টুকরো টুকরো হওয়া মন নিয়ে হাইস্কুল রোডের ধারের ছোট্ট পার্কে বেঞ্চিতে গিয়ে বসল হাসনাত। প্রায় তিনঘণ্টা ঠায় বসে থেকে আকাশ পাতাল চিন্তার পর কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকালো। রুপু দাঁড়িয়ে। “হাসনাত। আমি জানতাম না এত কিছু হয়েছে। আমি বুঝতে পারি নি। ক্ষমা করো প্লিজ আমাকে” এই বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো রুপু হাসনাতে স্বল্পপরিসর বক্ষে। রুপুকে সান্ত্বনা দেবে কিসের, তার নিজেরই কান্না পাচ্ছে বাবার চেহারা মনে করে।

ঝড় বয়ে যাওয়া পিতৃহারা একটি ছেলের ভবিষ্যতে উঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম, এটা খুবই অনিশ্চিত। এত অনিশ্চয়তার মাঝেও রুপুর ভালোবাসায় কোন ফাঁকফোকর ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর মিসেস রহমান একটা হাইস্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে ঢোকেন। আর হাসনাতের টিউশনি। দুয়ে মিলে মা ছেলের ছোট্ট সংসারখানি বেশ চলতো। দিনশেষে তিনি বিছানায় শুতেন, আর হাসনাত তখন বেরিয়ে পড়ত তার টিউশনিতে। আর সপ্তাহান্তে শুক্রবার রাতে সারা সপ্তাহের জমানো কথাগুলো রুপুকে বলতো সে। দেখা হত খুব কম। তাই বুভুক্ষুর মত ক্যালেন্ডারের তারিখে লাল কালির আঁচড় দিত হাসনাত, কবে আসবে শুক্রবার?

“নামেন্না ক্যান গো?” ড্রাইভারের কথায় হুঁশ হলো হাসনাতের। সিএনজি সাতারপায়া পৌঁছেছে।
“ভাড়া কত?”
“৩০টাকা”

মানিব্যাগ খুলে টাকাটা দিয়ে নামলো হাসনাত। বাজারটা খুব অচেনা ঠেকলো। প্রায় সাত বছর পর পা দিল এখানে। বাজারের উত্তরে ঢালু হয়ে নেমে কাশিপুর বাজারমুখে এগিয়ে যাওয়া রাস্তাটা দেখেই বুঝলো, ভুল পথে আসে নি সে। ফোন বেজে উঠল, বসের ফোন।

“হ্যালো, স্যার, বলুন”
“আমাদের এ মান্থের টার্গেট ফিলআপের জন্যে যে শিডিউলগুলো সেগুলো আফসার সাহেবকে ফরোয়ার্ড করে দিন”
“জ্বি স্যার। আমি হাফ অ্যান আওয়ারের মধ্যেই দিচ্ছি”
“ওকে”

ফোন পকেটে চালান করে পুনরায় সিএনজি চেপে যখন মনামিয়ার হাসপাতালের সামনের পুলের গোড়ায় নামলো তখন তার সামনে ১৫ মিনিটের পায়ে চলা আঁধারে ঢাকা ঝিল্লিরবপূর্ণ গ্রাম্য পথ বাকি। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট আর আরো কিছু স্মৃতি পথচলায় সঙ্গী হলো তার।

বাবার সাথে বাসে উঠে মাঝামাঝি একটা জায়গায় বসলো রুপু আর তার বাবা। তাদের পিছু পিছু বাসে উঠল হাসনাত। সে তাদের দু’সিট পেছনে সিট পেয়েছে। রুপু মিটিমিটি হাসি লুকোতে পারছে না। তার ভারি মজা লাগছে এমন একটা ঘটনায়। তার প্রেমিক তার বাবার সামনে দিয়ে গেল, আর তিনি জানেনও না। কেমন রোমাঞ্চকর আর মজার একটা ব্যাপার! হাসনাত কিছুক্ষণ পরই কোন না কোন অজুহাতে সামনে যায় আর নিজের সিটে ফেরার পথে আড়চোখে রুপুকে দেখে। কিংবা অন্যদিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে যায়। আর রুপু? সেও আড়চোখে তাকিয়ে হাসি ফিরিয়ে দেয়। ছয়ঘণ্টার জার্নি শেষে পৌঁছেছিল রুপুর দাদাবাড়ি। হাসনাত অবশ্য বাড়িতে যায় নি। দূর থেকে বাপবেটিকে ঢুকতে দেখে চিনে রেখেছিল বাড়িটি।

রুপু আর তার বাবা সেখানে ছিল তিনদিন। তার বাবার জমিজমা নিয়ে পাশের বাড়ির লেকূের সাথে মন কষাকষি। তার মীমাংসার জন্যেই আসা। আর রুপু বাবার সঙ্গী হয়েছিল স্রেফ ঘুরতে। এসময়টা হাসনাত কাশিপুর বাজারে এক হুজুরের বাড়িতে দিনপ্রতি ৩০০ টাকা ভাড়ায় থেকেছিল। তিনটি দিন গ্রাম ঘুরে দেখতেই দেখতেই কেটে গেল তার। বিশেষভাবে সোনাইমুড়িতে দর্শনীয় কোন জায়গা নেই বটে। কিন্তু আরো সময় থাকলে সে নোয়াখালির কেন্দ্র; মাইজদী শহরটা ঘুরে আসতো। গুগল ম্যাপের দৌলতে ঘুরাঘুরি কোন ব্যাপারই না আজকাল।

ফিরে আসার দিন এত সুন্দর একটা গ্রাম ছেড়ে যেতে কষ্টই লাগছিল হাসনাতের। কিন্তু মায়ায় কিছু থেমে থাকে না। রুপুর বাবা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারতেন যে একটা ছেলে তাদের সাথেই ঢাকা থেকে নোয়াখালি এসেছে এবং একসাথেই ফেরত যাচ্ছে। আসলে এরকম একটা ব্যাপার যে হতে পারে তা তার কল্পনাতেই আসে নি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর বাস কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অতিক্রম করলো। যথারীতি হাসনাত তার পাশের যাত্রীর জন্যে বমি করার পলিথিন নিতে কন্ডাক্টরের কাছে যাচ্ছিল সামনে। উদ্দেশ্য-ফিরে আসার সময়ে রুপুকে মিটিমিটি হাসি উপহার দেবে আরেকবার। রুপুর বাবা গুরুগম্ভীর টাইপ মানুষ। মুখের ওপর খবরের কাগজ ধরেছেন তো ধরেই আছেন। তাতে অবশ্য প্রেমিক প্রেমিকার হাসি চালাচালিতে সুবিধাই হয়েছে।

ফিরে আসার সময়ে ভয়ংকর ধাক্কা আর ঝাঁকুনি লাগলো এবং বিকট আওয়াজ, কাঁচ চুরমার হওয়ার শব্দ। তাদের বাসটি একটি ট্রাকের সাথে ওভারটেক করার সময় ধাক্কা লেগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কয়েক পাক গড়িয়ে পাশের জমিতে পড়লো। কাত হয়ে যাওয়া বাসের একপাশের জানালায় মাথা ঠুকে গেল হাসনাতের। তারপর চারপাশ আঁধার। হাসনাত চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল হাসপাতালের শুভ্র বেডে। তার বেডের পাশে টুলে মা আনোয়ারা রহমান বসে। ছেলেকে চোখ মেলতে দেখেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি। আল্লাহ তার একমাত্র সম্বল আর যক্ষের ধন, হাসনাতকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এই অশ্রু আনন্দের। অবারিত আনন্দের আর চিন্তামুক্তির। কিন্তু হাসনাত? তার চিন্তা তো কেউ মুক্ত করে নি। রুপু আর তার বাবার কী হলো?

প্রায় দেড়মাস হাসপাতালে কাটিয়ে ঘনঘোর বর্ষার এক দিনে সে পা রাখলো ঢাকার আগারগাঁওয়ের সেই বাসায়। সময় এগিয়ে যাচ্ছিল তার মতো। যথারীতি হাসনাত টিউশনিতে গেল। আর মিসেস রহমান তার স্কুলে। হাসনাত রুপুর জন্যে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু সে আর আসে নি। রুপু এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে, এ ধরণের কিছু একটা কল্পনা করাও তার জন্য ভয়াবহ একটা ব্যাপার ছিল। রুপু বেঁচে আছে,এরকম একটা স্থির বিশ্বাস নিয়ে সে সময়ের স্রোতে এগোচ্ছিলো। রুপুর দেওয়া ঠিকানায় সে গিয়েছিলো খোঁজ করতে। সেখানে একজন মহিলা বেরিয়ে বললো,

“কে গো রুপু? আমরার তো কুনো মাইয়াই নাই। আমি আমার এক পোলারে নিয়া থাকি”
“আপনারা কবে এসেছেন?”
“তা অবশ্য দুই মাস হয়”
“আপনাদের বাড়িঅলার নম্বর দিন”

নম্বর নিয়ে হাসনাত যোগাযোগ করলো। যদি তিনি আগের ভাড়াটে অর্থাৎ রুপুদের খোঁজ দিতে পারেন। কিন্তু তিনিও পারলেন না কোন সুদুত্তর দিতে। একরাশ হতাশা নিয়ে হাসনাত যখন হাইস্কুল রোডের সেই পার্কে গিয়ে বসেছিল, তার অবচেতন মন খুব করে চাইছিল পেছন থেকে তার কাঁধে একটি হাত রাখা হবে। সে ঘুরে তাকিয়ে রুপুকে দেখে জড়িয়ে নেবে। একে একে সাতটি বছর পেরিয়ে গেল। জীবনের সুখদুঃখ, হাসিকান্না নিয়ে একসময় হাসনাত একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে একটা মোটামুটি বড় পদে চাকরি পেল। মনের কোণে রুপুর গোলাকৃতি ফর্সা মুখটি কিন্তু বেশ আঁকা ছিল।

স্থির বিশ্বাসকে সম্বল করে চারদিনের ছুটি নিয়ে চেপে বসল নোয়াখালিগামী হিমাচল এক্সপ্রেসে। তারপর দীর্ঘ ছয়ঘণ্টার জার্নি শেষে এখন আর মিনিট দুয়েকের পথ বাকি তার। কে গো তুমি বাবা? বৃদ্ধার চেনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু চিনতে পারছেন না। পারার কথাও নয়। “আমায় চিনবেন না, দাদু। আমায় ভেতরে আসতে দেবেন? অনেকটা পথ এসেছি “এসো এসো” গ্রামের মানুষের এদিকটা ভালো। শহরের কেউ হলে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিত। “দাদু, আমি হাসনাত। আমি থাকতাম আগারগাঁওয়ে। রুপুদের বাসার কাছেই একটা বাসায় সব খুলে বলল হাসনাত। কয়েক মূহুর্ত চুপ করে রইলেন বৃদ্ধা। তারপর বললেন,

“শোন বাবা, তুমি রুপুকে ভুলে যাও গো”
“কেন দাদু, কী হয়েছে বলুন?”
“এখন থাক। তুমি আমাদের রুপুর বন্ধুর মত, আমার নাতিই এক হিসেবে। এসেছো; পরিষ্কার হও, খাওয়া দিতে বলি”
“না না দাদু, এখনই বলুন আমায়, আপনার দোহাই লাগে”
“রুপুর তো গলা কেঁপে গেল বৃদ্ধার।

“কী হয়েছে বলুন না!” “শফিক মারা গেছে(রুপুর বাবা) আর রুপুর একটা হাত কেটে বাদ দিতে হয়েছে এবংও পাগল হয়ে গেছে…এক্সিডেন্টের পর” অনেক কষ্টে কথাগুলো টেনে নিল হাসনাত। তার কানে বাজলো একটি কথা, “আপনার কলেজ নেই? পড়ালেখা করেন না? নাকি কলেজ ফাঁকি দেন আমাকে দেখার জন্য?” আর কড়া কড়া করে তাকিয়ে থাকা একজোড়া স্নিগ্ধ চোখ।

“দাদু, ও কোথায় আছে বলুন বৃদ্ধার চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। বললেন, “রুপু নেই গো বাবা। ও প্রায় দু বছর আগে একরাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমরা অনেক খুঁজেছি গো। রুপুর মা তিনদিন পর আত্মহত্যা করেছিল। একটাই মেয়ে ছিল ওদের। আমার মেজো ছেলের পরিবারটাই আল্লাহ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন গো বাবা। রুপু বেঁচে আছে এটা আমরা আর বিশ্বাস করি নাহ” উঠে দাঁড়ালো হাসনাত। বৃদ্ধা সামলে নিয়ে বললো, “আরে বাবা, তুমি বসো। এতদূর এসেছো” কথার জবাব না দিয়ে বেরিয়ে এল হাসনাত। ঝিঁঝিরা তাদের চিরন্তন ডাক ডেকে চলেছে। হাসনাত কিছুটা পথ যেয়ে আর পারলো না। কাঁধের ব্যাগটা ফেলে রাস্তায় শুয়ে পড়লো। না, সে কাঁদছে না। এত শোকে অশ্রুরও ঝরতে কষ্ট হয়। আকাশে অনেক তারার মেলা। তারাদের নিয়ে সে কল্পনায় রুপুর চেহারা আঁকবে অসীম আকাশের বুকে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত