রাগিনী

রাগিনী

আজ সকাল থেকে রশ্মির আম্মু আমার সাথে রাগ কথা বলছে না। মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। কথায় কথায় কেবল রাগ করে। এতো কৈত্থেকে যে আসে তার। আর সেই রাগ ভাঙ্গাতে ভাঙ্গাতে আমার দিনরাত্রি এক হয়ে যায়।
ছোট্ট একটা অজুহাত নিয়ে বাড়াবাড়ি আর সেখান থেকে রাগারাগি। অবশ্য রশ্মির আম্মু আমার সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না। আজ মনে হয় রাগ একটু বেশি তাই এখনো কথা বলছে না। আমিও ঘাপটি মেরে বসে আছি। দেখি কতোক্ষণ আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারে।

লেখকদের আইডিতে মেয়েদের আনাগোনা একটু বেশিই থাকে। মূলত লেখকদের সাথে ভাব জমাতে চাই। আমিও ভদ্রতার খাতিরে তাদের রিফ্রলে করে থাকি। কিন্তু আজ সকালে নাকি কোন মেয়ে আমার ইনবক্সে I LOVE YOU লিখে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। আর এটা রশ্মির আম্মুর চোখে পড়ে। রাগে মুখটা লাল টমেটোর মতো লাল হয়ে আছে। আর আমার উপর তো নিম্ন গতিতে ছোটখাটো একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে। এক্ষেত্রে একটা মেয়ে রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি না।

কারণ একটা মেয়ে কখনো তার ভালোবাসার মানুষটির পাশে অন্য কাউকে পছন্দ করবে না। ফেসবুকের মেয়েরাও আস্ত একটা জলহস্তী। তাদের বুঝা উচিৎ যে বাসায় কারো বউ বাচ্চা থাকতে পারে। রাগ করে সকালে নাস্তাও বানায় নি। মেয়ে চুপিচুপি কয়েকটা বাসি পাউরুটি এনে দিলো আমায়। আপাতত এগুলো দিয়ে কাজ চালাচ্ছি। না জানি কখন তার রাগ ভাঙ্গবে। অবশ্য এই রাগী চেহেরার কারনেই আমি তার প্রেমে পড়ি। আমি তখন বিসিএস করার জন্য চট্টগ্রাম যায়। একটা ব্যাচেলর ফ্লাটে থাকতাম আমি। নিচ তলায় আমি আর তিন তলায় থাকতেন বাড়িওয়ালারা। ব্যাচেলর মানেই টিউশন।

সে সুবাদে কয়েকটা টিউশনি করাতাম। সেখানে সুপ্তি নামে একটা মেয়েকে পড়াতাম আমি। সুপ্তি বাড়িওয়ালার মেয়ে। বাড়ির মালিক আংকেলটি যথেষ্ঠ ভদ্রলোক। খুব সহজে মানুষকে আপন করে নেয়। সুপ্তি নবম শ্রেনীর ছাত্রী। অল্পতেই পেঁকে গেছে। বড্ড ফাযিল মেয়ে। পড়ানোর সময় কেমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মাঝে মাঝে আমার ধমক খেয়ে ঘোর কাটতো তার। আমি নিয়মমাফিক পড়িয়ে চলে আসতাম। আমি পড়ানোর প্রাক্কালে দরজার বাহিরে অথবা বারান্দার আড়ালে মাঝে মাঝে কারো অস্তিত্ব টের পেতাম। তবে আমি সচক্ষে কাউকে দেখতে পাইনি। আমি বের হওয়ার আগেই দৌঁড়ে পালিয়ে যেতো। যদিও আংকেল আন্টির সাথে আমার পরিচয় হয়েছে কিন্তু ওনার ছেলে মেয়েদের সাথে আমার এখনো পরিচয় হয়নি।

সেদিন সুপ্তিকে একটা সেটের অংক করাচ্ছিলাম। সুপ্তি তার একটা পা ইচ্ছে করেই আমার পায়ের উপর তুলে দিলো। যেটা সে প্রায়ই সময় করে। জানালার দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখি ড্যাবড্যাব চোখে কে যেনো তাকিয়ে আছে। ভয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। চোখ দিয়ে যেন আগুনের পুলকি বেরুচ্ছে। সরি বলে সুপ্তি পা টা সরিয়ে নিলো। আমি ইট’স ওকে বলে পড়াতে মন দিলাম। আমি সুপ্তির চোখ দেখে মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। মেয়েটা আমায় কিছু বলতে চাই কিন্তু ভয়, লজ্জা আর সংশয়ে বলতে পারছে না। নিরবতা ভেঙ্গে সুপ্তি বলল:স্যার আপনার কি রিলেশন আছে? এক কথায় উত্তর দিলাম, না। সুপ্তি লজ্জা মাখা মুখে বলল: ভালোবাসবেন আমায়।

হঠাৎ বিদ্যুৎ গতিতে একটা মেয়ে এসে সুপ্তির গালে ঠাশশ করে একটা চড় বসিয়ে দিলো। আর আমার হাতে একটা ঘাম ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সুপ্তির গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। মেয়েদের শরীর নরম হয় জানি কিন্তু এতোটা নরম হয় জানা ছিলো না। গালে হাত দিয়ে কাঁদছে সুপ্তি। আমি ফিক্ করে হেসে দিলাম। অমনি সুপ্তি কপট রাগ দেখিয়ে শুধালো: স্যার আপনি হাসছেন কেনো? ধ্যাত আর পড়বোই না আমি বলে দৌঁড়ে চলে গেলো। আমি হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ম্যাসে এসে খাম খুলতেই দেখি তিনটা এক হাজার টাকার নোট সাথে একটা ছোট্ট একটা চিরকুট। ছোট্ট করে লেখা, বিকালে ছাদে আসবেন।( নীলা) বুঝলাম সুপ্তির বড়বোন দিয়েছে চিরকুট টা।

বিকালে ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি মনে মনে অনেক পুলকিত আবার চাপা ভয়ও কাজ করছে। না জানি কি বলে আজকে। ছাদটা বেশ পরিষ্কার, একপাশে ফুল ও ফলের চারা বেষ্টিত। অন্যপ্রান্তে একটা দোলনা আর চিলেকোঠা। ছাদে এর আগে আসা হয় নি। বাড়িওয়ালা নোটিশ ঝুলিয়েছে, ছাদে ব্যাচেলর দের প্রবেশ নিষেধ। যদি কেউ আইন অমাণ্য করে তাহলে তাকে বাড়ি থেকে বহিষ্কার করা হইবে। কম মাইনে দিয়ে থাকি বলে আজ ছাদের এই সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত। পশ্চিম আকাশে গোধূলি লগ্নে নির্বাক শ্রোতার মতো দাঁড়িয়ে আছি। বসন্তের ঝিরঝির বাতাসে নিমিষেই মনকে প্রশান্ত করে দিচ্ছে। চোখ বুজে প্রকৃতি অনুভব করছি আমি। সুরেলা কন্ঠে পিছন থেকে কেউ যেনো বলল: “আস্লাল্লামুয়ালাইকুম” সালামের জবাব দিয়ে বললাম, আপনিই নীলা।

মিষ্টি করে শুধালো: জ্বি আমিই নীলা। আসলে আমি সুপ্তির আচরনে দুঃখিত। ছোট মানুষ কিছু মনে করবেন না।

আমি বললাম: জ্বি আমি কিছু মনে করিনি। এই বয়সে সবাই একটু আবেগ প্রবণ হয়ে থাকে। ও যা বলছে সেটা কেবল আবেগ, যখন সে বুঝতে পারবে তখন সে নিজেই লজ্জিত হবে। এটা জাস্ট মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

নীলা: বাহ আপনি তো বেশ ম্যাচুয়েড। বলার আগেই সব বুঝে ফেলেন। কিছুক্ষণ তার সাথে খোশগল্পে মেতে উঠলাম। মেয়েটা তার কথার জাদুতে আমায় কাবু করে ফেলল। আশ্চর্যের বিষয় হলো মেয়েটার সাথে এতোক্ষন কথা বললাম কিন্তু তার চেহেরাটা এখন পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। মুখ ফুঠে বলেই ফেললাম, আপনার চেহেরাটা তো দেখতে পেলাম না। বলা মাত্রই মুখ থেকে উড়নাটা সরিয়ে দিলো নীলা। উড়নাটা সরাতেই আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। একটা মানুষ কিভাবে এতো সুন্দর হতে পারে। সুন্দরী বললে ভুল হবে নীলা মেয়েটা একেবারে আগুন সুন্দরী।

আমি অবাক পানে বিমোহিত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছি। টসটসে দুটি ঠোঁট, কাজল কালো চোখ বালিকার অময়াসিক্ত হাসি মূহুর্তে আমার হৃদয়ে প্রেমের দোলা দিয়ে যায়। হালকা বাতাসে তার চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। সন্ধ্যার পূর্ব মূহুর্তে যেন একটা ডানাকাটা পরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। বালিকা বসন্ত আর তুমি মিলেমিশে একাকার। নিরবতা ভেঙ্গে নীলা বলল: কি দেখছেন অমন করে? আমি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। নীলা শুধালো, কিছু বলছেন না যে?

আমি: আপনি খুব সুন্দরী।

নীলা: ধ্যাত কি যে বলেন না।

আমি: শুধু সুন্দরী না একেবারে আগুন সুন্দরী। রূপবতী ও মায়াবতী। যেন ডানাকাটা পরী। আর আমি এই পরীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।

বালিকা লজ্জা পেয়ে দৌঁড়ে পালালো। সেদিনের পর থেকে রোজই ছাদে যাওয়া হয়। শুধু তাকে একপলক দেখার জন্য। যদিও ছাদে যাওয়া নিষেধ। প্রেম কি আর বাঁধা নিষেধ মানে। ধীরে ধীরে কাছে আসা, তারপর ভালো লাগা, অবশেষে ভালোবাসা। এক বছরের মাথায় আমি আর নীলা গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। প্রত্যহ ইনবক্সে কিংবা মোবাইল ফোনে প্রেমের ঝড় উঠে। সে ঝড়ের উত্তাল গহ্বরে পড়ে দুজন টালমাটাল হয়ে যায়।

একদিন আমি নীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের সম্পর্ক যদি তোমার বাবা মা মেনে না নেয়? নীলা আমার বুকে মাথা রেখে শুধালো: ভালোবাসার বাঁধ দিয়ে সব প্লাবন রোধ করবো আমি। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো। আমি বাকরুদ্ধ, কেবল নীলাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলাম নিজের আলিঙ্গনে। সেদিন রাতে সুপ্তি আমায় কল করে তাদের বাসায় যেতে বলে। চড় খাওয়ার পর থেকে সুপ্তি আর আমার দিকে চোখ তুলে তাকাইনি। দুষ্টুমি, ফাইযলামি সব বন্ধ। বুঝালাম নীলার হাতে প্রচুর কেলানি খেয়েছে। ফ্রেস হয়ে নীলাদের বাসায় গেলাম। সবাই জটলা হয়ে বসে আছে। কাছে যেতেই আংকেল বলল: বাবা একটু সমস্যায় পড়ে গেছি। আংকেলের কোনো ছেলে নেই সে হিসেবে তিনি আমায় নিজের ছেলের মতোই জানতেন। আমি বললাম, কি সমস্যা আংকেল?

আংকেল: আজকে সকালে নীলাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। এজন্য নীলা রাগ করে সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছে। অনেক ডাকাডাকির পরেও দরজা খুলছে না। দুপুরেও খাইনি। আমি জানি আংকেল তার মেয়ে দুটোকে অনেক ভালোবাসেন। মেয়েদের টেনশনে আংকেল প্রায়শই দিশেহারা থাকেন। আমি যথেষ্ঠ সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় আংকেল কে আমাদের সম্পর্কের কথা বুঝিয়ে বললাম। আংকেল আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। আমি বললাম, আমি দেখছি বিষয়টা আপনি শান্ত হোন আংকেল। নীলার দরজায় টোকা দিলাম। কোনো সাড়া শব্দ নেই। বললাম, নীলা আমি মিরাজ বলছি দরজা খোলো। দরজা খোলা মাত্রই নীলা আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোখ দুটো লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করেছে। বুঝেছি বালিকা প্রচুর অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। আমি ধমকের সুরে বললাম, নীলা হাত কাটছো কেনো?

প্রত্যুত্তরে নীলা বলল: ভালোবাসি, বড্ড ভালোবাসি।

আমি: কাকে?

নীলা: এই পঁচা ছেলটাকে।

ঘোর কাটলো রশ্মির ডাকে। পাপ্পা পাপ্পা তুমাই মা মনি কেতে ডাকতে?(অস্পষ্ট স্বরে) মনের অজান্তেই এক রোমাঞ্চকর অতীতে ডুবে গিয়েছিলাম আমি। অতীতের স্মৃতি গুলো আজও আমায় কি রোমন্থন করে। আমি মিষ্টি করে বললাম, তোমার আম্মুকে বলো পাপ্পা খাবে না। পাপ্পার ক্ষিধে নেই। পাশের রুম থেকে নীলা ছেঁচিয়ে বললো, রশ্মি তোমার পাপ্পা কে বলো ডং না করে ক্ষেতে আসতে। নিত্য নতুন এসব ডং দেখতে আর ভাল্লাগে না। আমি জোর গলায় বললাম, কি আমি ডং দেখায়। আজকে খাবো না ভাত, এই আমি শুতে গেলাম। বলেই মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। জানি নীলাও আজকে না খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। দীর্ঘ সাত বছরের অভিজ্ঞতা আছে আমার। মধ্যরাতে বুকে উপর কারো অস্তিত্ব টের পেলাম। কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। আমি নীলার কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বললাম: ঠিক আছে আর কাঁদতে হবে না। মেয়ে ঘুম থেকে উঠে যাবে। নীলা কন্দনরত স্বরে জবাব দিলো: এই পঁচা ছেলে, তুমি আজ আমার রাগ ভাঙ্গাওনি কেনো।

আমি: ইশশশ আমার বয়েই গেছে। নীলা অভিমানী সুরে বলল: বুঝি তো আমি, পুরনো হয়ে গেছি না তাই এখন আর আমাকে ভাল্লাগে না। এখন তো ফেসবুকের মেয়েরাই তোমার সব।

আমি নীলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম: পাগলী মেয়ে, ভালোবাসা কখনো পুরনো হয় না। হয় না ধূসর কিংবা বর্ণহীন। ভালোবাসা শুধু রঙ বদলায়, এক রূপ থেকে অন্য রূপ। কিছু কিছু ভালোবাসা হারিয়ে যায় অজানা কথার ভীড়ে। কিছু কিছু ভালোবাসা ফিরিয়ে আনে দুজনকে আপন নীড়ে। কিছু কিছু ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে ডায়েরীর শেষ পাতায়। কিছু কিছু ভালোবাসা জমা থাকে মনের মনি কোঠায়। সব ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই। কিছু কিছু ভালোবাসা বুঝে নিতে হয় মনের অন্তরালে। ভালোবাসি, বড্ড ভালোবাসি আমার রাগিনীকে। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ভালোবেসে যেতে চাই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত