রাত এখন ৩.১২ বাজে।আর আমি আমার বাসার গেটের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবছি।ভাবনার বিষয় অন্যকিছু নাহ।কিভাবে নিজের রুমে যাওয়া যায় সেটাই।রুমে আমি একা থাকলে এতক্ষণে রুমেই থাকতাম।কিন্তু এখন অইখানে রিয়া নামের আরেকজন আছে।যার সাথে চাইলেও আমি আলাদা থাকতে পারিনা।তবুও সকালে উনার বাপের বাড়ি ওরফে আমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়া নিয়ে ঝগড়া করে বেরিয়ে পড়েছি।অফিসেও যাইনি।বাসা থেকে দিনে অনেক ফোন আসছে।
অবশেষে বিরক্ত হয়ে ফোন সুইচ অফ করে রাখি।রাত ১২টার পর পার্কের গেট আমাকে বের করে বন্ধ করে দিয়েছে।কিছুক্ষণের জন্য সিকিউরিটির কালো পোশাককে আমার কাছে র্যাবের মত লাগতেছিলো।নাহলে আজ বাসায় আসার কোন লক্ষণী ছিলোনা।যাই হোক এই সময়ে আশেপাশে কেও নেই তাকিয়ে দেখে নিলাম।বেশিক্ষণ তাকানো লাগেনাই পাশের বাসার তিনতলাতেই একটা চশ্মিস মেয়ে বারান্দায় বসে বই পড়ছে।মেয়েটার নাম তাহমিনা।এইবার ভার্সিটি এডমিশন দিবে।মনে মনে বললাম পড়ো পড়ো,এখন রাত জেগে পড়বা আর ভার্সিটিতে চান্স না পেলে রাত জেগে কাঁদবা।মাঝেমধ্যে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো।সারা শহরে আমিই হয়তো একমাত্র নতুন বিবাহিত পুরুষ এত রাত্রেও ঘরের বাহিরে।আমার রুম দু’তলায়।জানালা দেখা যায় গেট থেকে।আর রুমের দরজা ভিতরে।আমার এখন সর্বপ্রথম কাজ হবে জানালা দিয়ে ভিতরটা দেখা।ভিতরের মানুষটা রাত জাগছে কিনা দেখা লাগবে।
গেটে এতরাতে চ্যাংদোলা হয়ে গেট পার করা আমার ভার্সিটি জীবনের অভ্যাস ছিলো।আজ বিয়ের পর তা আবার শুরু করলাম।যদিও বাসায় ফোন দিলে এসে গেট খুলে দিবে।কিন্তু গেটের আওয়াজে উপরের উনার ঘুম ভাঙ্গলে সমস্যা।অবশেষে গেট অতিক্রম করলাম।পাশের বাড়ির মেয়েটা এখন এক দৃষ্টিতে বইয়ের বদলে আমার দিকে ধ্যান দিচ্ছে।হলিউডের সিনেমার স্পাইডারম্যান এর প্রাকটিস করছিতো তাই।এখন দু’তলার জানালায় উকি দিতে হলে আগে পাইপ বেয়ে উঠতে হবে।আর মাঝেমধ্যে কয়েকটা পেরাক আছে যেটা আমি অনেক আগেই নিজের জন্যেই লাগাইছিলাম। আজ আবারো সেটা কাজে লাগলো।রুমে এখনো মনে হয়না কেও ঘুমাচ্ছে।লাইট অন করা।ধীরে ধীরে উঠে গেলাম।টিভি অফ।উনিও ঘুমোচ্ছে। জানতাম ঘুমাবে।আমার চিন্তা করার টাইম আছে উনার কাছে।
হঠাৎ পাশের বাড়ির মেয়েটা কাব্য ভাই বলে ঢেকে উঠলো।আমি হকচকিয়ে গেলাম আর দেখলাম খাট থেকে কে যেন উঠলো।আমি পড়ে যেতে ছিলাম,হঠাৎ কে যেন হাতটা ধরে ফেলল।আর কেও নাহ।আমার উনিই।কোথেকে যেন বাতাস আসছে।আমার চার ইঞ্চি চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।উনাকে দেখে আমি প্রতিদিনের মতই ক্রাশ খেলাম।আমার চুলগুলো উড়ছে প্রাকৃতিক বাতাসে।আর উনারগুলো টেবিল ফ্যানের বাতাসে।চুলগুলো যেন ভেসে আসতে চাচ্ছে আমার নিকটে।চোখগুলোতে অভিমানের ছাপ,চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছি একে অপরের দিকে।মহান আল্লাহর কি অপরূপ সৃষ্টি সে।চোখগুলো ফুলে লাল।
এমনিতেই কান্না করা উনার অভ্যাস।অল্প ঝাড়িতে সাগর বানিয়ে ফেলে বিছানা।কিন্তু উনার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না আর কিছুক্ষণ পর শাড়ীর আচল দিয়ে চোখ মুছতে দেখার সময় অনেকটা ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায় আমার।ছোটবেলায় প্রতিদিন পটেটো ক্রাকার্স না পেলে দোকান থেকে বাসা পর্যন্ত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কানতে কানতে আসতাম আর হাত দিয়ে চোখ মুছতাম।মাঝেমধ্যে অনেক খারাপ লাগে মেয়েটা একটু কাদলেই।কাদানোর জন্যেতো ওর হাতটা ধরিনি।তবে কেন এমন হয় আমার দ্বারা!!আমি ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম। এতক্ষণ হাত ধরার ব্যাপারটা স্বপ্ন ছিলো।ধপাস করে পরারটা সত্য।
পড়েই পাশের বাসার মেয়েটাকে হাত আর মুখ দিয়ে ইশারা করলাম চুপ থাকতে।বই না পড়ে আমায় কে দেখছে?আগে কখনো দেখেনাই?নিজেকে এই বলে রাগাতে লাগলাম।সিড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম।দরজার সামনে গেলাম। কিছুক্ষণ ওয়েট করলাম লাইট অফ হওয়ার। সময়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ৩.৩০ বাজে। ঘুমে চোখ লাল হয়ে গেছে আমারো।কিন্তু ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে বুলেটের গতিতে।কেন যে বিয়ে করলাম? আজ বিয়ে না করলে পাশের বাড়ির মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে বিয়ের করব কল্পনা করা যেতো।আর এখন যাকেই দেখি বোন বানানো ছাড়া উপায় নেই।অফিসের তিনজন মেয়ে কলিগ রীতিমত আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।কিন্তু কেন তা অজানা।শুধু এইটা জানি যে আমার বিয়ের আগে তিনজনই প্রায়ই ডিনার বা লাঞ্চের অফার দিতো।রেস্টুরেন্ট বিলও নিজেই দিতো।আমি এই ব্যাপারে উদাসীন।অন্যের বউকে বিয়ের আগে নিজের টাকায় রেস্টুরেন্টে ট্রিটের কথা ভাবতেও পারিনা।তাও কষ্টের টাকায়।বাপের টাকা হলে ভাবা যেতো।যাই হোক হঠাৎ দেখলাম দরজার নিচে লাইটের আলো নেই।অস্বাভাবিক ভালো লাগছে লাইট অফ দেখে।
চারটার সময় দরজার তালা খোলার জন্যে চাবি ডুকালাম।কিন্তু খুলছেনা।অথচো তালা ঠিকই ঘুড়ছে।ব্যাপারটা বুঝছিনা। লক খুলে অথচো দরজা খুলেনা।অবশেষে নিঃশ্বাস বন্ধ করার মত অবস্থা করে দরজায় হেলান দিয়ে থাকলাম।চোখ বুঝে ঘুমোতে চাইলাম।এমনিতেই দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে।কোমর ভেঙ্গে গেছে বোধহয়।আচমকা দরজা হঠাৎ করে খুলে গেল।আবারো ধপাস করে ঘরের ভিতরে পরে গেলাম।ওমাগো বলে চিৎকার দিলাম।সামনেই দেখি একটা কালো ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।লাইট যেহেতু অফ তাই ছায়াই দেখা যাচ্ছে।আমি এইবার বুঝছি দরজা কেন খুলছিলোনা।আমি বাহির দিয়ে লক খুলি আর উনি ভিতর দিয়ে লক করে। মেয়ে মানুষের মাথায় এত বুদ্ধি যে কোথেকে আসে! আমি কোন কথা না বলেই ওয়াশরুমের দিকে হাটা দিলাম।এখনো ঘর অন্ধকার।আর উনিই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
ওয়াশরুমে যেয়ে প্রথমে হাত মুখ ধুয়ে মাঝাটা কিছুক্ষণ মালিশ করে বের হলাম।বের হয়েই দেখি লাইট অন।টেবিলে ভাত বেরেই রাখছে।কিন্তু উনি প্রতিদিনের মত আজ আর টেবিলে আমার পাশে নেই।খাটে লেপ গায় দিয়ে শুয়ে আছে।আমার ক্ষিধে অনেক তাই কিছু জিজ্ঞেস না করে খাওয়া শুরু করলাম।খাওয়া শেষে ম্যামের একটা পার্সোনাল ডায়রী আছে যেটা প্রতিদিন লিখে।আজকেরটায় কিছু লিখছে কিনা চেক দিলাম। হ্যা লিখেছে।রাত ২টা পর্যন্ত লিখছে যে জমিদার সাহেব নতুন বউ রেখে বাইরে হাওয়া খাচ্ছে, বউয়ের যখন দরকার নাই তখন বউও কথা বলবেনা।অবশ্য পাতাটা ভিজা দেখলাম।ভাজ ভাজ হয়ে আছে।আমিও তখন নিচে লিখে দিলাম জমিদার সাহেব তার বউকে কান ধরে সরি বলছে। শুয়ে পড়লাম বিছানায় উনার পাশেই।লেপটা একটু টান দিলাম শরীরে নেয়ার জন্যে আর উনি চারগুণ জোরে টান দিলেন আমাকে না দেয়ার জন্যে।কি জোর বাপরে বাপ।
অতঃপর শীতের মধ্যে ঝিমিয়ে শুতে হলো।বেশিক্ষণ ঝিমানো লাগেনাই।কিছুক্ষণ পর দেখলাম যে প্রথমে শরীরে লেপ এমনিতেই চলে আসছে, তারপর উনার বা হাত আর অবশেষে পুরো মাথাটাই আমার বুকের উপরে। সারাদিন রাগ অভিমান করলেও দিনশেষে দুইজন এক হয়ে যাওয়াটাই হয়তো ভালোবাসা।ঝগড়াঝাঁটি করব অথচো কেও কাওকে ছাড়া একমিনিটও থাকতে পারবোনা। আমিও আর কোন কথা না বলেই উনার মাথায় হাত দিলাম।আর এমন সময় আমার টি শার্টে ফোটা ফোটা পানি পড়তে লাগলো ম্যামের চোখ থেকে সম্ভবত।