রাত তিনটা।হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল অভ্রর। সাধারণত এত রাতে ওর ঘুম ভেঙে যায় না। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে এই সমস্যাটা হচ্ছে ওর। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক তিনটার
সময়েই ঘুম ভেঙ্গে যায়।তারপর ফজরের আযানের আগে আর ঘুম আসে না। তখন সে বেলকুনিতে বসে থাকে। রাতের শহরটাকে দেখে। দিনের ব্যস্ততা শেষে শহরটা নিশ্চুপ হয়ে যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতের শহরের এই নিশ্চুপ নীরবতা কে সে খুব উপভোগ করে। অভ্রর আজ বেলকুনিতে বসতে ইচ্ছা করছে না। তাই সে ছাদে গেল।
.
আজ সম্ভবত পূর্ণিমা। আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে।সাধারণত পূর্ণিমা ছাড়া এত সুন্দর চাঁদ হয় না। অভ্র একদৃষ্টে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।চাঁদের নরম আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অভ্র হঠাৎ লক্ষ্য করল ছাদের এক কোণায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার শরীর থেকে সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা চাঁদের টুকরো । ওর শরীর থেকে যেন আলো ছড়িয়ে পড়ছে। চাঁদের আলোয় মেয়েটাকে এতো সুন্দর লাগছে যা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।
.অভ্র মেয়েটির কাছে গিয়ে বলল,
-এ্যাই যে শুনছেন?
মেয়েটা কিছু বলল না। শুধু মুচকি হাসলো।
অভ্র আবার বলল,
-এত রাতে আপনি এখানে কি করছেন?
-চাঁদ দেখি। দেখেন কত সুন্দর চাঁদ উঠেছে।
-হুম অনেক সুন্দর।আচ্ছা আপনি কি এই বিল্ডিংয়ে থাকেন?
মেয়েটি কিছুই বলল না ।শুধু বলল, আসেন, একসাথে চাঁদ দেখি।
.
এভাবেই মেয়েটির সাথে কথা বলা শুরু হয় অভ্রর। মেয়েটি প্রতিদিন ঠিক একই সময়ে ছাদে আসত। তারপর দুজনে ফজর হওয়া অবধি গল্প করত। ফজরের আযান হওয়া মাত্রই সে
চলে যেতো। অভ্র আরও কিছুক্ষণ গল্প করতে চাইলেও সে থাকত না।
.
মেয়েটির নাম ছিল নীল। অভ্র ধীরে ধীরে অনুভব করে যে সে নীলের প্রেমে পড়ে গেছে। নীলকে ছাড়া ওর কিছুই ভাল লাগে না।সবসময় নীলের কথা ভাবতেই ভাল লাগে।
.
রাত দুইটা। নীল অভ্রর সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য বের হল। নীলেরও কেন জানি ইদানিং কিছুই ভাল লাগে না। শুধু অভ্রর কথা ভাবতেই ভাল লাগে। অভ্রকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে। তবে কি সে অভ্রর প্রেমে পড়ে গেলো? কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? নীল তো মানুষ নয়। সে তো পরী। জ্বীন
রাজ্যের রাজা আহকাফ এর একমাত্র কন্যা সে। পৃথিবীর মানুষ অভ্রর সাথে কী তার মিলন সম্ভব?
.
.
অভ্র আর নীল ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে। অভ্র সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে যে, সে নীলকে ওর ভালবাসার কথা বলবে। কিন্তু কীভাবে বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। আর কথাটা নীল কীভাবে নেবে সেটাও চিন্তার বিষয়। নীলের সাথে ওর খুব ভাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। প্রপোজ করার ফলে যদি সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়! এই কথাটাই অভ্রর মনে বার বার উঁকি দিচ্ছে।
.
নীল বুঝতে পারছে অভ্র কিছু একটা তাকে বলতে চায়। কি বলতে চায় সেটাও সে জানে। মানুষের মনের কথা তারা বলতে পারে । কিন্তু তার আগে অভ্রকে জানানো উচিত যে, সে মানুষ নয়। সে পরী । জ্বীন রাজ্যের রাজকন্যা সে।
.
নীল বললো,
-অভ্র, আমার সম্পর্কে তোমার কিছু জানা প্রয়োজন ।আমি কে? কোথায় থাকি? আমার কী পরিচয়? এ বিষয়গুলো কি তুমি জানতে চাও?
-এগুলো জেনে কী হবে! এগুলো পরে শুনবো।
-না, অভ্র । আমার সম্পর্কে তোমার জানা উচিত।
-আচ্ছা বলো।
– অভ্র , আমি মানুষ নই ।আমি পরী। আমার বাবা জ্বীনদের রাজা। আমরা আকাশে থাকি।
.
নীলের কথা শুনে অভ্র হেসে উঠল।বললো,
– আমি এসব জ্বীন পরীতে বিশ্বাস করি না। আমাকে অযথা ভয় দেখানোর চেষ্টা করো না।
-আমার কথা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?
-বিশ্বাস করার কোন প্রশ্নই আসে না।
-ঠিক আছে তোমাকে বিশ্বাস করাচ্ছি । একথা বলে নীল মুহূর্তের মধ্যেই বিশাল এক অজগর সাপের রুপ ধরল। এটা দেখে অভ্র প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। সেই
দৌড়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো। ঐ রাতে অভ্রর চোখে আর ঘুম এলো না। সে শুধু একটা কথাই চিন্তা করতে লাগলো এতদিন তাহলে সে একটা পরীর সাথে রাত জেগে গল্প করেছে।
.
.
অভ্র বাবা মার একমাত্র সন্তান। ওর বাবা মা কানাডা থাকেন। অভ্রও আগে কানাডায় ছিলো।সেখানেই সে বড় হয়েছে। বছরখানেক আগে দেশে আসে সে।তারপর আর ফিরে যায় নি । বিদেশ ওকে আকর্ষণ করে না। তাই বাবা মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেশে থাকা শুরু করেছে সে। দেশে তার কোন আত্মীয়
স্বজন নেই। একটা ফ্ল্যাটে সে একাই থাকে। রহিম নামে এক বয়স্ক লোক ওর বাসার কাজ করে দেয়। রহিমকে সে চাচা ডাকে।
.
সেদিনের ঐ ঘটনায় অভ্র প্রচন্ড ভয় পায়। সে রাতেই ওর ভীষণ জ্বর আসে। প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেলো কিন্তু ওর জ্বর সারতেছে না। কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। শেষে সে রহিম চাচাকে পুরো ঘটনা বলল। সব শুনে রহিম চাচা এক হুজুরের কাছ থেকে তাবিজ আর কিছু ওষুধ নিয়ে আসলো। দশ দিনের মাথায় অভ্র পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যায়।
.
.
.
সুস্থ্য হওয়ার পরে অভ্রকে আবারো রাত তিনটার সময়ে নীল পরীর সাথে ছাদে গল্প করতে দেখা গেলো।
.
.
.
অভ্র আবেগ জড়ানো কন্ঠে বলল,
-নীল, আমি তোমাকে ভালবাসে ফেলেছি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। নীল কিছু বললো না। শুধু ডান হাতটা অভ্রর দিকে বাড়িয়ে দিলো।
…….,
.
অতঃপর নীল পরীর সাথে অভ্রর বিয়ে হয়।
.
.
.
বিয়ের পরেরদিন রহিম চাচা বাড়ি থেকে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায় নি। তার গ্রামের বাড়িতেও খোঁজ নেয় অভ্র ।কিন্তু সে সেখানেও ছিল না। যাইহোক, নীল পরীর সাথে অভ্রর খুব সুখেই দিন কাটছিলো।
.
কিন্তু অভ্র কেন জানি দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই সে রোগা হয়ে গেল। ওর মাথার চুল উঠে গেল ।অনেকগুলো দাঁতও পড়ে গলো। চেহারা হাড্ডিসার হয়ে গেল। অনেক বড় বড় ডাক্তারের কাছে গেলো সে। কিন্তু কোন অসুখ ধরা পড়লো না।
.
অবশেষে বিয়ের ছয় মাসের মাথায় অভ্র ওর নীল পরীকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো।